আল-আদাবুল মুফরাদ- ইমাম বুখারী রহঃ
আল-আদাবুল মুফরাদের পরিচ্ছেদসমূহ
হাদীস নং: ৩৫
১৯-পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার--তাঁহাদের মৃত্যুর পর
৩৫। হযরত আবু উসায়দ (রাযিঃ) বলেন, আমরা নবী করীম (ﷺ)-এর দরবারে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি প্রশ্ন করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতামাতার মৃত্যুর পর তাঁহাদের প্রতি কোনরূপ সদ্ব্যবহার করার অবকাশ আছে কি? ফরমাইলেন ঃ হ্যা, চারটি কাজ—(১) তাঁহাদের জন্য দু'আ করা। (২) তাঁহাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা (৩) তাঁহাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ পূর্ণ করা ও (৪) তাহাদের বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁহাদের পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা।
بَابُ بِرِّ الْوَالِدَيْنِ بَعْدَ مَوْتِهِمَا
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ الْغَسِيلِ قَالَ: أَخْبَرَنِي أُسَيْدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا أُسَيْدٍ يُحَدِّثُ الْقَوْمَ قَالَ: كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، هَلْ بَقِيَ مِنْ بِرِّ أَبَوَيَّ شَيْءٌ بَعْدَ مَوْتِهِمَا أَبَرُّهُمَا؟ قَالَ: نَعَمْ، خِصَالٌ أَرْبَعٌ: الدُّعَاءُ لَهُمَا، وَالِاسْتِغْفَارُ لَهُمَا، وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِمَا، وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِمَا، وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتِي لاَ رَحِمَ لَكَ إِلاَّ مِنْ قِبَلِهِمَا.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তানের করণীয় কী, এ সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি পাঁচটি কাজের কথা বলে দেন।
তার মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে- (তাদের জন্য দুআ করা)।
কুরআন মাজীদে পিতা-মাতার জন্য দুআ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে- وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (হে আমার প্রতিপালক ! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)।১৬৫ এটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক দুআ। পিতা-মাতার জন্য প্রত্যেক সন্তানেরই এ দুআ করা উচিত। আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার শেখানো দুআ করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও তাদের সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তির জন্য যে-কোনও ভাষায়ই দুআ করা যেতে পারে। পিতা-মাতার জন্য দুআ করাও একরকম খেদমত। এর দ্বারা পিতা-মাতার সন্তুষ্টি লাভ হয়, আল্লাহ তাআলাও খুশি হন। দুআ করা একটি ইবাদতও বটে।
দ্বিতীয় কাজ বলা হয়েছে- (তাদের জন্য ইস্তিগফার করা)। ইস্তিগফার অর্থ আল্লাহ তাআলার কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া। এটাও একরকম দুআ। তবে এ দুআ যেহেতু গুনাহ মাফ সম্পর্কে, তাই অন্যান্য দুআ অপেক্ষা এর গুরুত্ব অনেক বেশি। সেজন্য আলাদাভাবে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর পর থেকেই বান্দাকে দুনিয়ায় করে যাওয়া নেক ও বদ্ আমলের সম্মুখীন হতে হয়। তাই মৃত্যুর পর বান্দার সবচে বড় প্রয়োজন গুনাহ থেকে মুক্তিলাভ করা। কাজেই যারা তার গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে, তারাই তার সবচে' বড় উপকার করে। এ উপকার যে-কেউ করতে পারে। তবে প্রত্যেক সন্তানের জন্য এটা অবশ্যকরণীয় কাজ। তাদের উচিত পিতা-মাতার গুনাহ মাফের জন্য নিয়মিত দুআ করতে থাকা।
আরেকটি কাজ হলো- ‘তাদের (মৃত্যুর) পর তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করা’। অর্থাৎ পিতা-মাতা যদি কারও সম্পর্কে কিছু অসিয়ত করে যায়, সন্তানের কর্তব্য তা পূরণ করা। তারা যদি কোনও দীনী খাতে সম্পত্তি ওয়াক্ফ করে যায়, সন্তানের কর্তব্য সেই খাতে তা প্রদান করা। তারা যদি কোনও দান-সদাকা করার ওয়াদা করে যায়, সন্তানের কর্তব্য সে ওয়াদা পূরণ করা।
উল্লেখ্য, পিতা-মাতার ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষাকালে সে ওয়াদা-অঙ্গীকার শরীআতসম্মত কি না তা যাচাই করে দেখা উচিত। অনেকের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার দিয়ে যাওয়া কথার এতবেশি গুরুত্ব যে, তারা সে কথাটি শরীআতসম্মত কি না তা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। শরীআতবিরোধী কোনও কথা বা ওয়াদা দেওয়া এমনিতেই গুনাহ। যেমন গান-বাদ্যের অনুষ্ঠানে চাঁদা দেওয়ার ওয়াদা, কোনও মাজারে শিরনী দেওয়ার মানত, মৃত্যুর পর যিয়াফত খাওয়ানোর অসিয়ত ইত্যাদি। এ জাতীয় ওয়াদা- অসিয়তের ক্ষেত্রে কর্তব্য হলো তা পূরণ না করে বরং আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করা। এর পরিবর্তে সে ওয়াদা যদি রক্ষা করা হয়, তবে গুনাহ'র উপর গুনাহ হলো। সুতরাং এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
আরেকটি কাজ হলো- (তাদের ওই আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তাদের সূত্রেই)। অর্থাৎ পিতার রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়স্বজন। যেমন নিজ ভাইবোন, ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগিনা-ভাগিনী ইত্যাদি। এদের সঙ্গে সম্পর্ক পিতা-মাতা উভয়ের সূত্রে। চাচা, ফুফু, দাদা-দাদী, চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোন ইত্যাদি। এরা পিতার দিককার আত্মীয়। আর মায়ের দিক থেকে আত্মীয় হলো নানা-নানী, মামা, খালা, মামাতো ও খালাতো ভাইবোন ইত্যাদি। পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তো বটেই, তাদের মৃত্যুর পরও এদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা চাই। তা করাও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লামা আকূলী রহ. বলেন, এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত অর্জনের প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে। এর দ্বারা জানানো হয়েছে যে, আত্মীয়তা রক্ষা এমন এক ইবাদত, যা কেবল পিতা-মাতার সূত্রেই লাভ করা যায়। ধরে নিন কোনও ব্যক্তি সরাসরি মাটি দ্বারা সৃষ্ট হলো এবং তার কোনও সন্তান-সন্ততির জন্ম নিল না। তো এরূপ ব্যক্তির কোনও আত্মীয় থাকতে পারে না। ফলে আত্মীয়তা রক্ষার মাধ্যমে জান্নাতলাভের যে সুযোগ, তাও সে পাবে না। সুতরাং পিতা-মাতাই যখন এরূপ ইবাদত করতে পারার মাধ্যম, তখন সন্তানের অবশ্যকর্তব্য তাদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখা এবং আত্মীয়তা রক্ষার মাধ্যমে তাদের সম্মান ও মর্যাদা হেফাজত করা।
আরেকটি কাজ হলো- (তাদের বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করা)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। একবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর সঙ্গে মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামায় যাচ্ছিলেন। পথে জনৈক বেদুঈনের সঙ্গে দেখা হলে হযরত ইবন উমর রাযি. তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তাতে জানা গেল সে বেদুঈন তাঁর পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর একজন বন্ধুস্থানীয় লোক। তখন তিনি নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন। সফরকালে এ গাধাটি তিনি নিজের সঙ্গে রাখতেন। উটনীর পিঠে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ওই গাধাটি ব্যবহার করতেন। তারপর ক্লান্তি দূর হওয়ার পর ফের উটনীর পিঠে সওয়ার হতেন। এরকম প্রয়োজনীয় বাহনটি তো তাকে দিলেনই, সেইসঙ্গে নিজের ব্যবহার করা একটা পাগড়িও তাকে দিলেন।
বেদুঈনকে এরূপ খাতির করতে দেখে আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ.-এর আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি বলেই ফেললেন যে, সামান্য কিছু পেলেই যারা খুশি হয়ে যায় তাদেরকে এমন দামী বস্তু দেওয়া কেন? এ কথা বলার আগে তিনি তাঁর জন্য দুআ করে নিলেন যে- اصلحك الله (আল্লাহ তাআলা আপনার কল্যাণ করুন) এবং غفر الله لك (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন)। এটা এক সময়কার দীনদারদের মধ্যে ব্যবহৃত সম্বোধনের ভাষা। নিজের চেয়ে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে বিশেষ কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণকালে এরকম দুআ করা হতো। এর দ্বারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার যদি কোনও ভুলও হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এর জন্য যে কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেটি ভুল হওয়া জরুরি নয়। সেটি ভুল না হলেও মানুষের জীবনে কোনও না কোনও ভুলত্রুটি ও গুনাহখাতা থাকেই । কাজেই এরকম দুআ যে-কারও জন্যই করা যায়।
যাহোক আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. বিস্ময় প্রকাশ করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বললেন, এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি— إنَّ مِنْ أبرِّ البرِّ أنْ يَصِلَ الرّجلُ أهلَ وُدِّ أبِيه بَعْدَ أَنْ يُوَلِّيَ (নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা)। হাদীছটির অর্থ এরকমও করা যায় যে, পিতার প্রতি একটি উৎকৃষ্ট সদাচরণ এইও যে, তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। অর্থাৎ বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ প্রকারান্তরে পিতার প্রতিই সদাচরণ। কেননা এর দ্বারা বন্ধুবর্গের মধ্যে পিতার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পায়। হযরত ইবন উমর রাযি. বোঝাচ্ছেন যে, আমি এ অনুসরণার্থেই এই ব্যক্তির প্রতি এরকম আচরণ করেছি।
লক্ষণীয়, ওই ব্যক্তি ছিল বেদুঈন, আমাদের অঞ্চলে যেমন কোনও গ্রাম্য ব্যক্তি। সামাজিকভাবে শহুরে ব্যক্তিদের মত তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় না । কিন্তু হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেন না। কেননা এ জাতীয় সামাজিক বিভাজন ইসলামসম্মত নয়। তিনি তাকে দেখেছেন পিতার বন্ধুরূপে। বন্ধু শহুরে হোক বা গ্রামের হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা তার প্রাপ্য। অনুরূপ যে-কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পর্কটাই লক্ষণীয়। বাসস্থান, পেশা ইত্যাদি বিবেচ্য নয়।
উল্লেখ্য, একই কথা মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
এ হাদীছটির কোনও কোনও বর্ণনায় সবশেষে আছে-
فَقَالَ : مَا أَكْثَرَ هُذَا وَأَطْيَبَهُ يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: فَاعْمَلْ بِهِ، فَإِنَّهُ يَصِلُ إِلَيْهِمَا
'ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কতইনা বিশাল ও কতইনা উৎকৃষ্ট! তিনি বললেন, তুমি এর উপর আমল কর, কেননা তোমার সে আমল তাদের কাছে পৌঁছবে।১৬৬
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য জানা গেল ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা পিতা-মাতার খেদমত ও সেবার প্রতি সাহাবায়ে কেরামের বিশেষ আগ্রহ-উদ্দীপনা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। তারা পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সেবার ধারা অব্যাহত রাখার প্রতি কেমন যত্নবান ছিলেন।
গ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার জারি রাখা সন্তানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
ঘ. শরীআতের সীমারেখার ভেতর পিতা-মাতার করে যাওয়া ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষায় সন্তানের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ঙ. পিতা-মাতার সূত্রে যারা আত্মীয়, পিতা-মাতার সম্মানার্থেই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।
চ. পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করাও একটি সৎকর্ম বটে।
১৬৫. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪
১৬৬. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৮৯৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৮
তার মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে- (তাদের জন্য দুআ করা)।
কুরআন মাজীদে পিতা-মাতার জন্য দুআ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে- وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (হে আমার প্রতিপালক ! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)।১৬৫ এটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক দুআ। পিতা-মাতার জন্য প্রত্যেক সন্তানেরই এ দুআ করা উচিত। আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার শেখানো দুআ করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও তাদের সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তির জন্য যে-কোনও ভাষায়ই দুআ করা যেতে পারে। পিতা-মাতার জন্য দুআ করাও একরকম খেদমত। এর দ্বারা পিতা-মাতার সন্তুষ্টি লাভ হয়, আল্লাহ তাআলাও খুশি হন। দুআ করা একটি ইবাদতও বটে।
