আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৯- নবীজী সাঃ ও সাহাবা রাঃ ; মর্যাদা ও বিবিধ ফাযায়েল
৩৪০৫। ইসমাঈল ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... নবী সহধর্মিণী আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর যখন ওফাত হয়, তখণ আবু বকর (রাযিঃ) (স্বীয় বাসগৃহ) সুনহ-এ ছিলেন। ইসমাঈল (রাবী) বলেন, সুনহ মদীনার উঁচু এলাকার একটি স্থানের নাম। (ওফাতের সংবাদ শুনার সাথে সাথে) উমর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর ওফাত হয় নাই। আয়েশা (রাযিঃ) বলেন, উমর (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, তখন আমার অন্তরে এ বিশ্বাসই ছিল (তাঁর ওফাত হয় নাই) আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁকে পুনরায় জীবিত করবেন। এবং তিনি কিছু সংখ্যক লোকের (মুনাফিকের) হাত-পা কেঁটে ফেলবেন। তারপর আবু বকর (রাযিঃ) এলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর চেহারা মোবারক থেকে আবরণ সরিয়ে তাঁর ললাটে চুমু খেলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান। আপনি জীবনে মরণে পূত পবিত্র। ঐ সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আল্লাহ্ আপনাকে কখনও দু’বার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করাবেন না।
তারপর তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং (উমর (রাযিঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন) হে হলফকারী, ধৈর্যধারণ কর। আবু বকর (রাযিঃ) যখন কথা বলতে লাগলেন, তখন উমর (রাযিঃ) বসে পড়লেন। আবু বকর (রাযিঃ) আল্লাহ্ পাকের হামদ ও সানা বর্ণনা করে বললেন, যারা মুহাম্মাদ (ﷺ)- এর ইবাদতকারী ছিলে তারা জেনে রাখ, মুহাম্মাদ (ﷺ) ইন্তিকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তারা নিশ্চিত জেনে রাখ আল্লাহ্ চিরঞ্জীব, তিনি অমর। তারপর আবু বকর (রাযিঃ) এ আয়াত তিলাওয়াত করলেনঃ নিশ্চয়ই আপনি মরণশীল আর তারা সকলও মরণশীল (৩৯ঃ ৩০) আরো তিলওয়াত করলেনঃ মুহাম্মাদ (ﷺ) একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। তাই যদি তিনি মারা যান অথবা তিনি নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না। (৩ঃ১৪৪) আল্লাহ্ তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
রাবী বলেন, আবু বকর (রাযিঃ)-এর এ কথাগুলি শুনে সকলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাবী বলেন, আনসারগণ সাকীফা বনু সায়িদায়ে সা‘দ ইবনে উবাইদা (রাযিঃ)-এর নিকট সমবেত হলেন এবং বলতে লাগলেন, আমাদের (আনসারদের) মধ্য হতে একজন আমীর হবেন এবং তোমাদের (মুহাজিরদের) মধ্য হতে একজন আমীর হবেন। আবু বকর (রাযিঃ), উমর ইবনে খাত্তাব, আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রাযিঃ)-এ তিনজন আনসারদের নিকট গমন করলেন। উমর (রাযিঃ) কথা বলতে চাইলে আবু বকর (রাযিঃ) তাকে থামিয়ে দিলেন। উমর (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, আমি বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলাম এই জন্য যে, আমি আনসারদের মাহফিলে বলার জন্য চিন্তা-ভাবনা করে এমন কিছু চমৎকার ও যুক্তিপূর্ণ কথা তৈরী করেছিলাম। যার প্রেক্ষিতে আমার ধারণা ছিল হয়তঃ আবু বকর (রাযিঃ)-এর চিন্তা ভাবনা এতটা গভীরে নাও পৌছতে পারে।
কিন্তু আবু বকর (রাযিঃ) অত্যন্ত জোরালো ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, আমীর আমাদের (মুহাজিরদের) মধ্য হতে একজন হবেন এবং তোমাদের মধ্য হতে (আনসারদের) হবেন উযীর। তখন হুবাব ইবনে মুনযির (আনসারী) (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম। আমরা এরূপ করব না। রবং আমাদের মধ্যে একজন ও আপনাদের মধ্যে একজন আমীর হবেন। আবু বকর (রাযিঃ) বললেন, না, এমন হয় না। আমাদের মধ্য হতে খলীফা এবং তোমাদের মধ্য হতে উযীর হবেন। কেননা কুরাইশ গোত্র অবস্থানের (মক্কা) দিক দিয়ে যেমন আরবের মধ্যস্থানে, বংশ ও রক্তের দিক থেকেও তারা তেমনি শ্রেষ্ঠ। তাঁরা নেতৃত্বের জন্য যোগ্যতায় সবার শীর্ষে। “তোমরা উমর (রাযিঃ) অথবা আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রাযিঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে নাও। উমর (রাযিঃ) বলে উঠলেন, আমরা কিন্তু আপনার হাতেই বায়‘আত করব। আপনিই আমাদের নেতা। আপনিই আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমাদের মাঝে আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর প্রিয়তম ব্যক্তি। এ বলে উমর (রাযিঃ) তাঁর হাত ধরে বায়‘আত করে নিলেন। সাথে সাথে উপস্থিত সকলেই বায়‘আত করলেন।
তখন জনৈক ব্যক্তি বলে উঠলেন, আপনারা সা‘দ ইবনে উবাইদা (রাযিঃ)-কে মেরে ফেললেন? উমর (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহ্ তাকে মেরে ফেলেছেন।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে সালিম .... আয়েশা (রাযিঃ) বলেন, ওফাতের সময় নবী কারীম (ﷺ)- এর চোখ দু’টি বার বার উপর দিকে উঠছিল এবং তিনি বার বার বলছিলেন, (হে আল্লাহ্) সর্বোচ্চ বন্ধুর (আল্লাহর) সাক্ষাতের আমি আগ্রহী। আয়েশা (রাযিঃ) বলেন, আবু বকর ও উমর (রাযিঃ)-এর খুতবা দ্বারা আল্লাহ্ তাআলা এ চরম মুহুর্তে উম্মতকে রক্ষা করেছেন। উমর (রাযিঃ) জনগণকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এমন কিছু মানুষ আছে যাদের অন্তরে কপটতা রয়েছে আল্লাহ্ তাদের ফাঁদ থেকে উম্মতকে রক্ষা করেছেন। এবং আবু বকর (রাযিঃ) লোকদিগকে সত্য সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। হক ও ন্যায়ের পথে নির্দেশ করেছেন, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারপর সাহাবায়ে কেরামও আয়াত পড়তে পড়তে প্রস্থান করেছেনঃ মুহাম্মাদ (ﷺ) একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসুলগণ গত হয়েছেন .... কৃতজ্ঞ বান্দাদের। (৩ঃ ১৪৪)।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছটিতে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এতে উল্লেখ আছে, তিনি ওফাতকালে একটি বিশেষ দু'আ পড়ছিলেন। দুয়াটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সবচেয়ে বিস্তারিত হলো- «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وارْحَمْنِي، وأَلْحِقْنِي بالرَّفِيقِ الأَعْلَى». তিনি দু'আ করছিলেন- اللهم اغفرلي وارحمني (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। আমার প্রতি রহম করুন)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মা'সুম। তাঁর কোনও গুনাহ ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি এরূপ দু'আ করেছেন। এটা ছিল তাঁর বিনয়। ছিল আল্লাহ তা'আলার প্রতি চরম আত্মনিবেদন। ছিল আল্লাহ তা'আলার প্রতি পরম শ্রদ্ধা-ভক্তি ও তাঁর গৌরব-গরিমার প্রকাশ। এর মাধ্যমে তিনি নিজ উম্মতকেও শিক্ষা দিয়েছেন যে, মৃত্যুকালে আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া ও তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত। যেই মহানবীর কোনও গুনাহ ছিল না আর তা সত্ত্বেও তিনি এভাবে রহমত ও মাগফিরাত কামনা করেছেন, তাঁর উম্মতের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের কামনা কতইনা বেশি জরুরি, যখন তারা নানারকম গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত থাকে। দু'আটির শেষাংশ হল- وألحقني بالرفيق الأعلى (আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিয়ে দিন)। الرفيق الأعلى এর দ্বারা যেমন আল্লাহ তা'আলাকে বোঝানো হয়, তেমনি জান্নাত ও জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম বাসিন্দা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকেও বোঝানো হয়ে থাকে। সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণও এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا 'যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সেইসকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। কতইনা উত্তম সঙ্গী তারা!’ (সূরা নিসা, আয়াত ৬৯) এ দু'আটি দ্বারা বাহ্যত মনে হয় তিনি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। বস্তুত বিষয়টি সেরকম নয়। সাধারণভাবে মৃত্যুকামনা করা উচিত নয়। নিষেধ আছে। তিনি এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি তখন জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। তাঁর জান কবজের ফয়সালা হয়ে গেছে। তিনি তা জানতে পেরেছিলেন ফিরিশতাদের আগমন দ্বারা। সাধারণ নেককারদেরও মৃত্যুর সময় সুসংবাদ দানকারী ফিরিশতাদের আগমন ঘটে। নবীগণের ক্ষেত্রে তো তা ঘটেই থাকে। এমনকি মৃত্যুর ফিরিশতা এসে নবীগণের কাছে জান কবজের অনুমতিও চেয়ে থাকে। হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। তিনি যে নিজ মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন তা প্রমাণ হয় এর দ্বারাও যে, তিনি নিজ কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আজকের পর তোমার পিতার আর কোনও কষ্ট নেই। তো যখন মৃত্যুর ফয়সালা হয়ে গেছে এবং জান কবজকারী ফিরিশতাগণও এসে গেছেন, তখন তাঁর জন্য এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি সে ফয়সালায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন এবং পরম বন্ধু আল্লাহ তা'আলা ও আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবেন। এ দু'আটি দ্বারা তিনি তাই করেছেন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. নবীগণও মানুষ। অপরাপর মানুষের মতো তাঁদেরও রোগ-ব্যাধি হয় এবং তাঁরাও মৃত্যুবরণ করেন। খ. মৃত্যুকালে আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজ গুনাহের জন্য মাগফিরাতের দু'আ করা উচিত এবং তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন