আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
৪৬. কুরআনের তাফসীর অধ্যায়
হাদীস নং: ৩০১৯
আন্তর্জাতিক নং: ৩০১৯
সূরা আন-নিসা
৩০১৯. হুমায়দ ইবনে মাসআদা (রাহঃ) ...... আবু বাকরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের সবচেয়ে গুরুতর কবীরা গুনাহসমূহের কথা বলব?
সাহাবীগণ আরয করলেনঃ অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার সঙ্গে নাফরমানী করা।
আবু বাকরা (রাযিঃ) বলেনঃ তিনি কাত হয়ে ছিলেন। সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেনঃ মিথ্যা সাক্ষী দেয়া বা মিথ্যা কথা বলা। আবু বাকরা (রাযিঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কথাটি বারবার এমনভাবে বলতে লাগলেন যে, আমরা মনে মনে বলতে লাগলাম, তিনি যদি চুপ করতেন (তবে ভাল হতো)। বুখারি ও মুসলিম
(আবু ঈসা বলেন)হাদীসটি হাসান-সহীহ-গারীব।
সাহাবীগণ আরয করলেনঃ অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার সঙ্গে নাফরমানী করা।
আবু বাকরা (রাযিঃ) বলেনঃ তিনি কাত হয়ে ছিলেন। সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেনঃ মিথ্যা সাক্ষী দেয়া বা মিথ্যা কথা বলা। আবু বাকরা (রাযিঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কথাটি বারবার এমনভাবে বলতে লাগলেন যে, আমরা মনে মনে বলতে লাগলাম, তিনি যদি চুপ করতেন (তবে ভাল হতো)। বুখারি ও মুসলিম
(আবু ঈসা বলেন)হাদীসটি হাসান-সহীহ-গারীব।
بَابٌ: وَمِنْ سُورَةِ النِّسَاءِ
حَدَّثَنَا حُمَيْدُ بْنُ مَسْعَدَةَ، - بَصْرِيٌّ - حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ الْمُفَضَّلِ، حَدَّثَنَا الْجُرَيْرِيُّ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي بَكْرَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أَلاَ أُحَدِّثُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ " . قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ " الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ " . قَالَ وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا قَالَ " وَشَهَادَةُ الزُّورِ أَوْ قَوْلُ الزُّورِ " . قَالَ فَمَا زَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ صَحِيحٌ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বড় গুনাহের মধ্যে যেগুলো বেশি বড়, সেরকম কয়েকটি গুনাহ উল্লেখ করা হয়েছে। বোঝা গেল মৌলিকভাবে গুনাহ দুই প্রকার- সগীরা গুনাহ (ছোট গুনাহ) ও কবীরা গুনাহ (বড় গুনাহ)। আবার বড় গুনাহের মধ্যেও কিছু আছে অধিকতর বড়।
কেউ কেউ সগীরা গুনাহ'র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে সব গুনাহই কবীরা। কিন্তু কুরআন-হাদীছের ভাষ্যের প্রতি লক্ষ করলে তা সঠিক মনে হয় না। কেননা কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবেই কবীরা গুনাহ'র উল্লেখ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا
‘তোমাদেরকে যেই বড় বড় গুনাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তোমরা যদি তা পরিহার করে চল, তবে আমি নিজেই তোমাদের ছোট ছোট গুনাহ তোমাদের থেকে মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দাখিল করব ।১২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ “সেইসব লোককে, যারা বড়-বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পিছলে পড়লে সেটা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল।১২৫
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় কতক গুনাহ ছোটও আছে। তবে এ কথা সত্য যে, ছোট গুনাহকে তাচ্ছিল্য করলে তখন আর তা ছোট থাকে না। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের নামান্তর।
কবীরা গুনাহ কাকে বলে, উলামায়ে কেরাম তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সব ব্যাখ্যারই সারকথা একই। তা এই যে, কুরআন ও হাদীছে যেসকল গুনাহকে কবীরা গুনাহ, জুলুম, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি গুরুতরতাজ্ঞাপক বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে কিংবা যেসব অপরাধ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে সেগুলো কবীরা গুনাহ।
ইমামুল হারামায়ন রহ. বলেন, যেসকল অপরাধ দীনের প্রতি ব্যক্তির বিশেষ তোয়াক্কা না থাকা এবং দীনদারীতে তার ঘাটতি থাকার ইঙ্গিত বহন করে সেগুলোই কবীরা গুনাহ।
কোন্ কোন্ অপরাধ কবীরা গুনাহ এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের অনেকেই পৃথক কিতাব লিখেছেন। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ হলো মুহাক্কিক শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবন হাজার হায়তামী রহ.-এর লেখা আয-যাওয়াজির ‘আন ইকতিরাফিল কাবাইর।
এ হাদীছে চারটি বিষয়কে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে— الإشراك بالله (আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা)। এর দ্বারা বোঝানে উদ্দেশ্য সর্বপ্রকার কুফরী কর্ম। যেমন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করা, দেব-দেবীর পূজা করা, আল্লাহর দেওয়া দীন প্রত্যাখ্যান করা, নবী-রাসূলকে অমান্য করা, কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলার কালাম বলে স্বীকার না করা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হয় এবং মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তার পরিণাম স্থায়ী জাহান্নামবাস। তাকে কখনও ক্ষমা করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোনও বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হলো।১২৬
আরও ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ 'নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম।১২৭
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা
দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে- عقوق الوالدين(পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা)। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করার পরই পিতা-মাতার আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফরয হলো পিতা-মাতার আনুগত্য করা। তা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই এটাও বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী না করা তথা কুফরীকর্ম করা সবচে' ভয়ংকর পাপ এবং তার পরপরই গুরুতর পাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সেটিই স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরীক করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ এবং তারপর হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। অপর এক হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثلاثة لا ينظر الله عز وجل إليهم يوم القيامة: العاق لوالديه، والمرأة المترجلة والديوث، وثلاثة لا يدخلون الجنة : العاق لوالديه، والمدمن على الخمر، والمنان بما أعطى
'তিন ব্যক্তি এমন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দেবেন না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশধারী নারী ও স্ত্রীকে বেপর্দায় ছেড়ে দেওয়া পুরুষ। এবং তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী ও দান করার পর তা নিয়ে খোটা দানকারী।১২৮
মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে বলেছেন- ألا وقول الزور وشهادة الزور (শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া)। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াও মিথ্যা বলাই বটে। তা সত্ত্বেও এটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, সাধারণ মিথ্যা বলা অপেক্ষা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অধিকতর অনিষ্টকর। কেননা এর দ্বারা বিচারককে বিভ্রান্ত করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে বান্দার অধিকার খর্ব করে এবং তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনেক সময় সাধারণ মিথ্যার দ্বারাও অন্যের অধিকার হরণ করা হয় বটে, কিন্তু তার পেছনে আইনের পোষকতা থাকে না। ফলে আইন-আদালতের আশ্রয় নিয়ে তার পক্ষে তার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে। পক্ষান্তরে মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা যে অধিকার হরণ করা হয়, তাতে যেহেতু আইন আদালত ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সে কারণে অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার ফিরে পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।
বস্তুত মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া একটি সামাজিক অপরাধ। এটা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। তাই এর প্রতি বাড়তি গুরুত্বারোপের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি বলার সময় নিজ ভাবভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। এর আগে তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এ কথাটি বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসেন, যাতে শ্রোতার উপর স্বতন্ত্র প্রভাব পড়ে এবং তারা মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার মন্দত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এমনকি তিনি এ উপলব্ধিকে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দেওয়ার জন্য কথাটির বার বার পুনরাবৃত্তিও করতে থাকেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন فما زال يكررها ، حتى قلنا : ليته سكت (তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন!)। তাঁরা তাঁর ক্ষান্ত হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রতি মমত্ববশত। তাঁরা লক্ষ করছিলেন কথাটির একাধারে পুনরাবৃত্তি করে যাওয়ায় তাঁর যথেষ্ট মানসিক ও দৈহিক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কোনও কথার বার বার পুনরাবৃত্তি ক্লান্তিকর বটে। এটা মুখ ও জবানের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টদায়ক হয়ে থাকে। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কষ্ট অসহনীয় বোধ হচ্ছিল। সন্দেহ নেই এটি তাঁদের গভীর নবীপ্রেমের পরিচায়ক। এর দ্বারা তাঁর প্রতি তাঁদের আদব রক্ষার প্রযত্নও উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন হতে পারে, যে-কোনও জিনিস সবচে' বড় তো একটিই হতে পারে, সে হিসেবে সবচে' বড় গুনাহও একটিই হবে বৈকি, আর তা হবে কেবলই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, সুতরাং এ হাদীছে অনেকগুলো বিষয়কে সবচে' বড় পাপ কিভাবে বলা হলো?
উত্তর এই যে, আক্ষরিক অর্থে সবচে' বড় একটিই হতে পারে এ কথা সত্য। কিন্তু সবচে' বড় হওয়ার বিষয়টিকে যদি আপেক্ষিক ধরা হয়, তবে তা একাধিকও হতে পারে। এস্থলে মূলত আপেক্ষিক অর্থে সবচে' বড় গুনাহ বোঝানোই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অন্যান্য গুনাহের তুলনায় যেসব গুনাহ বেশি বড় তা হলো এই এই।
আরও কয়েকটি মহাপাপ
প্রকাশ থাকে যে, সবচে' বড় কবীরা গুনাহ কেবল এ চারটিই নয়; আরও আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اجتنبوا السبع الموبقات، قالوا: يا رسول الله وما هنّ؟ قال: الشرك بالله، والسحر وقتل النفس التي حرم الله إلا بالحق، وأكل الربا، وأكل مال اليتيم، والتولي يوم الزحف، وقذف المحصنات المؤمنات الغافلات
“তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি কর্ম হতে বাঁচ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা; জাদু করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে হত্যা করা, অবশ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে হলে (অর্থাৎ শরীআতের বিধান মোতাবেক হলে) ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা; যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সরলা চরিত্রবর্তী মুমিন নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেওয়া।১২৯
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن من أكبر الكبائر استطالة المرء في عرض رجل مسلم بغير حق، ومن الكبائر السبتان بالسبة
'সবচে বড় কবীরা গুনাহ হলো অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্মানের উপর আঘাত করা। এক গালির বদলে দুই গালি দেওয়াও মহাপাপ।১৩০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছে আছে-
قلت: فأي الكبائر أكبر؟ قال: «أن تجعل لله ندا وهو خلقك»، قلت: ثم أي؟ قال: «أن تقتل ولدك من أجل أن يأكل معك»، قلت: ثم أي؟ قال: «ثم أن تزاني بحليلة جارك»، ثم تلا رسول اللہ ﷺ وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا »
'আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ কবীরা গুনাহ অধিকতর বড়? তিনি বললেন, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ বানানো। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, নিজ সন্তানকে এ কারণে হত্যা করা যে, সে তোমার সঙ্গে খাওয়ায় শরীক হবে। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন—
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا
এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে' –সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৮।১৩১
বিভিন্ন হাদীছে আরও কিছু গুনাহকে বড় কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ অনেকগুলোই আছে। তা সত্ত্বেও এ হাদীছে মাত্র চারটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ইসলামী শিক্ষার একটি পদ্ধতি যে, কোনও বিষয়েরই সবগুলো কথা একসঙ্গে বলা হয় না, যাতে শ্রোতার কাছে চাপবোধ না হয়। বরং ব্যক্তি ও স্থান অনুযায়ী যখন যা প্রয়োজন বোধ হত, তখন সে সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন। এ হাদীছেও চারটি বৃহত্তম কবীরা গুনাহের উল্লেখ সম্ভবত ব্যক্তি বা সময়ের চাহিদা অনুযায়ীই করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলো পৃথকভাবে উল্লেখ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আমরা যেন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছে সর্বাপেক্ষা বড় যে গুনাহগুলো উল্লেখ করা হলো, আমাদেরকে অবশ্যই তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
খ. শিরক ও কুফরের পর পিতা-মাতার অবাধ্যতা সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলোর একটি।
গ. মিথ্যা কথা বলা বিশেষত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অত্যন্ত ভয়ানক পাপ। এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ঘ. ওয়াজ-নসীহতকালে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-উপদেশ পুনরাবৃত্তি করা ভালো। তা অন্তরে প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
১২৪. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩১
১২৫. সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২
১২৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৮
১২৭.সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭২
১২৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৪০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩১৮০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৩৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪১৭
১২৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬৭১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৮৭৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৬১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৮০; বাগাবী শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৫;
১৩০. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৭৭
১৩১. মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১০৩
কেউ কেউ সগীরা গুনাহ'র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে সব গুনাহই কবীরা। কিন্তু কুরআন-হাদীছের ভাষ্যের প্রতি লক্ষ করলে তা সঠিক মনে হয় না। কেননা কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবেই কবীরা গুনাহ'র উল্লেখ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا
‘তোমাদেরকে যেই বড় বড় গুনাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তোমরা যদি তা পরিহার করে চল, তবে আমি নিজেই তোমাদের ছোট ছোট গুনাহ তোমাদের থেকে মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দাখিল করব ।১২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ “সেইসব লোককে, যারা বড়-বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পিছলে পড়লে সেটা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল।১২৫
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় কতক গুনাহ ছোটও আছে। তবে এ কথা সত্য যে, ছোট গুনাহকে তাচ্ছিল্য করলে তখন আর তা ছোট থাকে না। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের নামান্তর।
কবীরা গুনাহ কাকে বলে, উলামায়ে কেরাম তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সব ব্যাখ্যারই সারকথা একই। তা এই যে, কুরআন ও হাদীছে যেসকল গুনাহকে কবীরা গুনাহ, জুলুম, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি গুরুতরতাজ্ঞাপক বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে কিংবা যেসব অপরাধ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে সেগুলো কবীরা গুনাহ।
ইমামুল হারামায়ন রহ. বলেন, যেসকল অপরাধ দীনের প্রতি ব্যক্তির বিশেষ তোয়াক্কা না থাকা এবং দীনদারীতে তার ঘাটতি থাকার ইঙ্গিত বহন করে সেগুলোই কবীরা গুনাহ।
কোন্ কোন্ অপরাধ কবীরা গুনাহ এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের অনেকেই পৃথক কিতাব লিখেছেন। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ হলো মুহাক্কিক শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবন হাজার হায়তামী রহ.-এর লেখা আয-যাওয়াজির ‘আন ইকতিরাফিল কাবাইর।
এ হাদীছে চারটি বিষয়কে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে— الإشراك بالله (আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা)। এর দ্বারা বোঝানে উদ্দেশ্য সর্বপ্রকার কুফরী কর্ম। যেমন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করা, দেব-দেবীর পূজা করা, আল্লাহর দেওয়া দীন প্রত্যাখ্যান করা, নবী-রাসূলকে অমান্য করা, কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলার কালাম বলে স্বীকার না করা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হয় এবং মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তার পরিণাম স্থায়ী জাহান্নামবাস। তাকে কখনও ক্ষমা করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোনও বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হলো।১২৬
আরও ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ 'নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম।১২৭
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা
দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে- عقوق الوالدين(পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা)। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করার পরই পিতা-মাতার আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফরয হলো পিতা-মাতার আনুগত্য করা। তা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই এটাও বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী না করা তথা কুফরীকর্ম করা সবচে' ভয়ংকর পাপ এবং তার পরপরই গুরুতর পাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সেটিই স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরীক করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ এবং তারপর হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। অপর এক হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثلاثة لا ينظر الله عز وجل إليهم يوم القيامة: العاق لوالديه، والمرأة المترجلة والديوث، وثلاثة لا يدخلون الجنة : العاق لوالديه، والمدمن على الخمر، والمنان بما أعطى
'তিন ব্যক্তি এমন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দেবেন না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশধারী নারী ও স্ত্রীকে বেপর্দায় ছেড়ে দেওয়া পুরুষ। এবং তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী ও দান করার পর তা নিয়ে খোটা দানকারী।১২৮
মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে বলেছেন- ألا وقول الزور وشهادة الزور (শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া)। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াও মিথ্যা বলাই বটে। তা সত্ত্বেও এটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, সাধারণ মিথ্যা বলা অপেক্ষা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অধিকতর অনিষ্টকর। কেননা এর দ্বারা বিচারককে বিভ্রান্ত করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে বান্দার অধিকার খর্ব করে এবং তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনেক সময় সাধারণ মিথ্যার দ্বারাও অন্যের অধিকার হরণ করা হয় বটে, কিন্তু তার পেছনে আইনের পোষকতা থাকে না। ফলে আইন-আদালতের আশ্রয় নিয়ে তার পক্ষে তার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে। পক্ষান্তরে মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা যে অধিকার হরণ করা হয়, তাতে যেহেতু আইন আদালত ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সে কারণে অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার ফিরে পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।
বস্তুত মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া একটি সামাজিক অপরাধ। এটা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। তাই এর প্রতি বাড়তি গুরুত্বারোপের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি বলার সময় নিজ ভাবভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। এর আগে তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এ কথাটি বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসেন, যাতে শ্রোতার উপর স্বতন্ত্র প্রভাব পড়ে এবং তারা মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার মন্দত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এমনকি তিনি এ উপলব্ধিকে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দেওয়ার জন্য কথাটির বার বার পুনরাবৃত্তিও করতে থাকেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন فما زال يكررها ، حتى قلنا : ليته سكت (তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন!)। তাঁরা তাঁর ক্ষান্ত হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রতি মমত্ববশত। তাঁরা লক্ষ করছিলেন কথাটির একাধারে পুনরাবৃত্তি করে যাওয়ায় তাঁর যথেষ্ট মানসিক ও দৈহিক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কোনও কথার বার বার পুনরাবৃত্তি ক্লান্তিকর বটে। এটা মুখ ও জবানের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টদায়ক হয়ে থাকে। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কষ্ট অসহনীয় বোধ হচ্ছিল। সন্দেহ নেই এটি তাঁদের গভীর নবীপ্রেমের পরিচায়ক। এর দ্বারা তাঁর প্রতি তাঁদের আদব রক্ষার প্রযত্নও উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন হতে পারে, যে-কোনও জিনিস সবচে' বড় তো একটিই হতে পারে, সে হিসেবে সবচে' বড় গুনাহও একটিই হবে বৈকি, আর তা হবে কেবলই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, সুতরাং এ হাদীছে অনেকগুলো বিষয়কে সবচে' বড় পাপ কিভাবে বলা হলো?
উত্তর এই যে, আক্ষরিক অর্থে সবচে' বড় একটিই হতে পারে এ কথা সত্য। কিন্তু সবচে' বড় হওয়ার বিষয়টিকে যদি আপেক্ষিক ধরা হয়, তবে তা একাধিকও হতে পারে। এস্থলে মূলত আপেক্ষিক অর্থে সবচে' বড় গুনাহ বোঝানোই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অন্যান্য গুনাহের তুলনায় যেসব গুনাহ বেশি বড় তা হলো এই এই।
আরও কয়েকটি মহাপাপ
প্রকাশ থাকে যে, সবচে' বড় কবীরা গুনাহ কেবল এ চারটিই নয়; আরও আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اجتنبوا السبع الموبقات، قالوا: يا رسول الله وما هنّ؟ قال: الشرك بالله، والسحر وقتل النفس التي حرم الله إلا بالحق، وأكل الربا، وأكل مال اليتيم، والتولي يوم الزحف، وقذف المحصنات المؤمنات الغافلات
“তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি কর্ম হতে বাঁচ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা; জাদু করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে হত্যা করা, অবশ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে হলে (অর্থাৎ শরীআতের বিধান মোতাবেক হলে) ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা; যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সরলা চরিত্রবর্তী মুমিন নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেওয়া।১২৯
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن من أكبر الكبائر استطالة المرء في عرض رجل مسلم بغير حق، ومن الكبائر السبتان بالسبة
'সবচে বড় কবীরা গুনাহ হলো অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্মানের উপর আঘাত করা। এক গালির বদলে দুই গালি দেওয়াও মহাপাপ।১৩০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছে আছে-
قلت: فأي الكبائر أكبر؟ قال: «أن تجعل لله ندا وهو خلقك»، قلت: ثم أي؟ قال: «أن تقتل ولدك من أجل أن يأكل معك»، قلت: ثم أي؟ قال: «ثم أن تزاني بحليلة جارك»، ثم تلا رسول اللہ ﷺ وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا »
'আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ কবীরা গুনাহ অধিকতর বড়? তিনি বললেন, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ বানানো। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, নিজ সন্তানকে এ কারণে হত্যা করা যে, সে তোমার সঙ্গে খাওয়ায় শরীক হবে। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন—
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا
এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে' –সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৮।১৩১
বিভিন্ন হাদীছে আরও কিছু গুনাহকে বড় কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ অনেকগুলোই আছে। তা সত্ত্বেও এ হাদীছে মাত্র চারটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ইসলামী শিক্ষার একটি পদ্ধতি যে, কোনও বিষয়েরই সবগুলো কথা একসঙ্গে বলা হয় না, যাতে শ্রোতার কাছে চাপবোধ না হয়। বরং ব্যক্তি ও স্থান অনুযায়ী যখন যা প্রয়োজন বোধ হত, তখন সে সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন। এ হাদীছেও চারটি বৃহত্তম কবীরা গুনাহের উল্লেখ সম্ভবত ব্যক্তি বা সময়ের চাহিদা অনুযায়ীই করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলো পৃথকভাবে উল্লেখ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আমরা যেন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছে সর্বাপেক্ষা বড় যে গুনাহগুলো উল্লেখ করা হলো, আমাদেরকে অবশ্যই তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
খ. শিরক ও কুফরের পর পিতা-মাতার অবাধ্যতা সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলোর একটি।
গ. মিথ্যা কথা বলা বিশেষত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অত্যন্ত ভয়ানক পাপ। এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ঘ. ওয়াজ-নসীহতকালে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-উপদেশ পুনরাবৃত্তি করা ভালো। তা অন্তরে প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
১২৪. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩১
১২৫. সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২
১২৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৮
১২৭.সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭২
১২৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৪০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩১৮০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৩৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪১৭
১২৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬৭১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৮৭৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৬১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৮০; বাগাবী শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৫;
১৩০. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৭৭
১৩১. মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১০৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: