আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ৫১৮
২৩৪- রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখিতে যাওয়া
৫১৮। হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ্ তাআলা (কিয়ামতের দিন) বলিবেন, হে বান্দা! তোর নিকট ক্ষুধার অন্ন চাহিয়াছিলাম, তুই আমাকে অন্ন দান করিস নাই। তখন বান্দা বলিবে, পরওয়ারদিগার! কেমন করিয়া আপনি অন্ন চাহিলেন আর আমি অন্ন দান করিলাম না। আপনি তো রাব্বুল আলামীন-বিশ্ব জাহানের অন্নদাতা প্রভু! তখন আল্লাহ্ বলিবেন, তুই কি জানিসনে আমার অমুক বান্দা তোর কাছে অন্ন ভিক্ষা চাহিয়াছিল। আর তুই তাহাকে অন্ন দান করিস নাই? তুই কি জানিসনে যদি তুই তাহাকে অন্ন দান করিতে, তবে আজ তুই তাহা আমার নিকট পাইতে। হে আদম সন্তান! আমি তোর নিকট পিপাসার্ত হইয়া পানি চাহিয়াছিলাম, তুই আমাকে পানি দিস নাই! বান্দা বলিবে, প্রভু! কেমন করিয়া আমি তোমাকে পিপাসার পানি দান করিতাম, তুমি তো রাব্বুল আলামীন-বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক! আল্লাহ্ বলিবেন, আমার অমুক বান্দা তোর কাছে পিপাসার্ত হইয়া পানি চাহিয়াছিল, তুই তাহাকে পানি দিস নাই। তুই কি জানিসনে যদি তুই সেদিন তাহাকে পানি দান করিতে, তবে আজ তুই তাহা আমার নিকট পাইতে। হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত হইয়াছিলাম, তুই আমার শুশ্রূষা করিস নাই! বান্দা বলিবে, প্রভু! কেমন করিয়া আমি তোমার শুশ্রূষা করিতাম, তুমি যে রাব্বুল আলামীন বিশ্ব জাহানের প্রভু! আল্লাহ্ বলিবেন, ও তুই কি জানিসনে, আমার অসুক বান্দা পীড়িত হইয়াছিল, যদি তুই তাহার শুশ্রূষা করিতে তবে আজ তাহা আমার নিকট পাইতে অথবা তুই তাহার কাছেই আমাকে পাইতে!
حَدَّثَنَا حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ ، قَالَ : أَخْبَرَنَا النَّضْرُ بْنُ شُمَيْلٍ قَالَ : أَخْبَرَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ ، عَنْ ثَابِتٍ الْبُنَانِيِّ ، عَنْ أَبِي رَافِعٍ ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : " يَقُولُ اللَّهُ : اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمَنِي ، قَالَ : فَيَقُولُ : يَا رَبِّ ، وَكَيْفَ اسْتَطْعَمْتَنِي وَلَمْ أُطْعِمْكَ ، وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ ؟ قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلانًا اسْتَطْعَمَكَ فَلَمْ تُطْعِمْهُ ؟ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ كُنْتَ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي ؟ ابْنَ آدَمَ ، اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي ، فَقَالَ : يَا رَبِّ ، وَكَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ ؟ فَيَقُولُ : إِنَّ عَبْدِي فُلانًا اسْتَسْقَاكَ فَلَمْ تَسْقِهِ ، أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ كُنْتَ سَقَيْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي ؟ يَا ابْنَ آدَمَ ، مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي ، قَالَ : يَا رَبِّ ، كَيْفَ أَعُودُكَ ، وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ ؟ قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلانًا مَرِضَ ، فَلَوْ كُنْتَ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي ؟ أَوْ وَجَدْتَنِي عِنْدَهُ ؟ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি গভীর উপদেশপূর্ণ ও সারগর্ভ একটি হাদীছ। এতে হৃদয়গ্রাহী পন্থায় রোগীকে দেখতে যাওয়া, ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো ও পিপাসার্তকে পানি পান করানোর ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। পরোক্ষভাবে এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর বান্দার যে কত উচ্চমর্যাদা, তাও ফুটে উঠেছে। হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা মানুষকে বলবেন-
يا ابن آدم، مرضت فلم تعدني (আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে আসনি)। অর্থাৎ আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে যাওনি। বান্দার অসুস্থতাকে আল্লাহ তা'আলা নিজের অসুস্থতা সাব্যস্ত করেছেন। এমনিভাবে বান্দাকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টিকে তাঁকে দেখতে যাওয়ার নামান্তর সাব্যস্ত করেছেন। এর দ্বারা বান্দা যে আল্লাহর কাছে কত মর্যাদাবান এবং তাঁর কতটা নিকটবর্তী, তা অনুমান করা যায়। আল্লাহ তা'আলার এ কথাটি তাঁর পক্ষ থেকে একটা তিরস্কার। যে ব্যক্তি কারও অসুস্থতার সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে দেখতে যায়নি, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা এই বলে তাকে তিরস্কার করবেন। এর উত্তরে বান্দা বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَعُوْدُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আপনি জগৎসমূহের পালনকর্তা। আপনি কীভাবে অসুস্থ হতে পারেন যে, আমি আপনাকে দেখতে যাব)? অর্থাৎ অসুস্থ তো হয় দুর্বল বান্দা। আর দেখতে যাওয়া যায় সেই দুর্বল বান্দাকেই। আপনি মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। আপনি সর্বশক্তিমান। কোনওরকম দুর্বলতা আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই আপনার অসুস্থ হওয়ার প্রশ্ন আসে না। সুতরাং আপনার অসুস্থ হওয়ারই বা কী অর্থ আর আপনাকে দেখতে যাওয়াই বা কীভাবে সম্ভব? এর উত্তরে আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
! أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ ( তুমি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তা সত্ত্বেও তুমি তাকে দেখতে যাওনি)? অর্থাৎ তুমি তো তার অসুস্থ হওয়ার কথা জানতে। তা জানা সত্ত্বেও যে তুমি তাকে দেখতে যাওনি, এটা তোমার একটা অবহেলা। এ অবহেলার দ্বারা তুমি কত বড়ই না মাহাত্ম্য ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছ। আল্লাহ বলবেন-
! أمَّا عَلَمْتَ أَنكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوجَدَتنى عنده (তুমি জানতে না যদি তাকে দেখতে যেতে, তবে অবশ্যই আমাকে তার কাছে পেতে)? অর্থাৎ তাকে দেখতে যাওয়ার ছাওয়াব ও পুরস্কার আমার কাছে পেতে। কী গভীর ভাবপূর্ণ কথা। আল্লাহ বলছেন, তুমি তাকে দেখতে গেলে আমাকে তার কাছে পেতে। আল্লাহ তাঁর অসুস্থ বান্দার কাছে থাকেন। সেখানে গেলে কেবল বান্দার কাছেই যাওয়া হয় না, যাওয়াটা এক রোগীর কাছেই হয় না, তার মালিক স্বয়ং আল্লাহর কাছেও যাওয়া হয়। এমনই ভালোবাসেন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে! এমনই নিকটবর্তী তিনি তাঁর বান্দার এবং বান্দাও তাঁর।
এর দ্বারা যেমন রুগ্ন ব্যক্তির মর্যাদা ফুটে ওঠে, তেমনি যে ব্যক্তি তাকে দেখতে যায় তার মর্যাদাও পরিস্ফুট হয়। কারণ তার যাওয়াটাকে কেবল একজন মানুষের কাছে যাওয়া নয়; বরং মানুষের সৃষ্টিকর্তার কাছে যাওয়ার মহিমা দেওয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ মহিমা কেবল তখনই লাভ হয়, যখন যাওয়ার উদ্দেশ্য হবে আল্লার তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। মানুষকে দেখানোর জন্য গেলে তো মানুষের কাছে যাওয়ার নামান্তর হল। এটা আল্লাহর কাছে যাওয়া বলে গণ্য হবে কেবল তখনই, যখন লক্ষ্যবস্তু হবে কেবল আল্লাহ তা'আলাই। সুতরাং নিয়ত সহীহ থাকা জরুরি।
এমনিভাবে যার কাছে কোনও ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাবার চেয়েছে, কিন্তু সে তাকে খাবার দেয়নি, তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
! يَا ابْنَ آدَمَ، اِسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمِنِي (হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি)। অর্থাৎ আমার অমুক ক্ষুধার্ত বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাবার দাওনি। কী প্রেমময়, কী দয়াময় মহান আল্লাহ! ক্ষুধার্ত বান্দার খাবার চাওয়াকে নিজের খাবার চাওয়া শব্দে প্রকাশ করেছেন। এমনিভাবে তাকে খাওয়ানোকে স্বয়ং তাঁকে খাওয়ানো সাব্যস্ত করেছেন। বান্দা বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আমি কীভাবে আপনাকে খাওয়াতে পারি, যখন আপনি জগৎসমূহের প্রতিপালক)? অর্থাৎ জগৎপালক হওয়ায় আপনিই আপনার সকল সৃষ্টিকে খাবার দিয়ে থাকেন। আপনিই সকলের রিযিকদাতা। সকল মাখলূক দুর্বল। তাদের রিযিকের প্রয়োজন হয়। ক্ষুধা পেলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। সে দুর্বলতা কাটানোর জন্য তাদের খাদ্যের দরকার পড়ে। খাবার খেয়ে তারা মেরুদণ্ড সোজা করে। আপনি তো সর্বশক্তিমান। আপনি কোনওকিছুর মুখাপেক্ষী নন। আপনার ক্ষুধা লাগার প্রশ্ন নেই যে, আপনার খাবার প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় আমি কীভাবে আপনাকে খাবার দিতে পারি? আল্লাহ বলবেন-
! أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تُطعمهُ (তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, অথচ তুমি তাকে খাবার দাওনি)? অর্থাৎ আমি তোমাকে সচ্ছলতা দিয়েছিলাম। তা দ্বারা তুমি নিজেরও ক্ষুধা মেটাতে পারতে, অন্যেরও ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্য রাখতে। এ অবস্থায় আমার অমুক ক্ষুধার্ত বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। সে ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল। তুমি তার অবস্থা জানতে। তা সত্ত্বেও তুমি তাকে খাবার দাওনি। তার ক্ষুধা মেটাওনি। তুমি কি ভেবে দেখেছ এটা তোমার কত বড় অবহেলা? সে অবহেলা না করলে আজ আমার কাছে কী মর্যাদাই না তুমি লাভ করতে! আল্লাহ বলবেন-
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي (তুমি কি জানতে না যদি তাকে খাবার খাওয়াতে, তবে অবশ্যই তা আমার কাছে পেতে)? অর্থাৎ আমার কাছে তার ছাওয়াব ও পুরস্কার লাভ করতে। লক্ষণীয়, রোগীকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- তুমি আমাকে সেখানে পেতে। আর ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর বেলায় বলা হয়েছে- তুমি আমার কাছে তা পেতে। এর কারণ রোগীর ক্ষেত্রে দর্শনার্থী তার কাছে যায়। অপরদিকে পানাহারের ক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত ব্যক্তিগণ নিজেরা সাহায্যকারীর কাছে আসে। ওখানে যেহেতু দর্শনার্থী নিজে যায়, তাই তার যাওয়াকে আল্লাহর কাছে যাওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এখানে সাহায্যপ্রার্থী নিজে আসে, তারপর সাহায্যকারী তাকে সাহায্য করে। তার নিজের যাওয়ার কোনও বিষয় নেই। তবে সে যেহেতু অন্ন-পানি দান করে, তাই সে দানের জন্য তাকে ছাওয়াব দেওয়া হবে ও তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
তারপর আল্লাহ তা'আলা আরেক ব্যক্তিকে তিরস্কার করবেন। সে ওই ব্যক্তি, যার কাছে কোনও তৃষ্ণার্ত পানি চেয়েছিল, কিন্তু সে তাকে পানি দেয়নি। আল্লাহ বলবেন-
!يَا ابْنَ آدَمَ، اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي (হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি)। এর উত্তরে সে ব্যক্তি বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আমি কীভাবে আপনাকে পানি পান করাতে পারি, যখন আপনি জগৎসমূহের প্রতিপালক)? অর্থাৎ আমি আপনাকে কীভাবে পানি পান করাতে পারি? আপনার তো পিপাসা লাগে না। পিপাসা লাগে দুর্বল মাখলূকের। পিপাসা নিবারণের জন্য তার পানি পান করার দরকার হয়। অন্যথায় সে বাঁচতে পারে না। কিন্তু আপনি তো সকল দুর্বলতা ও সকল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে। কাজেই আপনার পিপাসার্ত হওয়াই বা কী, আর আপনাকে পানি পান করানোরই বা কী অর্থ? আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
استسقاك عبدي فلان فلم تسقه (আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্ত তুমি তাকে পানি পান করাওনি)। তার পানি চাওয়াটা যেন আমারই চাওয়া ছিল। তাকে পানি না দিয়ে যেন তুমি আমাকেই দাওনি। ফলে তুমি আমার কাছে পানি পান করানোর পুরস্কার থেকেও বঞ্চিত হয়ে গেলে। আল্লাহ বলবেন-
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي (শোন হে! যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে, তবে অবশ্যই আমার কাছে তা পেতে)। অর্থাৎ আমার কাছে পানি পান করানোর পুরস্কার পেতে। আমি প্রত্যেককে তার ভালো কাজের পুরস্কার দিয়ে থাকি। কারওই কর্মফল আমি নষ্ট করি না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ
'তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম যাই অগ্রিম পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে তোমরা তা বিদ্যমান পাবে।' (সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত ২০ )
বরং পাওয়া যাবে আরও বেশি। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا
'আল্লাহ (কারও প্রতি) অণু-পরিমাণও জুলুম করেন না। আর যদি কোনও সৎকর্ম হয়, তাকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেন এবং নিজের পক্ষ হতে মহা পুরস্কার দান করেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৪০)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর বান্দা অনেক মর্যাদাবান।
খ. রোগী দেখতে যাওয়া অতি উচ্চ ফযীলতের কাজ।
গ. রোগী দেখতে যাওয়াটা আল্লাহ তা’আলাকে পাওয়ার একটি শ্রেষ্ঠ উপায়। কারও অসুস্থতার সংবাদ জানতে পারলে যথাসম্ভব তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
ঘ. কেউ খাবার চাইলে তাকে ফেরাতে নেই।
ঙ. ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করা একটি সেরা সৎকর্ম।
চ. তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির তৃষ্ণা নিবারণ করা অনেক সহজ কাজ। কিন্তু এর ফযীলত অনেক বেশি। তাই এতে অবহেলা করা উচিত নয়।
ছ. যে-কোনও সৎকর্ম সম্পর্কে জানা থাকে, তা আগ্রহের সঙ্গে পালন করা চাই।
يا ابن آدم، مرضت فلم تعدني (আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে আসনি)। অর্থাৎ আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে যাওনি। বান্দার অসুস্থতাকে আল্লাহ তা'আলা নিজের অসুস্থতা সাব্যস্ত করেছেন। এমনিভাবে বান্দাকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টিকে তাঁকে দেখতে যাওয়ার নামান্তর সাব্যস্ত করেছেন। এর দ্বারা বান্দা যে আল্লাহর কাছে কত মর্যাদাবান এবং তাঁর কতটা নিকটবর্তী, তা অনুমান করা যায়। আল্লাহ তা'আলার এ কথাটি তাঁর পক্ষ থেকে একটা তিরস্কার। যে ব্যক্তি কারও অসুস্থতার সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে দেখতে যায়নি, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা এই বলে তাকে তিরস্কার করবেন। এর উত্তরে বান্দা বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَعُوْدُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আপনি জগৎসমূহের পালনকর্তা। আপনি কীভাবে অসুস্থ হতে পারেন যে, আমি আপনাকে দেখতে যাব)? অর্থাৎ অসুস্থ তো হয় দুর্বল বান্দা। আর দেখতে যাওয়া যায় সেই দুর্বল বান্দাকেই। আপনি মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। আপনি সর্বশক্তিমান। কোনওরকম দুর্বলতা আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই আপনার অসুস্থ হওয়ার প্রশ্ন আসে না। সুতরাং আপনার অসুস্থ হওয়ারই বা কী অর্থ আর আপনাকে দেখতে যাওয়াই বা কীভাবে সম্ভব? এর উত্তরে আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
! أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِي فُلَانًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ ( তুমি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তা সত্ত্বেও তুমি তাকে দেখতে যাওনি)? অর্থাৎ তুমি তো তার অসুস্থ হওয়ার কথা জানতে। তা জানা সত্ত্বেও যে তুমি তাকে দেখতে যাওনি, এটা তোমার একটা অবহেলা। এ অবহেলার দ্বারা তুমি কত বড়ই না মাহাত্ম্য ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছ। আল্লাহ বলবেন-
! أمَّا عَلَمْتَ أَنكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوجَدَتنى عنده (তুমি জানতে না যদি তাকে দেখতে যেতে, তবে অবশ্যই আমাকে তার কাছে পেতে)? অর্থাৎ তাকে দেখতে যাওয়ার ছাওয়াব ও পুরস্কার আমার কাছে পেতে। কী গভীর ভাবপূর্ণ কথা। আল্লাহ বলছেন, তুমি তাকে দেখতে গেলে আমাকে তার কাছে পেতে। আল্লাহ তাঁর অসুস্থ বান্দার কাছে থাকেন। সেখানে গেলে কেবল বান্দার কাছেই যাওয়া হয় না, যাওয়াটা এক রোগীর কাছেই হয় না, তার মালিক স্বয়ং আল্লাহর কাছেও যাওয়া হয়। এমনই ভালোবাসেন আল্লাহ তাঁর বান্দাকে! এমনই নিকটবর্তী তিনি তাঁর বান্দার এবং বান্দাও তাঁর।
এর দ্বারা যেমন রুগ্ন ব্যক্তির মর্যাদা ফুটে ওঠে, তেমনি যে ব্যক্তি তাকে দেখতে যায় তার মর্যাদাও পরিস্ফুট হয়। কারণ তার যাওয়াটাকে কেবল একজন মানুষের কাছে যাওয়া নয়; বরং মানুষের সৃষ্টিকর্তার কাছে যাওয়ার মহিমা দেওয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ মহিমা কেবল তখনই লাভ হয়, যখন যাওয়ার উদ্দেশ্য হবে আল্লার তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। মানুষকে দেখানোর জন্য গেলে তো মানুষের কাছে যাওয়ার নামান্তর হল। এটা আল্লাহর কাছে যাওয়া বলে গণ্য হবে কেবল তখনই, যখন লক্ষ্যবস্তু হবে কেবল আল্লাহ তা'আলাই। সুতরাং নিয়ত সহীহ থাকা জরুরি।
এমনিভাবে যার কাছে কোনও ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাবার চেয়েছে, কিন্তু সে তাকে খাবার দেয়নি, তাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
! يَا ابْنَ آدَمَ، اِسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمِنِي (হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি)। অর্থাৎ আমার অমুক ক্ষুধার্ত বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাবার দাওনি। কী প্রেমময়, কী দয়াময় মহান আল্লাহ! ক্ষুধার্ত বান্দার খাবার চাওয়াকে নিজের খাবার চাওয়া শব্দে প্রকাশ করেছেন। এমনিভাবে তাকে খাওয়ানোকে স্বয়ং তাঁকে খাওয়ানো সাব্যস্ত করেছেন। বান্দা বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আমি কীভাবে আপনাকে খাওয়াতে পারি, যখন আপনি জগৎসমূহের প্রতিপালক)? অর্থাৎ জগৎপালক হওয়ায় আপনিই আপনার সকল সৃষ্টিকে খাবার দিয়ে থাকেন। আপনিই সকলের রিযিকদাতা। সকল মাখলূক দুর্বল। তাদের রিযিকের প্রয়োজন হয়। ক্ষুধা পেলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। সে দুর্বলতা কাটানোর জন্য তাদের খাদ্যের দরকার পড়ে। খাবার খেয়ে তারা মেরুদণ্ড সোজা করে। আপনি তো সর্বশক্তিমান। আপনি কোনওকিছুর মুখাপেক্ষী নন। আপনার ক্ষুধা লাগার প্রশ্ন নেই যে, আপনার খাবার প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় আমি কীভাবে আপনাকে খাবার দিতে পারি? আল্লাহ বলবেন-
! أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلَانٌ فَلَمْ تُطعمهُ (তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, অথচ তুমি তাকে খাবার দাওনি)? অর্থাৎ আমি তোমাকে সচ্ছলতা দিয়েছিলাম। তা দ্বারা তুমি নিজেরও ক্ষুধা মেটাতে পারতে, অন্যেরও ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্য রাখতে। এ অবস্থায় আমার অমুক ক্ষুধার্ত বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। সে ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল। তুমি তার অবস্থা জানতে। তা সত্ত্বেও তুমি তাকে খাবার দাওনি। তার ক্ষুধা মেটাওনি। তুমি কি ভেবে দেখেছ এটা তোমার কত বড় অবহেলা? সে অবহেলা না করলে আজ আমার কাছে কী মর্যাদাই না তুমি লাভ করতে! আল্লাহ বলবেন-
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي (তুমি কি জানতে না যদি তাকে খাবার খাওয়াতে, তবে অবশ্যই তা আমার কাছে পেতে)? অর্থাৎ আমার কাছে তার ছাওয়াব ও পুরস্কার লাভ করতে। লক্ষণীয়, রোগীকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- তুমি আমাকে সেখানে পেতে। আর ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর বেলায় বলা হয়েছে- তুমি আমার কাছে তা পেতে। এর কারণ রোগীর ক্ষেত্রে দর্শনার্থী তার কাছে যায়। অপরদিকে পানাহারের ক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত ব্যক্তিগণ নিজেরা সাহায্যকারীর কাছে আসে। ওখানে যেহেতু দর্শনার্থী নিজে যায়, তাই তার যাওয়াকে আল্লাহর কাছে যাওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এখানে সাহায্যপ্রার্থী নিজে আসে, তারপর সাহায্যকারী তাকে সাহায্য করে। তার নিজের যাওয়ার কোনও বিষয় নেই। তবে সে যেহেতু অন্ন-পানি দান করে, তাই সে দানের জন্য তাকে ছাওয়াব দেওয়া হবে ও তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
তারপর আল্লাহ তা'আলা আরেক ব্যক্তিকে তিরস্কার করবেন। সে ওই ব্যক্তি, যার কাছে কোনও তৃষ্ণার্ত পানি চেয়েছিল, কিন্তু সে তাকে পানি দেয়নি। আল্লাহ বলবেন-
!يَا ابْنَ آدَمَ، اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي (হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি)। এর উত্তরে সে ব্যক্তি বলবে-
يَا رَبِّ، كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ (হে আমার প্রতিপালক! আমি কীভাবে আপনাকে পানি পান করাতে পারি, যখন আপনি জগৎসমূহের প্রতিপালক)? অর্থাৎ আমি আপনাকে কীভাবে পানি পান করাতে পারি? আপনার তো পিপাসা লাগে না। পিপাসা লাগে দুর্বল মাখলূকের। পিপাসা নিবারণের জন্য তার পানি পান করার দরকার হয়। অন্যথায় সে বাঁচতে পারে না। কিন্তু আপনি তো সকল দুর্বলতা ও সকল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে। কাজেই আপনার পিপাসার্ত হওয়াই বা কী, আর আপনাকে পানি পান করানোরই বা কী অর্থ? আল্লাহ তা'আলা বলবেন-
استسقاك عبدي فلان فلم تسقه (আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্ত তুমি তাকে পানি পান করাওনি)। তার পানি চাওয়াটা যেন আমারই চাওয়া ছিল। তাকে পানি না দিয়ে যেন তুমি আমাকেই দাওনি। ফলে তুমি আমার কাছে পানি পান করানোর পুরস্কার থেকেও বঞ্চিত হয়ে গেলে। আল্লাহ বলবেন-
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي (শোন হে! যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে, তবে অবশ্যই আমার কাছে তা পেতে)। অর্থাৎ আমার কাছে পানি পান করানোর পুরস্কার পেতে। আমি প্রত্যেককে তার ভালো কাজের পুরস্কার দিয়ে থাকি। কারওই কর্মফল আমি নষ্ট করি না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ
'তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম যাই অগ্রিম পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে তোমরা তা বিদ্যমান পাবে।' (সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত ২০ )
বরং পাওয়া যাবে আরও বেশি। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا
'আল্লাহ (কারও প্রতি) অণু-পরিমাণও জুলুম করেন না। আর যদি কোনও সৎকর্ম হয়, তাকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেন এবং নিজের পক্ষ হতে মহা পুরস্কার দান করেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত ৪০)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর বান্দা অনেক মর্যাদাবান।
খ. রোগী দেখতে যাওয়া অতি উচ্চ ফযীলতের কাজ।
গ. রোগী দেখতে যাওয়াটা আল্লাহ তা’আলাকে পাওয়ার একটি শ্রেষ্ঠ উপায়। কারও অসুস্থতার সংবাদ জানতে পারলে যথাসম্ভব তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
ঘ. কেউ খাবার চাইলে তাকে ফেরাতে নেই।
ঙ. ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণ করা একটি সেরা সৎকর্ম।
চ. তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির তৃষ্ণা নিবারণ করা অনেক সহজ কাজ। কিন্তু এর ফযীলত অনেক বেশি। তাই এতে অবহেলা করা উচিত নয়।
ছ. যে-কোনও সৎকর্ম সম্পর্কে জানা থাকে, তা আগ্রহের সঙ্গে পালন করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
