মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৫- নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭০২
৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাসজিদ ও সালাতের স্থান
৭০২। হযরত আবু হুরায়রাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, কোন ব্যক্তির মসজিদে জামাতে নামায সওয়াবের ক্ষেত্রে তার গৃহে বা বাজারে নামায অপেক্ষা পঁচিশ গুণ বেশী। আর এটা তখনই হয় যখন সে উত্তমরূপে অজু করে মসজিদের দিকে বের হয়। নামায ছাড়া সে অন্য কোন উদ্দেশ্যে বের হয় না। এমতাবস্থায় সে মসজিদে গমনে যত পদক্ষেপ করে তার প্রত্যেক পদক্ষেপে একটি করে মর্তবা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং একটি করে গুনাহ মাফ করা হয়। অতঃপর যখন সে নামায পড়তে থাকে ফিরিশতাগণ তার জন্য অবিরাম দোয়া করতে থাকে, যখন পর্যন্ত সে নামাযের স্থানে স্থির থাকে। ফিরিশতাগণ এরূপ দোয়া করেন যে, হে আল্লাহ্! তুমি তার প্রতি অনুগ্রহ কর, হে আল্লাহ্! তুমি তাকে রহম কর। (এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন) তোমাদের কেউ যে পর্যন্ত নামাযের অপেক্ষায় থাকে, সে পর্যন্ত সে নামাযেই থাকে। বর্ণনান্তরে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, যখন সে মসজিদে প্রবেশ করে নামায তাকে আব্দ্ধ রাখে। আর সেই বর্ণনায় ফিরিশতাদের দোয়ায় এটা বাড়িয়ে বলা হয়েছে, হে আল্লাহ্! তুমি তাকে মাফ কর, হে আল্লাহ! তুমি তার তাওবাহ কবুল কর- এরূপ দোয়া করতে থাকেন, যে পর্যন্ত না সে মসজিদে কাউকেও কোনরূপ কষ্ট দেয় এবং অজু ভঙ্গ করে। -বুখারী, মুসলিম
بَابُ الْمَسَاجِدِ وَمَوَاضِعِ الصَّلَاةِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «صَلَاةُ الرَّجُلِ فِي الْجَمَاعَةِ تُضَعَّفُ عَلَى صَلَاتِهِ فِي بَيْتِهِ وَفِي سُوقِهِ خَمْسًا وَعِشْرِينَ ضِعْفًا وَذَلِكَ أَنَّهُ إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُخْرِجُهُ إِلَّا الصَّلَاةُ لَمْ يَخْطُ خُطْوَةً إِلَّا رُفِعَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ وَحُطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ فَإِذَا صَلَّى لَمْ تَزَلِ الْمَلَائِكَةُ تُصَلِّي عَلَيْهِ مَا دَامَ فِي مُصَلَّاهُ اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ الله ارْحَمْهُ وَلَا يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِي صَلَاةٍ مَا انْتَظَرَ الصَّلَاةَ» . وَفِي رِوَايَةٍ: قَالَ: «إِذَا دَخَلَ الْمَسْجِدَ كَانَتِ الصَّلَاةُ تَحْبِسُهُ» . وَزَادَ فِي دُعَاءِ الْمَلَائِكَةِ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ تُبْ عَلَيْهِ. مَا لَمْ يُؤْذِ فِيهِ مَا لَمْ يُحْدِثْ فِيهِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাচ্ছেন যে, নিজ ঘরে বা বাজারের দোকানে একাকী নামায পড়া অপেক্ষা মসজিদে জামাতের সংগে নামায আদায় করলে তার ফযীলত পঁচিশ গুণেরও বেশি হয়। পঁচিশের বেশি বোঝাতে بِضْعٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে বোঝানো হয়। সে হিসেবে তেইশ থেকে ঊনত্রিশ পর্যন্ত যে-কোনও সংখ্যাই বোঝানো হতে পারে। তবে কোনও হাদীছে সাতাশ গুণের কথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। মসজিদে জামাতের সংগে নামায পড়লে তার ফযীলত যে এত বেশি, তার কারণ কি? এ হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, তার কারণ কেবল নামাযের নিয়তে পথচলা। ঘরে বা দোকানে নামায পড়লে নামায পড়া হয় বটে, কিন্তু নামাযের নিয়তে পথচলা হয় না। আবার কেউ যদি এমনিই পথ চলে কিন্তু নামাযের নিয়ত না থাকে, তা দ্বারাও এই বাড়তি ফযীলত হাসিল হয় না। এই বাড়তি ফযীলত কেবল নামাযের নিয়তে মসজিদে গমনের কারণে।
এই মহান নিয়তের কারণে পথ চলাটা এত দামি হয়ে যায় যে, মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছতে যতগুলি কদম ফেলা হয় তার প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা এক স্তর বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি গুনাহ মাফ করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে মসজিদ পর্যন্ত যার পথ যতবেশি দূরে হবে, তার মর্যাদাও তত বাড়বে এবং ততবেশি গুনাহ মাফ হবে। অপর এক হাদীছে আছে, একবার বনূ সালিমা গোত্র তাদের মহল্লা ছেড়ে মসজিদের নিকটে এসে বসবাসের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল। কারণ তাদের মহল্লা মসজিদ থেকে দূরে ছিল। মসজিদে যাতায়াতে বেশি সময় লাগত এবং অনেক সময় কষ্টও হত। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জানতে পারলেন যে, তারা মসজিদের কাছাকাছি এসে বসবাস করতে চাচ্ছে, তখন তিনি তাদেরকে তা থেকে বারণ করলেন এবং বললেন, হে বনূ সালিমা! আপন জায়গায়ই বাস করতে থাক। তাতে তোমাদের কদমে কদমে ছওয়াব লেখা হবে।
তারপর আবার মসজিদের ভেতরেও এই নিয়তের মাহাত্ম্য বাকি থেকে যায়। বান্দা যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নামাযী গণ্য করা হবে। আবার নামাযের পর যতক্ষণ নামাযের জায়গায় বসা থাকবে, ততক্ষণ সে ফিরিশতাদের দু'আ লাভ করতে থাকবে। সুবহানাল্লাহ! নিয়তের কারণে সাধারণ একেকটা কাজ কত বড় দামী হয়ে গেল!
ফিরিশতাদের দু'আ লাভের জন্য এ হাদীছে দু'টি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
ক. কাউকে কষ্ট না দেওয়া। অর্থাৎ যতক্ষণ সেখানে বসা থাকবে, ততক্ষণ কারো গীবত করবে না, কাউকে গালি দেবে না, কষ্টদায়ক কোনও কথা বলবে না, উচ্চ আওয়াজে কথা বলে অন্যের নামায ও যিকরের ব্যাঘাত ঘটাবে না, কাউকে মারধর করবে না, মোটকথা হাতে, মুখে এবং সবরকমেই অন্যকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকবে।
খ. যতক্ষণ বসা থাকবে, ওযূ অবস্থায় থাকবে। ওযূ নষ্ট করে অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জামাতে নামায পড়ার ফযীলত জানা যায়। সুতরাং যতসম্ভব জামাতের সাথে নামায আদায়ে যত্নবান থাকা উচিত।

খ. মসজিদে আগমনকালে দৈহিক ও মানসিকভাবে নামাযের জন্য প্রস্তুত হয়েই আসা উচিত। সেই প্রস্তুতির একটা অংশ উত্তমরূপে ওযূ করে আসা।

গ. মসজিদে গমনের উদ্দেশ্য যেহেতু নামায পড়া, তাই পথ চলাকালে সেই নিয়ত অন্তরে জাগ্রত রাখা উচিত, যাতে পথচলাটা ধীরশান্ত পদক্ষেপে হয় এবং গোটা পথ মুসল্লীসুলভ ভাবভঙ্গি বজায় থাকে।

ঘ. হাদীছে যে মর্যাদা বৃদ্ধি ও গুনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে, তা হাসিলের প্রতি মনোযোগ থাকা কর্তব্য। এটা পথচলার আদব-কায়দা রক্ষায় সহায়ক হয়।

ঙ. জামাতের সময় না হলে শান্তভাবে নামাযের অপেক্ষা করা উচিত। কোনওভাবেই ব্যস্ততা প্রকাশ কাম্য নয়, কেননা অপেক্ষার এই সময়টা বড়ই মূল্যবান। এই অপেক্ষা বৃথা যায় না; বরং নামাযরূপেই গণ্য হয়।

চ. মসজিদ আল্লাহর ঘর। ইবাদতের স্থান। সেইসাথে এমনিতেও মসজিদে অবস্থানকালে দেহমনের পবিত্রতা বজায় রাখা উচিত। তদুপরি যখন অবস্থানকালীন সময়ে ফিরিশতাদের দু'আ লাভ হয়, তখন তো সবরকম অসমীচীন কাজ থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। তাই এ অবস্থায় ওযূ বজায় রাখা ও সর্বপ্রকার কষ্টদায়ক কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৭০২ | মুসলিম বাংলা