আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ৫১৯
২৩৪- রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখিতে যাওয়া
৫১৯। হযরত আবু সাঈদ (রাযিঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখিতে যাইবে এবং জানাযার অনুসরণ করিবে। [অর্থাৎ শবযাত্রা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করিবে] উহা তোমাকে পরকালের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে।
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ ، قَالَ : حَدَّثَنَا أَبَانُ بْنُ يَزِيدَ ، قَالَ : حَدَّثَنَا قَتَادَةُ ، قَالَ : حَدَّثَنِي أَبُو عِيسَى الأُسْوَارِيُّ ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : " عُودُوا الْمَرِيضَ ، وَاتَّبَعُوا الْجَنَائِزَ ، تُذَكِّرُكُمُ الآخِرَةَ "
হাদীসের ব্যাখ্যা:
রোগী দেখতে যাওয়া
عِيَادَةُ الْمَرِيضِ (রোগীর 'ইয়াদাত করা)। অর্থাৎ রোগী দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কোনও কোনও হাদীছে একে মুসলিম ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। এটা যখন মুসলিম ব্যক্তির হক, তখন অবশ্যপালনীয়ও বটে। কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তার খোঁজখবর নিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাকে দেখতেও যেতে হবে। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরও দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من مسلم يعود مسلما غدوة, إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي, وإن عاده عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح, وكان له خريف في الجنة
'যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে عَادَهُ সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়’।
(জামে তিরমিযী: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৭৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৪১০)
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَيُّمَا رَجُلٍ يَعُودُ مَرِيضًا، فَإِنَّمَا يَخُوضُ فِي الرَّحْمَةِ، فَإِذَا قَعَدَ عِنْدَ الْمَرِيضِ غَمَرَتْهُ الرَّحْمَةُ، قَالَ : فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللهِ ، هَذَا لِلصَّحِيحِ الَّذِي يَعُودُ الْمَرِيضِ، فَالْمَرِيض مَا لَهُ؟ قَالَ: تُحَطَّ عَنْهُ ذُنُوبُهُ.
'যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়’।
(মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৮২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ১০৮৩৯; মুসান্নাফ আব্দুর রায্ যাক : ৬৭৬৪; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা: ৬৫৮৩; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত: ২২০৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৪৫২)
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
.مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً
‘যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক’।
(জামে তিরমিযী: ২০০৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৩৪৫; শারহুস্ সুন্নাহ: ২৪৭৪)
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَائِدُ الْمَرِيضِ فِي مَخْرَفَةِ الْجَنَّةِ
'যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ সে জান্নাতের পথে) থাকে’।
(সহীহ মুসলিম : ২৫৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪২; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩৭৫০; মুসনাদে আহমাদ: ২২৪০৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫৮০; শুআবুল ঈমান : ৮৭৩৮)
জানাযায় অংশগ্রহণ
إِتَّبَاعُ الْجَنائِز (জানাযায় অংশগ্রহণ করা)। কোনও মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার জানাযা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা জীবিতদের উপর ফরয। এটা ফরযে কিফায়াহ। একদল লোক এটা সমাধা করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। অন্যথায় সকলেই গুনাহগার হয়। এ কাজ মৃতব্যক্তির হক, তার প্রাপ্য। এর দ্বারা মৃতব্যক্তিও উপকৃত হয় এবং যারা এ কাজে অংশগ্রহণ করে তারাও উপকৃত হয়। সেইসঙ্গে এটা মৃতব্যক্তির পরিবার ও তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশও বটে। এতে তারা সান্ত্বনা পায়, তাদের কষ্ট লাঘব হয়। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যেকেরই এতে অংশগ্রহণ করা উচিত। এতে মৃতব্যক্তির উপকার তো এই যে, জানাযার নামায মূলত তার জন্য দু'আ। মৃতব্যক্তির জন্য জীবিতদের দু'আ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হয়ে থাকে। এটা তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ। জীবিতদের সুপারিশ মৃতব্যক্তির উপকারে আসে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ مَيِّتِ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُوْنَ مِائَةً، كُلُّهُمْ يَشْفَعُوْنَ لَهُ، إِلَّا شُفّعُوا فِيهِ
'একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়িয়তের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়’।
(সহীহ মুসলিম: ৯৩২; জামে তিরমিযী: ১০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৩৮০৪; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ১১৬২২; সুনানে নাসাঈ ১৯৯১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৮১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৯০৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلاً، لا يشركون بالله شيئاً إلا شَفَعهم الله فيه
'কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন। (সহীহ মুসলিম: ৯৪৮; সুনানে আবু দাউদ: ৩১৭০; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩০৮২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৫৬২১; শুআবুল ঈমান: ৮৮১২)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের নিজেদেরও অনেক ফায়দা হয়। একটা বড় ফায়দা তো নসীহত ও উপদেশলাভ। জানাযায় অংশগ্রহণ দ্বারা এই উপদেশ লাভ হয় যে, একদিন আমারও মরতে হবে। আমারও জানাযা পড়া হবে। হয়তো যে-কোনওদিনই মালাকুল-মাওত আমার কাছে এসে পড়বে। আমি সেজন্য কতটুকু প্রস্তুত? এভাবে এ চিন্তা জানাযায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আখিরাতমুখী করে তোলে। এ চিন্তা তার আত্মসংশোধনে সহায়ক হয়। সে সৎকর্মশীল হলে সৎকর্মের প্রতি আরও অগ্রগামী হবে। পাপী হলে তাওবা করে সৎকর্মে মনোযোগী হবে। তাই হাদীছে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عُودُوا الْمَرْضَى، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ يُذَكِّرْكُمُ الْآخِرَةَ
'রোগীদের ইয়াদাত করো এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করো। তা তোমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেবে’।
(মুসনাদে আহমাদ:১২৩৬; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৫৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১০৮৪১; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৫১৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ১১১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৫৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৭৫০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫০৩)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলতেন-
كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا
'উপদেশদাতা হিসেবে মৃত্যুই যথেষ্ট।'
অর্থাৎ মৃতব্যক্তিকে দেখলে তার দ্বারা উপদেশ লাভ হয়। আর নিজেকে সংশোধন করা ও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য সে উপদেশই যথেষ্ট। এ বাক্যটি হাদীছরূপেও বর্ণিত আছে।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৭২; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ১৯২৫)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণকারীর আরেকটা বড় ফায়দা হল বিপুল ছাওয়াব অর্জন। এর অনেক ছাওয়াব। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من شهد الجنازة حتى يصلي، فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان»، قيل: وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين
'যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
(সহীহ বুখারী: ১৩২৫ সহীহ মুসলিম : ৯৪৫; মুসনাদে আহমাদ: ৯২০৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৭৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৭৪৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ২১৩৩)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর খোঁজখবর নেওয়া মুসলিম ব্যক্তির এক বিশেষ দায়িত্ব।
খ. জানাযার নামায ও দাফনে অংশগ্রহণ করা মৃতব্যক্তির হক। এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
عِيَادَةُ الْمَرِيضِ (রোগীর 'ইয়াদাত করা)। অর্থাৎ রোগী দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কোনও কোনও হাদীছে একে মুসলিম ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। এটা যখন মুসলিম ব্যক্তির হক, তখন অবশ্যপালনীয়ও বটে। কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তার খোঁজখবর নিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাকে দেখতেও যেতে হবে। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরও দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من مسلم يعود مسلما غدوة, إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي, وإن عاده عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح, وكان له خريف في الجنة
'যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে عَادَهُ সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়’।
(জামে তিরমিযী: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৭৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৪১০)
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَيُّمَا رَجُلٍ يَعُودُ مَرِيضًا، فَإِنَّمَا يَخُوضُ فِي الرَّحْمَةِ، فَإِذَا قَعَدَ عِنْدَ الْمَرِيضِ غَمَرَتْهُ الرَّحْمَةُ، قَالَ : فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللهِ ، هَذَا لِلصَّحِيحِ الَّذِي يَعُودُ الْمَرِيضِ، فَالْمَرِيض مَا لَهُ؟ قَالَ: تُحَطَّ عَنْهُ ذُنُوبُهُ.
'যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়’।
(মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৮২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ১০৮৩৯; মুসান্নাফ আব্দুর রায্ যাক : ৬৭৬৪; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা: ৬৫৮৩; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত: ২২০৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৪৫২)
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
.مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً
‘যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক’।
(জামে তিরমিযী: ২০০৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৩৪৫; শারহুস্ সুন্নাহ: ২৪৭৪)
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَائِدُ الْمَرِيضِ فِي مَخْرَفَةِ الْجَنَّةِ
'যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ সে জান্নাতের পথে) থাকে’।
(সহীহ মুসলিম : ২৫৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪২; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩৭৫০; মুসনাদে আহমাদ: ২২৪০৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫৮০; শুআবুল ঈমান : ৮৭৩৮)
জানাযায় অংশগ্রহণ
إِتَّبَاعُ الْجَنائِز (জানাযায় অংশগ্রহণ করা)। কোনও মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার জানাযা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা জীবিতদের উপর ফরয। এটা ফরযে কিফায়াহ। একদল লোক এটা সমাধা করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। অন্যথায় সকলেই গুনাহগার হয়। এ কাজ মৃতব্যক্তির হক, তার প্রাপ্য। এর দ্বারা মৃতব্যক্তিও উপকৃত হয় এবং যারা এ কাজে অংশগ্রহণ করে তারাও উপকৃত হয়। সেইসঙ্গে এটা মৃতব্যক্তির পরিবার ও তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশও বটে। এতে তারা সান্ত্বনা পায়, তাদের কষ্ট লাঘব হয়। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যেকেরই এতে অংশগ্রহণ করা উচিত। এতে মৃতব্যক্তির উপকার তো এই যে, জানাযার নামায মূলত তার জন্য দু'আ। মৃতব্যক্তির জন্য জীবিতদের দু'আ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হয়ে থাকে। এটা তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ। জীবিতদের সুপারিশ মৃতব্যক্তির উপকারে আসে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ مَيِّتِ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُوْنَ مِائَةً، كُلُّهُمْ يَشْفَعُوْنَ لَهُ، إِلَّا شُفّعُوا فِيهِ
'একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়িয়তের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়’।
(সহীহ মুসলিম: ৯৩২; জামে তিরমিযী: ১০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৩৮০৪; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ১১৬২২; সুনানে নাসাঈ ১৯৯১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৮১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৯০৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلاً، لا يشركون بالله شيئاً إلا شَفَعهم الله فيه
'কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন। (সহীহ মুসলিম: ৯৪৮; সুনানে আবু দাউদ: ৩১৭০; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩০৮২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৫৬২১; শুআবুল ঈমান: ৮৮১২)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের নিজেদেরও অনেক ফায়দা হয়। একটা বড় ফায়দা তো নসীহত ও উপদেশলাভ। জানাযায় অংশগ্রহণ দ্বারা এই উপদেশ লাভ হয় যে, একদিন আমারও মরতে হবে। আমারও জানাযা পড়া হবে। হয়তো যে-কোনওদিনই মালাকুল-মাওত আমার কাছে এসে পড়বে। আমি সেজন্য কতটুকু প্রস্তুত? এভাবে এ চিন্তা জানাযায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আখিরাতমুখী করে তোলে। এ চিন্তা তার আত্মসংশোধনে সহায়ক হয়। সে সৎকর্মশীল হলে সৎকর্মের প্রতি আরও অগ্রগামী হবে। পাপী হলে তাওবা করে সৎকর্মে মনোযোগী হবে। তাই হাদীছে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عُودُوا الْمَرْضَى، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ يُذَكِّرْكُمُ الْآخِرَةَ
'রোগীদের ইয়াদাত করো এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করো। তা তোমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেবে’।
(মুসনাদে আহমাদ:১২৩৬; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৫৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১০৮৪১; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৫১৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ১১১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৫৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৭৫০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫০৩)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলতেন-
كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا
'উপদেশদাতা হিসেবে মৃত্যুই যথেষ্ট।'
অর্থাৎ মৃতব্যক্তিকে দেখলে তার দ্বারা উপদেশ লাভ হয়। আর নিজেকে সংশোধন করা ও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য সে উপদেশই যথেষ্ট। এ বাক্যটি হাদীছরূপেও বর্ণিত আছে।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৭২; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ১৯২৫)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণকারীর আরেকটা বড় ফায়দা হল বিপুল ছাওয়াব অর্জন। এর অনেক ছাওয়াব। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من شهد الجنازة حتى يصلي، فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان»، قيل: وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين
'যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
(সহীহ বুখারী: ১৩২৫ সহীহ মুসলিম : ৯৪৫; মুসনাদে আহমাদ: ৯২০৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৭৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৭৪৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ২১৩৩)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর খোঁজখবর নেওয়া মুসলিম ব্যক্তির এক বিশেষ দায়িত্ব।
খ. জানাযার নামায ও দাফনে অংশগ্রহণ করা মৃতব্যক্তির হক। এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
