আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ

আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ১১৬২
৫৪৮. আমানতদারী
১১৬২. হযরত সাবিত বলেন, হযরত আনাস (রাযিঃ) বলিয়াছেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ্‌ (ﷺ)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। যখন আমি কাজ হইতে অবসর হইলাম, তখন মনে মনে ভাবিলাম, এবার নবী করীম (ﷺ) বুঝি বিশ্রাম গ্রহণ করিবেন। (তাই আমার আর তাঁহার ঘরে থাকা সমীচীন হইবে না) এই ভাবিয়া যখন বাহিরে আসিলাম তখন কয়েকটি বালক বাহিরে খেলিতেছিল। আমি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাদের খেলা দেখিতে লাগিলাম। এমন সময় নবী করীম (ﷺ) বাহির হইয়া আসিলেন এবং তাহাদিগকে সালাম দিলেন। তারপর তিনি আমাকে কাছে ডাকাইলেন এবং একটি কাজে পাঠাইয়া দিলেন। তারপর আমি কাজ সারিয়া তাঁহার কাছে আসিলাম এবং আমার কাছে যাইতে আমার বিলম্ব হইয়া গেল। তখণ তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাকে এতক্ষণ কিসে আটকাইয়া রাখিয়াছিল? আমি বলিলামঃ নবী করীম (ﷺ) একটি কাজে আমাকে পাঠাইয়াছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ উহা কী? আমি বলিলাম, উহা নবী করীম (ﷺ)-এর একটি গোপনীয় ব্যাপার। তিনি বলিলেন, নবী ক্রিং (ﷺ)-এর গোপ্নীয়ত ব্যাপারে গোপনীয় অবশ্যই রক্ষা করিবে। সেই অবধি আজ পর্যন্ত সৃষ্টিজগতের কাহারও কাছে সেই কাজটি যে কি ছিল প্রকাশ করি নাই। যদি উহা বলিবারই হইত, তবে (হে সাবিত!) অবশ্যই তোমার কাছে উহা বলিতাম।
بَابُ الأَمَانَةِ
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، قَالَ‏:‏ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسٍ‏:‏ خَدَمْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا، حَتَّى إِذَا رَأَيْتُ أَنِّي قَدْ فَرَغْتُ مِنْ خِدْمَتِهِ قُلْتُ‏:‏ يَقِيلُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم، فَخَرَجْتُ مِنْ عِنْدِهِ، فَإِذَا غِلْمَةٌ يَلْعَبُونَ، فَقُمْتُ أَنْظُرُ إِلَيْهِمْ إِلَى لَعِبِهِمْ، فَجَاءَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَانْتَهَى إِلَيْهِمْ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ، ثُمَّ دَعَانِي فَبَعَثَنِي إِلَى حَاجَةٍ، فَكَانَ فِي فَيْءٍ حَتَّى أَتَيْتُهُ‏.‏ وَأَبْطَأْتُ عَلَى أُمِّي، فَقَالَتْ‏:‏ مَا حَبَسَكَ‏؟‏ قُلْتُ‏:‏ بَعَثَنِي النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِلَى حَاجَةٍ، قَالَتْ‏:‏ مَا هِيَ‏؟‏ قُلْتُ‏:‏ إِنَّهُ سِرٌّ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَقَالَتِ‏:‏ احْفَظْ عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم سِرَّهُ، فَمَا حَدَّثْتُ بِتِلْكَ الْحَاجَةِ أَحَدًا مِنَ الْخَلْقِ، فَلَوْ كُنْتُ مُحَدِّثًا حَدَّثْتُكَ بِهَا‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আনাস রাযি.-এর বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখন তাঁর মা হযরত উন্মু সুলায়ম রাযি. তাঁকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে খুব আদর-যত্ন করতেন। তিনি তাঁর টুকটাক কাজ করে দিতেন। যেহেতু তিনি বালকবয়সী ছিলেন, তাই অন্যান্য বালকের সঙ্গে খেলাধুলায়ও মশগুল হয়ে যেতেন। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কোনও বারণ ছিল না। একদিন তিনি বালকদের সঙ্গে খেলায় মশগুল রয়েছেন। এ অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌছে বালকদের সালাম দিলেন।

সাধারণ নিয়ম হল ছোট বড়কে সালাম দেবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটদেরকেও সালাম দিতেন। এর দ্বারা ছোটকে শিক্ষা দেওয়া উদ্দেশ্য হত। তাছাড়া এটা তাঁর বিনয়েরও প্রকাশ ছিল। তিনি অন্যান্য মহৎ গুণের মতো অসাধারণ বিনয়েরও অধিকারী ছিলেন। আগে সালাম দেওয়া বিনয়ের আলামত।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস রাযি.-কে কোনও একটা কাজে পাঠালেন। সে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে যেতে তাঁর বিলম্ব হয়ে গেল। মা বিলম্বের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তা জিজ্ঞেস করাই স্বাভাবিক। সন্তান সচরাচর যে সময়ে বাড়িতে ফিরে আসে, কখনও তারচে' বিলম্ব হলে জিজ্ঞেস করা চাই কেন তার বিলম্ব হল। এটা সতর্কতা। এ সতর্কতা না থাকলে সে হয়তো অনুচিত কোনও কাজে জড়িয়ে পড়বে। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অসতর্কতা অনেক সময়ই তাকে বিপথগামিতায় উৎসাহ যোগায়। সচেতন পিতা-মাতা কখনও সে অবকাশ তার সন্তানকে দিতে পারে না।

মায়ের জিজ্ঞাসার উত্তরে হযরত আনাস রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে একটি প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। মা জিজ্ঞেস করলেন, কী সে প্রয়োজন? সন্তান যদি বিলম্ব হওয়ার কারণ স্বরূপ কোনও অস্পষ্ট উত্তর দেয়, যেমন একটা কাজ ছিল বা একটা প্রয়োজন ছিল, তবে তার ব্যাখ্যা চাওয়া ভালো। কেননা অস্পষ্টভাবে কোনও কাজ বা প্রয়োজনের কথা বলে সে এমন কিছু লুকাতে পারে, যা সমর্থনযোগ্য নয়। হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. একজন সচেতন মা ছিলেন। তাই তিনি প্রয়োজনটির ব্যাখ্যা চাইলেন।

হযরত আনাস রাযি. বললেন, সেটি গোপন কথা। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক কাজে আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যা প্রকাশ করা যাবে না। নিশ্চয়ই সেটি এমন এক কাজ ছিল, দীন ও শরী'আতের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই। দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও লুকাতেন না। ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন। আল্লাহ তা'আলা উম্মতের প্রয়োজনীয় যা-কিছু তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি তা সবই পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্টরূপে উম্মতের কাছে প্রকাশ করেছেন । কাজেই হযরত আনাস রাযি.-কে যে কাজে পাঠিয়েছিলেন তা হয়তো তাঁর স্ত্রীদের বা তাঁর নিজের এমন ব্যক্তিগত কোনও বিষয় ছিল, যা অন্যের জানার প্রয়োজন ছিল না। হয়তো জানানো সঙ্গতও ছিল না। তাই তা প্রকাশ করতে বারণ করেছিলেন।

হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. তাঁর সন্তানের এক উত্তম শিক্ষিকাও ছিলেন। তাই তিনি হযরত হযরত আনাস রাযি.-কে সতর্ক করলেন যে, দেখো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা গোপন রাখতে বলেছেন, তুমি তা অবশ্যই গোপন রাখবে। কোনও অবস্থায়ই তা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। সুতরাং হযরত আনাস রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে গোপন কথা জীবনভর গোপনই রেখেছেন। কোনও প্রিয়জনের কাছেও তা কখনও প্রকাশ করেননি। ছাবিত রহ. ছিলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। প্রিয় শিষ্যের কাছে শিক্ষক নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুও বলে থাকে। ঘনিষ্ঠ শিষ্যরা তাদের শিক্ষকের অনেক গোপন কথা জেনে থাকে। কিন্তু হযরত আনাস রাযি, তাঁর প্রিয় শিষ্য ছাবিত রহ.-কে পর্যন্ত এ গোপন কথাটি বলেননি। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হযরত আনাস রাযি.-এর পূর্ণ আনুগত্য, পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিচয় বহন করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটা উচ্চপর্যায়ের বিনয়ী ছিলেন। সায়্যিদুল আম্বিয়া হওয়া সত্ত্বেও তিনি খেলাধুলায় রত একদল বালককে সালাম দিয়েছেন।

খ. কারও কাছ দিয়ে অতিক্রমকালে তাকে সালাম দেওয়া চাই, যদিও সে বয়সে ছোট হয়।

গ. নাবালককে কোনও কাজে পাঠানো যেতে পারে, যদি তার নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে।

ঘ. কারও গোপন কথা ফাঁস করা জায়েয নয়। এমনকি পিতা-মাতার কাছেও নয়। পিতা-মাতার উচিত নয় তা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করা।

ঙ. সন্তান যাতে কর্তব্যকর্ম পালনে যত্নবান থাকে, পিতা-মাতার উচিত সেজন্য তাকে সতর্ক ও সচেতন করা এবং সে কখন কী করে সে বিষয়ে উদাসীন না থাকা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আল-আদাবুল মুফরাদ - হাদীস নং ১১৬২ | মুসলিম বাংলা