আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৬. যুহদ-দুনিয়া বিমুখতার বর্ণনা

হাদীস নং: ২৩০৬
আন্তর্জাতিক নং: ২৩০৬
আমলের বিষয়ে প্রতিযোগী হয়ে এগিয়ে যাওয়া।
২৩০৯. আবু মুসআব (রাহঃ) ..... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলু্লাহ (ﷺ) বললেনে সাতটি বিষয়ে আমলর প্রতিযোগীতায় এগিয় থাকতে যত্নবান হও। তোমরা কি অপেক্ষায় আছ এমন দারিদ্রের যা আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয় বা এমন ধনাঢ্য হওয়ার যা আল্লাহ নাফরমানীতে লিপ্ত করে বা এমন রোগের যা স্বাস্থ্য বিনষ্ট করে দেয় বা এমন বার্ধক্যের যা একজনকে নিঃশেষ করে দেয় বা এমন মৃত্যুর যা হঠাৎ করে আপতিত হয়; না দাজ্জালের? অদৃশ্য অমঙ্গলের অপেক্ষা করা হচ্ছে; না কিয়ামতের? কিয়ামত তো আরো ভীষণ, আরো তিক্ত।
باب مَا جَاءَ فِي الْمُبَادَرَةِ بِالْعَمَلِ
حَدَّثَنَا أَبُو مُصْعَبٍ الْمَدَنِيُّ، عَنْ مُحَرَّرِ بْنِ هَارُونَ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ سَبْعًا هَلْ تَنْظُرُونَ إِلاَّ فَقْرًا مُنْسِيًا أَوْ غِنًى مُطْغِيًا أَوْ مَرَضًا مُفْسِدًا أَوْ هَرَمًا مُفَنِّدًا أَوْ مَوْتًا مُجْهِزًا أَوِ الدَّجَّالَ فَشَرُّ غَائِبٍ يُنْتَظَرُ أَوِ السَّاعَةَ فَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ " . قَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ إِلاَّ مِنْ حَدِيثِ مُحَرَّرِ بْنِ هَارُونَ وَقَدْ رَوَى بِشْرُ بْنُ عُمَرَ وَغَيْرُهُ عَنْ مُحَرَّرِ بْنِ هَارُونَ هَذَا . وَقَدْ رَوَى مَعْمَرٌ هَذَا الْحَدِيثَ عَمَّنْ سَمِعَ سَعِيدًا الْمَقْبُرِيَّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم نَحْوَهُ . وَقَالَ تَنْتَظِرُونَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে আমলে যত্নবান হয়ে বর্তমান সময়কে কাজে লাগাতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন- بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ سَبْعًا (তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও)। সাতটি জিনিস বলে জীবনের সাতটি অবস্থা, অনুষঙ্গ ও পরিস্থিতির কথা বোঝানো হয়েছে। মানুষকে এগুলোর কোনও না কোনও অবস্থার সম্মুখীন হতেই হয়। আর এগুলোর যে-কোনও একটির সম্মুখীন হলে আমল বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা আমল করার সুযোগই শেষ হয়ে যায়। সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আগে আগেই প্রত্যেকের উচিত আখিরাতের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করে নেওয়া। সে সাতটি জিনিস কী, সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক একটি করে তা তুলে ধরছেন। তিনি বলেন-
هَلْ تَنْتَظِرُوْنَ إِلَّا فَقرًا مُنْسِيًا (তোমরা কি ওই দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়)? অর্থাৎ তোমরা আমলের দিকে ধাবিত হচ্ছ না কেন? কিসের অপেক্ষা করছ? বর্তমানে যে অবস্থায় আছ, এটাই তো আমলের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। তা সত্ত্বেও আমলে মনোযোগ না দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় তোমরা এর বিপরীত কোনও অবস্থার অপেক্ষায় আছ। কিন্তু তোমরা জান না সে অবস্থা কেমন হতে পারে। তা তো এমনও হতে পারে, যা তোমাদের আমলের পক্ষে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেরকম একটা অবস্থা হচ্ছে সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য, যখন জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো কঠিন হয়ে যায়। এরূপ অবস্থায় আমলে মনোযোগ দেওয়া কীভাবে সম্ভব? তখন নফল তো পরের কথা, ফরয আমলসমূহ করাই তার পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অনেক সময় সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য মানুষকে ঈমান-আকীদার কথাও ভুলিয়ে দেয়। তাই এ হাদীছে বলা হয়েছে- তোমরা কি ওই দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়?

প্রকাশ থাকে যে, দারিদ্র্য যদি সীমাতিরিক্ত না হয়; বরং সাধারণ পর্যায়ে থাকে, তবে তা আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। কেননা এ অবস্থায় অন্তরে ধন-সম্পদের লোভ-লালসা কম থাকে। অন্যের সঙ্গে দুনিয়াদারীর প্রতিযোগিতা করার মনোভাব থাকে না; বরং মন আখিরাতমুখী থাকে ও অন্তরে আল্লাহর স্মরণ বিরাজ করে। ফলে ইবাদত-বন্দেগীতে মন দেওয়া সহজ হয় ও বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকা যায়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, দারিদ্র্য নবীগণের ভূষণ ও ওলী-বুযুর্গদের বসন।

সুতরাং স্বাভাবিক ও সাধারণ পর্যায়ের দারিদ্র্য অর্থাৎ সাদামাটাভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু সম্পদ দরকার তা থাকা ভালো। মন্দ হল সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য অর্থাৎ প্রাণরক্ষার মতো উপায়-অবলম্বনও না থাকা, যেমনটা উপরে বলা হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত সেরকম কঠিন অভাব-অনটনে যাতে পড়তে না হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা এবং নেককাজে যত্নবান থেকে পরকালীন সফলতা লাভের চেষ্টা করা।

আমলের প্রতি উৎসাহ দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে দ্বিতীয় যে বাধার উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে অতিরিক্ত ধন-সম্পদ। তিনি ইরশাদ করেন- أَوْ غنًى مُطغيًا (তোমরা কি অপেক্ষা করছ ওই প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে)? مُطغيًا শব্দটির উৎপত্তি اَلطّغْيانُ থেকে, যার অর্থ ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতা। مُطغيًا মানে ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতায় লিপ্তকারী। অতি ধনাঢ্যতা মানুষকে শরী'আতের অবাধ্য করে তোলে। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, তোমরা কি অপেক্ষা করছ ওই প্রাচুর্যের, যা মানুষকে শরী'আতের বিধানাবলির প্রতি অবাধ্য করে তোলে? টাকা-পয়সা বেশি হলে তখন নিশ্চিন্তে বসে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারবে, এরূপ মনে করে থাকলে সেটা তোমাদের মনের ধোঁকা। কেননা টাকা-পয়সা বেশি হলে প্রতিযোগিতার মনোভাব এসে যায়। তখন ধনী থেকে আরও ধনী হওয়াটাই হয়ে যায় জীবনের একমাত্র সাধনা। এ অবস্থায় দীন ও ঈমান এবং আমল-আখলাক কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করা হয় না। এরূপ ব্যক্তি হয়ে পড়ে ইহকালসর্বস্ব। সে আখিরাতের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়। উপরন্তু তার অন্তরে জন্ম নেয় অহংকার। সে অহংকার তাকে করে তোলে শরী'আতের অবাধ্য।

প্রকাশ থাকে যে, অতিরিক্ত ধন-সম্পদ যে মানুষের দীন ও ঈমানের ক্ষতি করে, এটা সাধারণ অবস্থা। এর ব্যতিক্রমও আছে। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে অনেক বড় বড় ধনী ইবাদত-বন্দেগী ও দীনী কাজে অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে। মূলত এটা ঈমানের দৃঢ়তার উপর নির্ভর করে। ঈমান যার বেশি শক্তিশালী, ধন তাকে ঈমানী কাজকর্ম থেকে দূরে সরাতে পারে না। কিন্তু সেরকম শক্ত ঈমানের লোক বড় কম। আমাদের মতো সাধারণ লোকদের পক্ষে অতি ধন ও অতি দারিদ্র্য অপেক্ষা মাঝামাঝি অবস্থাই বেশি নিরাপদ।

أَوْ مَرضًا مُفْسِدًا (না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে)? مُفْسِد শব্দটির উৎপত্তি الفسادُ থেকে, যার অর্থ নষ্ট, বিলোপ, বিনাশ, বিকৃতি ইত্যাদি। مُفْسِد মানে নষ্ট ও লোপকারী। এমন অনেক রোগ আছে, যা মানুষের শরীর সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয় এবং বিবেক-বুদ্ধির বিলোপ ঘটায়। সেরকম রোগ দেখা দিলে মানুষের পক্ষে কোনও ইবাদত- বন্দেগী ভালোভাবে আদায় করা কিংবা একেবারেই আদায় করা সম্ভব হয় না। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলছেন, (তোমরা যে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হচ্ছ না) তবে কি এমন রোগ-ব্যাধির অপেক্ষা করছ, যা শরীর-মন সব নষ্ট করে দেয়?

বস্তুত সুস্বাস্থ্য মানুষের পক্ষে অনেক বড় নি'আমত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ নি'আমতের মূল্য বোঝে না এবং এর শোকর আদায় করে না। দরকার ছিল স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী হওয়া। এর দ্বারা সুস্বাস্থ্যের শোকর আদায় হয়। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা করে না। বরং তখন ফুর্তি করে সময় কাটায়। ইবাদতে গড়িমসি করে। ভাবটা এমন যে, এ স্বাস্থ্য চিরদিন থাকবে। কিন্তু কারও স্বাস্থ্যই চিরদিন থাকে না। একসময় রোগ-ব্যাধি ঘিরে ধরে। শরীর ও মন নষ্ট হয়ে যায়। তখন হয়তো ইবাদতের ইচ্ছাই হয় না। আর ইচ্ছা হলেও শরীর সায় দেয় না। তখন কেবল আফসোসই করা যায়। কিন্তু সময় হারিয়ে সে আফসোসের কী ফায়দা?

তাই সুস্থ থাকাকালে গড়িমসি না করে সাধ্যমতো পুণ্য অর্জন করে নেওয়া চাই। মনে রাখতে হবে, নিজ সময়, মেধা, বিদ্যাবুদ্ধি ও শারীরিক শক্তিসহ আর যা-কিছু নি'আমত আছে, সবগুলোর সদ্ব্যবহার করে আখিরাতের পুঁজি সংগ্রহের এটাই সময়। এ সময়টাকে সৎকাজে লাগানোর একটা বাড়তি লাভও আছে। তা হচ্ছে- অসুস্থ অবস্থায় যখন নেককাজ করা সম্ভব হয় না, তখন সুস্থ অবস্থায় যে সমস্ত নেক কাজ করা হতো, আল্লাহ তা'আলার দয়ায় তার আমলনামায় সে সমস্ত নেককাজের ছাওয়াব লেখা হতে থাকে।

أَوْ هرمًا مفندًا (নাকি বুদ্ধিনাশা বার্ধক্যের)? هرمٌ মানে অতি বার্ধক্য। مفند শব্দটির উৎপত্তি الفند থেকে। الفند এর অর্থ মিথ্যা, ভ্রম, বিস্মৃতি। مفند মানে বিস্মৃতি ও বিভ্রম সৃষ্টিকারী। অতি বার্ধক্য মানুষের স্মৃতিনাশ ঘটায়। কেউ যখন অতিরিক্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়ে তখন কোনওকিছুই মনে থাকে না। এরূপ অবস্থায় মানুষ ঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে না। একটা করতে গিয়ে আরেকটা করে ফেলে। সব ভুল হয়ে যায়। কাজেই অতি বার্ধক্য 'ইবাদত-বন্দেগীর জন্য একটি বড় বাধা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

বস্তুত যৌবন ও তারুণ্য মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট দান। যৌবনকালের ইবাদত-বন্দেগী অনেক বেশি মূল্যবান। এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যে ব্যক্তি তার যৌবনকালকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর ভেতর কাটায়, হাশরের ময়দানে সে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে জায়গা পাবে। কিন্তু মানুষ বড় গাফেল। যেখানে দরকার ছিল যৌবনকালকে বেশি বেশি ছাওয়াব অর্জনের কাজে ব্যয় করা, সেখানে এ সময়টাকে ফুর্তির ভেতর নষ্ট করা হয়। মনে করা হয় ইবাদত-বন্দেগী এ সময়কার কাজ নয়; এটা বৃদ্ধ বয়সের কাজ। এটা কত বড়ই না ভুল ধারণা। বার্ধক্য যখন আসে, তা তার সব পারিপার্শ্বিকতা নিয়েই আসে। তখন শরীর-মন জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ نُعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ أَفَلَا يَعْقِلُونَ (68)
‘আমি যাকে দীর্ঘায়ু দান করি, গঠনগতভাবে তাকে উল্টিয়ে দেই। তথাপি কি তারা উপলব্ধি করবে না?’(সূরা ইয়াসীন (৩৬), আয়াত ৬৮)

মানুষ যখন অত্যধিক বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তার শক্তিসমূহ নিঃশেষ হয়ে যায়। তার আর দেখার, শোনার, বলার ও বোঝার মতো ক্ষমতা থাকে না। থাকলেও তা এতই সামান্য, যা বিশেষ কাজে আসে না। একদম শিশুর মতো হয়ে যায়। ফলে এ সময় সে সম্পূর্ণ নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে। না ইবাদত-বন্দেগী করার মতো মন থাকে, না থাকে সেই শক্তি। উপরন্তু সে তখন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

তাই এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করে বলছেন- যুবক থাকা অবস্থায়ও যে বেশি বেশি ইবাদত করছ না, তা তোমরা কিসের অপেক্ষায় আছ? বৃদ্ধকালের? তোমরা ভাবছ বৃদ্ধকালে ইবাদত-বন্দেগীতে মন দেবে, তখন বেশি বেশি নেক কাজ করবে? এটা বৃথা ভাবনা। তখন কিছুই করতে পারবে না। যা করার এখনই করে নাও।

موتًا مجهزًا (নাকি আকস্মিক মৃত্যুর)? مجهز শব্দটির উৎপত্তি جهز থেকে। এর অর্থ দ্রুত সম্পাদন করা। বলা হয়ে থাকে, جَهَزَ وَأَجْهَزَ عَلَى الْجَرِيحِ অর্থাৎ আহত ব্যক্তির হত্যাকার্য দ্রুত সম্পাদন করল। সে হিসেবে مجهز মানে দ্রুত সম্পাদনকারী। আকস্মিক মৃত্যুকে مجهز বলা হয়েছে এ কারণে যে, তা এমন দ্রুততার সাথে ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটায় যে, সে তাওবা করা, অসিয়ত করা ইত্যাদি কোনও কিছুরই সুযোগ পায় না। অথবা এর দ্বারা যৌবনকালে মৃত্যু হয়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। মানুষের আশা থাকে, সে অনেক বয়স পেয়ে মারা যাবে। যখন সে আশা পূরণ হয় না এবং যৌবনকালেই মারা যায়, তখন বলা হয় সে খুব তাড়াতাড়ি মারা গেল এবং মৃত্যু খুব অল্প দিনেই তার জীবন শেষ করে দিল। مجهز এর এক অর্থ سَرِيعٌ। অর্থাৎ যা অতি শীঘ্র ঘটে যায়। যে মৃত্যু যৌবনকালে হয় বা যে মৃত্যু হঠাৎ করেই হয়ে যায়, তাকে الْمَوْتُ الْمُجهِز বলে। আকস্মিক মৃত্যুকে مَوْتُ الْفَجْأَةِ -ও বলা হয়ে থাকে।

বস্তুত আল্লাহ তা'আলা মানুষকে একটা সীমিত সময়ের জন্য এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সে সময় যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন প্রত্যেককেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের আমল করার সুযোগ থাকে। মৃত্যু দ্বারা যেমন ইহজীবনের সমাপ্তি হয়, তেমনি আমলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

কার কখন আয়ু ফুরাবে কেউ জানে না। সে হিসেবে সব মৃত্যুই আকস্মিক। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মৃত্যু এমন আছে, মানুষ যাকে স্বাভাবিক গণ্য করে থাকে। যেমন বৃদ্ধ বয়সে মারা যাওয়া, কঠিন কোনও রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ইত্যাদি।

কোনও কোনও মৃত্যুর প্রকাশ্য পূর্বাভাস থাকে না। এ অবস্থায় মারা গেলে লোকে অবাক হয়ে বলাবলি করে, সে এভাবে হঠাৎ মারা গেল! কারণ তার মৃত্যুর ব্যাপারে তার নিজের এবং অন্য কারও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। যেমন, কেউ ঘুমের মধ্যে মারা গেল বা গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল কিংবা কর্মক্ষেত্রে কাজ করছিল আর এ অবস্থায় হার্টফেল করে মারা গেল। এসব মৃত্যুকে সাধারণত আকস্মিক মৃত্যু মনে করা হয়ে থাকে। এরূপ মৃত্যুর আগে সাধারণ লোকজনের মৃত্যুর প্রস্তুতি থাকে না। তাওবা ও ইস্তিগফারেরও সুযোগ হয় না। ফলে হয়তো তার মৃত্যু এমন অবস্থায় ঘটে, দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে যে অবস্থাটি প্রশংসনীয় নয়। হয়তো তখন কালেমা পড়ারই অবকাশ হয় না, অথবা কালেমাওয়ালা আমল অর্থাৎ কোনও নেক আমলের সাথে মৃত্যু হয় না।

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে আমলের উৎসাহ দিতে গিয়ে আকস্মিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তোমরা যে দ্রুত আমলের দিকে ধাবিত হচ্ছ না, এর কারণ কী? তোমাদের কিসের অপেক্ষা? মৃত্যুর অপেক্ষা কি? মৃত্যু তো যে-কোনও সময়ই হয়ে যেতে পারে। তা হয়ে গেলে তো আর কোনও আমলের সুযোগ থাকবে না। বরং তখন শুরু হয়ে যাবে আমলের ফলভোগের কাল। যেমন আমল নিয়ে কবরে যাবে তেমনি ফল সেখানে পাবে। সুতরাং অবহেলায় সময় নষ্ট না করে নেক আমলে মনোযোগী হও এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও।

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমলের পক্ষে ষষ্ঠ যে বাধার কথা উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে দাজ্জালের আবির্ভাব। তিনি ইরশাদ করেন-
أَوِ الدَّجَّالَ، فَشَرُّ غائبٍ يُنتظَرُ (না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে)? اَلدَّجَّالُ শব্দটি আতিশয্যবোধক। এর উৎপত্তি دَجَلٌ থেকে, যার অর্থ মিথ্যা বলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। দাজ্জাল হবে এক চরম মিথ্যুক ও কঠিন বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী। কিয়ামতের আগে তার আবির্ভাব ঘটবে। আল্লাহ তা'আলা তাকে অনেক ক্ষমতা দান করবেন। এমনকি তার আদেশে বৃষ্টি হবে। তার হুকুমে যমীন থেকে ফসল উদ্গত হবে। তার সঙ্গে একটি উদ্যান ও একটি অঙ্গিকুণ্ড থাকবে, যাকে সে তার জান্নাত ও জাহান্নাম বলে প্রচার করবে। সে নিজেকে 'রব্ব' বলে দাবি করবে। মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনতে বলবে। যে ঈমান আনবে তাকে তার জান্নাতে স্থান দেবে। আর যে ঈমান আনবে না তাকে তার জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, সাবধান! প্রকৃতপক্ষে তার জান্নাতই হবে জাহান্নামের টুকরা, আর তার জাহান্নাম হবে জান্নাতের মতো শান্তিদায়ক। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমানের উপর মজবুত থাকবে এবং তাকে রব্ব বলে স্বীকার করবে না, আর এ কারণে সে তাকে তার জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য তার জাহান্নামকে জান্নাত বানিয়ে দেবেন। আগুন তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না; বরং তার জন্য শান্তিদায়ক হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে ও তাকে রব্ব বলে স্বীকার করবে, আর এ কারণে সে তাকে জান্নাত দান করবে, আল্লাহ তা'আলা সে জান্নাতকে তার জন্য জাহান্নামে পরিণত করে দেবেন।

বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ফিতনা। পরিপক্ক ঈমান ও আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সে ফিতনায় নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যখন দেখা যাবে তার কথায় বৃষ্টি হচ্ছে, সে মৃত মানুষকে জীবিত করে তুলছে, আবার তার কথা না শুনলে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, তখন আল্লাহর সাহায্য না হলে নিজ ঈমানের উপর অবিচল থাকা কার পক্ষে সম্ভব হবে?

তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয় এবং তাকে 'আল্লাহ' মনে না করে বসে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্টভাবে তার আলামত বলে দিয়েছেন। যেমন একটি আলামত হল সে হবে এক চোখবিশিষ্ট। একটি চোখ থাকবে না। সে চোখের জায়গা মাংসপিণ্ড দ্বারা ঢাকা থাকবে। যে চোখটি থাকবে সেটিও এতবেশি উপরে উত্থিত থাকবে যে, মনে হবে যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে। হাদীছে সেটিকে এক থোকা আঙ্গুরের উপর আলাদাভাবে উপড়ে উঠে থাকা একটি আঙ্গুরের দানার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তার দুই চোখের মাঝখানে লেখা থাকবে ك ف ر (কাফের)। প্রত্যেক মু'মিন তা পড়তে পারবে। কিন্তু কাফের ও মুনাফিক ব্যক্তি তা পড়তে পারবে না।

তাকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ তা'আলা হযরত 'ঈসা আলাইহিস-সালামকে পাঠাবেন। ফিলিস্তীনের 'বাবে লুদ' নামক স্থানে তিনি তাকে হত্যা করবেন। এটাই হবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুনিয়ায় আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য।

মোটকথা দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। সব নবীই তার ফিতনা সম্পর্কে নিজ নিজ উম্মতকে সতর্ক করে গেছেন। তার বিষয়টা সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট করেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তার ফিতনা থেকে নিরাপত্তার জন্য দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে, জীবন ও মরণের পরীক্ষাসমূহ থেকে এবং কানা দাজ্জালের ফিতনা থেকে।(সহীহ বুখারী: ১৩৭৭; সহীহ মুসলিম: ৫৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৪৯৫; সুনানে নাসাঈ: ৫৫০৯: সুনানে আবূ দাউদ: ১৫৪২; সুনানে ইবন মাজাহ ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪১)

এ হাদীছে আমলের সর্বশেষ বাধা বলা হয়েছে কিয়ামতকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَوِ السَّاعَةَ وَالسَّاعَةُ أدهَى وأمرُّ (না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত)? কিয়ামত যখন সংঘটিত হবে, তখন যে ভয়ংকর অবস্থা দেখা দেবে তাতে কারও পক্ষে কোনও আমল করার প্রশ্নই আসে না। এমনকি তাওবা করার মতো অবস্থাও থাকবে না। তখন তাওবা কবুলও হবে না।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতকে বলেছেন অতি ভয়াবহ ও অতি তিক্ত। কুরআন মাজীদও সে কথাই বলেছে। ইরশাদ হয়েছে-
بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ (46)
‘বরং তাদের প্রকৃত প্রতিশ্রুত কাল তো কিয়ামত। কিয়ামত তো আরও বেশি কঠিন, অনেক বেশি তিক্ত।(সূরা কামার (৫৪), আয়াত ৪৬)

যাহোক এ হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মতকে এ সাতটি বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আমলে যত্নবান হওয়ার তাগিদ করেছেন। আমরা প্রত্যেকেই সাধারণত বর্তমান সময়কে অবহেলা করে কাটাই। আমলের বিষয়টিকে আগামী দিনের জন্য রেখে দিই। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়ই আমলের জন্য উৎকৃষ্ট সময়। এসময় শরীরে শক্তি থাকে, মনে উৎসাহ থাকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাও আমলের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি উপযোগী। তাই যা আমল করার এখনই করে নেওয়া উচিত। পরে সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এ হাদীছে যেসব বাধার কথা বলা হয়েছে তার যে-কোনও একটি দেখা দিতে পারে। সুতরাং কোনও গড়িমসি নয়। আমলের প্রকৃত সময় এখনই। এখনই তাতে লেগে পড়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ আমাদেরকে মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক করছে এবং অলসতা ছেড়ে এখনই আমলে রত হতে তাগাদা দিচ্ছে।

খ. অতি দারিদ্র্য ঈমান-আমলের জন্য বাধা। তাই প্রত্যেকের উচিত সচ্ছল অবস্থায় বেশি বেশি নেক আমল করা এবং হালাল পথে উপার্জনে সচেষ্ট থাকা।

গ. সাধারণত অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ ঔদ্ধত্য সৃষ্টি করে। তাই বেশি ধনী হওয়ার আশা না করে অল্পে সন্তুষ্ট থাকার গুণ অর্জন করা উচিত।

ঘ. কঠিন রোগ-ব্যাধিতে 'ইবাদত-বন্দেগী করা কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় মানুষ তাতে ধৈর্যও হারিয়ে ফেলে। তাই তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া উচিত।

ঙ. সুস্বাস্থ্য আল্লাহ তা'আলার এক বড় নিআমত। তাই সুস্থতাকে যতবেশি সম্ভব পুণ্য অর্জনের কাজে ব্যবহার করা এবং এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য রক্ষায়ও যত্নবান থাকা উচিত।

চ. অতিরিক্ত বার্ধক্য নেক আমলের জন্য বাধা। তার আগেই শক্ত-সমর্থ থাকা অবস্থায় ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী থাকতে হবে।

ছ. মৃত্যু সকলেরই অবধারিত। কিন্তু আকস্মিকভাবে মৃত্যু হলে তাওবা-ইস্তিগফার ও অসিয়ত করার সুযোগ হয় না। তাই যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং আল্লাহর কাছে এর থেকে পানাহ চাওয়া উচিত।

জ. দাজ্জালের ফিতনা সবচে' ভয়ংকর ফিতনা। এ ফিতনা থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে নিয়মিত পানাহ চাওয়া উচিত।

ঝ. কিয়ামত অবশ্যসম্ভাবী এবং তা বড় বিভীষিকাময়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২৩০৬ | মুসলিম বাংলা