আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৭. কিয়ামত-মৃত্যুপরবর্তী জগতের বিবরণ

হাদীস নং: ২৪১৭
আন্তর্জাতিক নং: ২৪১৭
কিয়ামত প্রসঙ্গে।
২৪২০. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান (রাহঃ) ..... আবু বারযা আসলামী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ বান্দার পা (কিয়ামতের দিন) নড়বে না যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে তার বয়স সম্পর্কে যে, কি কাজে সে তা শেষ করেছে; তার ইলম সম্পর্কে তদনুযায়ী কি আমল করেছে সে; তার সম্পদ সম্পর্কে কোথা সে তা অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে; তার শরীর সম্পর্কে সে কিসে তা বিনাশ করেছে।
بَابٌ فِي الْقِيَامَةِ
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَخْبَرَنَا الأَسْوَدُ بْنُ عَامِرٍ، حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ عَيَّاشٍ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ جُرَيْجٍ، عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الأَسْلَمِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لاَ تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَا فَعَلَ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ " . قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَسَعِيدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ جُرَيْجٍ هُوَ بَصْرِيٌّ وَهُوَ مَوْلَى أَبِي بَرْزَةَ وَأَبُو بَرْزَةَ اسْمُهُ نَضْلَةُ بْنُ عُبَيْدٍ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাশরের ময়দানে যখন হিসাব-নিকাশের জন্য সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে, তখন তাদেরকে যেসকল বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে তার মধ্যে বিশেষ পাঁচটির কথা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো তার আয়ু।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সীমিত কালের আয়ু দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। মানুষের কর্তব্য তার সীমিত আয়ুষ্কালকে এমন আমলে খরচ করা, যা দ্বারা আখেরাত আবাদ হয়। এককথায় সে আমল হলো শরীআতের অনুসরণ। দুনিয়ার মানুষ কিভাবে জীবনযাপন করবে, সে লক্ষ্যে তাকে শরীআত দেওয়া হয়েছে। শরীআত পালন দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য করা হয়। তার খেলাফ করার দ্বারা হয় আল্লাহর নাফরমানি। আল্লাহ প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করবেন সে তার সীমিত আয়ু আল্লাহর আনুগত্যের কাজে তথা শরীআতপালনে খরচ করেছে, না তাঁর নাফরমানিতে। এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেউ নড়তে পারবে না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে আমল সম্পর্কে। আমল তো করতে হবে শরীআত অনুযায়ীই। তবে তাতেও ইখলাস থাকা জরুরি। ইখলাসবিহীন আমল গ্রহণযোগ্য নয়। ইখলাসের সঙ্গে আমল করার অর্থ কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা, দুনিয়ার কোনও স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। দুনিয়ার স্বার্থ যেমন টাকাপয়সা হতে পারে, তেমনি হতে পারে সুনাম-সুখ্যাতিও। সবটারই সারকথা লোকদেখানোর জন্য আমল করা। পরিভাষায় তাকে 'রিয়া' বলে। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করবেন, তুমি আমল করেছিলেন আমার সন্তুষ্টির জন্য, নাকি মানুষকে দেখানোর জন্য? আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য হলে তিনি পুরস্কৃত করবেন, অন্যথায় কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

তৃতীয় প্রশ্ন করা হবে অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে যে, তা হালাল পথে উপার্জন করেছিল, না হারাম পথে। আল্লাহ তাআলা অর্থ উপার্জনের জন্য কিছু রীতিনীতি বলে দিয়েছেন। কুরআন ও হাদীছে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। সে নীতি অনুযায়ী উপার্জন করা জরুরি। সে নীতি অনুযায়ী উপার্জন করলে তা ইবাদতরূপে গণ্য হয়। সে নীতি উপেক্ষা করে উপার্জন করলে তা হয় হারাম উপার্জন। হারাম উপার্জন কঠিন পাপ। যে ব্যক্তির খাবার ও পোশাক হালাল উপার্জনের নয়, তার ইবাদত কবুল হয় না। সে দুআ করলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হালাল খাবারের গুরুত্ব ও হারাম পরিহারের আবশ্যিকতা সম্পর্কে ইরশাদ করেন-

أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ} [المؤمنون: 51] وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ} [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟

‘হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাঁর রাসূলদেরকে যে বিষয়ে আদেশ করেছেন, সে বিষয়ে মুমিনদেরও আদেশ করেছেন। আল্লাহ বলেন- يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ (হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে খাবে এবং সৎকর্ম করবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, আমি সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত -সূরা মু'মিনূন : ৫১)। এবং আল্লাহ আরও বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ (হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র বস্তুসমূহ দান করেছি তা থেকে খাও -সূরা বাকারা : ১৭২)। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যে অনেক লম্বা সফর করে, চুল আলুথালু হয়ে যায়, শরীর ধুলোমলিন হয়ে যায়, এ অবস্থায় সে আসমানের দিকে দু'হাত তুলে বলে- ইয়া রাব্ব, ইয়া রাব্ব। অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম এবং যে পোশাক পরে তাও হারাম। সে হারাম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়। কিভাবে তার দুআ কবুল হবে?৩৭৮

চতুর্থ প্রশ্ন হবে তার অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে যে, সে তা কোন্ কোন্ খাতে খরচ করেছে। বৈধ খাতে, না অবৈধ খাতে। অর্থ-সম্পদের অর্জন যেমন হালাল পন্থায় হওয়া জরুরি, তেমনি তা খরচও করতে হবে বৈধ খাতে। শরীআত যেসকল ক্ষেত্রে খরচ করতে অনুমতি দিয়েছে, কেবল তাতেই খরচ করা যাবে। যেসব ক্ষেত্রে খরচের অনুমতি নেই, তাতে খরচ করা জায়েয নয়। তাতে খরচ করলে তা হবে সম্পদের অপচয়। সম্পদের অপচয় সম্পূর্ণ হারাম। কুরআন মাজীদে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। এমনিভাবে বৈধ খাতেও প্রয়োজনের বেশি খরচ করার অনুমতি নেই। সেটা অপব্যয়। ইসলাম অপব্যয় থেকেও বেঁচে থাকতে তাগিদ করেছে। এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, আমার সম্পদ যেখানে ইচ্ছা যেমন ইচ্ছা খরচ করব। কেননা সম্পদ আল্লাহর দান। তা আল্লাহর নি'আমত। এর জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা জরুরি। আল্লাহর হুকুমমত খরচ করাই তাঁর শোকর।

কোনও কোনও খাতে খরচ করা ফরয। যেমন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর খাওয়া-পরায় খরচ করা, অসচ্ছল পিতা-মাতার ভরণপোষণ দেওয়া, অভুক্তকে খাওয়ানো, যাকাত- ফিতরা আদায় করা। এমনিভাবে সম্পদের এছাড়া আরও হক আছে। তা আদায় করাও জরুরি। আল্লাহ তাআলা এ প্রশ্নও করবেন যে, যেসকল খাতে খরচ করার হুকুম দেওয়া হয়েছিল তাতে যথাযথভাবে খরচ করা হয়েছে কি না। কাজেই খরচের শরীআতসম্মত খাতসমূহ ভালোভাবে জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ খরচ করা একান্ত জরুরি।

পঞ্চম প্রশ্ন হবে শরীর সম্পর্কে যে, শরীরের শক্তি কোন্ কোন্ কাজে নিঃশেষ করা হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্যের কাজে, না নাফরমানির কাজে। শরীরের শক্তি আল্লাহ তাআলার দান। এটা অনেক বড় এক নি'আমত। এরও শোকর আদায় জরুরি। এ শক্তি ইবাদত-বন্দেগীতে খরচ করলে এবং এর দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করলে যথার্থ শোকর হয়। পক্ষান্তরে এ শক্তি যদি নাফরমানির কাজে ব্যয় করা হয়, এর দ্বারা সৃষ্টির প্রতি জুলুম-অত্যাচার করা হয়, তবে তা হবে আল্লাহর নি'আমতের চরম অকৃতজ্ঞতা। সুতরাং শরীরের শক্তিসমূহ- দৃষ্টিশক্তি, বাকশক্তি, শ্রবণশক্তিসহ যাবতীয় ইন্দ্রিয়শক্তির শরীআতসম্মত ব্যবহার একান্ত জরুরি, যাতে হাশরের ময়দানে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়।

প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তাআলার সামনে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হলে নিস্তার পাওয়া খুব সহজ হবে না। আমাদের তো কামনা এটাই যেন তিনি আমাদেরকে বিনা হিসাবে ছেড়ে দেন। বিনা হিসাবে পার পাওয়ার জন্যই আয়ু, অর্থ-সম্পদ ও ইন্দ্রিয় শক্তিসহ আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নিআমতের শরীআতসম্মত ব্যবহারের চেষ্টা থাকা জরুরি। আপন সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা হিসাব-নিকাশের কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তি দান করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেরকম চেষ্টা করার তাওফীক দান করুন। চেষ্টার মধ্যেও যে অবহেলা ও গাফলাতি করে ফেলি, তাও তিনি ক্ষমা করে দিন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল আখেরাতে হিসাব-নিকাশের একটা বিষয় আছে। আমাদেরকে এর সত্যতায় বিশ্বাস রাখতে হবে।

খ. আখেরাতে আমাদের হিসাব-নিকাশ যাতে সহজ হয়; বরং বিনা হিসাবেই যাতে মুক্তি পেতে পারি, সে লক্ষ্যে হাদীছে বর্ণিত এ পাঁচওটি বিষয়ে আমাদেরকে শরীআতের বিধি-নিষেধ পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে।

৩৭৮. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৩৪৮; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ২৭৫৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৮৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১১১৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২০২৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২৪১৭ | মুসলিম বাংলা