আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৬. যুহদ-দুনিয়া বিমুখতার বর্ণনা

হাদীস নং: ২৩৪১
আন্তর্জাতিক নং: ২৩৪১
এতদসম্পর্কে আরো একটি অনুচ্ছেদ।
২৩৪৪. আব্দ ইবনে হুমায়দ (রাহঃ) .... উসমান ইবনে আফফান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেছেনঃ এই কয়টা বস্তু ছাড়া আর কিছুতেই আদম সন্তানের কোন হক নাইঃ একটি ঘর যাতে সে বসবাস করে, এতটুকু কাপড় যা দিয়ে সে তার সতর ঢাকে। এক টুকরা তরকারীহীন রুটি আর পানি।
باب مِنْهُ
حَدَّثَنَا عَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الصَّمَدِ بْنُ عَبْدِ الْوَارِثِ، حَدَّثَنَا حُرَيْثُ بْنُ السَّائِبِ، قَالَ سَمِعْتُ الْحَسَنَ، يَقُولُ حَدَّثَنِي حُمْرَانُ بْنُ أَبَانَ، عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لَيْسَ لاِبْنِ آدَمَ حَقٌّ فِي سِوَى هَذِهِ الْخِصَالِ بَيْتٌ يَسْكُنُهُ وَثَوْبٌ يُوَارِي عَوْرَتَهُ وَجِلْفُ الْخُبْزِ وَالْمَاءِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ وَهُوَ حَدِيثُ الْحُرَيْثِ بْنِ السَّائِبِ . وَسَمِعْتُ أَبَا دَاوُدَ سُلَيْمَانَ بْنَ سَلْمٍ الْبَلْخِيَّ يَقُولُ قَالَ النَّضْرُ بْنُ شُمَيْلٍ جِلْفُ الْخُبْزِ يَعْنِي لَيْسَ مَعَهُ إِدَامٌ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মানুষের তিনটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। তা হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। বলা হয়েছে এ তিনটি ছাড়া আর কোনওকিছুতে বনী আদমের কোনও অধিকার নেই। অধিকার বলতে এমন অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য, যা না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না। শীত ও তাপ থেকে আত্মরক্ষা, শরীর ঢাকা ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য সেগুলো তার চাই-ই চাই। বস্তুত দুনিয়ায় মাল বলতে প্রকৃতপক্ষে এগুলোকেই বোঝায়। কেউ কেউ বলেন, এগুলো যদি হালাল পন্থায় উপার্জন করা হয়, তবে সেজন্য তাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে না।

এক বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও এক রাতে বের হলেন। তিনি সঙ্গে তাঁর আযাদকৃত গোলাম আবু 'আসীবকেও নিয়ে নিলেন। তারপর যথাক্রমে আবু বকর রাযি. ও উমর রাযি.-কেও সঙ্গে নিলেন। তিনি চলতে থাকলেন। একপর্যায়ে জনৈক আনসারীর একটি বাগানে ঢুকলেন। তাকে বললেন, আমাদেরকে অপক্ক খেজুর খাওয়াও। আনসারী সাহাবী একটি খেজুরের ছড়া এনে তাঁর সামনে রাখলেন। তা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীগণ খেলেন। তারপর ঠাণ্ডা পানি আনতে বললেন। তিনি তা পান করলেন। তারপর বললেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তারপর উমর রাযি. ছড়াটি নিয়ে মেঝেতে আঘাত করলেন। তাতে খেজুরগুলো ছড়িয়ে পড়ল। তিনি সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামতের দিন আমাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন--
نعم، إِلَّا مِنْ ثَلاثة: خِرْقَة كَفَّ بِهَا الرَّجُلُ عَوْرَتَهُ، أَوْ كِسْرَةٍ سَدَّ بِهَا جَوْعته أو حجرٍ يَتَدَخل فِيهِ مِنَ الْحَر، وَالْقُر
"হাঁ, তবে তিনটি জিনিস ছাড়া- সতর ঢাকার জন্য একখণ্ড কাপড়, ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক টুকরো রুটি, শীত ও তাপ থেকে বাঁচার জন্য একটা আশ্রয়স্থান।"

