আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৭৯৮
২১২০. (আল্লাহর বাণীঃ) আর তারা (আনসারগণ) নিজেরা অভাবগ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও অন্যদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় (৫৯ঃ ৯)
৩৫২৬। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক (ক্ষুধার্ত) ব্যক্তি নবী কারীম (ﷺ)- এর খেদমতে এল। তিনি খাদ্য দ্রব্য কিছু আছে কিনা তা জানার জন্য তাঁর সহধর্মিণীদের কাছে লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের নিকট পানি ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, কে আছ যে এই (ক্ষুধার্ত) ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন জনৈক আনসারী সাহাবী (আবু তালহা (রাযিঃ) বললেন আমি (পারব)। এ বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে (বাড়িতে) গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর মেহমানকে সন্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাঁদের আহার্য ব্যতীত আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনসারী বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত কর এবং বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।
(স্বামীর কথা অনুযায়ী) সে বাতি জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াল এবং সামান্য খাবার যা তৈরী ছিল তা উপস্থিত করল। (তারপর মেহমান সহ তারা খেতে বসলেন) বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে, তারাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই (বাচ্চারা সহ) সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট গেলেন, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ্ তোমাদের গতরাতের কার্যকলাপ দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশী হয়েছেন এবং এ আয়াত নাযিল করেছেন। (আনসারদের অন্যতম গুণ হল এই): তারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের উপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম। (৫৯ঃ ৯)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলেছিল- إِنِّي مَجْهُودٌ (আমি খুব ক্ষুধার্ত)। কে সেই ব্যক্তি, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেউ কেউ বলেন, তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. নিজেই। কারও মতে তিনি ছিলেন একজন মুহাজির সাহাবী।

مجهود শব্দটির উৎপত্তি جُهْدٌ থেকে। এর অর্থ কষ্ট, অভাব, ক্ষুধা, কষ্টকর জীবন। এখানে ক্ষুধার কষ্ট বোঝানো উদ্দেশ্য। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, যার যা প্রয়োজন তা প্রথমে নিজের পক্ষ থেকেই পূরণের চেষ্টা করা। কাজেই আগুন্তুক ব্যক্তি নিজ ক্ষুধার কষ্টের কথা জানালে তিনি প্রথমে নিজ ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখলেন তাকে খাওয়ানোর মতো কিছু আছে কি না। এক এক করে প্রত্যেক স্ত্রীর ঘরে খোঁজ নেওয়া হল। কিন্তু সেদিন কারও ঘরেই কোনও খাবার ছিল না। এর দ্বারা অনুমান করা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গ কেমন অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন!

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও অভ্যাস ছিল, অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে মেটাতে না পারলে যাদের পক্ষে মেটানো সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করতেন। অভাবগ্রস্তকে তাদের সামনে তুলে ধরতেন, যাতে তারা তার অভাব পূরণে সহযোগিতা করে। নিজে না পারলে যে খালিহাতে ফিরিয়ে দিতেন এমন নয়। যেভাবেই হোক তার প্রয়োজন যাতে মিটিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টাই তিনি সর্বদা করতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন-
مَنْ يُضِيْفُ هَذَا اللَّيْلَةَ؟ (এ রাতে কে এই ব্যক্তির মেহমানদারি করবে)? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন- أَلَا رَجُلٌ يُضَيفُهُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، يَرْحَمُهُ اللهُ؟ (এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যে আজ রাতে এর মেহমানদারি করবে, বিনিময়ে আল্লাহ তার প্রতি রহম করবেন?)।(সহীহ বুখারী: ৪৮৮৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩৩০৩)

فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: أَنَا يَا رَسُوْلَ اللَّهِ (এক আনসারী ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি)। এই সাহাবী কে ছিলেন? বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। যেমন হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি., হযরত ছাবিত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আসলে এরূপ ঘটনা বহুবারই ঘটেছিল। মাঝেমধ্যেই ক্ষুধার্ত, অভুক্ত অতিথি এসে হাজির হতো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার মেহমানদারির ব্যবস্থা করতে হতো। তাই ধারণা করা যায়, এসকল সাহাবীর প্রত্যেকেই কোনও না কোনওবার অভুক্ত অতিথিকে সঙ্গে করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

যাহোক সেই সাহাবী অতিথিকে নিয়ে নিজ বাড়ি গেলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন- أَكْرِمِي ضَيْفَ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো)। মূলত সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অতিথি ছিল। কারণ সে এসেছিল তাঁর কাছেই। এ মেজবান সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই তার আতিথেয়তা করছিলেন। সে কারণেই স্ত্রীকে এরূপ বলেছেন। এমনিতেই অতিথিকে সম্মান করা জরুরি। অতিথি যেই হোক, ইসলাম তাকে সম্মান করতে বলেছে। আবার এ অতিথি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের! তাই বাড়তি তার প্রাপ্য। তাকে সম্মান করা হলে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই সম্মান করা হবে। তাই স্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অতিথির সম্মান করো।

কিন্তু কী দিয়ে অতিথির সেবা করা হবে? ঘরে তো কোনও খাবার নেই? স্বামী-স্ত্রী খাবেন, সেরকম কিছুও নেই। কেবল বাচ্চাদের খাওয়ানোর মতো সামান্য যা আছে। কিন্তু অতিথিকে তো খাওয়াতে হবে! তাই স্ত্রীকে বললেন-
فعَلِّليهم بشيءٍ (তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রেখো)। এ কথাটি সেই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যখন বাচ্চারা ক্ষুধার্ত না থাকে। অনেক সময় বাচ্চারা ক্ষুধা না থাকলেও খাবার চায়। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের খাবার না দিয়ে অন্য কোনও অভুক্ত বা মেহমানকে খাওয়ানো উত্তম। পক্ষান্তরে তারা ক্ষুধার্ত থাকলে তখন তাদেরই অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুধা মেটানো অবশ্যকর্তব্য। তাদেরকে অভুক্ত রেখে অন্যদের খাওয়ানো জায়েয নয়। সুতরাং সাহাবী যে বলছেন তাদেরকে কোনওকিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখো, অর্থাৎ তাদের খাবার আমরা মেহমানকে খাওয়াব, এর দ্বারা তিনি শিশুকে উপোস রেখে মেহমানকে খাওয়ানোর কথা বলেছেন এরূপ ধারণা করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে ছাওয়াব নয়; বরং গুনাহই হতো।

وَإِذَا أَرَادُوا الْعَشَاءَ فَنومِيهِمْ (আর যখন রাতের খাবার চাবে, তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো)। কারণ তারা সজাগ থাকলে তাদের বাদ দিয়ে মেহমান খেতে চাবে না। আবার তারা সঙ্গে খেলে মেহমানের ক্ষুধা মিটবে না। বাচ্চাদের জন্য রাখা খাবার কতটুকুই বা ছিল!

وَإِذَا دَخَلَ ضَيْفُنَا فَأَطْفِي السّرَاجَ، وَأَرِيْهِ أَنَّا نَأْكُلُ (যখন আমাদের অথিতি প্রবেশ করবে, বাতি নিভিয়ে দিয়ো আর তাকে দেখিয়ো যেন আমরা খানা খাচ্ছি)। অর্থাৎ আমরাও মেহমানের সঙ্গে বসব, হাত নাড়ব, মুখে খাওয়ার আওয়াজ করব, যাতে মেহমান বুঝে আমরাও খাচ্ছি। অন্যথায় সে একা খেতে চাবে না। আবার আমরা খেলে অল্প খাবারে তার ক্ষুধাও মিটবে না। ফলে মেহমানের যথাযথ সেবা করা হবে না। এটা ছিল সে আনসারী দম্পতির চমৎকার ভদ্রতার পরিচায়ক। অতিথিকে একা খেতে বসার সংকোচে ফেললেন না, অধিকন্তু নিজেরা খাওয়ার ভান করে তাকে স্বস্তির সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এভাবে তারা মেহমানকে খাওয়ালেন এবং নিজেরা সে রাত না খেয়ে কাটালেন। ভোরবেলা সে সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন-
لَقَدْ عَجِبَ اللهُ مِنْ صَنِيْعِكُمَا بِضَيْفِكُمَا اللَّيْلَةَ (আজ রাতে অথিতির প্রতি তোমাদের আচরণে আল্লাহ খুব খুশি হয়েছেন)। বোঝাই যাচ্ছে অতিথির প্রতি আনসারী দম্পতি যে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। তাই সাহাবী নিজের থেকে কিছু বলার আগেই তিনি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের আচরণে তাদের প্রতি খুশি হয়েছেন। عجب শব্দটির প্রকৃত অর্থ মুগ্ধ হওয়া, বিস্মিত হওয়া। আল্লাহ তা'আলার জন্য এ অর্থ খাটে না। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি খুশি হয়েছেন বা তিনি তোমাদের কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব দান করেছেন কিংবা তিনি তোমাদের এ কাজটিকে মূল্যায়ন করেছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ।

খ. কোনও অতিথি বা অভাবগ্রস্ত লোক আসলে সর্বপ্রথম নিজ গৃহেই তার আতিথেয়তা বা তার প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করা উচিত, যেমনটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন।

গ. কোনও অভাবগ্রস্তের অভাব নিজে পূরণ করতে না পারলে যাদের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব তাদের কাছে সুপারিশ করা উচিত।

ঘ. অতিথিকে নিজ ঘরে সাদরে গ্রহণ করা চাই।

ঙ. অতিথিসেবায় স্ত্রীর উচিত স্বামীকে সহযোগিতা করা।

চ. নিজেরা অভুক্ত থেকে অতিথির ক্ষুধা নিবারণ করা সাহাবীদের আদর্শ।

ছ. শিশুরা খুব ক্ষুধার্ত না হলে তাদের উপর অতিথি বা অভাবগ্রস্তকে প্রাধান্য দেওয়া মহত্ত্বতার পরিচায়ক।

জ. অতিথির সেবা করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন।

ঝ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে অনেক বিষয় আগাম জানতে পারতেন। এটা তাঁর এক মু'জিযা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন