আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৪৫৫
২০৪৭. বনী ইসরাইলের ঘটনাবলীর বিবরণ
৩২০৯। মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) .... আবু হাযিম (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি পাঁচ বছর যাবত আবু হুরায়রা (রাযিঃ)- এর সাহচর্যে ছিলাম। তখন আমি তাঁকে নবী (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, নবী (ﷺ) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মতকে শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিসিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলিফাহ হবে। সাহাবাগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদের কি নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা একের পর এক করে তাদের বায়‘আতের হক আদায় করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন ঐ সকল বিষয় সম্বন্ধে যে সবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরাঈল সম্পর্কে বলেন- كَانَتْ بَنُو إِسْرَائِيلَ تَسُوْسُهُمُ الْأَنْبِيَاء (বনী ইসরাঈলকে নেতৃত্বদান করতেন নবীগণ)। বনী ইসরাঈল অর্থ ইসরাঈলের বংশধরগণ। ইসরাঈল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পৌত্র ইয়া'কুব ইবন ইসহাক আলাইহিস সালামের উপাধি। এর অর্থ আল্লাহর বান্দা। তাঁর বংশধরগণকে বনী ইসরাঈল বলা হয়। সাধারণত এরা ইহুদি নামে পরিচিত। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র ইসমা'ঈল আলাইহিস সালামের বংশধরগণকে বলা হয় বনী ইসমা'ঈল। এ বংশে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম হয়েছে। তিনি ছাড়া হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশে যত নবী এসেছেন তাদের সকলেরই জন্ম হয়েছে বনী ইসরাঈলে। বনী ইসরাঈলের সে নবীগণ প্রজাসাধারণের শাসনকার্যও পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ পার্থিব বিষয়াবলিতে জনগণের নেতৃত্বদানের কাজও তাদের নবুওয়াতী দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيُّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ (যখনই কোনও নবীর ওফাত হয়ে যেত, অপর নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন)। অর্থাৎ কোনও নবীর ইন্তিকালের পর যখন জনগণের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ত এবং মানুষ আল্লাহর বিধান ছেড়ে দিয়ে বিপথগামিতার শিকার হয়ে যেত, তখন আল্লাহ তা'আলা নতুন একজন নবী পাঠাতেন, যিনি তাদেরকে সত্য-সঠিক পথের দিকে ফিরিয়ে আনতেন এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান তথা তাওরাতের আইন প্রতিষ্ঠা করতেন। এর দ্বারা বোঝা গেল, সবসময়ই জনগণের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও তাদের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একজন দায়িত্বশীল নেতা থাকা প্রয়োজন। একজন নেতার অধীনে থাকা ছাড়া কোনও জনগোষ্ঠীর পক্ষে শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বনী ইসরাঈলের মধ্যে আল্লাহ তা'আলা এ ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন।
এ তো গেল বনী ইসরাঈলের কথা। তাদের নেতৃত্ব দান করতেন নবীগণ। এ উম্মতের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي (কিন্তু আমার পরে কোনও নবী নেই)। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে পরিচালনার যে দায়িত্ব তাদের নবীগণ আঞ্জাম দিতেন, আমার উম্মতের ক্ষেত্রে সেরকম হবে না। কেননা আমিই শেষনবী। আমার পরে কেউ নবী হয়ে আসবে না। তাই আমার উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব কোনও নবী আঞ্জাম দেবেন না। বরং এ দায়িত্ব পালন করবে খলীফাগণ।
খলীফা ও খেলাফত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ আছে। তা দ্বারা জানা যায়, কোনও কোনও খলীফা হবে ন্যায়পরায়ণ। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করবে। তাঁর পরে চারজন খলীফা শতভাগ তাঁর আদর্শ অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন। তাই তাদেরকে 'খুলাফায়ে রাশিদীন' বলা হয়ে থাকে। তাঁরা হলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উমর ফারুক রাযি., হযরত উছমান গনী রাযি. ও হযরত আলী রাযি.। অবশ্য হযরত হাসান রাযি.-কেও তাদের মধ্যে গণ্য করা হয়, যদিও তাঁর খেলাফতকাল ছিল অতি অল্পসময়ের- মাত্র ৭ মাস ২৬ দিনের। তাদের সম্মিলিত শাসনকাল ছিল ৩০ বছর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
خِلَافَةُ النُّبُوَّةِ ثَلَاثُوْنَ سَنَةً، ثُمَّ يُؤْتِي اللَّهُ الْمُلْكَ أَوْ مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ
নবুওয়াতের খেলাফত ৩০ বছর। তারপর আল্লাহ তাঁর রাজত্ব যাকে ইচ্ছা দান করবেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৪৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৩৪৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৪৪৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪৬৯৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৮৬৫)
পরবর্তীকালে হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর শাসনকালকেও খেলাফতে রাশেদা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তিনিও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন পুরোপুরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী।
খুলাফায়ে রাশিদীনের পর হযরত মু'আবিয়া রাযি.-ও ইসলামের রীতিনীতি অনুসারেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর শাসনকালকে খেলাফতে রাশেদার মধ্যে গণ্য করা না হলেও উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন।
তারপর বনূ উমায়্যা ও বনূ আব্বাসিয়া আমলে খেলাফতের বাগডোর যে সর্বদা ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের হাতে গিয়েছিল এমন নয়। তাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবন বিতর্কিত ছিল। তবে শাসন পরিচালনায় বিশেষত বিচারব্যবস্থায় সাধারণত শরী'আতের আইনই অনুসরণ করা হত। ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এ দুই যুগের শাসকদেরকেও খলীফা নামেই অভিহিত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, খলীফা হলেই তিনি যে ন্যায়পরায়ণও হবেন এটা অনিবার্য নয়। তবে হাঁ, খলীফায়ে রাশিদ বা নবুওয়াতী নীতিসম্মত খলীফা কেবল তাকেই বলা হবে, যার শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ইনসাফসম্মত ঐ শরী'আত মোতাবেক হবে। এ হাদীছে যেসকল খলীফা পুরোপুরি নবুওয়াতী নীতিসম্মত নয় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
وَسَيَكُوْنُ بَعْدِي خُلَفَاءُ فَيَكُثُرُونَ ‘আমার পরে আসবে খলীফাগণ। তারা (কখনও একই সময়ে) অনেকজন হবে'। অর্থাৎ একই সময়ে একাধিক ব্যক্তি খেলাফতের দাবিদার হবে। হয়তো তাদের প্রত্যেকের অনুকূলে আনুগত্যের শপথও অনুষ্ঠিত হবে। অথচ একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির খলীফা হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। একই সময়ে খলীফা হবে একজনই । দু'জন খলীফা হলে নৈরাজ্য দেখা দেওয়া অনিবার্য। সুতরাং বাস্তবিকই যদি কখনও এমন হয়, তখন জনগণের করণীয় কী? সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন-
فَما تَأْمُرُنَا؟ (সে ক্ষেত্রে আপনি আমাদের কী আদেশ করেন)? অর্থাৎ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আাপনার পর যদি একাধিক ব্যক্তি খেলাফতের দাবিদার হয় এবং তাদের মধ্যে কলহ ও বিবাদ দেখা দেয়, তখন আমাদের করণীয় কী হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَوْفُوْا ببَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ (তোমরা পর্যায়ক্রমে প্রথমজনের বায়'আতে বিশ্বস্ততা রক্ষা করবে)। অর্থাৎ সর্বপ্রথম যার বায়'আত বা যার প্রতি আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তোমরা তার আনুগত্য করবে এবং আনুগত্যের পুরোপুরি হক আদায় করবে। কোনও অবস্থায়ই তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না। তার মৃত্যুর পর যার অনুকূলে প্রথম বায়'আত সংঘটিত হবে, তোমরা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। এভাবে সব যুগে সর্বপ্রথম যার অনুকূলে বায়'আত সংঘটিত হবে, তাকেই খলীফারূপে গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, একজন খলীফার বায়'আত সংঘটিত হওয়ার পর যদি অন্য কারও অনুকূলে খেলাফতের বায়'আত গ্রহণ করা হয়, তবে প্রথমজনের বায়'আতই সঠিক বলে গণ্য হবে। জনগণের কর্তব্য কেবল তারই প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। দ্বিতীয়জনের বায়'আত বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হবে, তাতে দ্বিতীয়জনের অনুকূলে যারা বায়'আত গ্রহণ করেছে তাদের প্রথমজনের বায়'আত সম্পর্কে জানা থাকুক বা নাই থাকুক। এমনিভাবে তারা একই নগরের বাসিন্দা হোক বা অন্য নগরের।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ হাদীছ প্রমাণ করছে, যার অনুকূলে প্রথম আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছে, শাসন কেবল তারই চলবে এবং জনগণের কর্তব্য হবে তার প্রতি পুরোপুরি আনুগত্য রক্ষা করা।
যদি অপরজন প্রথমজনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, তবে তো ভালো। অন্যথায় জনগণের কর্তব্য হবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এক হাদীছে তো তাকে হত্যাই করতে বলা হয়েছে।
ثُمَّ أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ، وَاسْأَلُوا اللَّهَ الَّذِي لَكُمْ، فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ (এবং তাদেরকে তাদের হক প্রদান করবে। আর তোমাদের যা প্রাপ্য তা আল্লাহর কাছে চাইবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে যে বিষয়ে দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, সে সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন)। অর্থাৎ তোমরা তাদের আনুগত্য করো এবং তারা যা হুকুম করে তা মেনে চলো। তারা তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, আল্লাহ তা'আলাই তাদের থেকে সে হিসাব গ্রহণ করবেন।
বোঝা গেল, পার্থিব বিষয়াবলির উপর দীনী বিষয়সমূহকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাবস্থায় শাসকের হক আদায়ের হুকুম করেছেন; শাসক জনগণের হক যথাযথ আদায় করুক বা নাই করুক। শাসকের হক আদায় করার দ্বারা আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত রাখার পক্ষে সহায়তা করা হয়। অপরদিকে জনগণকে বলা হয়েছে, তারা যেন ফিতনা বিস্তার ও বিদ্রোহ করা হতে বিরত থাকে। শাসক যদি তাদের হক আদায় না করে, তবে তারা যেন আল্লাহ তা'আলার কাছেই তা প্রার্থনা করে। এর ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে হয়তো দুনিয়ায়ই জালেমের শাসন থেকে মুক্তিদান করবেন। অন্যথায় আখিরাতে তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পুরস্কারের ব্যবস্থা তো রয়েছেই।
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল, জনগণের কোনও একজন নেতা থাকা এবং সেই নেতাকর্তৃক তাদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা দীনের অংশ। সাধারণ পরিভাষায় যাকে রাষ্ট্রনীতি বা পলিটিক্স বলা হয়। আরবীতে বলা হয় সিয়াসাহ। সুতরাং যারা বলে রাষ্ট্রের সঙ্গে দীনের কোনও সম্পর্ক নেই এবং দীন ব্যক্তিগত বিষয় ও রাষ্ট্র সকলের, তাদের এ কথা সম্পূর্ণই ইসলামবিরোধী। বিচারব্যবস্থা, পৌরনীতি, অর্থনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই দীনের সম্পর্ক আছে। ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের কোনও ক্ষেত্রই ইসলামের আওতাবহির্ভূত নয়। সুতরাং ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এমন রাষ্ট্র থাকাও জরুরি, যার প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ইসলামী বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা খলীফাদের মর্যাদা উপলব্ধি করা যায়। আগের যমানায় নবীগণ দ্বারা যে কাজ নেওয়া হত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বেলায় তার একটা অংশ অর্থাৎ জনগণকে নেতৃত্বদানের কাজ খলীফাদের দ্বারা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
খ. আগের যমানায় এক নবীর পর অপর নবী তাঁর প্রতিনিধি হত। এ যমানায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্ব করবেন তাঁর খলীফাগণ।
গ. এ হাদীছ দ্বারা এটাও প্রমাণ হল যে, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনও নবী নেই।
ঘ. খলীফার কর্তব্য শরী'আত অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
ঙ. খলীফা যেহেতু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত, তাই তার একান্ত কর্তব্য নিজ আমল-আখলাকেও তাঁর পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করা।
চ. জনগণের কর্তব্য খলীফার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা।
ছ. একই সময়ে দুই খলীফা হতে পারে না।
জ. খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয নয়। তার পক্ষ থেকে কারও হক অনাদায় থেকে গেলে সে তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, খলীফাকে অমান্য করবে না।
ঝ. খলীফাকে মনে রাখতে হবে আখিরাতে তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ঞ. এ হাদীছ প্রমাণ করে, ইসলাম কেবল ব্যক্তিগত জীবনে চর্চার দীন নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে। সুতরাং ইসলামকে খণ্ডিত আকারে দেখা চলবে না। যে ব্যক্তি সেরকম করে দেখবে, সে মোটেই মুসলিম নয়।
كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيُّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ (যখনই কোনও নবীর ওফাত হয়ে যেত, অপর নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন)। অর্থাৎ কোনও নবীর ইন্তিকালের পর যখন জনগণের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ত এবং মানুষ আল্লাহর বিধান ছেড়ে দিয়ে বিপথগামিতার শিকার হয়ে যেত, তখন আল্লাহ তা'আলা নতুন একজন নবী পাঠাতেন, যিনি তাদেরকে সত্য-সঠিক পথের দিকে ফিরিয়ে আনতেন এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান তথা তাওরাতের আইন প্রতিষ্ঠা করতেন। এর দ্বারা বোঝা গেল, সবসময়ই জনগণের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও তাদের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একজন দায়িত্বশীল নেতা থাকা প্রয়োজন। একজন নেতার অধীনে থাকা ছাড়া কোনও জনগোষ্ঠীর পক্ষে শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বনী ইসরাঈলের মধ্যে আল্লাহ তা'আলা এ ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন।
এ তো গেল বনী ইসরাঈলের কথা। তাদের নেতৃত্ব দান করতেন নবীগণ। এ উম্মতের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِي (কিন্তু আমার পরে কোনও নবী নেই)। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে পরিচালনার যে দায়িত্ব তাদের নবীগণ আঞ্জাম দিতেন, আমার উম্মতের ক্ষেত্রে সেরকম হবে না। কেননা আমিই শেষনবী। আমার পরে কেউ নবী হয়ে আসবে না। তাই আমার উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব কোনও নবী আঞ্জাম দেবেন না। বরং এ দায়িত্ব পালন করবে খলীফাগণ।
খলীফা ও খেলাফত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ আছে। তা দ্বারা জানা যায়, কোনও কোনও খলীফা হবে ন্যায়পরায়ণ। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করবে। তাঁর পরে চারজন খলীফা শতভাগ তাঁর আদর্শ অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন। তাই তাদেরকে 'খুলাফায়ে রাশিদীন' বলা হয়ে থাকে। তাঁরা হলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উমর ফারুক রাযি., হযরত উছমান গনী রাযি. ও হযরত আলী রাযি.। অবশ্য হযরত হাসান রাযি.-কেও তাদের মধ্যে গণ্য করা হয়, যদিও তাঁর খেলাফতকাল ছিল অতি অল্পসময়ের- মাত্র ৭ মাস ২৬ দিনের। তাদের সম্মিলিত শাসনকাল ছিল ৩০ বছর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
خِلَافَةُ النُّبُوَّةِ ثَلَاثُوْنَ سَنَةً، ثُمَّ يُؤْتِي اللَّهُ الْمُلْكَ أَوْ مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ
নবুওয়াতের খেলাফত ৩০ বছর। তারপর আল্লাহ তাঁর রাজত্ব যাকে ইচ্ছা দান করবেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৪৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৩৪৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৪৪৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪৬৯৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৮৬৫)
পরবর্তীকালে হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয রহ.-এর শাসনকালকেও খেলাফতে রাশেদা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তিনিও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন পুরোপুরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী।
খুলাফায়ে রাশিদীনের পর হযরত মু'আবিয়া রাযি.-ও ইসলামের রীতিনীতি অনুসারেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর শাসনকালকে খেলাফতে রাশেদার মধ্যে গণ্য করা না হলেও উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন।
তারপর বনূ উমায়্যা ও বনূ আব্বাসিয়া আমলে খেলাফতের বাগডোর যে সর্বদা ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের হাতে গিয়েছিল এমন নয়। তাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবন বিতর্কিত ছিল। তবে শাসন পরিচালনায় বিশেষত বিচারব্যবস্থায় সাধারণত শরী'আতের আইনই অনুসরণ করা হত। ইতিহাস গ্রন্থসমূহে এ দুই যুগের শাসকদেরকেও খলীফা নামেই অভিহিত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, খলীফা হলেই তিনি যে ন্যায়পরায়ণও হবেন এটা অনিবার্য নয়। তবে হাঁ, খলীফায়ে রাশিদ বা নবুওয়াতী নীতিসম্মত খলীফা কেবল তাকেই বলা হবে, যার শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ইনসাফসম্মত ঐ শরী'আত মোতাবেক হবে। এ হাদীছে যেসকল খলীফা পুরোপুরি নবুওয়াতী নীতিসম্মত নয় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
وَسَيَكُوْنُ بَعْدِي خُلَفَاءُ فَيَكُثُرُونَ ‘আমার পরে আসবে খলীফাগণ। তারা (কখনও একই সময়ে) অনেকজন হবে'। অর্থাৎ একই সময়ে একাধিক ব্যক্তি খেলাফতের দাবিদার হবে। হয়তো তাদের প্রত্যেকের অনুকূলে আনুগত্যের শপথও অনুষ্ঠিত হবে। অথচ একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির খলীফা হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। একই সময়ে খলীফা হবে একজনই । দু'জন খলীফা হলে নৈরাজ্য দেখা দেওয়া অনিবার্য। সুতরাং বাস্তবিকই যদি কখনও এমন হয়, তখন জনগণের করণীয় কী? সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন-
فَما تَأْمُرُنَا؟ (সে ক্ষেত্রে আপনি আমাদের কী আদেশ করেন)? অর্থাৎ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আাপনার পর যদি একাধিক ব্যক্তি খেলাফতের দাবিদার হয় এবং তাদের মধ্যে কলহ ও বিবাদ দেখা দেয়, তখন আমাদের করণীয় কী হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَوْفُوْا ببَيْعَةِ الْأَوَّلِ فَالْأَوَّلِ (তোমরা পর্যায়ক্রমে প্রথমজনের বায়'আতে বিশ্বস্ততা রক্ষা করবে)। অর্থাৎ সর্বপ্রথম যার বায়'আত বা যার প্রতি আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তোমরা তার আনুগত্য করবে এবং আনুগত্যের পুরোপুরি হক আদায় করবে। কোনও অবস্থায়ই তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না। তার মৃত্যুর পর যার অনুকূলে প্রথম বায়'আত সংঘটিত হবে, তোমরা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। এভাবে সব যুগে সর্বপ্রথম যার অনুকূলে বায়'আত সংঘটিত হবে, তাকেই খলীফারূপে গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, একজন খলীফার বায়'আত সংঘটিত হওয়ার পর যদি অন্য কারও অনুকূলে খেলাফতের বায়'আত গ্রহণ করা হয়, তবে প্রথমজনের বায়'আতই সঠিক বলে গণ্য হবে। জনগণের কর্তব্য কেবল তারই প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। দ্বিতীয়জনের বায়'আত বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত হবে, তাতে দ্বিতীয়জনের অনুকূলে যারা বায়'আত গ্রহণ করেছে তাদের প্রথমজনের বায়'আত সম্পর্কে জানা থাকুক বা নাই থাকুক। এমনিভাবে তারা একই নগরের বাসিন্দা হোক বা অন্য নগরের।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ হাদীছ প্রমাণ করছে, যার অনুকূলে প্রথম আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছে, শাসন কেবল তারই চলবে এবং জনগণের কর্তব্য হবে তার প্রতি পুরোপুরি আনুগত্য রক্ষা করা।
যদি অপরজন প্রথমজনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, তবে তো ভালো। অন্যথায় জনগণের কর্তব্য হবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এক হাদীছে তো তাকে হত্যাই করতে বলা হয়েছে।
ثُمَّ أَعْطُوهُمْ حَقَّهُمْ، وَاسْأَلُوا اللَّهَ الَّذِي لَكُمْ، فَإِنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ (এবং তাদেরকে তাদের হক প্রদান করবে। আর তোমাদের যা প্রাপ্য তা আল্লাহর কাছে চাইবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে যে বিষয়ে দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, সে সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন)। অর্থাৎ তোমরা তাদের আনুগত্য করো এবং তারা যা হুকুম করে তা মেনে চলো। তারা তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, আল্লাহ তা'আলাই তাদের থেকে সে হিসাব গ্রহণ করবেন।
বোঝা গেল, পার্থিব বিষয়াবলির উপর দীনী বিষয়সমূহকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাবস্থায় শাসকের হক আদায়ের হুকুম করেছেন; শাসক জনগণের হক যথাযথ আদায় করুক বা নাই করুক। শাসকের হক আদায় করার দ্বারা আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত রাখার পক্ষে সহায়তা করা হয়। অপরদিকে জনগণকে বলা হয়েছে, তারা যেন ফিতনা বিস্তার ও বিদ্রোহ করা হতে বিরত থাকে। শাসক যদি তাদের হক আদায় না করে, তবে তারা যেন আল্লাহ তা'আলার কাছেই তা প্রার্থনা করে। এর ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে হয়তো দুনিয়ায়ই জালেমের শাসন থেকে মুক্তিদান করবেন। অন্যথায় আখিরাতে তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পুরস্কারের ব্যবস্থা তো রয়েছেই।
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল, জনগণের কোনও একজন নেতা থাকা এবং সেই নেতাকর্তৃক তাদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা দীনের অংশ। সাধারণ পরিভাষায় যাকে রাষ্ট্রনীতি বা পলিটিক্স বলা হয়। আরবীতে বলা হয় সিয়াসাহ। সুতরাং যারা বলে রাষ্ট্রের সঙ্গে দীনের কোনও সম্পর্ক নেই এবং দীন ব্যক্তিগত বিষয় ও রাষ্ট্র সকলের, তাদের এ কথা সম্পূর্ণই ইসলামবিরোধী। বিচারব্যবস্থা, পৌরনীতি, অর্থনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই দীনের সম্পর্ক আছে। ইসলাম এক পরিপূর্ণ দীন। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের কোনও ক্ষেত্রই ইসলামের আওতাবহির্ভূত নয়। সুতরাং ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এমন রাষ্ট্র থাকাও জরুরি, যার প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ইসলামী বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা খলীফাদের মর্যাদা উপলব্ধি করা যায়। আগের যমানায় নবীগণ দ্বারা যে কাজ নেওয়া হত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের বেলায় তার একটা অংশ অর্থাৎ জনগণকে নেতৃত্বদানের কাজ খলীফাদের দ্বারা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
খ. আগের যমানায় এক নবীর পর অপর নবী তাঁর প্রতিনিধি হত। এ যমানায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্ব করবেন তাঁর খলীফাগণ।
গ. এ হাদীছ দ্বারা এটাও প্রমাণ হল যে, হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনও নবী নেই।
ঘ. খলীফার কর্তব্য শরী'আত অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
ঙ. খলীফা যেহেতু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত, তাই তার একান্ত কর্তব্য নিজ আমল-আখলাকেও তাঁর পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করা।
চ. জনগণের কর্তব্য খলীফার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা।
ছ. একই সময়ে দুই খলীফা হতে পারে না।
জ. খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয নয়। তার পক্ষ থেকে কারও হক অনাদায় থেকে গেলে সে তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, খলীফাকে অমান্য করবে না।
ঝ. খলীফাকে মনে রাখতে হবে আখিরাতে তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ঞ. এ হাদীছ প্রমাণ করে, ইসলাম কেবল ব্যক্তিগত জীবনে চর্চার দীন নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে। সুতরাং ইসলামকে খণ্ডিত আকারে দেখা চলবে না। যে ব্যক্তি সেরকম করে দেখবে, সে মোটেই মুসলিম নয়।
