আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ২১৪
১০৯- নারী ঘরের রাখাল
২১৪. এই হাদীসখানি ২০৬ ও ২১২ নং হাদীসের পূনরাবৃত্তি মাত্র । একটি বাক্য অতিরিক্ত আছে ; তাহা হইল : হযরত ইব্ন উমর ( রা ) বলেন : এই সব কথা আমি নবী করীম ( সা ) -এর কাছে শুনিয়াছি এবং আমার যতদূর মনে পড়ে , তিনি আরও বলিয়াছেন ‘ এবং পুরুষ তাহার পিতার সম্পত্তির রাখাল স্বরূপ । '
بَابُ الْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، قَالَ: أَخْبَرَنَا شُعَيْبُ بْنُ أَبِي حَمْزَةَ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ: أَخْبَرَنَا سَالِمٌ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، الإِمَامُ رَاعٍ وَهُوَ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا، وَالْخَادِمُ فِي مَالِ سَيِّدِهِ، سَمِعْتُ هَؤُلاَءِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، وَأَحْسَبُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: وَالرَّجُلُ فِي مَالِ أَبِيهِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সারগর্ভ। এমনিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি হাদীছই অত্যন্ত মূল্যবান। তাঁর হাদীছসমূহ ইসলামী শরীআতের উৎস ও হিদায়াতের বাতিঘর। তবে কিছু কিছু হাদীছ এমনই সারগর্ভ, যা অথৈ সাগরতুল্য। তার একেকটিই সারা জীবনের জন্য পথচলার নির্দেশিকা হতে পারে। জীবনের নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণকল্পে এরকম যে-কোনও একটি হাদীছ অবলম্বন করাই যথেষ্ট। আলোচ্য হাদীছটিও সেরকমই।
এ হাদীছে প্রথমে সাধারণ নীতি জানানো হয়েছে যে- كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته (তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। راع শব্দটির উৎপত্তি رعاية , থেকে, যার মূল অর্থ রক্ষণাবেক্ষণ করা। রাখালকে راع বলা হয়। কারণ সে তার দায়িত্বভুক্ত গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। এ হাদীছে প্রত্যেককে راع বলা হয়েছে। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই দায়িত্বে কেউ না কেউ থাকে। আর কেউ না থাকুক, অন্ততপক্ষে নিজ সত্তা তো থাকেই। যার অধীনে আর কেউ নেই, তার কর্তব্য নিজের রক্ষণাবেক্ষণ করা। অর্থাৎ নিজেকে অন্যায়-অপরাধ থেকে বাঁচানো ও ক্ষতিকর কাজ থেকে হেফাজত করা, যাতে নিজ সত্তা জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পায়।
মোটকথা নিজ আওতা ও ক্ষমতার বিস্তারভেদে জান-মালের যা-কিছুই যার অধীনে আছে, সে তার বা তাদের দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পরিচালনা করা। কেননা আখেরাতে তাকে তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। যেসব ব্যক্তির পরিচালনাভার তার উপর ন্যস্ত ছিল, আখেরাতে জিজ্ঞেস করা হবে সে শরীআত মোতাবেক তাদের পরিচালনা করেছিল কি না, তাদের পরিচালনায় সে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করেছিল কি না এবং তাদের দ্বীনী ও দুনিয়াবী প্রয়োজন সমাধার চেষ্টা সে ঠিক কতটুকু করেছিল? এমনিভাবে যেসব মালামালের রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত ছিল, সে কতটুকু বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলে তো সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর কাছ থেকে অভাবনীয় পুরস্কার লাভ হবে। অন্যথায় পরিণাম হবে ভয়াবহ। সেদিন তার কাছ থেকে তার অধীনস্থ বা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকে আপন আপন হক বুঝে নিতে চাইবে।
আল্লাহ তাআলা ন্যায়বিচারক। তাঁর আদালতে যখন হকদারগণ আপন আপন হক দাবি করবে, কী অবস্থা তখন হবে? এ হাদীছ সাবধান করছে যে, প্রত্যেকেই যখন কোনও না কোনওভাবে দায়িত্বশীল, তখন প্রত্যেকেরই কর্তব্য আপন আপন দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, যাতে দায়িত্বপালনে ত্রুটির কারণে মহাবিচারের সে দিনে আটকা পড়তে না হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের শর'ঈ যিম্মাদারী
প্রথমে সাধারণ মূলনীতি বয়ান করার পর এবার পর্যায়ক্রমে বিশেষ বিশেষ দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম আমীর ও শাসক সম্পর্কে বলা হচ্ছে- والامير راع (আমীর একজন দায়িত্বশীল)। অন্য বর্ণনায় আছে والامام راع وهو مسؤول عن رعيته (ইমাম একজন দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে)। এ হাদীছে আমীর ও ইমাম বলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে। তাদের কর্তব্য ন্যায় ও ইনসাফের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীআত মোতাবেক জনগণের দেখভাল করা, দেশে ইসলামী বিধানবলী জারি করা, ইসলামী শরীআত মোতাবেক আইন-আদালত পরিচালনা করা,জামা'আত, জুমু'আ ও ঈদের নামায কায়েম করা, দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি। আখেরাতে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তারা এসব দায়িত্ব কিভাবে পালন করেছিল? শরীআত মোতাবেক, না নিজেদের খেয়াল-খুশিমত?
সরকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারি বড় বড় পদ মানুষের কাছে বড়ই লোভনীয়। কিন্তু এ লোভের অন্তরালে যে কী কঠিন পরিণতি নিহিত রয়েছে, তা কেউ চিন্তা করে না। একসময় মানুষের মনে যখন যথেষ্ট পরিমাণে আল্লাহ তাআলার ভয় ছিল, তখন তারা এসব পদ গ্রহণ করতেও ভয় পেত। বর্তমানে ভয় তো করাই হয় না, উল্টো এসব পাওয়ার জন্য নানা তদবির করা হয়, অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা। যে পদ গ্রহণ করা হয় লোভ-লালসার সাথে এবং যা পাওয়ার জন্য অবলম্বন করা হয় অন্যায় অনুচিত পন্থা, তা পদাধিকারীর জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তার নিজের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে না এবং জনগণের জন্যও তা হয় না কল্যাণপ্রসূ। এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা দেশের জনগণও অন্যায়-অনাচার দ্বারা জর্জরিত হয় আর তারা নিজেরাও দীন ও ঈমানের সর্বনাশ ঘটিয়ে আখেরাতের জীবন ধ্বংস করে। মুমিনগণ যাতে সে ধ্বংসের পথে পা না বাড়ায়, তাই এ হাদীছ সতর্ক করছে যে, রাষ্ট্রীয় পদ অত্যন্ত কঠিন ও গুরুদায়িত্বের পদ। তোমরা সাবধান থেক, আখেরাতে কিন্তু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গৃহকর্তার দায়িত্ব
তারপর গৃহকর্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে- والرجل راع على اهل بيته , (পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল)। সুতরাং তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খরচা বহন করা, তাদের পার্থিব কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা আর দীনের জরুরি ইলম শিক্ষা দেওয়া। তাদের পার্থিব জরুরত মেটানোর তুলনায় পরকালীন প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্ব কোনও অংশেই কম নয়; বরং তার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ স্বামী বা গৃহকর্তার নেই। আল্লাহ তাআলা আদেশ করেন يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا “হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর জাহান্নামের আগুন থেকে।
এ হাদীছ যখন গৃহকর্তাকে পরিবারবর্গের দায়িত্বশীল বলেছে, তখন স্ত্রীসহ পরিবারের সকলের কর্তব্য তাকে মেনে চলা। অবশ্য তার কোনও আদেশ যদি শরীআতের বিরুদ্ধে হয়, তখন তা মানা যাবে না। তাতে আল্লাহর নাফরমানি হয়।আল্লাহর নাফরমানি হয়, এমন কাজে কোনও মানুষের আনুগত্য করা জায়েয নয়। কাজেই স্বামীরও সতর্ক থাকা জরুরি যাতে তার পরিচালনা শরীআত মোতাবেক হয়।
স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য
তৃতীয় পর্যায়ে স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে- والمراة راعية على بيت زوجها وولده (নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল)। এতে স্ত্রীর দুটি কর্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. ঘরের মালামাল হেফাজত করা, যাতে তা চুরি না হয়ে যায় বা পশুপাখিতে নষ্ট না করে ফেলে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে তার অর্থ-সম্পদ দান-সদাকাও করবে না। কেননা তা তার জন্য আমানতস্বরূপ। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীতে তা খরচ করলে আমানতের খেয়ানত হয়, যা কঠিন পাপ। অবশ্য হাঁ, যদি স্বামীর পক্ষ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষ অনুমতি থাকে, তবে তা করতে পারবে। তাতে তার নিজেরও ছাওয়াব হবে এবং স্বামীরও ছাওয়াব হবে। স্বামীরও উচিত দান-খয়রাতের অনুমতি তাকে দিয়ে দেওয়া।
দুই. এমনিভাবে তার কর্তব্য সন্তানের লালন-পালন ও পরিচর্যায় যত্নবান থাকা। সন্তানের দীনী পরিচর্যা করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এক হাদীছে তার পায়ের নিচে তার সন্তানের জান্নাত বলে জানানো হয়েছে। কাজেই যে সন্তানের জান্নাত তার পায়ের নিচে, তাকে জান্নাতের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বৈকি। সুতরাং দীনের বুনিয়াদী শিক্ষাদান করা এবং ইসলামী আদব-কায়দার উপর তাকে গড়ে তোলার প্রতিও তার মা'কে যত্নবান থাকতে হবে।
ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেন, راع (দায়িত্বশীল) বিশেষণটি আমীর ও তার পরবর্তী সকলের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে একেকজনের ক্ষেত্রে এর মর্ম একেকরকম। আমীর ও শাসকের ক্ষেত্রে এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য শরীআতের সংরক্ষণকর্ম। শরীআতের বিধানাবলী প্রতিষ্ঠা করা ও ইনসাফসম্মত শাসন দ্বারা তা সম্পন্ন হয়। গৃহকর্তার ক্ষেত্রে এর অর্থ হল পরিবার-পরিজনের যথাযথ দেখভাল করা ও তাদের হকসমূহ আদায় করা। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এর অর্থ হচ্ছে ঘর ও ঘরের মালামাল হেফাজত করা, সন্তানদের পরিচর্যা করা ও স্বামীর প্রতি কল্যাণকামিতামূলক আচরণ করা।
মোটকথা, একক এক ব্যক্তি থেকে শুরু করে কমবেশি সংখ্যক সমষ্টির প্রতিনিধিত্বকারী সকলেই আপন আপন পরিসরে দায়িত্বশীল ও যিম্মাদার। প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করা হবে সে তার করণীয় যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছে কি না। এক রেওয়ায়েতে আছে لا يسترعي الله تبارك وتعالى عبدا رعية، قلت أو كثرت، إلا سأله الله تبارك وتعالى عنها يوم القيامة، أقام فيهم أمر الله تبارك وتعالى أم أضاعه؟ حتى يسأله عن أهل بيته خاصة ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর যে বান্দাকেই লোকজনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, তাদের সংখ্যা কম হোক বা বেশি, তাকে অবশ্যই কিয়ামতের দিন তার দায়িত্বভুক্ত লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, সে তাদের মধ্যে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করেছিল, না তা নষ্ট করেছিল? এমনকি তাকে বিশেষভাবে তার ঘরের লোকজন সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবেন।
এভাবে হাদীছটির শুরু-শেষে একই মূলনীতির পুনরাবৃত্তি করে দায়িত্ব ও দায়িত্বের জবাবদিহিতার তাকিদ করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের দায়িত্ব কিন্তু অত্যন্ত কঠিন। তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থাক। একদিন এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। এক বর্ণনায় এ হাদীছের শেষে অতিরিক্ত আছে فأعدوا للمسائل جوابا، قالوا: يا رسول الله! وما جوابها؟ قال: أعمال البر “তোমরা জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর প্রস্তুত কর। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, তার উত্তর কী? তিনি বললেন, সৎকর্মসমূহ।
শরীআত যে ক্ষেত্রে যেসকল কর্তব্য স্থির করেছে তাই সৎকর্ম। অতএব আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য আপন আপন ক্ষেত্রে শরীআত-নির্দেশিত কর্তব্য জেনে নেওয়া ও তা পালনে সচেষ্ট থাকা। একান্ত মনে সেই চেষ্টা থাকলে আশা করা যায় আখেরাতে আল্লাহ তাআলা আসানীর সঙ্গে পার করে দেবেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আমরা কেউ দায়িত্বমুক্ত নই। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উপরই কোনও না কোনও দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সে দায়িত্ব পালনে প্রত্যেকেরই সচেষ্ট থাকা চাই।
খ. জানা গেল যে, শাসক শ্রেণীর কর্তব্য দেশবাসীকে শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালনা করা।
গ. গৃহকর্তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারবর্গের দুনিয়াবী প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের দীনদারীরও তত্ত্বাবধান করা।
