মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৫- নামাযের অধ্যায়
হাদীস নং:
৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আযানের ফযীলত ও মুয়াযযিনের উত্তর দান
৬৬৩। হযরত আবু হুরায়রাহ (রাযিঃ) হতে বরণ্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ইমাম নামাযের জামিনস্বরূপ। আর মুয়াযযিন হল আমানতদার। হে আল্লাহ্! আপনি ইমামদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং মুয়াযযিনদেরকে মাফ করুন। -আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, শাফেয়ী
হাদীসের ব্যাখ্যা:
নাবালকের ইমামতিঃ
রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: কলম তুলে নেয়া হয়েছে তিন ধরণের ব্যক্তির উপর থেকে: ১. পাগল, যতক্ষণ সে সুস্থ না হয়, ২. নাবালক, যতক্ষণ সে প্রাপ্তবয়স্ক না হয় এবং ৩. ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ সে জাগ্রত না হয়। (ইবনে মাযা-২০৪২) এ হাদীসটি তিরমিযী এবং আবু দাউদ শরীফে সনদসহ আর বুখারী শরীফে সনদবিহীন বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে হাজার রহ. এ হাদীসের অনেক সনদ উল্লেখ করে বলেন: وَهَذِهِ طُرُقٌ تَقَوَّى بَعْضُهَا بِبَعْضٍ “এ সনদগুলো একটির দ্বারা অপরটি শক্তিশালী হয়”। (ফাতহুল বারী, অধ্যায়: পাগল-পাগলীকে রজম করা হবে না) এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, নাবালকের উপর শরীআতের কোন দায়-দায়িত্ব বর্তায় না। আর পূর্বের হাদীসে ইমামকে অত্যনত্ম দায়িত্বপূর্ণ পদ অর্পণ করে বলা হয়েছে যে, ‘ইমাম জামিনদার’। নাবালককে ইমাম বানানো হলে দায়িত্বহীনকে দায়িত্বশীল বানানো আবশ্যক হয় যা পূর্বের হাদীসের আলোকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
এ ছাড়াও রসূলুল্লাহ স. প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্বশীল মানুষদেরকে ইমামতির দায়িত্ব অর্পণের ব্যাপারে একাধিকবার এ কথা বলে নির্দেশ দিয়েছেন যে, لِيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ “তোমাদের ইমামতি করবে তোমাদের মধ্যে তুলনামূলক বেশী বয়স্ক ব্যক্তি”। (বুখারী-৬০০) অন্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, لِيَؤُمَّكُمَا أَكْبَرُكُمَا “তোমাদের মধ্যে যিনি তুলনামূলক বেশী বয়স্ক তিনি তোমাদের দু’জনের ইমামতি করবে”। (বুখারী-৬০২) এ থেকেও স্বাভাবিকভাবে এটাই বুঝে আসে যে, ইমামতির গুণাবলীর মধ্যে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইমাম তুলনামূলক বয়স্ক হওয়া। সুতরাং শুধু নাবালকরা জামাতে নামায আদায় করলে তাদের মধ্যে তুলনামূলক যে বেশী বয়সী সে নামায পড়াবে। আর শুধু প্রাপ্তবয়স্করা জামাতে নামায পড়লে তাদের মধ্যে যে তুলনামূলক বেশী বয়সী সে ইমামতি করবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক এবং নাবালক একত্রে জামাতে নামায আদায় করলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইমামতির অন্যান্য যোগ্যতা বিদ্যমান থাকা সাপেক্ষে তুলনামূলক যে বেশী বয়স্ক সে ইমামতি করবে।
عَبْدُ الرَّزَّاقِ عَن بْنِ جُرَيْجٍ قَالَ أخْبَرَنِيْ إبْرَاهِيْمُ أنَّ عَبْدَ الْعَزِيْزِ بْنَ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيْزِ أخْبَرَه أنَّ مُحَمَّدَ بْنَ أبِيْ سُوَيْدٍ أقَامَه لِلنَّاسِ وَهُوَ غُلَامٌ بِالطَّائِفِ فِيْ شَهْرِ رَمْضَانَ يَؤُمُّهُمْ فَكَتَبَ بِذَلِكَ إلى عُمَرَ يُبَشِّرُه فَغَضِبَ عُمَرُ وَكَتَبَ إلَيْهِ مَا كَانَ نُوَلِّكَ أنْ تُقَدِّمَ لِلنَّاسِ غُلَامًا لم تَجِبْ عَلَيْهِ الْحُدُوْدُ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ বিন আবু সুআইদ রহ. আব্দুল আজীজ বিন উমারকে তায়েফ নামক স্থানে রমাযান মাসে ইমাম বানালেন অথচ তখনও তিনি নাবালক। মুহাম্মাদ বিন আবু সুআইদ হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ.কে সুসংবাদ হিসেবে খবরটি জানালেন। (আপনার ছেলেকে ইমাম বানিয়েছি) হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ.-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি রাগান্বিত হয়ে মুহাম্মাদ বিন সুআইদকে পত্র লেখেন যে, আমি আপনাকে এ দায়িত্ব দেইনি যে, আপনি একজন নাবালক বাচ্চাকে ইমাম বানাবেন যার উপর শরীআতের হুদুদ বা দ-বিধি আরোপিত হয়নি। (আব্দুর রাযযাক-৩৮৪৮)
খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ. হাদীসের বড় ইমাম। সাথে সাথে ফকীহ ও মুজতাহিদ। তিনি মুহাম্মাদ বিন সুআইদকে শাসিয়ে পত্র দিলেন যে, একজন নাবালককে কেন ইমাম বানানো হলো। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, নাবালকের ইমামতি গ্রহণযোগ্য নয়।
হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ এবং আতা রহ. থেকে অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, ফরয ও নফল কোন নামাযে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক ইমামতি করবে না। (ইবনে আবী শাইবা: ৩৫২৪)
عَبْدُ الرَّزَّاقِ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ دَاوُدَ بْنِ الْحُصَيْنِ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: «لَا يَؤُمُّ الْغُلَامُ حَتَّى يَحْتَلِمَ، وَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ خِيَارُكُمْ»
অনুবাদ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে কোন বালক ইমামতি করবে না। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি আযান দিবে। (আব্দুর রায্যাক-৩৮৪৭, ১৮৭২, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী: ৫৮৫৮)
নাবালকের ইমামতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে আরো অনেক সাহাবা ও তাবিঈগণের আছার বর্ণিত থাকায় এটা অন্য দলীলের সহযোগী হিসেবে চলতে পারে। ইমাম বায়হাকীও এ হাদীসটি বর্ণনা করে এটাকে মাউকূফ বলেছেন কিন্তু কোন ত্রম্নটি উল্লেখ করেননি। হযরত আতা রহ. থেকে সহীহ সনদে উল্লেখ আছে যে, নাবালক বাচ্চা ইমামতি করবে না। (আব্দুর রাযযাক-৩৮৪৫) এ হাদীসটির সকল রাবীই বুখারী-মুসলিমের রাবী। হাসান সনদে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে কোন বালক ইমামতি করবে না। (ইবনে আবী শাইবা-৩৫২৬) অনুরূপ মনত্মব্য ইমাম শা’বী রহ. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে আবী শাইবা-৩৫২৫)
ইমাম মুহাম্মাদ বিন নাসর আল মারওয়াজী রহ. (মৃত্যু-২৯৪ হিঃ) তাঁর কিয়ামুল লাইল কিতাবে নাবালকের ইমামতির বিরম্নদ্ধে বেশ কিছু আছার বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারী, ইবনে আব্বাস, আতা বিন আবী রবাহ, মুজাহিদ বিন জবর, ইবরাহীম নাখাঈ, সুফিয়ান সাওরী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ রহ.-এর নাম অন্যতম। এ ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ রহ.-এর মতও উল্লেখ করেন যে, তিনি এটাকে অপছন্দ করতেন। যদিও নামায পুনরায় পড়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না।
ফায়দা : উপরিউক্ত দলীলের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করি যে, ইমামতির গুরম্ন দায়িত্ব কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক পালন করতে পারে না এবং তার পেছনে ইক্তিদা করলে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নামায হয় না। এটাই হানাফী মাযহাবের মত। (শামী: ১/৫৫০)
এর বিপরীতে কিছু আলেম নাবালকের ইমামতি বৈধ বলে থাকেন। তাঁরা বুখারী শরীফের ৩৯৭১ নাম্বার হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। সে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আমর বিন সালামা রা.কে তাঁর কওমের লোকেরা ইমাম বানিয়েছিলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র ছয়/সাত বছর।
আমরা এ হাদীসটিকে নাবালকের ইমামতির দলীল হিসেবে গ্রহণ করি না। তাঁর পিতা রসূলুল্লাহ স.-এর সাথে সাক্ষাৎ করে মাত্র মুসলমান হয়ে আপন কওমে ফিরে এসে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর তাঁর কওমের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে নামাযের জন্য উপস্থিত হন এবং ছয়/সাত বছরের বালক আমর বিন সালামাকে ইমাম বানান। তিনি তাঁর ছেলেকে ইমাম বানানোর দলীল হিসেবে রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ বর্ণনা করেন যে, তোমাদের মধ্যে যে বেশী কুরআন জানে সে তোমাদের নামায পড়াবে। রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ শুনে কওমের লোকেরা অধিক কুরআন জানার কারণে ঐ নাবালকের উপর ইমামতির গুরম্নদায়িত্ব অর্পণ করেছিলো।
উক্ত হাদীসে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, যখন তিনি (ইমাম) সিজদা করতেন তখন নিতম্বের কাপড় সংকুচিত হয়ে নিতম্ব বের হয়ে যেতো। এ অবস্থা দেখে কওমের লোকেরা তাঁকে একটি জামা বানিয়ে দিয়েছিলো। তারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করায় সতর ঢাকা নামায সহীহ হওয়ার শর্ত তা-ও জানতো না। এছাড়াও নামাযের অনেক জরম্নরী মাসআলা তখনও পর্যনত্ম তারা শিখতে পারেননি। যে কারণে নামাযের মধ্যে ইমামের নিতম্ব আবরণহীন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নামায চালিয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে। ইমাম আহমাদ রহ.-এর নিকট এ হাদীস পেশ করা হলে তিনি এটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, أَنَّهُ لَيْسَ فِيهِ اطِّلَاعُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ذ لَك এ বিষয়ে রসূল স. অবগত ছিলেন না। অর্থাৎ এটা সাহাবার বিচ্ছিন্ন আমল। (ফাতহুল বারী-২/১৮৫) হযরত সাহল বিন সা’দ রা. থেকে মুসতাদরাকে হাকেমে বর্ণিত ৭৮৫ নাম্বার হাদীস দ্বারাও কেউ কেউ দলীল পেশ করে থাকেন। উক্ত হাদীসে উলেস্নখ রয়েছে যে, তিনি এক নাবালককে ইমাম বানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আপত্তি করা হলে তিনি দলীল হিসেবে রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ পেশ করেন যে, إِنَّ الْإِمَامَ ضَامِنٌ، فَإِنْ أَتَمَّ كَانَ لَهُ وَلَهُمْ، وَإِنْ نَقَصَ كَانَ عَلَيْهِ وَلَا عَلَيْهِمْ، فَلَا أُرِيدُ أَنْ أَتَحَمَّلَ ذَلِكَ “ইমাম যামিনদার। যদি সে নামায পূর্ণ করে তাহলে ইমাম-মুক্তাদী সকলেই সওয়াব পাবে। আর যদি ত্রম্নটি হয় তাহলে তার দায়ভার ইমামের উপর বর্তাবে। আর আমি এ দায়িত্ব কাঁধে নিতে চাই না”। হাকেম এবং ইমাম জাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
হযরত সাহল রা. যে হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করলেন সে হাদীসে নাবালককে ইমাম বানানোর কোন কথাই বিদ্যমান নেই। বরং ‘ইমাম যামিনদার’ শব্দের মধ্যে নাবালককে ইমাম না বানানোর বিষয়টিই পরিস্কার যা এ অধ্যায়ের প্রথম হাদীসে উলেস্নখ করা হয়েছে।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, সাহাবার আমল হওয়া সত্ত্বেও ইমামতির মতো একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ে এ জাতীয় আমল থেকে দলীল গ্রহণ করা যায় না। উপরন্তু ফকীহ সাহাবা হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর আমল এর বিপরীত রয়েছে। সাথে সাথে এটা অতি স্বাভাবিক কথা যে, যার প্রতি শরীআতের কোন দায়িত্ব এখনো বর্তায়নি সে নামাযের মতো গুরম্নত্বপূর্ণ ইবাদাতে অন্যদের কী প্রতিনিধিত্ব করবে? এ ছাড়া, উপরিউক্ত হাদীস দু’টির ভিত্তিতে নাবালকের ইমামতিকে বৈধ বলা হলে তা পূর্ববর্ণিত মারফু’ হাদীস, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈগণের মতামত এবং শরীআতের বেশ কিছূ মূলনীতির পরিপন্থী হবে। আবার বৈধ ও অবৈধের দ্বন্দ্ব হলে সর্বদা অবৈধের দিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ নিয়মের আওতায়ও নাবালককে ইমাম বানানো থেকে বেঁচে থাকা জরুরী; বিশেষ করে ফরয নামাযে।
রসূলুল্লাহ স. বলেছেন: কলম তুলে নেয়া হয়েছে তিন ধরণের ব্যক্তির উপর থেকে: ১. পাগল, যতক্ষণ সে সুস্থ না হয়, ২. নাবালক, যতক্ষণ সে প্রাপ্তবয়স্ক না হয় এবং ৩. ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ সে জাগ্রত না হয়। (ইবনে মাযা-২০৪২) এ হাদীসটি তিরমিযী এবং আবু দাউদ শরীফে সনদসহ আর বুখারী শরীফে সনদবিহীন বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে হাজার রহ. এ হাদীসের অনেক সনদ উল্লেখ করে বলেন: وَهَذِهِ طُرُقٌ تَقَوَّى بَعْضُهَا بِبَعْضٍ “এ সনদগুলো একটির দ্বারা অপরটি শক্তিশালী হয়”। (ফাতহুল বারী, অধ্যায়: পাগল-পাগলীকে রজম করা হবে না) এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, নাবালকের উপর শরীআতের কোন দায়-দায়িত্ব বর্তায় না। আর পূর্বের হাদীসে ইমামকে অত্যনত্ম দায়িত্বপূর্ণ পদ অর্পণ করে বলা হয়েছে যে, ‘ইমাম জামিনদার’। নাবালককে ইমাম বানানো হলে দায়িত্বহীনকে দায়িত্বশীল বানানো আবশ্যক হয় যা পূর্বের হাদীসের আলোকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
এ ছাড়াও রসূলুল্লাহ স. প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্বশীল মানুষদেরকে ইমামতির দায়িত্ব অর্পণের ব্যাপারে একাধিকবার এ কথা বলে নির্দেশ দিয়েছেন যে, لِيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ “তোমাদের ইমামতি করবে তোমাদের মধ্যে তুলনামূলক বেশী বয়স্ক ব্যক্তি”। (বুখারী-৬০০) অন্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, لِيَؤُمَّكُمَا أَكْبَرُكُمَا “তোমাদের মধ্যে যিনি তুলনামূলক বেশী বয়স্ক তিনি তোমাদের দু’জনের ইমামতি করবে”। (বুখারী-৬০২) এ থেকেও স্বাভাবিকভাবে এটাই বুঝে আসে যে, ইমামতির গুণাবলীর মধ্যে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইমাম তুলনামূলক বয়স্ক হওয়া। সুতরাং শুধু নাবালকরা জামাতে নামায আদায় করলে তাদের মধ্যে তুলনামূলক যে বেশী বয়সী সে নামায পড়াবে। আর শুধু প্রাপ্তবয়স্করা জামাতে নামায পড়লে তাদের মধ্যে যে তুলনামূলক বেশী বয়সী সে ইমামতি করবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক এবং নাবালক একত্রে জামাতে নামায আদায় করলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইমামতির অন্যান্য যোগ্যতা বিদ্যমান থাকা সাপেক্ষে তুলনামূলক যে বেশী বয়স্ক সে ইমামতি করবে।
عَبْدُ الرَّزَّاقِ عَن بْنِ جُرَيْجٍ قَالَ أخْبَرَنِيْ إبْرَاهِيْمُ أنَّ عَبْدَ الْعَزِيْزِ بْنَ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيْزِ أخْبَرَه أنَّ مُحَمَّدَ بْنَ أبِيْ سُوَيْدٍ أقَامَه لِلنَّاسِ وَهُوَ غُلَامٌ بِالطَّائِفِ فِيْ شَهْرِ رَمْضَانَ يَؤُمُّهُمْ فَكَتَبَ بِذَلِكَ إلى عُمَرَ يُبَشِّرُه فَغَضِبَ عُمَرُ وَكَتَبَ إلَيْهِ مَا كَانَ نُوَلِّكَ أنْ تُقَدِّمَ لِلنَّاسِ غُلَامًا لم تَجِبْ عَلَيْهِ الْحُدُوْدُ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ বিন আবু সুআইদ রহ. আব্দুল আজীজ বিন উমারকে তায়েফ নামক স্থানে রমাযান মাসে ইমাম বানালেন অথচ তখনও তিনি নাবালক। মুহাম্মাদ বিন আবু সুআইদ হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ.কে সুসংবাদ হিসেবে খবরটি জানালেন। (আপনার ছেলেকে ইমাম বানিয়েছি) হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ.-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি রাগান্বিত হয়ে মুহাম্মাদ বিন সুআইদকে পত্র লেখেন যে, আমি আপনাকে এ দায়িত্ব দেইনি যে, আপনি একজন নাবালক বাচ্চাকে ইমাম বানাবেন যার উপর শরীআতের হুদুদ বা দ-বিধি আরোপিত হয়নি। (আব্দুর রাযযাক-৩৮৪৮)
খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ রহ. হাদীসের বড় ইমাম। সাথে সাথে ফকীহ ও মুজতাহিদ। তিনি মুহাম্মাদ বিন সুআইদকে শাসিয়ে পত্র দিলেন যে, একজন নাবালককে কেন ইমাম বানানো হলো। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, নাবালকের ইমামতি গ্রহণযোগ্য নয়।
হযরত উমার বিন আব্দুল আজীজ এবং আতা রহ. থেকে অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, ফরয ও নফল কোন নামাযে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক ইমামতি করবে না। (ইবনে আবী শাইবা: ৩৫২৪)
عَبْدُ الرَّزَّاقِ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ دَاوُدَ بْنِ الْحُصَيْنِ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: «لَا يَؤُمُّ الْغُلَامُ حَتَّى يَحْتَلِمَ، وَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ خِيَارُكُمْ»
অনুবাদ : হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে কোন বালক ইমামতি করবে না। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি আযান দিবে। (আব্দুর রায্যাক-৩৮৪৭, ১৮৭২, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী: ৫৮৫৮)
নাবালকের ইমামতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে আরো অনেক সাহাবা ও তাবিঈগণের আছার বর্ণিত থাকায় এটা অন্য দলীলের সহযোগী হিসেবে চলতে পারে। ইমাম বায়হাকীও এ হাদীসটি বর্ণনা করে এটাকে মাউকূফ বলেছেন কিন্তু কোন ত্রম্নটি উল্লেখ করেননি। হযরত আতা রহ. থেকে সহীহ সনদে উল্লেখ আছে যে, নাবালক বাচ্চা ইমামতি করবে না। (আব্দুর রাযযাক-৩৮৪৫) এ হাদীসটির সকল রাবীই বুখারী-মুসলিমের রাবী। হাসান সনদে বর্ণিত অপর একটি হাদীসে হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে কোন বালক ইমামতি করবে না। (ইবনে আবী শাইবা-৩৫২৬) অনুরূপ মনত্মব্য ইমাম শা’বী রহ. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে আবী শাইবা-৩৫২৫)
ইমাম মুহাম্মাদ বিন নাসর আল মারওয়াজী রহ. (মৃত্যু-২৯৪ হিঃ) তাঁর কিয়ামুল লাইল কিতাবে নাবালকের ইমামতির বিরম্নদ্ধে বেশ কিছু আছার বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারী, ইবনে আব্বাস, আতা বিন আবী রবাহ, মুজাহিদ বিন জবর, ইবরাহীম নাখাঈ, সুফিয়ান সাওরী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ রহ.-এর নাম অন্যতম। এ ব্যাপারে ইমাম শাফেঈ রহ.-এর মতও উল্লেখ করেন যে, তিনি এটাকে অপছন্দ করতেন। যদিও নামায পুনরায় পড়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না।
ফায়দা : উপরিউক্ত দলীলের ভিত্তিতে আমরা বিশ্বাস করি যে, ইমামতির গুরম্ন দায়িত্ব কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক পালন করতে পারে না এবং তার পেছনে ইক্তিদা করলে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নামায হয় না। এটাই হানাফী মাযহাবের মত। (শামী: ১/৫৫০)
এর বিপরীতে কিছু আলেম নাবালকের ইমামতি বৈধ বলে থাকেন। তাঁরা বুখারী শরীফের ৩৯৭১ নাম্বার হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। সে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আমর বিন সালামা রা.কে তাঁর কওমের লোকেরা ইমাম বানিয়েছিলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র ছয়/সাত বছর।
আমরা এ হাদীসটিকে নাবালকের ইমামতির দলীল হিসেবে গ্রহণ করি না। তাঁর পিতা রসূলুল্লাহ স.-এর সাথে সাক্ষাৎ করে মাত্র মুসলমান হয়ে আপন কওমে ফিরে এসে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর তাঁর কওমের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে নামাযের জন্য উপস্থিত হন এবং ছয়/সাত বছরের বালক আমর বিন সালামাকে ইমাম বানান। তিনি তাঁর ছেলেকে ইমাম বানানোর দলীল হিসেবে রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ বর্ণনা করেন যে, তোমাদের মধ্যে যে বেশী কুরআন জানে সে তোমাদের নামায পড়াবে। রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ শুনে কওমের লোকেরা অধিক কুরআন জানার কারণে ঐ নাবালকের উপর ইমামতির গুরম্নদায়িত্ব অর্পণ করেছিলো।
উক্ত হাদীসে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, যখন তিনি (ইমাম) সিজদা করতেন তখন নিতম্বের কাপড় সংকুচিত হয়ে নিতম্ব বের হয়ে যেতো। এ অবস্থা দেখে কওমের লোকেরা তাঁকে একটি জামা বানিয়ে দিয়েছিলো। তারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করায় সতর ঢাকা নামায সহীহ হওয়ার শর্ত তা-ও জানতো না। এছাড়াও নামাযের অনেক জরম্নরী মাসআলা তখনও পর্যনত্ম তারা শিখতে পারেননি। যে কারণে নামাযের মধ্যে ইমামের নিতম্ব আবরণহীন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নামায চালিয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে। ইমাম আহমাদ রহ.-এর নিকট এ হাদীস পেশ করা হলে তিনি এটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, أَنَّهُ لَيْسَ فِيهِ اطِّلَاعُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ذ لَك এ বিষয়ে রসূল স. অবগত ছিলেন না। অর্থাৎ এটা সাহাবার বিচ্ছিন্ন আমল। (ফাতহুল বারী-২/১৮৫) হযরত সাহল বিন সা’দ রা. থেকে মুসতাদরাকে হাকেমে বর্ণিত ৭৮৫ নাম্বার হাদীস দ্বারাও কেউ কেউ দলীল পেশ করে থাকেন। উক্ত হাদীসে উলেস্নখ রয়েছে যে, তিনি এক নাবালককে ইমাম বানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আপত্তি করা হলে তিনি দলীল হিসেবে রসূলুল্লাহ স.-এর ইরশাদ পেশ করেন যে, إِنَّ الْإِمَامَ ضَامِنٌ، فَإِنْ أَتَمَّ كَانَ لَهُ وَلَهُمْ، وَإِنْ نَقَصَ كَانَ عَلَيْهِ وَلَا عَلَيْهِمْ، فَلَا أُرِيدُ أَنْ أَتَحَمَّلَ ذَلِكَ “ইমাম যামিনদার। যদি সে নামায পূর্ণ করে তাহলে ইমাম-মুক্তাদী সকলেই সওয়াব পাবে। আর যদি ত্রম্নটি হয় তাহলে তার দায়ভার ইমামের উপর বর্তাবে। আর আমি এ দায়িত্ব কাঁধে নিতে চাই না”। হাকেম এবং ইমাম জাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
হযরত সাহল রা. যে হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করলেন সে হাদীসে নাবালককে ইমাম বানানোর কোন কথাই বিদ্যমান নেই। বরং ‘ইমাম যামিনদার’ শব্দের মধ্যে নাবালককে ইমাম না বানানোর বিষয়টিই পরিস্কার যা এ অধ্যায়ের প্রথম হাদীসে উলেস্নখ করা হয়েছে।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে, সাহাবার আমল হওয়া সত্ত্বেও ইমামতির মতো একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ে এ জাতীয় আমল থেকে দলীল গ্রহণ করা যায় না। উপরন্তু ফকীহ সাহাবা হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর আমল এর বিপরীত রয়েছে। সাথে সাথে এটা অতি স্বাভাবিক কথা যে, যার প্রতি শরীআতের কোন দায়িত্ব এখনো বর্তায়নি সে নামাযের মতো গুরম্নত্বপূর্ণ ইবাদাতে অন্যদের কী প্রতিনিধিত্ব করবে? এ ছাড়া, উপরিউক্ত হাদীস দু’টির ভিত্তিতে নাবালকের ইমামতিকে বৈধ বলা হলে তা পূর্ববর্ণিত মারফু’ হাদীস, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈগণের মতামত এবং শরীআতের বেশ কিছূ মূলনীতির পরিপন্থী হবে। আবার বৈধ ও অবৈধের দ্বন্দ্ব হলে সর্বদা অবৈধের দিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ নিয়মের আওতায়ও নাবালককে ইমাম বানানো থেকে বেঁচে থাকা জরুরী; বিশেষ করে ফরয নামাযে।
