আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৭. কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ

হাদীস নং: ২৫১০
আন্তর্জাতিক নং: ২৫১০
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
২৫১২. সুফিয়ান ইবনে ওয়াকী (রাহঃ) ..... যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ পূর্ববর্তী জাতিসমূহের রোগব্যাধি তোমাদের কাছেও এসে পৌঁছেছে। তা হল হিংসা ও বিদ্বেষ। এ হল মুণ্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা চুল মুণ্ডন করে বরং তা দ্বীনকে মুণ্ডন (ধ্বংস) করে দেয়। যাঁর হাতে প্রাণ সে সত্তার কসম, তোমরা মু‘মিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে দাখেল হতে পারবে না। আর তোমরা মু‘মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবেসেছ। এই ভালবাসা কেমন করে সুদৃঢ় হয় তা তোমাদের বলব কি? তা হল পরস্পর সালামের প্রসার ঘটাও।
بَابٌ
حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، عَنْ حَرْبِ بْنِ شَدَّادٍ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ يَعِيشَ بْنِ الْوَلِيدِ، أَنَّ مَوْلَى الزُّبَيْرِ، حَدَّثَهُ أَنَّ الزُّبَيْرَ بْنَ الْعَوَّامِ حَدَّثَهُ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ لاَ أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ قَدِ اخْتَلَفُوا فِي رِوَايَتِهِ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ فَرَوَى بَعْضُهُمْ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ يَعِيشَ بْنِ الْوَلِيدِ عَنْ مَوْلَى الزُّبَيْرِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَلَمْ يَذْكُرُوا فِيهِ عَنِ الزُّبَيْرِ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ জানাচ্ছে, জান্নাত লাভ করতে হলে ঈমানের অধিকারী হতে হবে। মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতেও এটা স্পষ্ট করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ

‘নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অহংকারের সাথে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের জন্য আকাশের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। এভাবেই আমি অপরাধীদেরকে (তাদের কৃতকর্মের) বদলা দিই।২৮৯

আরও ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (81) وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

‘যেসব লোক পাপ কামায় এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে ফেলে, তারাই জাহান্নামবাসী । তারা সর্বদা সেখানে থাকবে। যেসব লোক ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে।২৯০

ঈমানের বিভিন্ন স্তর আছে। সর্বনিম্ন স্তর হলো কুফর ও শিরকী আকীদা-বিশ্বাস পরিহার করা এবং যে সমস্ত কর্মকাণ্ড শিরক ও কুফরের পরিচয় বহন করে তা থেকে বিরত থাকা। তারপর কবীরা গুনাহসমূহ পরিত্যাগ করা ঈমানের পরবর্তী স্তর। ঈমান আনার পরও যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহে লিপ্ত থাকে, সে ফাসিক ও পাপী নামে অভিহিত হয়। কোনও মুমিন ব্যক্তির ফাসিক নামে অভিহিত হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ

‘ঈমানের পর ফাসিকী নাম যুক্ত হওয়া বড় খারাপ কথা।২৯১
কবীরা গুনাহ ছাড়ার পাশাপাশি সগীরা গুনাহও পরিহার করে চলা ঈমানের উচ্চতর ধাপ। প্রত্যেক মুমিনের এ ধাপে অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা থাকা উচিত।
এ হাদীছে জানানো হয়েছে, একে অন্যকে মহব্বত না করলে মুমিন হওয়া যায় না। তার মানে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়া যায় না। কেননা একে অন্যকে ভালো না বাসলে পারস্পরিক হক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যের হক নষ্ট করা কবীরা গুনাহ। অন্যের হক তিন প্রকার- জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। যার অন্তরে অন্যের প্রতি মহব্বত নেই, সে কোনও না কোনওভাবে অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে ফেলে। এরূপ ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয়। এক হাদীছে আছে—

وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ» قِيلَ: وَمَنْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: الَّذِي لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ

‘আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। আল্লাহর কসম! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, কে ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।২৯২

কারও অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকবে কেবল তখনই, যখন উভয়ের মধ্যে মহব্বত ও সুসম্পর্ক থাকবে। এর অর্থ দাঁড়াল, পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার জন্য পরস্পরের মধ্যে মহব্বত তৈরি করা জরুরি। সুতরাং হাদীছে ইরশাদ করা হয়েছে-

وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا (আর তোমরা মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাস)। কাজেই প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার লক্ষ্যে অন্যান্য মুমিনদের প্রতি অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করা। অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টির বিভিন্ন উপায় আছে। তার মধ্যে একটি হলো বেশি বেশি সালাম দেওয়া। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সে নির্দেশনাই দান করেছেন। তিনি বলেন-

أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ (তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও)। পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টির প্রথম উপায় সালাম দেওয়া। এর দ্বারা প্রথমত অপরিচিতির জড়তা দূর হয়। তারপর যত সালাম বিনিময় হয় ততই একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, তারপর একে অন্যের বন্ধুতে পরিণত হয়।

সালাম ইসলামী অভিবাদনের এক বৈশিষ্ট্যময় রীতি। এটা ইসলামের নিদর্শন। এর দ্বারা সালামদাতা ও গ্রহীতার মুসলিম পরিচয় প্রকাশ পায়। এটা আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনেরও এক উত্তম ব্যবস্থা। সালাম দেওয়ার দ্বারা অহমিকা দূর হয় এবং অন্তরে বিনয় সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা ছোট'র প্রতি স্নেহ-মমতার প্রকাশ ঘটে এবং বড়'র প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হয়। তাই এ হাদীছে বেশি বেশি সালাম দেওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে। সমাজে সালামের প্রসার ঘটানো ও এর রেওয়াজদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাত লাভের জন্য মুমিন হওয়া শর্ত। মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।

খ. আল্লাহর জন্য একে অন্যকে ভালোবাসলে ঈমানে পরিপূর্ণতা আসে।

গ. পরস্পরের মধ্যে বেশি বেশি সালাম বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে তোলা চাই। কেননা বেশি বেশি সালাম দেওয়ার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।

২৮৯. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৪০

২৯০. সূরা বাকারা (২), আয়াত ৮১- ৮২

২৯১. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১১

২৯২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৫৪২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৪৩২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮২৫০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯১১৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২০৩০
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান