আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৬. যুহদ-দুনিয়া বিমুখতার বর্ণনা

হাদীস নং: ২৩৪৬
আন্তর্জাতিক নং: ২৩৪৬
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
২৩৪৯. আমর ইবনে মালিক ও মাহমুদ ইবনে খিদাশ বাগদাদী (রাহঃ) ..... সালামা ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে মিহসান খাৎমী তৎ পিতা উবাইদুল্লাহ ইবনে মিহসান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যার পরিজন নিয়ে নিরাপদে প্রভাত হয়, তার শরীর যদি হয় সুস্থ আর তার কাছে থাকে এই দিনের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির মত খাবার তবে তার জন্য সারা পৃথিবীই যেন একত্রিত হয়ে গেল।
باب
حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ مَالِكٍ وَمَحْمُودُ بْنُ خِدَاشٍ الْبَغْدَادِيُّ قَالَا حَدَّثَنَا مَرْوَانُ بْنُ مُعَاوِيَةَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي شُمَيْلَةَ الْأَنْصَارِيُّ عَنْ سَلَمَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ مِحْصَنٍ الْخَطْمِيِّ عَنْ أَبِيهِ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِي سِرْبِهِ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لَا نَعْرِفُهُ إِلَّا مِنْ حَدِيثِ مَرْوَانَ بْنِ مُعَاوِيَةَ وَحِيزَتْ جُمِعَتْ حَدَّثَنَا بِذَلِكَ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْمَعِيلَ حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ حَدَّثَنَا مَرْوَانُ بْنُ مُعَاوِيَةَ نَحْوَهُ وَفِي الْبَاب عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ তিনটি নি'আমত সম্পর্কে বলেন যে, এগুলো যদি কারও হাসিল হয়ে যায়, তবে তাকে যেন দুনিয়ার সবকিছু পরিপূর্ণরূপে দিয়ে দেওয়া হল। তাই তার কর্তব্য এ নি'আমতসমূহের কারণে আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা এবং কিছুতেই অন্যের প্রাচুর্য দেখে নিজেকে ছোট মনে না করা।

জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা
নি'আমত তিনটির প্রথমটি হল জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- من أصبح منكم آمنا في سربه (তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির ভোর হল এ অবস্থায় যে, সে নিজ ঘরে নিরাপদ)। سِرْب শব্দটি যবরযুক্ত দ্বারাও পড়া যায়, যেরযুক্ত দ্বারাও। যবর দিয়ে পড়লে অর্থ হয় ছোট ঘর, কুটির। যের দিয়ে পড়লে অর্থ হবে সভা, অন্তর। উভয় অবস্থায় বাক্যটির মর্ম একই দাঁড়ায়। মনে মনে নিরাপত্তা বোধ করা আর ঘরে নিরাপদ থাকা একই কথা। তো প্রথম নি'আমত হল ভোরবেলায় নিজ ঘরে জান, মাল ও ইজ্জতের দিক থেকে নিজেকে নিরাপদ পাওয়া। শত্রুর পক্ষ হতে এ তিনটির কোনও একটি আঘাতপ্রাপ্ত না হওয়া।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদিও সম্বোধন করেছেন মজলিসে উপস্থিত সাহাবীকে, কিন্তু বোঝানো উদ্দেশ্য উম্মতের সকলকে। তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন যে, যে-কোনও দিন সকাল বা সন্ধ্যায় তুমি যদি নিজেকে এমন দেখতে পাও যে, কোনও শত্রুর দিক থেকে না তোমার জানের উপর হামলা হয়েছে, না মালের উপর, না ইজ্জতের উপর, তবে এটা তোমার পক্ষে অনেক বড় নি'আমত। এর জন্য তুমি শোকর আদায় করো। কেননা তোমার জান বা মাল কিংবা ইজ্জত এর যে-কোনও একটি যদি শত্রুর হামলার শিকার হয়ে যায়, তবে তা মারাত্মক পেরেশানির কারণ হয়ে যায়। এ অবস্থায় জীবন বড় কঠিন মনে হয়। মনের উদ্যমতা হারিয়ে যায়। কাজকর্ম নষ্ট হয়। জীবনের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ইবাদত-বন্দেগীও ঠিকভাবে করা যায় না। এভাবে দুনিয়া ও আখিরাত সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নিরাপত্তা অনেক বড় নি'আমত। এর মূল্য উপলব্ধি করা চাই।

শারীরিক সুস্থতার মূল্য
দ্বিতীয় নি'আমত হচ্ছে শারীরিক সুস্থতা। বলা হয়েছে- مُعَافًى فِي جَسَدِه (শারীরিকভাবে সুস্থ)।
বলা হয়ে থাকে স্বাস্থ্য সুখের মূল। বস্তুত স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে, তবে অন্যসব নি'আমত তৃপ্তির সঙ্গে ভোগ-উপভোগ করা যায়। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কোনওকিছুই ভালো লাগে না। ঈমানী বলে বলীয়ান না হলে একজন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে বিপুল অর্থ-সম্পত্তি, দামি বাড়ি-গাড়ি, প্রচুর শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি সবই বৃথা মনে হয়। কেননা সে এর কোনওকিছুই কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। এ অবস্থায় অন্যসব নি'আমত তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। ফলে সেসব নি'আমতের শোকর আদায় করার কথাও সে ভুলে যায়।

অনেকে এ নি'আমতের কদর করে না। এর যথাযথ ব্যবহার করে না। স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন এর যথাযথ ব্যবহার দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ লাভ করা যায়। আবার এর অপব্যবহার দ্বারা হয়ে যায় উভয় জগতের অপূরণীয় ক্ষতি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন--
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ : الصحَّةُ وَالْفَرَاعُ.
দুটি নি'আমত এমন, যে ক্ষেত্রে বহুলোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তা হল সুস্থতা ও অবসর সময়।

বস্তুত পার্থিব যে-কোনও নি'আমত ভালো বা মন্দ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সুস্বাস্থ্যের ভিত্তিতেই। তাই আখিরাতে সর্বপ্রথম যেসকল নি'আমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, এটি তার অন্যতম। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَعْنِي الْعَبْدَ مِنَ النَّعِيمِ، أَنْ يُقَالَ لَهُ: أَلَمْ نُصح لكَ جِسْمكَ، وَنُرْوِيكَ مِنَ الْمَاءِ الْبَارِدِ
কিয়ামতের দিন বান্দাকে যেসব নিআমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তার মধ্যে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসা হবে এই যে, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি এবং ঠাণ্ডা পানি দ্বারা তোমার পিপাসা নিবারণ করিনি?

কাজেই সুস্বাস্থ্য এক বিরাট নি'আমত। এ নি'আমত কাজে লাগানো চাই এবং এর জন্য শোকর আদায় করা চাই।

প্রয়োজনীয় জীবিকা থাকার মূল্য
তৃতীয় নি'আমত হচ্ছে জীবিকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- عِنْدَهُ قُوْتُ يَوْمِهِ (তার কাছে সেই দিনের খাবার আছে)। এখানে খাবার বলতে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বোঝানো হয়েছে, যেমন খাদ্য, পানীয়, পোশাক, ওষুধ ইত্যাদি। কারও কাছে যদি বর্তমান দিনটিরও খাদ্য ও জীবিকা থাকে, সেইসঙ্গে থাকে নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য, তবে সেই দিনের জন্য সে একজন রাজাই বটে। ক্ষুধার কষ্ট সবচে বড় কষ্ট। পৃথিবীতে মানুষ যা-কিছু চেষ্টা-পরিশ্রম করে, তার বড় অংশই করা হয় ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে। ক্ষুধার কষ্টে মানুষ তার মনুষ্যত্বও হারায়। অন্যের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। হারাম খেতেও দ্বিধাবোধ করে না।

কাজেই সীমাতিরিক্ত ক্ষুধা পার্থিব কষ্ট তো বটেই, পরকালীন দুঃখ-কষ্টও অবধারিত হওয়ার কারণ। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে পানাহ চাইতেন। তাঁর একটি দু'আয় আছে-
اللهم إني أعوذ بك من الجوع، فإنَّهُ بِئْسَ الضجيع، وأعوذُ بِكَ مِنَ الخيانة فَإِنَّهَا بِئْسَتِ الْبِطَانَة
হে আল্লাহ! আপনার কাছে পানাহ চাই ক্ষুধা থেকে। কেননা ক্ষুধা নিকৃষ্ট সঙ্গী। এবং পানাহ চাই খেয়ানত থেকে। কারণ খেয়ানত নিকৃষ্ট অন্তর্বাস।

পক্ষান্তরে ক্ষুধার কষ্ট যার নেই, সে তার মানবিক গুণাবলী রক্ষায় সক্ষম হয়। সে আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে পারে। কাজেই প্রতিদিনের ক্ষুধা নিবারণের মত খাবার যার কাছে আছে, তার উচিত আল্লাহ তা'আলার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত থাকা।

সবশেষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا بِحذَافِيرِهَا (তাকে যেন দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে)। অর্থাৎ এ তিনটি নি'আমত যে পেয়ে গেল, সে যেন দুনিয়ার সবকিছু পেয়ে গেল, তাতে অন্যকিছু সে না-ই পাক। তার কর্তব্য সে দিনটি শোকরগুয়ারীর সঙ্গে কাটানো। যে মহান দাতা আল্লাহ তা'আলা তাকে এগুলো দান করেছেন, তাঁর আনুগত্যে লিপ্ত থাকা। কোনওক্রমেই তাঁর অবাধ্যতা না করা ও তাঁর যিক্‌র-স্মরণ থেকে গাফিল না হওয়া।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এক বিশাল নি'আমত।

খ. শারীরিক সুস্থতা আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় দান।

গ. প্রতিদিনের জীবিকা যার আছে, সে মস্তবড় ধনী। অন্যের কাছে হাত পাতা তার শোভা পায় না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান