আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৪২. অনুমতি প্রার্থনা ও বিবিধ শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ২৭৪৯
আন্তর্জাতিক নং: ২৭৪৯
কাউকে তার আসন থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসা।
২৭৪৯. কুতায়বা (রাহঃ) ...... ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা কেউ তোমাদের অপর ভাইকে তার আসন থেকে উঠিয়ে দিয়ে তাতে বসবে না।
بَابُ كَرَاهِيَةِ أَنْ يُقَامَ الرَّجُلُ مِنْ مَجْلِسِهِ ثُمَّ يُجْلَسُ فِيهِ
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لاَ يُقِمْ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ مِنْ مَجْلِسِهِ ثُمَّ يَجْلِسُ فِيهِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যেন কোনও ব্যক্তিকে তার বসার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে না বসে। বরং তোমরা (আগন্তুকের জন্য) স্থান প্রশস্ত করে দাও ও জায়গা ফাঁকা করে দাও। হযরত ইবন উমর রাযি.–এর নিয়ম ছিল যে, কোনও ব্যক্তি তাঁর জন্য নিজ স্থান থেকে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি সেখানে বসতেন না।

এ হাদীছটিতে মজলিসের বিশেষ দু’টি আদব বর্ণনা করা হয়েছে। এক হল মজলিসে উপবিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে না বসা বা অন্য কাউকে না বসানো। দ্বিতীয় হল আগন্তুক বাক্তির বসার জন্য জায়গা করে দেওয়া।

প্রথম আদব সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
لا يقيمن أحدكم رجلا من مجلسه ثم يجلس فيه
‘তোমাদের কেউ যেন কোনও ব্যক্তিকে তার বসার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে না বসে'
অর্থাৎ কেউ যদি কোনও জায়গায় বসা থাকে, তবে অন্য কেউ এসে তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে নিজে বসতে পারবে না। কেননা আগে বসার দ্বারা সে জায়গাটিতে তার অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে ব্যক্তি পরে এসেছে সে যদি আগের ব্যক্তির চেয়ে ইলম, আমল ও মর্যাদায় উত্তমও হয়, তবুও এরূপ করা যাবে না। কেননা এরূপ করার দ্বারা উপবিষ্ট ব্যক্তিকে অপমান করা হয় এবং তার মনে আঘাত দেওয়া হয়। ইসলামে মানুষের মর্যাদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যে আচরণ দ্বারা অন্যের অমর্যাদা হয় তা করা জায়েয নয়। এটা করার কুফল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এবং হিংসা ও বিদ্বেষের সূত্রপাত হয়। তাছাড়া এটা অহমিকারও প্রকাশ। তাই এর থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি।

অবশ্য এ বিধান এমন জায়গার জন্য প্রযোজ্য, যে জায়গা সকলের জন্য উন্মুক্ত। যে-কারও সেখানে বসার অধিকার আছে। হাঁ, এরূপ জায়গায় কারও বসাটা যদি পরিচিত হয়, অর্থাৎ সকলে জানে যে সেই ব্যক্তি সাধারণত সেখানেই বসে এবং সেখানে বসে দীনের বিশেষ কোনও কাজ করে, তবে আলাদা কথা। যেমন কোনও আলেম মসজিদের কোনও এক জায়গায় বসে মানুষকে কুরআন শেখায় বা দীনের শিক্ষাদান করে, সে ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন যে, এরূপ স্থানে অন্য কেউ এসে বসে গেলে শিক্ষককে বসতে দেওয়ার জন্য তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া যাবে। এমনিভাবে বাজারের উন্মুক্ত স্থানের বিশেষ কোনও জায়গায় যদি কোনও বিক্রেতা নিয়মিত বসে মালামাল বিক্রি করে বলে জানা থাকে, তবে সে স্থানটিতেও তার অগ্রাধিকার সাব্যস্ত হয়। কাজেই কোনওদিন অন্য কেউ আগে আগে এসে সেখানে বসে গেলে তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া যাবে।

মজলিসের দ্বিতীয় আদব হল আগন্তুক ব্যক্তিকে বসার জায়গা দেওয়া। হাদীছটিতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَكِنْ تَوَسَّعُوا وَتَفَسَّحُوا
‘বরং তোমরা (আগন্তুকের জন্য) স্থান প্রশস্ত করে দাও ও জায়গা ফাঁকা করে দাও'।
অর্থাৎ মজলিসে যে ব্যক্তি পরে আসে সে যদি বসার জায়গা না পায়, তখন মজলিসের অন্য সকলের কর্তব্য নিজেরা সরে বসে তার জন্য জায়গা করে দেওয়া। তাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে না। তাতে আগন্তুক অপমানিত বোধ করবে ও অপ্রস্তুত হয়ে যাবে। এটা ভদ্রতার পরিপন্থি। নিজেরা সরে তাকে বসতে দেওয়ার দ্বারা তার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করা হয়। আর এভাবে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার বীজ বুনে যায়।

আগন্তুককে বসতে দেওয়ার জন্য যখন অন্যদেরকে সরে বসতে বলা হবে, তখন সরে বসা তাদের কর্তব্য হয়ে যাবে। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي الْمَجْلِسِ فَأَفْسَحُوْا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ
হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে যখন বলা হয় মজলিসে অন্যদের জন্য স্থান সংকুলান করে দাও, তখন স্থান সংকুলান করে দিয়ো, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্থান সংকুলান করে দেবেন। (সূরা মুজাদালা, আয়াত ১১)
অর্থাৎ এরূপ যারা করবে, তাদের প্রতি অন্যদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার হবে। ফলে তারাও তাদের সঙ্গে এরূপ সম্মানজনক ব্যবহার করবে। এরূপ লোক যেখানেই যাবে, সেখানেই সাদর অভ্যর্থনা পাবে। আখিরাতেও আল্লাহ তা'আলা এরূপ ব্যক্তিকে নিজ রহমতের ছায়ায় জায়গা দেবেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি তাঁকে বসতে দেওয়ার জন্য নিজ জায়গা ছেড়ে দিত, তবে সেখানে তিনি বসতেন না। এটা ছিল তাঁর অধিকতর তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পরিচায়ক। তিনি আশঙ্কাবোধ করতেন, না জানি সেখানে বসলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদেশ অমান্য করা হয়। হযরত আবূ বাকরা রাযি.-এর নীতিও এরকমই ছিল। এ নীতির স্বপক্ষে হাদীছও পাওয়া যায়। যেমন একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. একটি মজলিসে আসলেন। তাঁকে দেখে এক ব্যক্তি নিজ জায়গা থেকে উঠে গেল। কিন্তু তিনি সেখানে বসলেন না। অন্য এক জায়গায় বসলেন। সে ব্যক্তি বলল, এখানে বসাতে আপনার কী সমস্যা ছিল? তিনি বললেন, আমি তোমার বসার স্থানে বা অন্য কারও বসার স্থানে কিছুতেই বসার নই। কারণ আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন সেখানে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলে অপর এক ব্যক্তি তার জন্য নিজ জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। আগন্তুক ব্যক্তি সেখানে বসতে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করে দেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮২৮; মুসনাদে আহমাদ: ৫৫৬৭; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২০৬২)

এটা ভিন্ন কথা যে, মর্যাদাবান লোক বিশেষত আল্লাহওয়ালা ও পরহেযগার ব্যক্তি আসলে উপস্থিত লোকেরা তার বসার জন্য নিজেদের জায়গা ছেড়ে দেবে। এমনিভাবে পিতার জন্য পুত্র, উস্তাযের জন্য ছাত্র, বড় ভাইয়ের জন্য ছোট ভাই এবং যে-কোনও বয়োজ্যেষ্ঠের জন্য কনিষ্ঠ ব্যক্তির কর্তব্য নিজ আসন ছেড়ে দেওয়া। এটা বড়দের প্রতি ছোটদের আদব। অতঃপর সেখানে বসা বা না বসা সেই বড় বা বুযুর্গের এখতিয়ার।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিজে বসার জন্য অন্যকে তার স্থান থেকে উঠিয়ে দেওয়া জায়েয নয়।

খ. মজলিসে উপস্থিত লোকদের কর্তব্য আগন্তুক ব্যক্তিকে সাদর সংবর্ধনা জানানো ও তার বসার জন্য জায়গা করে দেওয়া।

গ. কেউ যদি অন্যের বসার জন্য নিজ স্থান ছেড়ে দেয়, তবে তা উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে সেখানে বসা না বসা আগন্তুকের ইচ্ছা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২৭৪৯ | মুসলিম বাংলা