আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৭. কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ

হাদীস নং: ২৪৫০
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৫০
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
২৪৫৩. আবু বকর ইবনে আবুন নযর (রাহঃ) ..... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ভয় করে, সে সাহরীর আওয়াল ওয়াক্তে সফর করে। আর যে ব্যক্তি সওয়ারীর আওয়াল ওয়াক্তেই সফর করে সে তার মানযিলে পৌছে যায়। জেনে রাখ, আল্লাহর পন্য খুবই দামী। শোন, আল্লাহর পণ্য সামগ্রী হল জান্নাত।
بَابٌ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي النَّضْرِ، حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ، حَدَّثَنَا أَبُو عَقِيلٍ الثَّقَفِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو فَرْوَةَ، يَزِيدُ بْنُ سِنَانٍ التَّمِيمِيُّ حَدَّثَنِي بُكَيْرُ بْنُ فَيْرُوزَ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ خَافَ أَدْلَجَ وَمَنْ أَدْلَجَ بَلَغَ الْمَنْزِلَ أَلاَ إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ غَالِيَةٌ أَلاَ إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ الْجَنَّةُ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ حَدِيثِ أَبِي النَّضْرِ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আখেরাতে নাজাত লাভের পক্ষে আল্লাহভীতি যে কতটা সহায়ক, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা আমাদের তা বুঝিয়েছেন। কোনও এলাকার বাসিন্দাদের উপর রাত্রিবেলা শত্রুরা হামলা করবে বলে যদি সংবাদ পাওয়া যায়, তবে সে ক্ষেত্রে করণীয় হলো অবিলম্বে এলাকাটি ছেড়ে নিরাপদ কোনও স্থানে চলে যাওয়া। যারা এ কাজটি যত তাড়াতাড়ি করবে, তারা তত নিরাপদ থাকবে বলে আশা থাকে। যারা গড়িমসি করবে তারা নির্ঘাত শত্রুর হামলার শিকার হবে। যারা আখেরাতে মুক্তি চায়, তাদের বিষয়টিও এরকমই। শয়তান মানুষের চির শত্রু। সে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। সে শপথ করে রেখেছে-

لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ (16) ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ (17) قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَدْحُورًا لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ أَجْمَعِينَ (18

‘আমি শপথ করছি যে, আমি তাদের (অর্থাৎ মানুষের) জন্য তোমার সরল পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারপর আমি (চারওদিক থেকে) তাদের উপর হামলা করব, তাদের সম্মুখ থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকেও। আর তুমি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবে না। আল্লাহ বললেন, এখান থেকে ধিকৃত ও বিতাড়িত হয়ে বের হয়ে যা। তাদের মধ্যে যারা তোর পেছনে চলবে (তারাও তোর সঙ্গী হবে), আমি তোদের সকলকে দিয়ে জাহান্নাম ভরব।৩৯১

এহেন ঘোর শত্রুর ব্যাপারে তো অবহেলা করা চলে না। যখনই আল্লাহ তাআলার যে হুকুম পালনের সময় আসে, অবিলম্বে তা পালন করে ফেলা চাই। দেরি করলেই শয়তান হামলা করে বসবে। সে নানা প্ররোচনা দেবে। ছলচাতুরী করবে। যে করেই হোক সে আদেশ পালন থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা চালাবে। তাই গড়িমসি করা উচিত না কিছুতেই।

কেউ কেউ হাদীছটির অর্থ করেছেন এরকম যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে যেন নাফরমানি থেকে পালিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে রত হয়ে যায়।

অথবা এর অর্থ- যার মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, আল্লাহর ভয় তাকে আখেরাতের মুক্তিলাভের পথে পরিচালিত করবে। তাকে দ্রুত সৎকর্মে নিয়োজিত হতে উৎসাহ যোগাবে, পাছে কোনও বাধা এসে যায়, শয়তান কোনও প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করিয়ে দেয়।

হাদীছটির দ্বিতীয় অংশে জানানো হয়েছে, জান্নাত হলো আল্লাহর পণ্য। এ পণ্য অনেক দামী। উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হয়। সে মূল্য হলো মানুষের জান ও মাল । জান ও মালের ব্যবহার আল্লাহ তাআলার দেওয়া শরীআত মোতাবেক হলেই সে মহান মূল্যবান পণ্য অর্জিত হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (111)

‘বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়। এটা এক সত্য প্রতিশ্রুতি, যার দায়িত্ব আল্লাহ তাওরাত ও ইনজীলেও নিয়েছেন এবং কুরআনেও। আল্লাহ অপেক্ষা বেশি প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে সওদা করেছ, সেই সওদার জন্য তোমরা আনন্দিত হও এবং এটাই মহা সাফল্য।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (10) تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (11) يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (12)

‘হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে,) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটা তোমাদের পক্ষে শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। এর ফলে আল্লাহ তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন উদ্যানে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসগৃহে, যা স্থায়ী জান্নাতে অবস্থিত। এটাই মহা সাফল্য।

এসব আয়াতের সারমর্ম হলো, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভের জন্য সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়া জরুরি। তা পালন করার জন্য মুমিনদেরকে অব্যাহতভাবে জিহাদ চালিয়ে যেতে হয়। জিহাদ করতে হয় নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতসহ দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত-বন্দেগীতে নফস ও শয়তান হামেশাই বাধা দেয়। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া সে বাধা অতিক্রম করা যায় না। এটা এক কঠিন সংগ্রাম। যারা সে সংগ্রামে টিকে থাকে, তাদের পক্ষেই এসব ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হয়। অনেক সময় প্রতিবন্ধক হয় মানব শয়তানও। তখন তো সসস্ত্র সংগ্রামও অনিবার্য হয়ে যায়। সসস্ত্র সংগ্রামের দরকার হয় আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্যও। দুনিয়ার সর্বত্র আল্লাহর দীন ছড়িয়ে দেওয়া এবং মানবরচিত ধর্ম ও মতবাদের উপর তাকে জয়যুক্ত করার মেহনত চালিয়ে যাওয়াও মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এক অপরিবর্তনীয় নির্দেশ। জান্নাতের মহামূল্যবান পণ্য হস্তগত করার লক্ষ্যে এ নির্দেশ পালনে প্রস্তুত থাকাও অবশ্যকর্তব্য। পণ্য যখন সর্বাপেক্ষা দামী, তখন তা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ মূল্য তো দিতেই হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহভীতির দাবি হলো গড়িমসি ছেড়ে দিয়ে অবিলম্বে শরীআতের প্রতিটি বিধান পালন করে যাওয়া।

খ. শয়তান মানুষের চিরশত্রু। তার হামলা থেকে বাঁচতে হলে গাফলাতি ছাড়তেই হবে।

গ. জান্নাত মহামূল্যবান পুরস্কার। তা পাওয়ার জন্য আল্লাহর পথে আল্লাহর দেওয়া জান-মাল অব্যাহতভাবে খরচ করা অর্থাৎ জান-মাল সম্পর্কিত আল্লাহর যাবতীয় হুকুম পালন করা জরুরি।

৩৯১. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬-১৮

৩৯২. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১১

৩৯৩. সূরা সাফ্ফ (৬১), আয়াত ১০-১২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২৪৫০ | মুসলিম বাংলা