আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
৩৭. কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ
হাদীস নং: ২৪৮১
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৮১
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
২৪৮৩. আব্বাস ইবনে মুহাম্মাদ দূরী (রাহঃ) ...... সাহল ইবনে মুআয ইবনে আনাস যুহানী তার পিতা মুআয ইবনে আনাস যুহানী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিনয়ে মূল্যবান পোশাক পরা পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন সকল সৃষ্টির সম্মুখে তাকে ডাকবেন এবং ঈমানদারদের যে কোন লেবাস তিনি পরিধান করতে চান তাকে পরিধান করার ইখতিয়ার দেওয়া হবে।
بَابٌ
حَدَّثَنَا عَبَّاسُ بْنُ مُحَمَّدٍ الدُّورِيُّ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يَزِيدَ الْمُقْرِئُ، حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ أَبِي أَيُّوبَ، عَنْ أَبِي مَرْحُومٍ عَبْدِ الرَّحِيمِ بْنِ مَيْمُونٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذِ بْنِ أَنَسٍ الْجُهَنِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسِ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَىِّ حُلَلِ الإِيمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا " . هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ . وَمَعْنَى قَوْلِهِ " حُلَلِ الإِيمَانِ " . يَعْنِي مَا يُعْطَى أَهْلُ الإِيمَانِ مِنْ حُلَلِ الْجَنَّةِ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে পোশাকের ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েও এবং যে ব্যক্তি পোশাকে বিনয় অবলম্বন করে তার ফযীলত তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من ترك اللباس تواضعا لله, وهو يقدر عليه
'যে ব্যক্তি (উচ্চমানের) পোশাক পরিধানের সামর্থ্য রাখা সত্ত্বেও আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের লক্ষ্যে তা পরিহার করে’। পোশাকে বিনয় অবলম্বন করার অর্থ দামি পোশাক পরিধানের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানের পোশাক পরিধান করা। সামর্থ্যবান ব্যক্তির সাধারণ পোশাক পরিধানের কারণ হতে পারে দু'টি- কৃপণতা ও বিনয়। কৃপণতা একটি নিন্দনীয় স্বভাব। কাজেই কোনও সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি কৃপণতার কারণে সাধারণ পোশাক পরিধান করে, তবে তা আদৌ প্রশংসনীয় হবে না। আখিরাতে এর জন্য কোনও ফযীলত নেই। সে ফযীলত পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন এরূপ পোশাক পরিধান করা হবে বিনয়ের কারণে। তবে সে ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় হল পোশাকে বিনয় অবলম্বন করা হচ্ছে কী উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য কি মানুষকে দেখানো যে, লোকে বলবে- এ লোকটি কতইনা বিনয়ী, সে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেমন গরিবানা পোশাক পরছে! মানুষকে দেখানোর এ মানসিকতারে 'রিয়া' বলা হয়। রিয়ার সঙ্গে আমল করার দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না। বরং তাতে গুনাহ হয়। কাজেই বিনয়ও হতে হবে আল্লাহ তা'আলার জন্যই। তাই হাদীছে বলা হয়েছে- تواضعًا للهِ (আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের লক্ষ্যে)। আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের অর্থ আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বন করা। এরূপ বিনয়ের ভিত্তি হয়ে থাকে দু'টি দৃষ্টিভঙ্গির উপর। এক তো মহান আল্লাহর সামনে নিজ ক্ষুদ্রতা ও নিজ আমল-আখলাকের কমতিকে বিবেচনায় রাখা। চিন্তা করা যে, আমি সর্বক্ষণ আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টির সামনে আছি। তিনি আমার ভেতর-বাহির সব জানেন। হাজারও পাপ-পঙ্কিলতায় আমি আচ্ছন্ন। আমার ত্রুটি ও অক্ষমতার কোনও শেষ নেই। এ অবস্থায় আল্লাহর সামনে পোশাকের বাবুগিরি আমার সাজে কি? দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ এরকম যে, আমার চোখের সামনে আল্লাহর কত বান্দা অতি সাধারণ বা ছেঁড়াফাড়া কাপড় পরিধান করছে। তাদের ভালো পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। কোনওমতে লজ্জা নিবারণ করে দিন কাটাচ্ছে। তাদের সামনে দামি পোশাক পরে বেড়ানো আমার সাজে কি? এমনিই তাদের অন্তরে অভাব-অনটনের কষ্ট। তাদের সামনে পোশাকের বিলাসিতা দেখানোর দ্বারা সে কষ্ট কি আরও বাড়িয়েই দেওয়া হয় না? এরূপ চিন্তা-ভাবনা থেকে যখন সাদামাটা পোশাক পরিধান করা হয় আর এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুটি হাসিল করা উদ্দেশ্য হয়, তখন এটা আল্লাহর জন্য বিনয় বলে সাব্যস্ত হবে। পোশাকের ক্ষেত্রে এ বিনয় ঈমানেরও অঙ্গ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ألا تسمعون, ألا تسمعون, إن البذاذة من الإيمان, إن البذاذة من الإيمان
তোমরা কি শুনছ না, তোমরা কি শুনছ না, নিশ্চয়ই বাযাযা (البذاذة = কৃচ্ছ্রতা) ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, নিশ্চয়ই বাযাযা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।
(সুনানে আবু দাউদ: ৪১৬১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১১৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৩৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৭৮৯: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬০৫১; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩১৫৫)
البذاذة এর অর্থ জীবনযাপনে সাদামাটা থাকা। অর্থাৎ পানাহার, পোশাক-আশাক ও ঘর-বাড়ির ক্ষেত্রে যতটুকু না হলেই নয় ততটুকুতে ক্ষান্ত ও সন্তুষ্ট থাকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সাদামাটা পোশাক পরতেই পসন্দ করতেন। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. বর্ণনা করেন-
أَخْرَجَتْ لَنَا عَائِشَةُ كِسَاء وَإِزَارا غَلِيظا ، قَالَتْ : قُبِضَ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ فِي هَذَيْنِ
'উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. আমাদের সামনে একটি কম্বল ও একটি মোটা লুঙ্গি বের করলেন। তারপর বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি পরিহিত অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন।
(সহীহ বুখারী: ৫৮১৮; সহীহ মুসলিম: ২০৮০; জামে তিরমিযী: ১৭৩৩; সুনানে আবু দাউদ:৪০৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ২৪০৩৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৬২৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা:৪৪৩২; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৫৭৫৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩০৯৫)
হযরত উমর রাযি, যখন মুসলিম জাহানের খলীফা, তখনও তাঁকে অনেকগুলি তালিযুক্ত কাপড় পরিহিত অবস্থায় খুতবা দিতে দেখা গেছে। খলীফা অবস্থায় হযরত আলী রাযি.-এর পোশাকেও অনেকগুলো তালি লক্ষ করা গেছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাবে-তাবি'ঈনের জীবনে এরূপ কৃচ্ছ্রতার বহু নিদর্শন মেলে। এটা ছিল তাদের বিনয়।
হাদীছটিতে এরূপ বিনয়ীর ফযীলত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- دعاه الله يوم القيامة على رؤوس الخلائق, حتى يخيره من أي حلل الإيمان شاء يلبسها কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে ডাকবেন এবং তাকে ঈমানের পোশাকসমূহ থেকে যেটি ইচ্ছা পরিধান করার এখতিয়ার দেবেন’। অর্থাৎ সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে প্রদর্শন করবেন। যেন বলা হবে- দেখো তোমরা আমার এ বান্দাকে। দুনিয়ায় তার সামর্থ্যের কোনও কমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও সে কেবল আমারই জন্য বিলাসিতা ত্যাগ করেছে। কেবল আমার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই দামি পোশাক পরিহার করে সাদামাটা পোশাক পরিধান করেছে।
প্রকাশ থাকে যে, বিনয় কথাবার্তা ও আচার-আচরণেও হয়ে থাকে। কিন্তু সে তুলনায় পোশাকের ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বন অনেক বেশি কঠিন। কারণ কথাবার্তাও আচার-আচরণ ক্ষণিকের বিষয়। তা সংঘটিত হয় আর অমনি শেষ হয়ে যায়। পরক্ষণে তা দেখা যায় না। কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে বিনয় স্থায়ী। তা শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। যতক্ষণ শরীরে পোশাক থাকে, ততক্ষণ বিনয়ও থাকে। এ বিনয়ে দীর্ঘক্ষণ মানুষের সামনে সাদামাটা অবস্থা বজায় রাখতে হয়। এতে মনের উপর অনেক চাপ পড়ে। লজ্জা-সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে বাধা উপেক্ষা করে এবং মনের সঙ্গে জিহাদ করে এ বিনয় রক্ষা করতে হয়। তাই এর প্রতিদানও অনেক বড়। কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলা সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে প্রদর্শন করিয়ে এখতিয়ার দেবেন যে, তুমি ঈমানের যে পোশাক চাও পরিধান করো।
ঈমানের পোশাক মানে যে পোশাক ঈমানের ফসল। ঈমানের দাবি অনুযায়ী চলার পুরস্কারস্বরূপ যে পোশাক আখিরাতে দান করা হবে। অথবা ঈমানের পোশাক বলে ঈমানদারদের পোশাক বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ঈমানদারগণ জান্নাতে যে পোশাক পরিধান করবে। উভয় অর্থ অনুযায়ী ঈমানের পোশাক হল জান্নাতের পোশাক। বিনয়ী ব্যক্তিকে বলা হবে- তুমি বিনয়বশত দুনিয়ার যে দামি দামি পোশাক পরিধান করা হতে বিরত থেকেছিলে, তার পুরস্কারস্বরূপ আজ জান্নাতের বহুমূল্য পোশাক থেকে তোমার যা পসন্দ তা পরিধান করো। সেখানে তার পসন্দমতো পোশাক বেছে নেওয়াতে কোনও বাধা থাকবে না। দুনিয়ার মতো নয় যে, নিজ রুচি অনুযায়ী যে পোশাক পসন্দ, তা সামর্থ্যের অতীত হলে পরিধান করা যায় না। জান্নাতের সমস্ত নি'আমত অবারিত। যত উচ্চরুচিই হোক, সে অনুযায়ী সবকিছুই সেখানে পাওয়া যাবে।
বিনয়ের পোশাক পরিধান করার এ ফযীলত দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় যে, অহংকারের পোশাক পরিধান করা নিন্দনীয়। অহংকার করা কঠিন পাপ। কাজেই যে পোশাক দ্বারা অহংকার প্রকাশ পায় তা অবশ্যই বর্জনীয়। এক হাদীছে স্পষ্টভাবে এর গুরুতরতা তুলে ধরা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِي الدُّنْيَا أَلْبَسَهُ اللَّهُ ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি দুনিয়ায় নামডাকের পোশাক পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।
(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৬০৬; সুনানে আবু দাউদ: ৪০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৬২; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৯৭৯; মুসনাদু ইবনিল জা'দ: ২১৪৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৫৬৯৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৮১৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩১১৬)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
مَنْ لَبِسَ رِدَاءَ شُهْرَةٍ، أَوْ ثَوْبَ شُهْرَةٍ أَلْبَسَهُ اللَّهُ نَارًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি নামডাকের চাদর বা পোশাক পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে আগুনের পোশাক পরাবেন।
(মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫২৬৬)
কারুনের পরিণতি তো সকলেরই জানা। সে তার দামি পোশাকে সজ্জিত হয়ে অহমিকার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছিল। পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান-
بينما رجل يتبختر، يمشي في برديه قد أعجبته نفسه، فخسف الله به الأرض، فهو يتجلجل فيها إلى يوم القيامة
এক ব্যক্তি তার একজোড়া পোশাকে সজ্জিত হয়ে দর্পের সঙ্গে হাঁটছিল। সে আপনাতে আপনি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। সে কিয়ামত পর্যন্ত মাটির ভেতর ধসে যেতে থাকবে।
(সহীহ মুসলিম: ২০৮৮; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৯১; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৩৩৪)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
পোশাকের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যাতে তাতে বিনয়ের ছাপ থাকে এবং কিছুতেই তা দ্বারা অহংকার প্রকাশ না পায়।
من ترك اللباس تواضعا لله, وهو يقدر عليه
'যে ব্যক্তি (উচ্চমানের) পোশাক পরিধানের সামর্থ্য রাখা সত্ত্বেও আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের লক্ষ্যে তা পরিহার করে’। পোশাকে বিনয় অবলম্বন করার অর্থ দামি পোশাক পরিধানের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানের পোশাক পরিধান করা। সামর্থ্যবান ব্যক্তির সাধারণ পোশাক পরিধানের কারণ হতে পারে দু'টি- কৃপণতা ও বিনয়। কৃপণতা একটি নিন্দনীয় স্বভাব। কাজেই কোনও সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি কৃপণতার কারণে সাধারণ পোশাক পরিধান করে, তবে তা আদৌ প্রশংসনীয় হবে না। আখিরাতে এর জন্য কোনও ফযীলত নেই। সে ফযীলত পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন এরূপ পোশাক পরিধান করা হবে বিনয়ের কারণে। তবে সে ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় হল পোশাকে বিনয় অবলম্বন করা হচ্ছে কী উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য কি মানুষকে দেখানো যে, লোকে বলবে- এ লোকটি কতইনা বিনয়ী, সে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেমন গরিবানা পোশাক পরছে! মানুষকে দেখানোর এ মানসিকতারে 'রিয়া' বলা হয়। রিয়ার সঙ্গে আমল করার দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না। বরং তাতে গুনাহ হয়। কাজেই বিনয়ও হতে হবে আল্লাহ তা'আলার জন্যই। তাই হাদীছে বলা হয়েছে- تواضعًا للهِ (আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের লক্ষ্যে)। আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বনের অর্থ আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বন করা। এরূপ বিনয়ের ভিত্তি হয়ে থাকে দু'টি দৃষ্টিভঙ্গির উপর। এক তো মহান আল্লাহর সামনে নিজ ক্ষুদ্রতা ও নিজ আমল-আখলাকের কমতিকে বিবেচনায় রাখা। চিন্তা করা যে, আমি সর্বক্ষণ আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টির সামনে আছি। তিনি আমার ভেতর-বাহির সব জানেন। হাজারও পাপ-পঙ্কিলতায় আমি আচ্ছন্ন। আমার ত্রুটি ও অক্ষমতার কোনও শেষ নেই। এ অবস্থায় আল্লাহর সামনে পোশাকের বাবুগিরি আমার সাজে কি? দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ এরকম যে, আমার চোখের সামনে আল্লাহর কত বান্দা অতি সাধারণ বা ছেঁড়াফাড়া কাপড় পরিধান করছে। তাদের ভালো পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। কোনওমতে লজ্জা নিবারণ করে দিন কাটাচ্ছে। তাদের সামনে দামি পোশাক পরে বেড়ানো আমার সাজে কি? এমনিই তাদের অন্তরে অভাব-অনটনের কষ্ট। তাদের সামনে পোশাকের বিলাসিতা দেখানোর দ্বারা সে কষ্ট কি আরও বাড়িয়েই দেওয়া হয় না? এরূপ চিন্তা-ভাবনা থেকে যখন সাদামাটা পোশাক পরিধান করা হয় আর এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুটি হাসিল করা উদ্দেশ্য হয়, তখন এটা আল্লাহর জন্য বিনয় বলে সাব্যস্ত হবে। পোশাকের ক্ষেত্রে এ বিনয় ঈমানেরও অঙ্গ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ألا تسمعون, ألا تسمعون, إن البذاذة من الإيمان, إن البذاذة من الإيمان
তোমরা কি শুনছ না, তোমরা কি শুনছ না, নিশ্চয়ই বাযাযা (البذاذة = কৃচ্ছ্রতা) ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, নিশ্চয়ই বাযাযা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।
(সুনানে আবু দাউদ: ৪১৬১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১১৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৩৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৭৮৯: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬০৫১; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩১৫৫)
البذاذة এর অর্থ জীবনযাপনে সাদামাটা থাকা। অর্থাৎ পানাহার, পোশাক-আশাক ও ঘর-বাড়ির ক্ষেত্রে যতটুকু না হলেই নয় ততটুকুতে ক্ষান্ত ও সন্তুষ্ট থাকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সাদামাটা পোশাক পরতেই পসন্দ করতেন। হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. বর্ণনা করেন-
أَخْرَجَتْ لَنَا عَائِشَةُ كِسَاء وَإِزَارا غَلِيظا ، قَالَتْ : قُبِضَ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ فِي هَذَيْنِ
'উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. আমাদের সামনে একটি কম্বল ও একটি মোটা লুঙ্গি বের করলেন। তারপর বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি পরিহিত অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন।
(সহীহ বুখারী: ৫৮১৮; সহীহ মুসলিম: ২০৮০; জামে তিরমিযী: ১৭৩৩; সুনানে আবু দাউদ:৪০৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ২৪০৩৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ৬৬২৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা:৪৪৩২; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৫৭৫৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩০৯৫)
হযরত উমর রাযি, যখন মুসলিম জাহানের খলীফা, তখনও তাঁকে অনেকগুলি তালিযুক্ত কাপড় পরিহিত অবস্থায় খুতবা দিতে দেখা গেছে। খলীফা অবস্থায় হযরত আলী রাযি.-এর পোশাকেও অনেকগুলো তালি লক্ষ করা গেছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন ও তাবে-তাবি'ঈনের জীবনে এরূপ কৃচ্ছ্রতার বহু নিদর্শন মেলে। এটা ছিল তাদের বিনয়।
হাদীছটিতে এরূপ বিনয়ীর ফযীলত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- دعاه الله يوم القيامة على رؤوس الخلائق, حتى يخيره من أي حلل الإيمان شاء يلبسها কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে ডাকবেন এবং তাকে ঈমানের পোশাকসমূহ থেকে যেটি ইচ্ছা পরিধান করার এখতিয়ার দেবেন’। অর্থাৎ সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে প্রদর্শন করবেন। যেন বলা হবে- দেখো তোমরা আমার এ বান্দাকে। দুনিয়ায় তার সামর্থ্যের কোনও কমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও সে কেবল আমারই জন্য বিলাসিতা ত্যাগ করেছে। কেবল আমার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই দামি পোশাক পরিহার করে সাদামাটা পোশাক পরিধান করেছে।
প্রকাশ থাকে যে, বিনয় কথাবার্তা ও আচার-আচরণেও হয়ে থাকে। কিন্তু সে তুলনায় পোশাকের ক্ষেত্রে বিনয় অবলম্বন অনেক বেশি কঠিন। কারণ কথাবার্তাও আচার-আচরণ ক্ষণিকের বিষয়। তা সংঘটিত হয় আর অমনি শেষ হয়ে যায়। পরক্ষণে তা দেখা যায় না। কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে বিনয় স্থায়ী। তা শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। যতক্ষণ শরীরে পোশাক থাকে, ততক্ষণ বিনয়ও থাকে। এ বিনয়ে দীর্ঘক্ষণ মানুষের সামনে সাদামাটা অবস্থা বজায় রাখতে হয়। এতে মনের উপর অনেক চাপ পড়ে। লজ্জা-সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে বাধা উপেক্ষা করে এবং মনের সঙ্গে জিহাদ করে এ বিনয় রক্ষা করতে হয়। তাই এর প্রতিদানও অনেক বড়। কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলা সমস্ত মাখলুকের সামনে তাকে প্রদর্শন করিয়ে এখতিয়ার দেবেন যে, তুমি ঈমানের যে পোশাক চাও পরিধান করো।
ঈমানের পোশাক মানে যে পোশাক ঈমানের ফসল। ঈমানের দাবি অনুযায়ী চলার পুরস্কারস্বরূপ যে পোশাক আখিরাতে দান করা হবে। অথবা ঈমানের পোশাক বলে ঈমানদারদের পোশাক বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ঈমানদারগণ জান্নাতে যে পোশাক পরিধান করবে। উভয় অর্থ অনুযায়ী ঈমানের পোশাক হল জান্নাতের পোশাক। বিনয়ী ব্যক্তিকে বলা হবে- তুমি বিনয়বশত দুনিয়ার যে দামি দামি পোশাক পরিধান করা হতে বিরত থেকেছিলে, তার পুরস্কারস্বরূপ আজ জান্নাতের বহুমূল্য পোশাক থেকে তোমার যা পসন্দ তা পরিধান করো। সেখানে তার পসন্দমতো পোশাক বেছে নেওয়াতে কোনও বাধা থাকবে না। দুনিয়ার মতো নয় যে, নিজ রুচি অনুযায়ী যে পোশাক পসন্দ, তা সামর্থ্যের অতীত হলে পরিধান করা যায় না। জান্নাতের সমস্ত নি'আমত অবারিত। যত উচ্চরুচিই হোক, সে অনুযায়ী সবকিছুই সেখানে পাওয়া যাবে।
বিনয়ের পোশাক পরিধান করার এ ফযীলত দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় যে, অহংকারের পোশাক পরিধান করা নিন্দনীয়। অহংকার করা কঠিন পাপ। কাজেই যে পোশাক দ্বারা অহংকার প্রকাশ পায় তা অবশ্যই বর্জনীয়। এক হাদীছে স্পষ্টভাবে এর গুরুতরতা তুলে ধরা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِي الدُّنْيَا أَلْبَسَهُ اللَّهُ ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি দুনিয়ায় নামডাকের পোশাক পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।
(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৬০৬; সুনানে আবু দাউদ: ৪০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৬২; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৯৭৯; মুসনাদু ইবনিল জা'দ: ২১৪৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৫৬৯৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৮১৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩১১৬)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
مَنْ لَبِسَ رِدَاءَ شُهْرَةٍ، أَوْ ثَوْبَ شُهْرَةٍ أَلْبَسَهُ اللَّهُ نَارًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি নামডাকের চাদর বা পোশাক পরবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে আগুনের পোশাক পরাবেন।
(মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫২৬৬)
কারুনের পরিণতি তো সকলেরই জানা। সে তার দামি পোশাকে সজ্জিত হয়ে অহমিকার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছিল। পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান-
بينما رجل يتبختر، يمشي في برديه قد أعجبته نفسه، فخسف الله به الأرض، فهو يتجلجل فيها إلى يوم القيامة
এক ব্যক্তি তার একজোড়া পোশাকে সজ্জিত হয়ে দর্পের সঙ্গে হাঁটছিল। সে আপনাতে আপনি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। সে কিয়ামত পর্যন্ত মাটির ভেতর ধসে যেতে থাকবে।
(সহীহ মুসলিম: ২০৮৮; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৫৯১; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৬৩৩৪)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
পোশাকের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যাতে তাতে বিনয়ের ছাপ থাকে এবং কিছুতেই তা দ্বারা অহংকার প্রকাশ না পায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: