মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৪- পাক-পবিত্রতার অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৮৫
৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - মিসওয়াক করা প্রসঙ্গে
৩৮৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, একবার আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি দাঁতন দ্বারা মেসওয়াক করছি। এমন সময় আমার নিকট, দুইজন লোক উপস্থিত হল। তাদের একজন অপরজনের তুলনায় জ্যেষ্ঠ। আমি কনিষ্ঠজনকেই আমার মেসওয়াক দিতে গেলাম। তখন আমাকে বলা হল, জ্যেষ্ঠজনকেই দিন। তখন আমি তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকেই দিলাম। -বুখারী, মুসলিম
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَرَانِي فِي الْمَنَامِ أَتَسَوَّكُ بِسِوَاكٍ فَجَاءَنِي رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا أَكْبَرُ مِنَ الْآخَرِ فَنَاوَلْتُ السِّوَاكَ الْأَصْغَرَ مِنْهُمَا فَقِيلَ لي: كبر فَدَفَعته إِلَى الْأَكْبَر مِنْهُمَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একটি স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। সে স্বপ্নে তিনি মুখে মিসওয়াক ব্যবহার করার পর মিসওয়াকটি উপস্থিত দুই ব্যক্তির মধ্যে যে ছোট তাকে দিয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়, এটি বড়জনকে দিন। তিনি সেটি বড়জনকে দিয়ে দেন।

তাঁকে এ নির্দেশ দানকারী ছিলেন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম। অপর এক বর্ণনায় তার উল্লেখ আছে।

এ হাদীছটির সরাসরি সম্পর্ক মিসওয়াক দেওয়ার সঙ্গে। কিন্তু এর নির্দেশ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন, খাবার বা পানীয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সে যে বড় তাকে আগে দেওয়া চাই। এমনিভাবে রাস্তায় চলার সময় বড়কে আগে চলতে দেওয়া চাই, গাড়িতে ওঠার সময় বড়কে আগে ওঠার সুযোগ দেওয়া চাই, কথা বলার সময়ও বড়কে আগে বলতে দেওয়া চাই।

তদ্রূপ খাদ্য বা পানীয় বা কোনো কিছু পরিবেশন বা বিতরণকালে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ বা সম্মানীকেই অগ্রাধিকার দেওয়া সুন্নাত। তা তিনি মজলিসের যেখানেই অবস্থান করুন না কেন। তারপর তার ডানদিকের জন থেকে আরম্ভ করা হবে। তখন ডানদিকের জন বয়সে ছোট হলেও উপস্থিত অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠের উপর তার অগ্রাধিকার থাকবে। সুতরাং একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি পান করছিলেন। তাঁর ডানদিকে এক বেদুঈন বসা ছিল। বামদিকে ছিলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি। তিনি অবশিষ্ট পানি প্রথমে আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে না দিয়ে বেদুঈনকেই দিলেন। তারপর বললেন, প্রথমে ডানদিকের জন, তারপর তার পরবর্তী জন।২০১

হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পেয়ালা থেকে পানি পান করলেন। তাঁর ডানে ছিল একটি বালক। সে উপস্থিত লোকদের মধ্যে সকলের ছোট। বামদিকে ছিল বয়স্করা। পানি পান করার পরে তিনি বললেন, ওহে বালক! তুমি কি বয়স্কদেরকে এটা দিতে আমাকে অনুমতি দেবে? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার বরকত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমি কাউকে অগ্রাধিকার দেব না। অগত্যা তিনি তা বালকটিকেই দিয়ে দিলেন।২০২

উক্ত দুই হাদীছে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মজলিসের সর্বাপেক্ষা সম্মানী ব্যক্তিত্ব তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে পানীয় গ্রহণ করার পর তাঁর ডানের জনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তা সে বালকই হোক না কেন। সুতরাং সর্বাপেক্ষা সম্মানীকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারপর তার ডানকে।

উল্লেখ্য, নবীগণের স্বপ্ন আমাদের স্বপ্নের মত নয়। তাঁদের স্বপ্নও ওহী হয়ে থাকে। তাই স্বপ্নযোগে যে আদেশ করা হয় তা জাগ্রত অবস্থার ওহীর মতই পালনীয়। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্র ইসমা'ঈল আলাইহিস সালামকে স্বপ্নযোগে যবাহ করতে দেখেছিলেন। ফলে তিনি সে যবাহকে আল্লাহ তাআলার আদেশ গণ্য করেন এবং সেমতে পুত্রকে যবাহ করতে প্রস্তুত হয়ে যান। এ কথা ভিন্ন যে, তাঁদের স্বপ্নেরও ব্যাখ্যা থাকে। সে ব্যাখ্যাও তাঁরা আল্লাহ তাআলার তরফ থেকেই প্রাপ্ত হন। ফলে তাতে কোনও ভুল হয় না।

পক্ষান্তরে আমাদের স্বপ্ন সেরকম নয়। এতে যথেষ্ট ভুলে সম্ভাবনা থাকে। আর সঠিক হলেও তা কোনও হুকুমের মর্যাদা রাখে না। বড়জোর তা উৎসাহমূলক বা সতর্কীকরণমূলক হয়। কাজেই স্বপ্নে শরীআতবিরোধী কোনও হুকুম পাওয়া গেলে সে হুকুম কিছুতেই পালন করা যাবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মিসওয়াক বা অন্য কোনও বস্তু উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বিতরণকালে তাদের মধ্যে বয়সে যে বড় বা সম্মানী তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া চাই। তারপর তার ডান দিকে যারা থাকবে তাদেরকে দিয়ে আরম্ভ করা হবে। অতঃপর এদের ডানে যারা থাকবে তাদেরকে। এভাবে শেষ পর্যন্ত। এ পদ্ধতিতে বড়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার হাদীছ এবং ডানকে প্রাধান্য দেওয়ার হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান হয়ে যায়।

খ. কারও কোনও ভুল কাজে সতর্ক করা হলে তা সংশোধন করতে কুণ্ঠাবোধ করতে নেই।

২০১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৬১২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০২৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৭২৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৮৯৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৪২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২০৭৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩৩৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৬৬৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৬৩৩

২০২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৩৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৩০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮৬৭; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৪৮৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৭৮০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৬৬৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৬৩৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৩৮৫ | মুসলিম বাংলা