দ্বিতীয় কাজ বলা হয়েছে- (তাদের জন্য ইস্তিগফার করা)। ইস্তিগফার অর্থ আল্লাহ তাআলার কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া। এটাও একরকম দুআ। তবে এ দুআ যেহেতু গুনাহ মাফ সম্পর্কে, তাই অন্যান্য দুআ অপেক্ষা এর গুরুত্ব অনেক বেশি। সেজন্য আলাদাভাবে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুর পর থেকেই বান্দাকে দুনিয়ায় করে যাওয়া নেক ও বদ্ আমলের সম্মুখীন হতে হয়। তাই মৃত্যুর পর বান্দার সবচে বড় প্রয়োজন গুনাহ থেকে মুক্তিলাভ করা। কাজেই যারা তার গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে, তারাই তার সবচে' বড় উপকার করে। এ উপকার যে-কেউ করতে পারে। তবে প্রত্যেক সন্তানের জন্য এটা অবশ্যকরণীয় কাজ। তাদের উচিত পিতা-মাতার গুনাহ মাফের জন্য নিয়মিত দুআ করতে থাকা।
আরেকটি কাজ হলো- ‘তাদের (মৃত্যুর) পর তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করা’। অর্থাৎ পিতা-মাতা যদি কারও সম্পর্কে কিছু অসিয়ত করে যায়, সন্তানের কর্তব্য তা পূরণ করা। তারা যদি কোনও দীনী খাতে সম্পত্তি ওয়াক্ফ করে যায়, সন্তানের কর্তব্য সেই খাতে তা প্রদান করা। তারা যদি কোনও দান-সদাকা করার ওয়াদা করে যায়, সন্তানের কর্তব্য সে ওয়াদা পূরণ করা।
উল্লেখ্য, পিতা-মাতার ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষাকালে সে ওয়াদা-অঙ্গীকার শরীআতসম্মত কি না তা যাচাই করে দেখা উচিত। অনেকের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার দিয়ে যাওয়া কথার এতবেশি গুরুত্ব যে, তারা সে কথাটি শরীআতসম্মত কি না তা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। শরীআতবিরোধী কোনও কথা বা ওয়াদা দেওয়া এমনিতেই গুনাহ। যেমন গান-বাদ্যের অনুষ্ঠানে চাঁদা দেওয়ার ওয়াদা, কোনও মাজারে শিরনী দেওয়ার মানত, মৃত্যুর পর যিয়াফত খাওয়ানোর অসিয়ত ইত্যাদি। এ জাতীয় ওয়াদা- অসিয়তের ক্ষেত্রে কর্তব্য হলো তা পূরণ না করে বরং আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করা। এর পরিবর্তে সে ওয়াদা যদি রক্ষা করা হয়, তবে গুনাহ'র উপর গুনাহ হলো। সুতরাং এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
আরেকটি কাজ হলো- (তাদের ওই আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা, যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তাদের সূত্রেই)। অর্থাৎ পিতার রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়স্বজন। যেমন নিজ ভাইবোন, ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগিনা-ভাগিনী ইত্যাদি। এদের সঙ্গে সম্পর্ক পিতা-মাতা উভয়ের সূত্রে। চাচা, ফুফু, দাদা-দাদী, চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোন ইত্যাদি। এরা পিতার দিককার আত্মীয়। আর মায়ের দিক থেকে আত্মীয় হলো নানা-নানী, মামা, খালা, মামাতো ও খালাতো ভাইবোন ইত্যাদি। পিতা-মাতার জীবদ্দশায় তো বটেই, তাদের মৃত্যুর পরও এদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা চাই। তা করাও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লামা আকূলী রহ. বলেন, এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত অর্জনের প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে। এর দ্বারা জানানো হয়েছে যে, আত্মীয়তা রক্ষা এমন এক ইবাদত, যা কেবল পিতা-মাতার সূত্রেই লাভ করা যায়। ধরে নিন কোনও ব্যক্তি সরাসরি মাটি দ্বারা সৃষ্ট হলো এবং তার কোনও সন্তান-সন্ততির জন্ম নিল না। তো এরূপ ব্যক্তির কোনও আত্মীয় থাকতে পারে না। ফলে আত্মীয়তা রক্ষার মাধ্যমে জান্নাতলাভের যে সুযোগ, তাও সে পাবে না। সুতরাং পিতা-মাতাই যখন এরূপ ইবাদত করতে পারার মাধ্যম, তখন সন্তানের অবশ্যকর্তব্য তাদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখা এবং আত্মীয়তা রক্ষার মাধ্যমে তাদের সম্মান ও মর্যাদা হেফাজত করা।
আরেকটি কাজ হলো- (তাদের বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করা)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। একবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর সঙ্গে মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামায় যাচ্ছিলেন। পথে জনৈক বেদুঈনের সঙ্গে দেখা হলে হযরত ইবন উমর রাযি. তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তাতে জানা গেল সে বেদুঈন তাঁর পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর একজন বন্ধুস্থানীয় লোক। তখন তিনি নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন। সফরকালে এ গাধাটি তিনি নিজের সঙ্গে রাখতেন। উটনীর পিঠে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ওই গাধাটি ব্যবহার করতেন। তারপর ক্লান্তি দূর হওয়ার পর ফের উটনীর পিঠে সওয়ার হতেন। এরকম প্রয়োজনীয় বাহনটি তো তাকে দিলেনই, সেইসঙ্গে নিজের ব্যবহার করা একটা পাগড়িও তাকে দিলেন।
বেদুঈনকে এরূপ খাতির করতে দেখে আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ.-এর আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি বলেই ফেললেন যে, সামান্য কিছু পেলেই যারা খুশি হয়ে যায় তাদেরকে এমন দামী বস্তু দেওয়া কেন? এ কথা বলার আগে তিনি তাঁর জন্য দুআ করে নিলেন যে- اصلحك الله (আল্লাহ তাআলা আপনার কল্যাণ করুন) এবং غفر الله لك (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন)। এটা এক সময়কার দীনদারদের মধ্যে ব্যবহৃত সম্বোধনের ভাষা। নিজের চেয়ে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে বিশেষ কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণকালে এরকম দুআ করা হতো। এর দ্বারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার যদি কোনও ভুলও হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এর জন্য যে কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেটি ভুল হওয়া জরুরি নয়। সেটি ভুল না হলেও মানুষের জীবনে কোনও না কোনও ভুলত্রুটি ও গুনাহখাতা থাকেই । কাজেই এরকম দুআ যে-কারও জন্যই করা যায়।
যাহোক আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. বিস্ময় প্রকাশ করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বললেন, এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি— إنَّ مِنْ أبرِّ البرِّ أنْ يَصِلَ الرّجلُ أهلَ وُدِّ أبِيه بَعْدَ أَنْ يُوَلِّيَ (নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা)। হাদীছটির অর্থ এরকমও করা যায় যে, পিতার প্রতি একটি উৎকৃষ্ট সদাচরণ এইও যে, তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। অর্থাৎ বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ প্রকারান্তরে পিতার প্রতিই সদাচরণ। কেননা এর দ্বারা বন্ধুবর্গের মধ্যে পিতার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পায়। হযরত ইবন উমর রাযি. বোঝাচ্ছেন যে, আমি এ অনুসরণার্থেই এই ব্যক্তির প্রতি এরকম আচরণ করেছি।
লক্ষণীয়, ওই ব্যক্তি ছিল বেদুঈন, আমাদের অঞ্চলে যেমন কোনও গ্রাম্য ব্যক্তি। সামাজিকভাবে শহুরে ব্যক্তিদের মত তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় না । কিন্তু হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেন না। কেননা এ জাতীয় সামাজিক বিভাজন ইসলামসম্মত নয়। তিনি তাকে দেখেছেন পিতার বন্ধুরূপে। বন্ধু শহুরে হোক বা গ্রামের হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা তার প্রাপ্য। অনুরূপ যে-কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পর্কটাই লক্ষণীয়। বাসস্থান, পেশা ইত্যাদি বিবেচ্য নয়।
উল্লেখ্য, একই কথা মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
এ হাদীছটির কোনও কোনও বর্ণনায় সবশেষে আছে-
فَقَالَ : مَا أَكْثَرَ هُذَا وَأَطْيَبَهُ يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: فَاعْمَلْ بِهِ، فَإِنَّهُ يَصِلُ إِلَيْهِمَا
'ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কতইনা বিশাল ও কতইনা উৎকৃষ্ট! তিনি বললেন, তুমি এর উপর আমল কর, কেননা তোমার সে আমল তাদের কাছে পৌঁছবে।১৬৬
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য জানা গেল ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা পিতা-মাতার খেদমত ও সেবার প্রতি সাহাবায়ে কেরামের বিশেষ আগ্রহ-উদ্দীপনা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। তারা পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সেবার ধারা অব্যাহত রাখার প্রতি কেমন যত্নবান ছিলেন।
গ. পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার জারি রাখা সন্তানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
ঘ. শরীআতের সীমারেখার ভেতর পিতা-মাতার করে যাওয়া ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষায় সন্তানের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ঙ. পিতা-মাতার সূত্রে যারা আত্মীয়, পিতা-মাতার সম্মানার্থেই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।
চ. পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবকে সম্মান করাও একটি সৎকর্ম বটে।
১৬৫. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪
১৬৬. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৮৯৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