ঘ. স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আনুগত্য করা এবং সন্তান-সন্ততি ও ঘর-সংসারের প্রতি কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচার-আচরণ করা।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আখেরাত সত্য, আখেরাতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে এবং আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
এ হাদীছে প্রথমে সাধারণ নীতি জানানো হয়েছে যে- كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته (তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে)। راع শব্দটির উৎপত্তি رعاية , থেকে, যার মূল অর্থ রক্ষণাবেক্ষণ করা। রাখালকে راع বলা হয়। কারণ সে তার দায়িত্বভুক্ত গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। এ হাদীছে প্রত্যেককে راع বলা হয়েছে। কেননা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই দায়িত্বে কেউ না কেউ থাকে। আর কেউ না থাকুক, অন্ততপক্ষে নিজ সত্তা তো থাকেই। যার অধীনে আর কেউ নেই, তার কর্তব্য নিজের রক্ষণাবেক্ষণ করা। অর্থাৎ নিজেকে অন্যায়-অপরাধ থেকে বাঁচানো ও ক্ষতিকর কাজ থেকে হেফাজত করা, যাতে নিজ সত্তা জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পায়।
মোটকথা নিজ আওতা ও ক্ষমতার বিস্তারভেদে জান-মালের যা-কিছুই যার অধীনে আছে, সে তার বা তাদের দায়িত্বশীল। তার কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠতার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা পরিচালনা করা। কেননা আখেরাতে তাকে তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। যেসব ব্যক্তির পরিচালনাভার তার উপর ন্যস্ত ছিল, আখেরাতে জিজ্ঞেস করা হবে সে শরীআত মোতাবেক তাদের পরিচালনা করেছিল কি না, তাদের পরিচালনায় সে ন্যায় ও ইনসাফ রক্ষা করেছিল কি না এবং তাদের দ্বীনী ও দুনিয়াবী প্রয়োজন সমাধার চেষ্টা সে ঠিক কতটুকু করেছিল? এমনিভাবে যেসব মালামালের রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত ছিল, সে কতটুকু বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলে তো সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর কাছ থেকে অভাবনীয় পুরস্কার লাভ হবে। অন্যথায় পরিণাম হবে ভয়াবহ। সেদিন তার কাছ থেকে তার অধীনস্থ বা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকে আপন আপন হক বুঝে নিতে চাইবে।
আল্লাহ তাআলা ন্যায়বিচারক। তাঁর আদালতে যখন হকদারগণ আপন আপন হক দাবি করবে, কী অবস্থা তখন হবে? এ হাদীছ সাবধান করছে যে, প্রত্যেকেই যখন কোনও না কোনওভাবে দায়িত্বশীল, তখন প্রত্যেকেরই কর্তব্য আপন আপন দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, যাতে দায়িত্বপালনে ত্রুটির কারণে মহাবিচারের সে দিনে আটকা পড়তে না হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের শর'ঈ যিম্মাদারী
প্রথমে সাধারণ মূলনীতি বয়ান করার পর এবার পর্যায়ক্রমে বিশেষ বিশেষ দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম আমীর ও শাসক সম্পর্কে বলা হচ্ছে- والامير راع (আমীর একজন দায়িত্বশীল)। অন্য বর্ণনায় আছে والامام راع وهو مسؤول عن رعيته (ইমাম একজন দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে)। এ হাদীছে আমীর ও ইমাম বলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে। তাদের কর্তব্য ন্যায় ও ইনসাফের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীআত মোতাবেক জনগণের দেখভাল করা, দেশে ইসলামী বিধানবলী জারি করা, ইসলামী শরীআত মোতাবেক আইন-আদালত পরিচালনা করা,জামা'আত, জুমু'আ ও ঈদের নামায কায়েম করা, দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা ইত্যাদি। আখেরাতে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তারা এসব দায়িত্ব কিভাবে পালন করেছিল? শরীআত মোতাবেক, না নিজেদের খেয়াল-খুশিমত?
সরকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারি বড় বড় পদ মানুষের কাছে বড়ই লোভনীয়। কিন্তু এ লোভের অন্তরালে যে কী কঠিন পরিণতি নিহিত রয়েছে, তা কেউ চিন্তা করে না। একসময় মানুষের মনে যখন যথেষ্ট পরিমাণে আল্লাহ তাআলার ভয় ছিল, তখন তারা এসব পদ গ্রহণ করতেও ভয় পেত। বর্তমানে ভয় তো করাই হয় না, উল্টো এসব পাওয়ার জন্য নানা তদবির করা হয়, অবলম্বন করা হয় অন্যায়-অনুচিত পন্থা। যে পদ গ্রহণ করা হয় লোভ-লালসার সাথে এবং যা পাওয়ার জন্য অবলম্বন করা হয় অন্যায় অনুচিত পন্থা, তা পদাধিকারীর জন্য কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তার নিজের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে না এবং জনগণের জন্যও তা হয় না কল্যাণপ্রসূ। এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা দেশের জনগণও অন্যায়-অনাচার দ্বারা জর্জরিত হয় আর তারা নিজেরাও দীন ও ঈমানের সর্বনাশ ঘটিয়ে আখেরাতের জীবন ধ্বংস করে। মুমিনগণ যাতে সে ধ্বংসের পথে পা না বাড়ায়, তাই এ হাদীছ সতর্ক করছে যে, রাষ্ট্রীয় পদ অত্যন্ত কঠিন ও গুরুদায়িত্বের পদ। তোমরা সাবধান থেক, আখেরাতে কিন্তু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গৃহকর্তার দায়িত্ব
তারপর গৃহকর্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে- والرجل راع على اهل بيته , (পুরুষ তার পরিবারবর্গের উপর দায়িত্বশীল)। সুতরাং তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খরচা বহন করা, তাদের পার্থিব কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখা এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা আর দীনের জরুরি ইলম শিক্ষা দেওয়া। তাদের পার্থিব জরুরত মেটানোর তুলনায় পরকালীন প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্ব কোনও অংশেই কম নয়; বরং তার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ স্বামী বা গৃহকর্তার নেই। আল্লাহ তাআলা আদেশ করেন يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا “হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর জাহান্নামের আগুন থেকে।
এ হাদীছ যখন গৃহকর্তাকে পরিবারবর্গের দায়িত্বশীল বলেছে, তখন স্ত্রীসহ পরিবারের সকলের কর্তব্য তাকে মেনে চলা। অবশ্য তার কোনও আদেশ যদি শরীআতের বিরুদ্ধে হয়, তখন তা মানা যাবে না। তাতে আল্লাহর নাফরমানি হয়।আল্লাহর নাফরমানি হয়, এমন কাজে কোনও মানুষের আনুগত্য করা জায়েয নয়। কাজেই স্বামীরও সতর্ক থাকা জরুরি যাতে তার পরিচালনা শরীআত মোতাবেক হয়।
স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য
তৃতীয় পর্যায়ে স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে- والمراة راعية على بيت زوجها وولده (নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল)। এতে স্ত্রীর দুটি কর্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. ঘরের মালামাল হেফাজত করা, যাতে তা চুরি না হয়ে যায় বা পশুপাখিতে নষ্ট না করে ফেলে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে তার অর্থ-সম্পদ দান-সদাকাও করবে না। কেননা তা তার জন্য আমানতস্বরূপ। স্বামীর ইচ্ছার বিপরীতে তা খরচ করলে আমানতের খেয়ানত হয়, যা কঠিন পাপ। অবশ্য হাঁ, যদি স্বামীর পক্ষ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষ অনুমতি থাকে, তবে তা করতে পারবে। তাতে তার নিজেরও ছাওয়াব হবে এবং স্বামীরও ছাওয়াব হবে। স্বামীরও উচিত দান-খয়রাতের অনুমতি তাকে দিয়ে দেওয়া।
দুই. এমনিভাবে তার কর্তব্য সন্তানের লালন-পালন ও পরিচর্যায় যত্নবান থাকা। সন্তানের দীনী পরিচর্যা করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এক হাদীছে তার পায়ের নিচে তার সন্তানের জান্নাত বলে জানানো হয়েছে। কাজেই যে সন্তানের জান্নাত তার পায়ের নিচে, তাকে জান্নাতের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বৈকি। সুতরাং দীনের বুনিয়াদী শিক্ষাদান করা এবং ইসলামী আদব-কায়দার উপর তাকে গড়ে তোলার প্রতিও তার মা'কে যত্নবান থাকতে হবে।
ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেন, راع (দায়িত্বশীল) বিশেষণটি আমীর ও তার পরবর্তী সকলের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে একেকজনের ক্ষেত্রে এর মর্ম একেকরকম। আমীর ও শাসকের ক্ষেত্রে এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য শরীআতের সংরক্ষণকর্ম। শরীআতের বিধানাবলী প্রতিষ্ঠা করা ও ইনসাফসম্মত শাসন দ্বারা তা সম্পন্ন হয়। গৃহকর্তার ক্ষেত্রে এর অর্থ হল পরিবার-পরিজনের যথাযথ দেখভাল করা ও তাদের হকসমূহ আদায় করা। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এর অর্থ হচ্ছে ঘর ও ঘরের মালামাল হেফাজত করা, সন্তানদের পরিচর্যা করা ও স্বামীর প্রতি কল্যাণকামিতামূলক আচরণ করা।
মোটকথা, একক এক ব্যক্তি থেকে শুরু করে কমবেশি সংখ্যক সমষ্টির প্রতিনিধিত্বকারী সকলেই আপন আপন পরিসরে দায়িত্বশীল ও যিম্মাদার। প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করা হবে সে তার করণীয় যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছে কি না। এক রেওয়ায়েতে আছে لا يسترعي الله تبارك وتعالى عبدا رعية، قلت أو كثرت، إلا سأله الله تبارك وتعالى عنها يوم القيامة، أقام فيهم أمر الله تبارك وتعالى أم أضاعه؟ حتى يسأله عن أهل بيته خاصة ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর যে বান্দাকেই লোকজনের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, তাদের সংখ্যা কম হোক বা বেশি, তাকে অবশ্যই কিয়ামতের দিন তার দায়িত্বভুক্ত লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, সে তাদের মধ্যে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করেছিল, না তা নষ্ট করেছিল? এমনকি তাকে বিশেষভাবে তার ঘরের লোকজন সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবেন।
এভাবে হাদীছটির শুরু-শেষে একই মূলনীতির পুনরাবৃত্তি করে দায়িত্ব ও দায়িত্বের জবাবদিহিতার তাকিদ করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের দায়িত্ব কিন্তু অত্যন্ত কঠিন। তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থাক। একদিন এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। এক বর্ণনায় এ হাদীছের শেষে অতিরিক্ত আছে فأعدوا للمسائل جوابا، قالوا: يا رسول الله! وما جوابها؟ قال: أعمال البر “তোমরা জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর প্রস্তুত কর। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, তার উত্তর কী? তিনি বললেন, সৎকর্মসমূহ।
শরীআত যে ক্ষেত্রে যেসকল কর্তব্য স্থির করেছে তাই সৎকর্ম। অতএব আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য আপন আপন ক্ষেত্রে শরীআত-নির্দেশিত কর্তব্য জেনে নেওয়া ও তা পালনে সচেষ্ট থাকা। একান্ত মনে সেই চেষ্টা থাকলে আশা করা যায় আখেরাতে আল্লাহ তাআলা আসানীর সঙ্গে পার করে দেবেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আমরা কেউ দায়িত্বমুক্ত নই। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উপরই কোনও না কোনও দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সে দায়িত্ব পালনে প্রত্যেকেরই সচেষ্ট থাকা চাই।
খ. জানা গেল যে, শাসক শ্রেণীর কর্তব্য দেশবাসীকে শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালনা করা।
গ. গৃহকর্তার কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারবর্গের দুনিয়াবী প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের দীনদারীরও তত্ত্বাবধান করা।
ঘ. স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আনুগত্য করা এবং সন্তান-সন্ততি ও ঘর-সংসারের প্রতি কল্যাণকামিতাপূর্ণ আচার-আচরণ করা।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আখেরাত সত্য, আখেরাতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে এবং আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
