আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৪৬. কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১১৫
আন্তর্জাতিক নং: ৩১১৫
সূরা হুদ
৩১১৫. আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান (রাহঃ) ......... আবুল ইউসর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ এক মহিলা একবার আমার কাছে খেজুর কিনতে আসল। আমি বললামঃ ঘরে আরো ভাল খেজুর আছে, সে তখন আমার সাথে ঘরে প্রবেশ করল। আমি তার দিকে ঝুঁকে তাকে চুমু দেই। পরে আবু বকর (রাযিঃ)-এর কাছে এসে তার বিষয়টি বললাম। তিনি বললেনঃ নিজের মধ্যে তা গোপন রাখ, আর তওবা কর। এ বিষয়ে কাউকে জানাবে না। কিন্তু (অনুশোচনায়) আমি স্থির থাকতে পারলাম না। উমর (রাযিঃ)-এর কাছে এসে বিষয়টি বললাম, তিনিও বললেনঃ নিজের মধ্যেই তা গোপন রাখ, আর তওবা কর। এ বিষয়ে কাউকে জানাবে না। কিন্তু (অনুশোচনায়) আমি স্থির তাকতে পারলাম না।

নবী (ﷺ) এর কাছে এসে বিষয়টি বললাম। তিনি বললেনঃ আল্লাহর পথে জেহদরত একজন যোদ্ধার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে তুমি কি এ ধরনের আচরণ করলে? ফলে সে কামনা করতে লাগল সে যদি পূর্বে ইসলাম গ্রহণ না করে এ মুহূর্তে ইসলাম গ্রহণ করত এবং ধারণা করতে লাগল যে, সে জাহান্নামী হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে রইলেন অবশেষে তাঁর কাছে ওহী এলঃ

أَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ

নামাযকায়েম কর দিনের দু’প্রান্ত ভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকাজ অবশ্যই অসৎ কাজ মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে এ তাদের জন্য এক উপদেশ (১১ : ১১৪)।

আবুল ইয়াসার (রাযিঃ) বলেনঃ আমি তাঁর কাছে হাযির হলাম। রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) আমাকে এই আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালেন। সাহাবীগণ বললেনঃ এটি কি বিশেষ করে এরই জন্য না সব মানুষের জন্য। তিনি বললেনঃ না বরং এ সব মানুষের জন্যই।

এ হাদীসটি হাসান-সহীহ-গারীব। রাবী কায়স ইবনে রবী কে ওয়াকী’ (রাহঃ) প্রমুখ হাদীসবিদগণ যঈফ বলেছেন। শরীক (রাহঃ)-ও এটি উছমান ইবনে আব্দুল্লাহ্ সূত্রে কায়স ইবনে রবী’ (রাহঃ) এর রিওয়ায়াতের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে আবু উসামা, ওয়াছিলা ইবনে আসকা’ ও আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। আবুল ইয়াসার (রাযিঃ)-এর নাম কা’ব ইবনে আমর।
بَابٌ: وَمِنْ سُورَةِ هُودٍ
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَخْبَرَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَخْبَرَنَا قَيْسُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَوْهَبٍ، عَنْ مُوسَى بْنِ طَلْحَةَ، عَنْ أَبِي الْيَسَرِ، قَالَ أَتَتْنِي امْرَأَةٌ تَبْتَاعُ تَمْرًا فَقُلْتُ إِنَّ فِي الْبَيْتِ تَمْرًا أَطْيَبَ مِنْهُ . فَدَخَلَتْ مَعِي فِي الْبَيْتِ فَأَهْوَيْتُ إِلَيْهَا فَقَبَّلْتُهَا فَأَتَيْتُ أَبَا بَكْرٍ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ قَالَ اسْتُرْ عَلَى نَفْسِكَ وَتُبْ وَلاَ تُخْبِرْ أَحَدًا . فَلَمْ أَصْبِرْ فَأَتَيْتُ عُمَرَ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ اسْتُرْ عَلَى نَفْسِكَ وَتُبْ وَلاَ تُخْبِرْ أَحَدًا . فَلَمْ أَصْبِرْ فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ . فَقَالَ لَهُ " أَخَلَفْتَ غَازِيًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فِي أَهْلِهِ بِمِثْلِ هَذَا " . حَتَّى تَمَنَّى أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ أَسْلَمَ إِلاَّ تِلْكَ السَّاعَةَ حَتَّى ظَنَّ أَنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ . قَالَ وَأَطْرَقَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم طَوِيلاً حَتَّى أَوْحَى اللَّهُ إِلَيْهِ : (أَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَىِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ ) إِلَى قَوْلِهِ : (ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ ) . قَالَ أَبُو الْيَسَرِ فَأَتَيْتُهُ فَقَرَأَهَا عَلَىَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَصْحَابُهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلِهَذَا خَاصَّةً أَمْ لِلنَّاسِ عَامَّةً قَالَ " بَلْ لِلنَّاسِ عَامَّةً " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ . وَقَيْسُ بْنُ الرَّبِيعِ ضَعَّفَهُ وَكِيعٌ وَغَيْرُهُ وَأَبُو الْيَسَرِ هُوَ كَعْبُ بْنُ عَمْرٍو . قَالَ وَرَوَى شَرِيكٌ عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ هَذَا الْحَدِيثَ مِثْلَ رِوَايَةِ قَيْسِ بْنِ الرَّبِيعِ . قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ أَبِي أُمَامَةَ وَوَاثِلَةَ بْنِ الأَسْقَعِ وَأَنَسِ بْنِ مَالِكٍ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে সাহাবীর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, তার নাম-পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। নাম জানার বিশেষ প্রয়োজন নেই। তার দ্বারা একটি গুনাহ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে আমাদের কাছে তার মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। তিনি যে কত বড় মুত্তাকী ও আল্লাহভীরু ছিলেন সেটাই লক্ষণীয়। কারও দ্বারা এ জাতীয় গুনাহ হয়ে গেলে শাস্তির ভয়ে বিচারকের কাছে সে তা গোপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সাহাবী তা গোপন করেননি। পেরেশান হয়ে গিয়েছিলেন কী উপায়ে ক্ষমা লাভ হবে। এর জন্য যে-কোনও শাস্তি গ্রহণে প্রস্তুত ছিলেন। এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি প্রথমে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বললেন, তাওবা করো, আর কখনও এমন করো না। কিন্তু এতে তিনি আশ্বস্ত হতে পারলেন না। যে উপায়েই হোক তার ক্ষমালাভের নিশ্চয়তা চাই। তারপর ছুটে আসেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তিনি তো বিচারপতিও। নারীদের সম্মানরক্ষায় তিনি যে পরিমাণ কঠোর ছিলেন, তাতে তার কঠিন শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাছে এসে নিজ অপরাধ স্বীকার করেন। নিঃসন্দেহে এটা শক্ত ঈমান ও গভীর আল্লাহভীরুতার পরিচায়ক। মহান সাহাবীদের থেকে এটাই আমাদের নেওয়ার বিষয়।

যা হোক ওই সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিজ অপরাধ স্বীকার করলেন। ওদিকে তার এ পেরেশানি ও ছোটাছুটি আল্লাহর বড় পসন্দ হয়ে গেছে। অনুশোচনাই প্রকৃত তাওবা। কী গভীর অনুশোচনায় তিনি ভুগছেন, আল্লাহ তা'আলা তা দেখেছেন। তিনি তার তাওবা কবুল করে ফেলেছেন। সুতরাং তিনি আয়াত নাযিল করেন-
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ
(এবং হে নবী!) দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম কর। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়)।
দিনের উভয়প্রান্তের নামায হল ফজর এবং যোহর ও আসরের নামায। রাতের কিছু অংশের নামায হল মাগরিব ও ইশার নামায। নামায শ্রেষ্ঠতম সৎকর্ম। আর সৎকর্মসমূহ দ্বারা পাপরাশির মার্জনা হয়ে যায়। বোঝা গেল, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পাপকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ। অবশ্য এর দ্বারা মাফ হয় সগীরা গুনাহ, কবীরা গুনাহ নয়। কবীরা গুনাহ থেকে মাফ পেতে হলে তাওবা জরুরি। কেবল নামায় দ্বারা তা মাফ হয় না। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الصلاة الخمس، والجمعة إلى الجمعة كفارة لما بينهن، ما لم تغش الكبائر
‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও এক জুমু'আ থেকে অপর জুমু'আ তার মধ্যবর্তী পাপসমূহ মোচন করে দেয়, যতক্ষণ না কবীরা গুনাহ করা হয়।'
সুবহানাল্লাহ! মহান রাব্বুল আলামীন কতইনা দয়াময়। নামায পড়া তাঁর আদেশ। বান্দা হিসেবে এ আদেশ পালন করতে আমরা বাধ্য। এর জন্য আবার পুরস্কার কিসের? অথচ তিনি নিজ দয়ায় এর জন্য অপরিমিত ছাওয়াবও দান করেন, আবার এর বদৌলতে তিনি আমাদের গুনাহও মাফ করেন। গুনাহ হচ্ছে আত্মার ময়লা। আল্লাহ তা'আলা চান না আমাদের আত্মায় ময়লা লেগে থাকুক। তাই তিনি নামায ও অন্যান্য সৎকর্মের দ্বারা আমাদের সে ময়লা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা মহান মাওলার এ করুণার কী শোকর আদায় করব?
কারও মতে এ আয়াতে الْحَسَنَاتِ (পুণ্যরাজি) দ্বারা سبحان الله ، والحمد لله ، ولا اله الا الله ، والله اكبر পড়া বোঝানো হয়েছে।

সাহাবী বুঝতে পারলেন তার গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। এবার জানতে চাইলেন, সৎকর্মের দ্বারা গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার বিধান কি কেবল তার জন্য? অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছিলেন, এটা কি আমার জন্য নির্দিষ্ট, না সকল মানুষের জন্য ব্যাপক? এ কথা শুনে হযরত উমর রাযি. বলে উঠেন, না; বরং সকল মানুষের জন্য ব্যাপক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর রাযি.-এর কথা সমর্থন করলেন। বললেন, উমর সঠিক বলেছে। এটা ছিল হযরত উমর রাযি.-এর ইজতিহাদ। তিনি আয়াতটির ভাষাগত ব্যাপকতা দ্বারা এটা বুঝেছিলেন। এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে দেন যে, এ নিয়ম আমার উম্মতের সকলের জন্য। অর্থাৎ যে-কারও দ্বারা সগীরা গুনাহ হয়ে গেলে তার সৎকর্ম দ্বারা তা মাফ হয়ে যাবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. গুনাহ সগীরা হোক বা কবীরা, কোনওটাতেই জড়ানো উচিত নয়। কেননা আল্লাহ তা ঘৃণা করেন। আর এ কারণেই নিজ দয়ায় তিনি তা মোচনের ব্যবস্থা করেছেন।

খ. যে-কোনও পাপকর্ম হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চিন্তে বসে থাকতে নেই। আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশায় অতিদ্রুত লজ্জা ও অনুতাপের সঙ্গে তাওবা করে ফেলা চাই।

গ. পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ে যত্নবান থাকা চাই। কেননা এ নামায আমাদের পাপমোচনের ব্যবস্থাও বটে।

ঘ. এ হাদীছ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির ব্যাপারে আমাদের আশান্বিত করে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
rabi
বর্ণনাকারী: