আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
৪৭. নবীজী ﷺ থেকে বর্ণিত যাবতীয় দোয়া-জিকির
হাদীস নং: ৩৫৩৫
আন্তর্জাতিক নং: ৩৫৩৫
তওবা ও ইস্তিগফারের ফযীলত এবং বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমতের বিবরণ
৩৫৩৫. ইবনে আবু উমর (রাহঃ) ..... যির ইবনে হুবাইশ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি সাফওয়ান ইবনে আসসাল মুরাদী (রাযিঃ) এর কাছে চামরার মোজার উপর মাসাহ করার বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্য এলাম। তিনি বললেনঃ হে যির! কি উদ্দেশ্যে তোমার আগমন? আমি বললামঃ ইলমের অন্বেষণে। তিনি বললেনঃ তালেবুল ইলমের জন্য ফিরিশতারা তাদের পাখনা বিছিয়ে দেন তার ইলম সন্ধানের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশে। আমি বললামঃ প্রসাব-পায়খানার পর (উযুর ক্ষেত্রে) চামড়ার মোজায় মাসাহ করার বিষয়টি আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। আপনি নবী (ﷺ) এর সাহাবীদের একজন। তাই আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে এলাম যে, এই বিষয়ে আপনি তাকে কিছু বলতে শুনেছেন কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যখন মুসাফির থাকি তখন যেন গোসল ফরযজনিত কারণ ব্যতীত (উযু করার) তিন দিন তিন রাত আমাদের চামড়ার মোজা না খুলি, প্রস্রাব-পায়খানা ও নিদ্রা ইত্যাদি কারণের বেলায়ও নয়।
আমি বললামঃ মুহাব্বাতের বিষয়ে তাঁকে কিছু বলতে শুনেছেন কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম।আমরা তাঁর কাছে ছিলাম এমন সময় বেদুঈন উচ্চৈস্বরে তাকে ডাক দিয়ে বললঃ হে মুহাম্মাদ! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার মত আওয়াজে উত্তর দিলেনঃ এস। আমরা তাকে বললামঃ ওহে! তোমার আওয়াজ একটু নীচু কর। কেননা তুমি তো নবী (ﷺ) এর কাছে এসেছ। আর তাঁর কাছে এরূপ করতে তোমাকে নিষেধ করা হয়েছে। সে বললঃ আল্লাহর কসম! আমি আমার আওয়াজ নীচু করতে পারব না। পরে ঐ বেদুঈন বললঃ কোন ব্যক্তি এক সম্প্রদায়কে ভালবাসে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারে নি। নবী (ﷺ) বললেনঃ যে যাকে ভালবাসবে, কিয়ামতের দিন সে তার সঙ্গেই থাকবে।
যির (রাহঃ) বলেনঃ সাফওয়ান (রাযিঃ) আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করতে করতে পশ্চিম প্রান্তের (সুফিয়ানের বর্ণনায় সিরিয়ার প্রান্তে) একটি দরজার কথা উল্লেখ করলেন। এই ফটকটির প্রশস্তাতা হল চল্লিশ বা (অপর বর্ণনায়) সত্তর বছরের সওয়ারী অতিক্রম করার পথ। আল্লাহ তাআলা যেদিন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে ঐটিও সৃষ্টি করেছেন। তওবার জন্য এটি সদা উন্মুক্ত। পশ্চিম থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ করা হবে না।
(আবু ঈসা বলেন) হাদীসটি হাসান-সহীহ।
আমি বললামঃ মুহাব্বাতের বিষয়ে তাঁকে কিছু বলতে শুনেছেন কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম।আমরা তাঁর কাছে ছিলাম এমন সময় বেদুঈন উচ্চৈস্বরে তাকে ডাক দিয়ে বললঃ হে মুহাম্মাদ! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার মত আওয়াজে উত্তর দিলেনঃ এস। আমরা তাকে বললামঃ ওহে! তোমার আওয়াজ একটু নীচু কর। কেননা তুমি তো নবী (ﷺ) এর কাছে এসেছ। আর তাঁর কাছে এরূপ করতে তোমাকে নিষেধ করা হয়েছে। সে বললঃ আল্লাহর কসম! আমি আমার আওয়াজ নীচু করতে পারব না। পরে ঐ বেদুঈন বললঃ কোন ব্যক্তি এক সম্প্রদায়কে ভালবাসে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারে নি। নবী (ﷺ) বললেনঃ যে যাকে ভালবাসবে, কিয়ামতের দিন সে তার সঙ্গেই থাকবে।
যির (রাহঃ) বলেনঃ সাফওয়ান (রাযিঃ) আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করতে করতে পশ্চিম প্রান্তের (সুফিয়ানের বর্ণনায় সিরিয়ার প্রান্তে) একটি দরজার কথা উল্লেখ করলেন। এই ফটকটির প্রশস্তাতা হল চল্লিশ বা (অপর বর্ণনায়) সত্তর বছরের সওয়ারী অতিক্রম করার পথ। আল্লাহ তাআলা যেদিন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে ঐটিও সৃষ্টি করেছেন। তওবার জন্য এটি সদা উন্মুক্ত। পশ্চিম থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ করা হবে না।
(আবু ঈসা বলেন) হাদীসটি হাসান-সহীহ।
باب فِي فَضْلِ التَّوْبَةِ وَالاِسْتِغْفَارِ وَمَا ذُكِرَ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ لِعِبَادِهِ
حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي عُمَرَ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ أَبِي النَّجُودِ، عَنْ زِرِّ بْنِ حُبَيْشٍ، قَالَ أَتَيْتُ صَفْوَانَ بْنَ عَسَّالٍ الْمُرَادِيَّ أَسْأَلُهُ عَنِ الْمَسْحِ، عَلَى الْخُفَّيْنِ فَقَالَ مَا جَاءَ بِكَ يَا زِرُّ فَقُلْتُ ابْتِغَاءَ الْعِلْمِ فَقَالَ إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ تَضَعُ أَجْنِحَتَهَا لِطَالِبِ الْعِلْمِ رِضًا بِمَا يَطْلُبُ . قُلْتُ إِنَّهُ حَكَّ فِي صَدْرِي الْمَسْحُ عَلَى الْخُفَّيْنِ بَعْدَ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ وَكُنْتَ امْرَأً مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَجِئْتُ أَسْأَلُكَ هَلْ سَمِعْتَهُ يَذْكُرُ فِي ذَلِكَ شَيْئًا قَالَ نَعَمْ كَانَ يَأْمُرُنَا إِذَا كُنَّا سَفَرًا أَوْ مُسَافِرِيِنَ أَنْ لاَ نَنْزِعَ خِفَافَنَا ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيَهُنَّ إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ لَكِنْ مِنْ غَائِطٍ وَبَوْلٍ وَنَوْمٍ . فَقُلْتُ هَلْ سَمِعْتَهُ يَذْكُرُ فِي الْهَوَى شَيْئًا قَالَ نَعَمْ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي سَفَرٍ فَبَيْنَا نَحْنُ عِنْدَهُ إِذْ نَادَاهُ أَعْرَابِيٌّ بِصَوْتٍ لَهُ جَهْوَرِيٍّ يَا مُحَمَّدُ . فَأَجَابَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى نَحْوٍ مِنْ صَوْتِهِ هَاؤُمُ وَقُلْنَا لَهُ وَيْحَكَ اغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ فَإِنَّكَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ نُهِيتَ عَنْ هَذَا . فَقَالَ وَاللَّهِ لاَ أَغْضُضُ . قَالَ الأَعْرَابِيُّ الْمَرْءُ يُحِبُّ الْقَوْمَ وَلَمَّا يَلْحَقْ بِهِمْ . قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم " الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ " . فَمَازَالَ يُحَدِّثُنَا حَتَّى ذَكَرَ بَابًا مِنْ قِبَلِ الْمَغْرِبِ مَسِيرَةُ عَرْضِهِ أَوْ يَسِيرُ الرَّاكِبُ فِي عَرْضِهِ أَرْبَعِينَ أَوْ سَبْعِينَ عَامًا قَالَ سُفْيَانُ قِبَلَ الشَّامِ خَلَقَهُ اللَّهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ مَفْتُوحًا يَعْنِي لِلتَّوْبَةِ لاَ يُغْلَقُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْهُ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাওবা বিষয়ে হাদীছটি দ্বারা মৌলিকভাবে দু'টি জিনিস জানা যায়-
(ক) তাওবা কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলার অন্তহীন দয়া। তিনি সৃষ্টির শুরু থেকেই তাওবা কবুলের জন্য বিশাল একটি দরজা তৈরি করে রেখেছেন। সেই দুয়ার সর্বদা খোলা থাকে। এই সংবাদ জানানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে বান্দাকে তাওবা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেন জানানো হচ্ছে, বান্দা! তুমি যত বড় গুনাহই কর এবং তোমার দ্বারা যত বেশি গুনাহ হয়ে যাক, তুমি কখনও হতাশ হয়ো না। আমি তোমার জন্য তাওবার দুয়ার খুলে রেখেছি। তুমি যখনই তাওবা করবে, আমি তা কবুল করে নেব এবং তোমার পাপ ক্ষমা করে দেব।
(খ) দ্বিতীয়তঃ হাদীসে জানানো হয়েছে তাওবা কবুলের শেষ মেয়াদ। আর তা হচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠা কিয়ামতের সবচে' বড় আলামত। এ আলামত প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর আর কারও তাওবা কবুল করা হবে না।
তাওবার দরজা সম্পর্কে বলা হয়েছে সেটি পশ্চিম দিকে। অর্থাৎ সূর্য যেদিকে অস্ত যায় সেদিকে। শামের দিক বলতেও পশ্চিম দিকই বোঝানো হয়েছে। পশ্চিম দিকের কোথায় কিভাবে দরজাটি আছে, তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ এটা অদৃশ্য জগতের ব্যাপার। সে জগতের যতটুকু আমাদেরকে জানানো হয়েছে, আমাদের পক্ষে কেবল ততটুকুই জানা সম্ভব, এর বেশি নয়। আমাদের কর্তব্য যতটুকু জানানো হয়েছে তাতে বিশ্বাস রাখা, আর যা জানানো হয়নি সে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করা। গায়েবী বিষয়ের কোনওকিছু পূর্ণাঙ্গরূপে বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন, আমরা তাতে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস করাই মু'মিনের কাজ।
দরজাটির বিশালত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে তার প্রস্থ এত বড় যে, একজন আরোহী তার একপ্রান্ত থেকে চলতে শুরু করলে অপর প্রান্তে পৌঁছতে চল্লিশ বা সত্তর বছর লাগবে। চল্লিশ না সত্তর, এ বিষয়ে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়েছে। আরোহী বলতে উট না ঘোড়ার আরোহী, তা স্পষ্ট করা হয়নি। দৃশ্যত অশ্বারোহীই বোঝানো হয়ে থাকবে। প্রস্থ যদি এত বড় হয়, তাহলে দৈর্ঘ্য কত বড় হবে তা কি চিন্তা করা যায়? সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর পক্ষে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর কোনোকিছুই সৃষ্টি করা কঠিন নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে যাই বর্ণিত আছে, আমরা তাতে বিশ্বাস রাখি।
এ হাদীছে তাওবা ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা এসেছে। নিচে তা যথাক্রমে উল্লেখ করা হল।
১. মোজার উপর মাসাহ করার বৈধতা। কেউ যদি ওযু করার পর চামড়া বা চামড়ার মত শক্ত কোনও জিনিসের তৈরি মোজা পরিধান করে, তবে পরবর্তী ওযুকালে তার জন্য এই সুযোগ রয়েছে যে, সে মোজা না খুলে মোজার উপর মাসাহ করে নেবে। কেউ সফর অবস্থায় থাকলে তার জন্য তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মাসাহ করা জায়েয। যে ব্যক্তি সফরে নেই, সে মাসাহ করতে পারে এক দিন এক রাত।
মাসাহ র এই বিধান কেবল ওযূর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যার উপর গোসল ফরয, তার জন্য মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। মোজার উপর মাসাহ সম্পর্কে আরও বহু মাসআলা আছে। সে ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করে নেওয়া কর্তব্য।
২. তালিবে ইলমের ফযীলত। হাদীছটির বর্ণনাকারী যির ইবনে হুবাইশ রহ.-এর মনে মোজার উপর মাসাহ করা সম্পর্কে খটকা দেখা দিয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে হযরত সাফওয়ান ইবন আসসাল রাযি.-এর কাছে আগমন করেছিলেন। সুতরাং তিনি তালিবে ইলম হলেন। হযরত সাফওয়ান রাযি. তাকে তার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি এ কথাই বলেছিলেন যে, আমি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে এসেছি। এতে খুশি হয়ে হযরত সাফওয়ান রাযি. তালিবে ইলমের ফযীলত সম্পর্কে তাকে হাদীছ শোনান। তাতে তিনি বলেন, তালিবে ইলম যেহেতু দীনী ইলম শেখার উদ্দেশ্যে বের হয়, তাই তার প্রতি সন্তুষ্টিতে ফিরিশতাগণ তাদের ডানা বিছিয়ে দেন। এভাবে তারা তালিবে ইলমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। সুবহানাল্লাহ! একজন তালিবে ইলমের কত বড় মর্যাদা। এ মর্যাদার কারণ সহীহ ইলম সহীহ আমলের ভিত্তি। বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া শরী'আত মোতাবেক আমল করা সম্ভব হয় না। বরং বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া সঠিক আকীদা-বিশ্বাসও পোষণ করা যায় না। আল্লাহ তা'আলার পরিচয় লাভ করা ও নবুওয়াত, আখিরাত প্রভৃতি বিষয় বোঝা বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। এ কারণেই ইলমে দীন শিক্ষার এত গুরুত্ব ও ফযীলত এবং তালিবে ইলমের এত মর্যাদা।
ফিরিশতাগণের ডানা বিছানোর স্বরূপ কী, তাদের ডানাই বা কেমন, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না। হাদীছে যতটুকু বলা হয়েছে, আমরা ততটুকুতে বিশ্বাস রাখি। এর বেশি খোঁজ-খবরের পেছনে পড়ার কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই। তা জানার উপর আমাদের দীনের কোনও বিষয় নির্ভরশীল নয়। না জানলে আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। কাজেই ওসব বিষয়ে নীরবতা অবলম্বনই শ্রেয়।
৩. নেককার লোকদেরকে মহব্বত করার ফযীলত।
হযরত যির ইবন হুবাইশ রাহঃ হযরত সাফওয়ান রাযি.-কে নেককার লোকদের মহব্বত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তার উত্তরে হযরত সাফওয়ান রাযি. জানান, একবার এক সফরে জনৈক বেদুঈন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ যদি কোনও লোকদের ভালোবাসে কিন্তু তার আমল তাদের মত না হয়, তবে এই ভালোবাসা দ্বারা সে কোনও উপকার পাবে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেন, যে যাকে ভালোবাসে, কিয়ামতের দিন সে তার সংগেই থাকবে। অর্থাৎ নেককার লোকদের ভালোবাসলে কিয়ামতের দিন নেককারদের সংগে থাকবে আর পাপীদের ভালোবাসলে কিয়ামতের দিন তাদের সংগেই থাকবে।
প্রকাশ থাকে যে, এই ভালোবাসা বলতে কেবল মৌখিক দাবি বোঝানো হয়নি, বরং অন্তরের ভালোবাসা বোঝানো উদ্দেশ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, কারও অন্তরে কারও প্রতি ভালোবাসা থাকলে সে তার মত আমলেরও চেষ্টা করবে। এখানে যে বেদুঈন সাহাবী বলেছেন তার আমল তাদের মত নয়, তার মানে একেবারেই আমল নেই তা নয়; বরং তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, নেককারদেরকে ভালোবেসে তিনি তাদের মত আমলের চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাদের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেননি। এ অবস্থায় তার ওই ভালোবাসা কাজে আসবে কি না? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, কাজে আসবে। কারণ তিনি যেহেতু তাদেরকে ভালোবেসে তাদের পর্যায়ে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন, তাই তার সে চেষ্টা আল্লাহ তা'আলার কাছে গৃহীত হবে এবং তিনি খুশি হয়ে তাকে আখিরাতে তাদের সংগেই রাখবেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য নেককার লোকদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসা এবং কথায় ও কাজে তাদের অনুসরণের চেষ্টা করা। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন- আমীন।
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও তাঁর সংগে আদব বজায় রাখা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। তাঁর আদব রক্ষার একটি দিক হলো, তাঁকে নাম ধরে না ডাকা এবং তাঁর সংগে উচ্চস্বরে কথা না বলা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
{لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنْكُمْ لِوَاذًا فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ} [النور: 63]
অর্থ : (হে মানুষ!) তোমরা নিজেদের মধ্যে রাসূলের ডাককে তোমাদের পারস্পরিক ডাকের মত (মামুলি) মনে করো না।- নুরঃ ৬৩
অর্থাৎ তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে যখন কোনও কথা বলবে, তখন তোমরা নিজেরা একে অন্যকে যেমন ডাক দিয়ে থাক, যেমন হে অমুক! শোন, তাকেও সেভাবে ডাক দিও না। সুতরাং তাকে লক্ষ্য করে "হে মুহাম্মাদ!" বলা কিছুতেই উচিত নয়। বরং তাঁকে সম্মানের সাথে ইয়া রাসূলাল্লাহ! বলে সম্বোধন করা চাই। আরও ইরশাদ হয়েছে-
{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ } [الحجرات: 2]
অর্থ : হে মু'মিনগণ! নিজেদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না এবং তার সাথে কথা বলতে গিয়ে এমন জোরে বলো না, যেমন তোমরা একে অন্যের সাথে জোরে কথা বলে থাক, পাছে তোমাদের কর্ম বাতিল হয়ে যায়, তোমাদের অজ্ঞাতসারে। হুজুরাতঃ ২
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যান। যাদের আওয়াজ বড় ছিল, তারা নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করেন। হযরত উমর রাঃ তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আওয়াজ এতই নিচু করে ফেলেন যে, তিনি কী বলছেন তা আবার তাকে জিজ্ঞেস করতে হত। হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস রাঃ ছিলেন আনসারদের প্রসিদ্ধ বক্তা ও কবি। এ আয়াত নাযিলের পর তিনি এতটা ভীত হয়ে উঠেন যে, ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেন। তাকে দেখতে না পেয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন যে, সাবিত কোথায়? জনৈক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তার খোঁজ নিয়ে আসছি। তিনি গিয়ে দেখেন সাবিত রাঃ নিজ ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাই আপনার খবর কী? বললেন, ভালো নয়। আমি উঁচু আওয়াজে কথা বলি। আর যে ব্যক্তি নবীর সামনে উঁচু আওয়াজে কথা বলে, আয়াতে বলা হয়েছে তার আমল বাতিল হয়ে যায়। আমার তো আমল বাতিল হয়ে গেছে। আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। ওই সাহাবী ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা জানালেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবার তার কাছে এই সুসংবাদ দিয়ে ফেরত পাঠালেন যে, তার কাছে যাও এবং তাকে বল, তুমি জাহান্নামের লোক নও; বরং তুমি জান্নাতবাসীদের একজন।
এ হাদীছে দেখা যায়, বেদুঈন সাহাবীর আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হয়েছে। এক তো তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ধরে ডাক দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত তিনি কথা বলেছেন উচ্চস্বরে। তিনি এরকম কেন করলেন? উত্তর এই যে, বলাই হয়েছে তিনি একজন বেদুঈন সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে তার দেখা-সাক্ষাত খুব কম হত। ফলে ইসলামী আদব-শিষ্টাচার তিনি তখনও পর্যন্ত শিখে উঠেননি। নাম ধরে ডাকার কথা তার জানা ছিল না। সে কারণেই তার দ্বারা এরকম আচরণ হয়ে গেছে। কাজেই এটিকে বেআদবী বলা যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এজন্য তার প্রতি অসন্তুষ্টি জ্ঞাপন করেননি। বরং তিনি খুশিমনেই তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তাআলা দয়াময় । তিনি তাওবার দুয়ার খুলে রেখেছেন। সুতরাং পাপ হওয়ামাত্র তাওবা করা উচিত এবং তাওবা কবুলের জন্য আশাবাদী থাকা উচিত।
খ. কোনও বিষয় জানা না থাকলে তা জানার জন্য জ্ঞানীজনের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, যেমন হযরত যির বহ, তার অজানা বিষয় জানার জন্য একজন সাহাবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কোনও দীনী বিষয়ে অন্তরে খটকা দেখা দিলে তা নিরসনের জন্য অবশ্যই কোনও বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হতে হবে।
গ. ইলমে দীন শেখা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এর জন্য কোনও বয়সের সীমারেখা নেই। যেকোনও বয়সেই তা শেখা যেতে পারে।
ঘ. ওযুতে পা ধোয়ার পরিবর্তে মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয। বহু হাদীছ দ্বারা এর বৈধতা প্রমাণিত। সুতরাং এর বৈধতায় সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
ঙ. প্রত্যেকের উচিত নেককার লোকদের ভালোবাসা ও তাদের অনুকরণ করা। আমলে তাদের সমপর্যায়ের না হলেও ভালোবাসার কারণে জান্নাতে তাদের সংগে থাকার আশা করা যায়, যেমনটা হাদীছে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার মহব্বতের পর এই ভালোবাসায় সর্বোচ্চ স্থানে থাকবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর ভালোবাসতে হবে তাঁর খুলাফায়ে রাশিদীন ও সুমহান সাহাবীগণকে। তারপর এই উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ, ফুকাহায়ে কিরাম, মুহাদ্দিছীন, ও উলামা-মাশায়েখকে। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর সিদ্দীক ও হযরত উমর ফারুক রাযি.-কে ভালোবাসি। তাই আমি আশা করি তাঁদের সংগে জান্নাতে থাকব।
চ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব রক্ষা করা সর্বাবস্থায় ফরয। তাঁর ওফাতের পরও এ হুকুম বলবৎ আছে। তাঁর নাম শ্রদ্ধাভক্তির সংগে নেওয়া, তাঁর হাদীছ ভক্তি-ভালোবাসার সাথে পড়া ও শোনা, তাঁর মসজিদে ও রওজা শরীফের কাছে নিম্নস্বরে কথা বলা, তাঁর নাম উচ্চারণকালে তাঁর প্রতি দরূদ পড়া প্রভৃতি বিষয়সমূহ তাঁর আদবের অন্তর্ভুক্ত।
ছ. উলামায়ে কিরাম যেহেতু নবীর ওয়ারিশ, তাই তাদের আদব ও সম্মান রক্ষা করাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সর্বাবস্থায় তাদের আদব রক্ষায় যত্নবান থাকা উচিত।
জ. কারও সামনে কোনও অনুচিত কথা বলা হলে বা অনুচিত কাজ করা হলে তার কর্তব্য তাতে বাঁধা দেওয়া, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে জনৈক ব্যক্তি উচ্চস্বরে কথা বললে হযরত সাফওয়ান রাযি. তাকে বাধা দিয়েছিলেন।
(ক) তাওবা কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলার অন্তহীন দয়া। তিনি সৃষ্টির শুরু থেকেই তাওবা কবুলের জন্য বিশাল একটি দরজা তৈরি করে রেখেছেন। সেই দুয়ার সর্বদা খোলা থাকে। এই সংবাদ জানানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে বান্দাকে তাওবা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেন জানানো হচ্ছে, বান্দা! তুমি যত বড় গুনাহই কর এবং তোমার দ্বারা যত বেশি গুনাহ হয়ে যাক, তুমি কখনও হতাশ হয়ো না। আমি তোমার জন্য তাওবার দুয়ার খুলে রেখেছি। তুমি যখনই তাওবা করবে, আমি তা কবুল করে নেব এবং তোমার পাপ ক্ষমা করে দেব।
(খ) দ্বিতীয়তঃ হাদীসে জানানো হয়েছে তাওবা কবুলের শেষ মেয়াদ। আর তা হচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়। পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠা কিয়ামতের সবচে' বড় আলামত। এ আলামত প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর আর কারও তাওবা কবুল করা হবে না।
তাওবার দরজা সম্পর্কে বলা হয়েছে সেটি পশ্চিম দিকে। অর্থাৎ সূর্য যেদিকে অস্ত যায় সেদিকে। শামের দিক বলতেও পশ্চিম দিকই বোঝানো হয়েছে। পশ্চিম দিকের কোথায় কিভাবে দরজাটি আছে, তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ এটা অদৃশ্য জগতের ব্যাপার। সে জগতের যতটুকু আমাদেরকে জানানো হয়েছে, আমাদের পক্ষে কেবল ততটুকুই জানা সম্ভব, এর বেশি নয়। আমাদের কর্তব্য যতটুকু জানানো হয়েছে তাতে বিশ্বাস রাখা, আর যা জানানো হয়নি সে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করা। গায়েবী বিষয়ের কোনওকিছু পূর্ণাঙ্গরূপে বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন, আমরা তাতে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস করাই মু'মিনের কাজ।
দরজাটির বিশালত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে তার প্রস্থ এত বড় যে, একজন আরোহী তার একপ্রান্ত থেকে চলতে শুরু করলে অপর প্রান্তে পৌঁছতে চল্লিশ বা সত্তর বছর লাগবে। চল্লিশ না সত্তর, এ বিষয়ে বর্ণনাকারীর সন্দেহ রয়েছে। আরোহী বলতে উট না ঘোড়ার আরোহী, তা স্পষ্ট করা হয়নি। দৃশ্যত অশ্বারোহীই বোঝানো হয়ে থাকবে। প্রস্থ যদি এত বড় হয়, তাহলে দৈর্ঘ্য কত বড় হবে তা কি চিন্তা করা যায়? সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর পক্ষে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর কোনোকিছুই সৃষ্টি করা কঠিন নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে যাই বর্ণিত আছে, আমরা তাতে বিশ্বাস রাখি।
এ হাদীছে তাওবা ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা এসেছে। নিচে তা যথাক্রমে উল্লেখ করা হল।
১. মোজার উপর মাসাহ করার বৈধতা। কেউ যদি ওযু করার পর চামড়া বা চামড়ার মত শক্ত কোনও জিনিসের তৈরি মোজা পরিধান করে, তবে পরবর্তী ওযুকালে তার জন্য এই সুযোগ রয়েছে যে, সে মোজা না খুলে মোজার উপর মাসাহ করে নেবে। কেউ সফর অবস্থায় থাকলে তার জন্য তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মাসাহ করা জায়েয। যে ব্যক্তি সফরে নেই, সে মাসাহ করতে পারে এক দিন এক রাত।
মাসাহ র এই বিধান কেবল ওযূর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যার উপর গোসল ফরয, তার জন্য মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। মোজার উপর মাসাহ সম্পর্কে আরও বহু মাসআলা আছে। সে ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করে নেওয়া কর্তব্য।
২. তালিবে ইলমের ফযীলত। হাদীছটির বর্ণনাকারী যির ইবনে হুবাইশ রহ.-এর মনে মোজার উপর মাসাহ করা সম্পর্কে খটকা দেখা দিয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে হযরত সাফওয়ান ইবন আসসাল রাযি.-এর কাছে আগমন করেছিলেন। সুতরাং তিনি তালিবে ইলম হলেন। হযরত সাফওয়ান রাযি. তাকে তার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি এ কথাই বলেছিলেন যে, আমি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে এসেছি। এতে খুশি হয়ে হযরত সাফওয়ান রাযি. তালিবে ইলমের ফযীলত সম্পর্কে তাকে হাদীছ শোনান। তাতে তিনি বলেন, তালিবে ইলম যেহেতু দীনী ইলম শেখার উদ্দেশ্যে বের হয়, তাই তার প্রতি সন্তুষ্টিতে ফিরিশতাগণ তাদের ডানা বিছিয়ে দেন। এভাবে তারা তালিবে ইলমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। সুবহানাল্লাহ! একজন তালিবে ইলমের কত বড় মর্যাদা। এ মর্যাদার কারণ সহীহ ইলম সহীহ আমলের ভিত্তি। বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া শরী'আত মোতাবেক আমল করা সম্ভব হয় না। বরং বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া সঠিক আকীদা-বিশ্বাসও পোষণ করা যায় না। আল্লাহ তা'আলার পরিচয় লাভ করা ও নবুওয়াত, আখিরাত প্রভৃতি বিষয় বোঝা বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। এ কারণেই ইলমে দীন শিক্ষার এত গুরুত্ব ও ফযীলত এবং তালিবে ইলমের এত মর্যাদা।
ফিরিশতাগণের ডানা বিছানোর স্বরূপ কী, তাদের ডানাই বা কেমন, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না। হাদীছে যতটুকু বলা হয়েছে, আমরা ততটুকুতে বিশ্বাস রাখি। এর বেশি খোঁজ-খবরের পেছনে পড়ার কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই। তা জানার উপর আমাদের দীনের কোনও বিষয় নির্ভরশীল নয়। না জানলে আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। কাজেই ওসব বিষয়ে নীরবতা অবলম্বনই শ্রেয়।
৩. নেককার লোকদেরকে মহব্বত করার ফযীলত।
হযরত যির ইবন হুবাইশ রাহঃ হযরত সাফওয়ান রাযি.-কে নেককার লোকদের মহব্বত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তার উত্তরে হযরত সাফওয়ান রাযি. জানান, একবার এক সফরে জনৈক বেদুঈন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেউ যদি কোনও লোকদের ভালোবাসে কিন্তু তার আমল তাদের মত না হয়, তবে এই ভালোবাসা দ্বারা সে কোনও উপকার পাবে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেন, যে যাকে ভালোবাসে, কিয়ামতের দিন সে তার সংগেই থাকবে। অর্থাৎ নেককার লোকদের ভালোবাসলে কিয়ামতের দিন নেককারদের সংগে থাকবে আর পাপীদের ভালোবাসলে কিয়ামতের দিন তাদের সংগেই থাকবে।
প্রকাশ থাকে যে, এই ভালোবাসা বলতে কেবল মৌখিক দাবি বোঝানো হয়নি, বরং অন্তরের ভালোবাসা বোঝানো উদ্দেশ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, কারও অন্তরে কারও প্রতি ভালোবাসা থাকলে সে তার মত আমলেরও চেষ্টা করবে। এখানে যে বেদুঈন সাহাবী বলেছেন তার আমল তাদের মত নয়, তার মানে একেবারেই আমল নেই তা নয়; বরং তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, নেককারদেরকে ভালোবেসে তিনি তাদের মত আমলের চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাদের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেননি। এ অবস্থায় তার ওই ভালোবাসা কাজে আসবে কি না? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, কাজে আসবে। কারণ তিনি যেহেতু তাদেরকে ভালোবেসে তাদের পর্যায়ে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন, তাই তার সে চেষ্টা আল্লাহ তা'আলার কাছে গৃহীত হবে এবং তিনি খুশি হয়ে তাকে আখিরাতে তাদের সংগেই রাখবেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য নেককার লোকদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসা এবং কথায় ও কাজে তাদের অনুসরণের চেষ্টা করা। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন- আমীন।
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও তাঁর সংগে আদব বজায় রাখা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। তাঁর আদব রক্ষার একটি দিক হলো, তাঁকে নাম ধরে না ডাকা এবং তাঁর সংগে উচ্চস্বরে কথা না বলা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
{لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنْكُمْ لِوَاذًا فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ} [النور: 63]
অর্থ : (হে মানুষ!) তোমরা নিজেদের মধ্যে রাসূলের ডাককে তোমাদের পারস্পরিক ডাকের মত (মামুলি) মনে করো না।- নুরঃ ৬৩
অর্থাৎ তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে যখন কোনও কথা বলবে, তখন তোমরা নিজেরা একে অন্যকে যেমন ডাক দিয়ে থাক, যেমন হে অমুক! শোন, তাকেও সেভাবে ডাক দিও না। সুতরাং তাকে লক্ষ্য করে "হে মুহাম্মাদ!" বলা কিছুতেই উচিত নয়। বরং তাঁকে সম্মানের সাথে ইয়া রাসূলাল্লাহ! বলে সম্বোধন করা চাই। আরও ইরশাদ হয়েছে-
{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ } [الحجرات: 2]
অর্থ : হে মু'মিনগণ! নিজেদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না এবং তার সাথে কথা বলতে গিয়ে এমন জোরে বলো না, যেমন তোমরা একে অন্যের সাথে জোরে কথা বলে থাক, পাছে তোমাদের কর্ম বাতিল হয়ে যায়, তোমাদের অজ্ঞাতসারে। হুজুরাতঃ ২
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যান। যাদের আওয়াজ বড় ছিল, তারা নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করেন। হযরত উমর রাঃ তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আওয়াজ এতই নিচু করে ফেলেন যে, তিনি কী বলছেন তা আবার তাকে জিজ্ঞেস করতে হত। হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শাম্মাস রাঃ ছিলেন আনসারদের প্রসিদ্ধ বক্তা ও কবি। এ আয়াত নাযিলের পর তিনি এতটা ভীত হয়ে উঠেন যে, ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেন। তাকে দেখতে না পেয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন যে, সাবিত কোথায়? জনৈক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তার খোঁজ নিয়ে আসছি। তিনি গিয়ে দেখেন সাবিত রাঃ নিজ ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাই আপনার খবর কী? বললেন, ভালো নয়। আমি উঁচু আওয়াজে কথা বলি। আর যে ব্যক্তি নবীর সামনে উঁচু আওয়াজে কথা বলে, আয়াতে বলা হয়েছে তার আমল বাতিল হয়ে যায়। আমার তো আমল বাতিল হয়ে গেছে। আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। ওই সাহাবী ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা জানালেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবার তার কাছে এই সুসংবাদ দিয়ে ফেরত পাঠালেন যে, তার কাছে যাও এবং তাকে বল, তুমি জাহান্নামের লোক নও; বরং তুমি জান্নাতবাসীদের একজন।
এ হাদীছে দেখা যায়, বেদুঈন সাহাবীর আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হয়েছে। এক তো তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ধরে ডাক দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত তিনি কথা বলেছেন উচ্চস্বরে। তিনি এরকম কেন করলেন? উত্তর এই যে, বলাই হয়েছে তিনি একজন বেদুঈন সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে তার দেখা-সাক্ষাত খুব কম হত। ফলে ইসলামী আদব-শিষ্টাচার তিনি তখনও পর্যন্ত শিখে উঠেননি। নাম ধরে ডাকার কথা তার জানা ছিল না। সে কারণেই তার দ্বারা এরকম আচরণ হয়ে গেছে। কাজেই এটিকে বেআদবী বলা যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এজন্য তার প্রতি অসন্তুষ্টি জ্ঞাপন করেননি। বরং তিনি খুশিমনেই তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তাআলা দয়াময় । তিনি তাওবার দুয়ার খুলে রেখেছেন। সুতরাং পাপ হওয়ামাত্র তাওবা করা উচিত এবং তাওবা কবুলের জন্য আশাবাদী থাকা উচিত।
খ. কোনও বিষয় জানা না থাকলে তা জানার জন্য জ্ঞানীজনের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, যেমন হযরত যির বহ, তার অজানা বিষয় জানার জন্য একজন সাহাবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কোনও দীনী বিষয়ে অন্তরে খটকা দেখা দিলে তা নিরসনের জন্য অবশ্যই কোনও বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হতে হবে।
গ. ইলমে দীন শেখা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এর জন্য কোনও বয়সের সীমারেখা নেই। যেকোনও বয়সেই তা শেখা যেতে পারে।
ঘ. ওযুতে পা ধোয়ার পরিবর্তে মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয। বহু হাদীছ দ্বারা এর বৈধতা প্রমাণিত। সুতরাং এর বৈধতায় সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
ঙ. প্রত্যেকের উচিত নেককার লোকদের ভালোবাসা ও তাদের অনুকরণ করা। আমলে তাদের সমপর্যায়ের না হলেও ভালোবাসার কারণে জান্নাতে তাদের সংগে থাকার আশা করা যায়, যেমনটা হাদীছে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার মহব্বতের পর এই ভালোবাসায় সর্বোচ্চ স্থানে থাকবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর ভালোবাসতে হবে তাঁর খুলাফায়ে রাশিদীন ও সুমহান সাহাবীগণকে। তারপর এই উম্মতের মুজতাহিদ ইমামগণ, ফুকাহায়ে কিরাম, মুহাদ্দিছীন, ও উলামা-মাশায়েখকে। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর সিদ্দীক ও হযরত উমর ফারুক রাযি.-কে ভালোবাসি। তাই আমি আশা করি তাঁদের সংগে জান্নাতে থাকব।
চ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব রক্ষা করা সর্বাবস্থায় ফরয। তাঁর ওফাতের পরও এ হুকুম বলবৎ আছে। তাঁর নাম শ্রদ্ধাভক্তির সংগে নেওয়া, তাঁর হাদীছ ভক্তি-ভালোবাসার সাথে পড়া ও শোনা, তাঁর মসজিদে ও রওজা শরীফের কাছে নিম্নস্বরে কথা বলা, তাঁর নাম উচ্চারণকালে তাঁর প্রতি দরূদ পড়া প্রভৃতি বিষয়সমূহ তাঁর আদবের অন্তর্ভুক্ত।
ছ. উলামায়ে কিরাম যেহেতু নবীর ওয়ারিশ, তাই তাদের আদব ও সম্মান রক্ষা করাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সর্বাবস্থায় তাদের আদব রক্ষায় যত্নবান থাকা উচিত।
জ. কারও সামনে কোনও অনুচিত কথা বলা হলে বা অনুচিত কাজ করা হলে তার কর্তব্য তাতে বাঁধা দেওয়া, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে জনৈক ব্যক্তি উচ্চস্বরে কথা বললে হযরত সাফওয়ান রাযি. তাকে বাধা দিয়েছিলেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