এর দ্বারা বোঝা যায় কোনওমতে ক্ষুধা মেটানোর মত খাবার, কোনওমতে শরীর ঢাকার মত কাপড় ও মাথা গোঁজার মত ন্যূনতম বাসস্থান, যদি কেউ বৈধ উপায়ে অর্জন করে তবে সেজন্য আখিরাতে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে না। এর বেশি হলেই সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তো এ হাদীছে 'অধিকার' বলে এই ন্যূনতম সম্পদকেই বোঝানো হয়েছে। এর বেশি যদি কেউ অর্জন করে, তবে তা জায়েয আছে বটে, কিন্তু সেজন্য জবাবদিহিতাও আছে। অর্থাৎ জিজ্ঞেস করা হবে সে সম্পদের কতটুকু শোকর আদায় করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মৌলিক অধিকারের। ব্যাখ্যা দেন নিম্নরূপ-
بيت يسكنه (বসবাস করার জন্য একটি ঘর)। অর্থাৎ সর্বনিম্ন যতটুকু পরিসরে বাস করা যায় এমন একটি ঘর। তারচে' বড় ঘর তৈরি করা জায়েয আছে, যদি হালাল উপায়ে অর্জন করা হয়। কিন্তু সেটা বান্দার অধিকার নয়। তাই সেরকম ঘর তৈরি করা হলে সেজন্য শোকর আদায়ের প্রশ্ন এসে যায়। শোকর আদায় করা না হলে সেজন্য আখিরাতে ধরা হবে। যদি ভাড়া দেওয়ার জন্য ঘর তৈরি করা হয় তবে সেটাও অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে। তার জন্যও জবাবদিহিতা আছে। শোকর আদায়ের শর্তে কাচারি ঘর বা বৈঠকখানা, মেহমানখানা এবং অন্যান্য সুবিধাদির জন্য অতিরিক্ত ঘর বা কামরা তৈরি করার অবকাশ রয়েছে। তবে ইসলাম বিলাসিতাকে অনুমোদন করে না। কেবল বিলাসিতার জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করা হলে সেটা অপব্যয় ও অপচয় বলে গণ্য হবে, যা সম্পূর্ণ নাজায়েয।

وثوب يواري عورته (সতর ঢাকার জন্য একটি কাপড়)। এখানে সতর ঢাকা বলে শরীরের যে অংশ অন্যকে দেখানো জায়েয নয় কেবল ততটুকু ঢাকাই নয়, বরং সেইসঙ্গে শীত ও তাপ থেকে যাতে শরীর রক্ষা হয় তাও বোঝানো উদ্দেশ্য। যতটুকু কাপড় দ্বারা এ উদ্দেশ্য পূরণ হয়, ততটুকু বান্দার মৌলিক অধিকার। অর্থাৎ বৈধ পন্থায় এতটুকু কাপড় সংগ্রহ করা হলে সেজন্য আখিরাতে কোনও জবাবদিহিতা নেই। বৈধ পন্থায় এর বেশি কাপড়ও সংগ্রহ করার অনুমতি আছে, তবে সেজন্য শোকর আদায়েরও দায় রয়েছে।

শরী'আত তিন ধরনের কাপড় রাখার অনুমতি দিয়েছে। একটি সার্বক্ষণিক ব্যবহারের কাপড়, আরেকটি অতিথির সামনে উপস্থিত হওয়ার বা বেড়ানোর কাপড় এবং আরেকটি ঈদ ও জুমু'আয় ব্যবহারের কাপড়।

এ তিন রকমের ব্যবহারের জন্য অবস্থাভেদে কাপড়ের সংখ্যায় কমবেশি হতে পারে। অর্থাৎ কারও অপেক্ষা কারও বেশি কাপড়ের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সর্বাবস্থায়ই বিলাসিতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

وجلف الخبز والماء (রুটির টুকরা ও পানি)। جلف الخبز অর্থ তরকারিবিহীন রুটি। কারও মতে মোটা রুটি। আমাদের দেশের জন্য মোটা ভাত বা তরকারিবিহীন ভাত, যা খেয়ে কোনওমতে প্রাণ রক্ষা করা যায়। প্রাণরক্ষা পরিমাণের বেশি খাবার খাওয়াও জায়েয। সুস্বাদু খাবার ও রকমারি খাবার গ্রহণেরও অনুমতি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও যেমন বিলাসিতা পরিত্যাজ্য, তেমনি অপচয়-অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকাও অবশ্যকর্তব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আমরা দুনিয়ায় নির্মোহ জীবন যাপনের শিক্ষা পাই।

খ. অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে যা দ্বারা ন্যূনতম প্রয়োজন মেটে, বৈধ পন্থায় তা অর্জন করা হলে আখিরাতে সে কারণে কোনও জবাবদিহিতা নেই।

গ. ন্যূনতম প্রয়োজন যা দ্বারা মেটে তার বেশির জন্য লোভ করতে নেই, যেহেতু সেজন্য আখিরাতে জবাবদিহিতা আছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান