আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৪৬. কুরআনের তাফসীর অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০৪৭
আন্তর্জাতিক নং: ৩০৪৭
কুরআনের তাফসীর অধ্যায়
সূরা আল-মাইদা
৩০৪৭. আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান (রাহঃ) ...... আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ বনু ইসরাঈলীরা যখন আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয় তখন তাদের আলিমগণ তাদের নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা নিষেধ শোনে নি। এতদসত্ত্বেও তাঁরা তাদের সাথে তাদের মজলিসে উঠা বসা করেছে, তাদের সাথে (একত্রে) পানাহার করেছে। অনন্তর আল্লাহ্ তাআলা তাদের কতকের (পাপীদের) সাথে একাকার করে দিলেন এবং দাউদ ও ঈসা ইবনে মাইয়াম (আলাইহিস সালাম) এর ভাষায় তারা লা’নতগ্রস্ত হল। কেননা, তারা নাফরমানী এবং সীমালংঘন করত।

রাবী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, তিনি তখন সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেনঃ কসম সেই সত্তার যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমরা রক্ষা পাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের কঠোরভাবে বাধা না দিয়েছ।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান (রাহঃ) বলেনঃ ইয়াযীদ বলেছেন যে, সুফিয়ান ছাওরী (রাহঃ) সনদে আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ)-এর উল্লেখ করেন নি। হাদীসটি হাসান-গারীব। এই হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম ইবনে আবুল ওয়াযযাহ ......... আলী ইবনে বাযীমা-আবু উবাইদা-আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে। কোন কোন রাবী এটিকে আবু উবাইদা ......... নবী (ﷺ) থেকে মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।
أبواب تفسير القرآن عن رسول الله صلى الله عليه وسلم
بَابٌ: وَمِنْ سُورَةِ الْمَائِدَةِ
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَخْبَرَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَخْبَرَنَا شَرِيكٌ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ بَذِيمَةَ، عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لَمَّا وَقَعَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ فِي الْمَعَاصِي نَهَتْهُمْ عُلَمَاؤُهُمْ فَلَمْ يَنْتَهُوا فَجَالَسُوهُمْ فِي مَجَالِسِهِمْ وَوَاكَلُوهُمْ وَشَارَبُوهُمْ فَضَرَبَ اللَّهُ قُلُوبَ بَعْضِهِمْ بِبَعْضٍ وَلَعَنَهُمْ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ " . قَالَ فَجَلَسَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ " لاَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ حَتَّى تَأْطِرُوهُمْ عَلَى الْحَقِّ أَطْرًا " . قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ يَزِيدُ وَكَانَ سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ لاَ يَقُولُ فِيهِ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ وَقَدْ رُوِيَ هَذَا الْحَدِيثُ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ مُسْلِمِ بْنِ أَبِي الْوَضَّاحِ عَنْ عَلِيِّ بْنِ بَذِيمَةَ عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم نَحْوَهُ وَبَعْضُهُمْ يَقُولُ عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مُرْسَلٌ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বনী ইসরাঈলের মধ্যে পাপকর্মের সূচনা এবং তাতে বাধাদানের ব্যাপারে তাদের আলেমদের গড়িমসি আর তার পরিণামে তাদের ওপর ব্যাপক আযাব নেমে আসার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এ উম্মতকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারাও যদি অন্যায়-অসৎকাজে বাধাদানের দায়িত্ব যথার্থভাবে আঞ্জাম না দেয়, তবে তাদেরও সেরকম শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বনী ইসরাঈল হচ্ছে ইয়াহুদী জাতি। এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। তাঁর অপর নাম ইসরাঈল। সে হিসেবে তাঁর বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈলের বংশধর বলা হয়।

অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করা

এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, তাদের মধ্যে যখন সর্বপ্রথম অসৎকাজ হতে শুরু করে, তখন সেই অসৎ কার্যকারীর সঙ্গে কারও সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে তাকে আল্লাহর ভয় দেখাত এবং সে কাজটি হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তার সামনে তুলে ধরত। কিন্তু এতে সেই ব্যক্তির কোনও ভাবান্তর হত না। সে নিজেকে সংশোধন না করে যথারীতি আপন কাজ করে যেত। এ অবস্থায় অন্যদের উচিত ছিল তাকে বয়কট করা এবং তার সঙ্গে লেনদেন, ওঠাবসা ও পানাহারে শরীক না হওয়া, যাতে তার মন- মানসিকতায় এ বয়কটের চাপ পড়ে আর সে চাপের কারণে তার অসৎকাজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারা তাকে বয়কট করত না। সংশোধন না হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পুরোপুরি বজায় রাখত।

তার সঙ্গে মিলেমিশে চলার কারণে তার অসৎকর্মের আছর তাদের অন্তরে পড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে তাদের অন্তর থেকে পাপকাজের প্রতি ঘৃণা লোপ পেয়ে যায় আর এভাবে তাদের গোটা সমাজে অন্যায়-অসৎকাজ বিস্তার লাভ করে। পরিণামে সকলের প্রতি আল্লাহর লা'নত নেমে আসে। সে লা'নতের বর্ণনাই সূরা মায়িদার উল্লিখিত আয়াতসমূহে দেওয়া হয়েছে। এতে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁরা তাদের পাপাচার সীমালঙ্ঘনের কারণে বদদু'আ করেছিলেন। সে বদদু'আর ফলেই তাদের ওপর লা'নত বর্ষিত হয়।

ইমাম আবু হাইয়ান রহ. বর্ণনা করেন যে, হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের আমলে তাওরাত গ্রন্থে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের আমলে যাবুর গ্রন্থে এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আমলে ইন্‌জীল গ্রন্থে লা'নত করা হয়। অর্থাৎ এসকল নবী যে আপন আপন যুগে তাদের ওপর বদদু'আ করেছিলেন তার উল্লেখ এ গ্রন্থসমূহে আছে।

আয়াতে তাদের এ পরিণতির কারণ বলা হয়েছে-

كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)

তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।

প্রকাশ্যে পাপকর্ম হওয়া ও তাতে বাধা না দেওয়ার কুফল

অর্থাৎ তাদের মধ্যে দুই অপরাধের সমন্বয় ঘটেছিল। এক তো প্রকাশ্যে অসৎকর্ম করা, দ্বিতীয়ত তাতে বাধাদান না করা। এমনিতে তো অসৎকর্ম কোনও অবস্থায়ই করা উচিত নয়। প্রকাশ্যেও না, গোপনেও না। কেননা আল্লাহ তা'আলা প্রকাশ্য ও গুপ্ত সব অবস্থাই সমানভাবে জানেন। তাঁর অগোচরে থাকে না কোনওকিছুই। তাই বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায়ই তাঁকে ভয় করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হতে বিরত থাকা। তা সত্ত্বেও গোপনে গুনাহ করা অপেক্ষা প্রকাশ্যে করা অধিকতর মন্দ। কেননা এটা আল্লাহভীতির অভাবের সঙ্গে সঙ্গে নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার পরিচায়কও বটে। বনী ইসরাঈল এরকম ধৃষ্টতার সাথেই পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল। এ তো গেল তাদের এক অপরাধ।

এরকম ধৃষ্টতাপূর্ণ পাপকর্মে কেউ লিপ্ত হলে অর্থাৎ প্রকাশ্যে জনসম্মুখে গুনাহ করলে অন্যদের কর্তব্য তাকে তা হতে বিরত রাখতে চেষ্টা করা, যার একটা পদ্ধতি অপরাধীকে বয়কট করা ও তার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেওয়া। অন্যথায় তার দ্বারা অন্যরাও পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহ পায় আর এভাবে গোটা সমাজে অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বনী ইসরাঈলের 'উলামা তাদেরকে সেই প্রকাশ্য পাপ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেনি। এ ছিল তাদের দ্বিতীয় অপরাধ। এর ফলে তাদের গোটা জাতির মধ্যে অন্যায়-অনাচার বিস্তার লাভ করে। পরিণামে তারা অভিশাপগ্রস্ত হয়।

এর দ্বারা মূলত আমাদেরকে সবক দেওয়া হচ্ছে যে, আমাদের মধ্যে যেন কিছুতেই এ দুই অন্যায়ের মিলন ঘটতে না পারে। আমরা কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্ম করব না এবং গোপনেও নয়। আর কেউ প্রকাশ্যে পাপকর্মে লিপ্ত হলে অন্যরা অবশ্যই তা থেকে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে তাকে বয়কট করবে, যাতে বনী ইসরাঈলের মত অশুভ পরিণামে শিকার আমাদের না হতে হয়।

কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিন্দা

এ আয়াতসমূহে বনী ইসরাঈলের আরেকটি অনাচার বলা হয়েছে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। ইরশাদ হয়েছে-

تَرَى كَثِيرًا مِنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنْفُسُهُمْ أَنْ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ (80)

তুমি তাদের অনেককেই দেখছ, কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা (সে কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শাস্তির ভেতর থাকবে। অর্থাৎ তারা যেহেতু আহলে কিতাব, তাদের কিতাব তাওরাতে শেষ নবী সম্পর্কে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে, সে ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে একজন সত্যনবী ও সর্বশেষ নবী তা তাদের ঢের জানা ছিল, সেহেতু তাদের তো উচিত ছিল তাঁর প্রতি অন্য সকলের আগে ঈমান আনা এবং তাঁকে সত্যনবী বলে বিশ্বাস করে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেওয়া। কিন্তু তা না করে তারা উল্টো তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে এবং তাদের কিতাবেও যে শিরক ও কুফরের নিন্দা করা হয়েছে, সেই শিরক ও কুফরে লিপ্ত আরব মুশরিকদের সঙ্গে তারা বন্ধুত্ব করছে। বন্ধুত্ব করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেইসঙ্গে তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধের উস্কানি দিয়েছে এবং বিভিন্ন যুদ্ধে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছে। তাদের এ আচরণ চরম গর্হিত ও নিতান্তই নিন্দনীয়। এ কারণে দুনিয়ায়ও তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হয়েছে এবং আখিরাতেও তারা স্থায়ী আযাবে নিপতিত থাকবে। পরের আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَكِنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (81)

তারা যদি আল্লাহ, নবী এবং তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে (মূর্তিপূজারীদেরকে) বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য। অর্থাৎ তারা যদি আল্লাহর প্রতি যথার্থ ঈমান রাখত এবং তাদের নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব তাওরাতে বিশ্বাস রাখত, তবে কিছুতেই মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত না। কেননা নবীর দাওয়াতই হচ্ছে শিরকের বিরুদ্ধে ও তাওহীদের পক্ষে। নবীর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবেও শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর দিকে ডাকা হয়। কাজেই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থে তাদের বিশ্বাস থাকলে তারা মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো করতই না; বরং নিজেরাও শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনত এবং মুশরিকদেরকেও শিরক পরিহার করে তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানাত। এরূপ না করায় প্রকৃতপক্ষে তারা আপন দীন থেকেও খারিজ হয়ে গেছে। তারা কার্যত হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী থাকেনি।

এর দ্বারাও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব বোঝা যায়। কেননা এ দায়িত্ব পালন করলে তখন পাপী ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অবকাশ থাকে না; বরং প্রথমত তাকে পাপকাজ ছেড়ে দেওয়ার হুকুম করতে হয়, তারপর সে হুকুম না মানলে দ্বিতীয় পর্যায়ে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয়। বনী ইসরাঈল তা না করে অভিশপ্ত হয়েছে। আমরাও যদি অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাই, তবে কর্তব্য হবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব সাধ্যানুযায়ী পালন করে যাওয়া।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবেই আমাদেরকে হুকুম করছেন যে, শরী'আত যে কাজটিকে সৎকর্ম সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই মানুষকে তার আদেশ দেবে। আর শরী'আত যে কাজকে অসৎকাজ সাব্যস্ত করেছে, তোমরা অবশ্যই তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। আর যদি কেউ কারও ওপর জুলুম করে তবে তোমরা শক্ত করে তার হাত ধরবে অর্থাৎ বাহুবল দ্বারা তাকে জুলুম করতে বাধা দেবে। যদি বাহুবল দ্বারা বাধা দিতে না পার, তবে মুখের কথা দ্বারা বাধা দেবে। এভাবে জালিম ও অবিচারকারীকে ন্যায় ও সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনবে এবং তাকে এমনভাবে ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখবে, যাতে কিছুতেই সে তার বাইরে যেতে না পারে।

তারপর তিনি সাবধান করছেন যে, তোমরা এ সমস্ত দায়িত্ব পালন না করলে তোমাদের পরস্পরের অন্তরসমূহ একরকম করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ নেককারদের অন্তর গুনাহগারদের অন্তরের মত হয়ে যাবে। গুনাহগারদের অন্তরে যেমন গুনাহের প্রতি ঘৃণাবোধ থাকে না, তেমনি তাদের অন্তর থেকেও ঘৃণাবোধ লোপ করে দেওয়া হবে। এটাও একরকম শাস্তি। অন্তর থেকে পাপ-পুণ্যবোধ মুছে যাওয়া আত্মিক শাস্তি। এর ফলে পাপাচার বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি ও সমাজ পুরোপুরিভাবে পাপাচারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পরিণামে দুনিয়ায় নানারকম আযাব-গযব নেমে আসে আর আখিরাতের কঠিন শাস্তি তো আছেই। তা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব যথারীতি পালন করে যেতে হবে।

হাদীসে আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর সোজা হয়ে বসে প্রথমে আল্লাহর কসম করলেন, তারপর শেষের কথাটি বললেন। এর দ্বারা অনুভব করা যায় তাঁর কাছে জালিম ও অপরাধীকে তাদের জুলুম অপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা এবং আমর বিল- মা'রুফ ও নাহী আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন - আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কেউ কারও অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানতে পারলে তার কর্তব্য তাকে আল্লাহর ভয় দেখানো এবং তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা।

খ. উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও অসৎ কর্মকারী তার অসৎকর্ম থেকে বিরত না হলে অন্যদের উচিত তার সঙ্গে একত্রে ওঠাবসা ও পানাহার করা বন্ধ করে দেওয়া, যাতে মানসিক চাপে পড়ে সে অসৎকর্ম ছেড়ে দেয়।

গ. অন্তর থেকে পাপের প্রতি ঘৃণা লোপ পাওয়াটা একরকম আত্মিক শাস্তি। কারও এরকম হলে যথাশীঘ্র তাওবা-ইস্তিগফারে লিপ্ত হওয়া উচিত।

ঘ. কাফের ও পাপী ব্যক্তির সাথে কিছুতেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে নেই।

ঙ. কেউ কারও প্রতি জুলুম করলে আপন ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে জুলুম থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত।

চ. কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিথিলভাবে বলা উচিত নয়। বক্তব্যে দৃঢ়তা প্রকাশের পাশাপাশি ভাবভঙ্গি দ্বারাও তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা উচিত, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুলুমে বাধাদানের আদেশ দেওয়ার সময় হেলান দেওয়া অবস্থা ছেড়ে সোজা হয়ে বসেছেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)