আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

৩৩. ফিতনাসমূহ ও কিয়ামতের বিবরণ

হাদীস নং: ২১৯১
আন্তর্জাতিক নং: ২১৯১
কিয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে সে সম্পর্কে নবী (ﷺ) কর্তৃক সাহাবীগণকে অবহিত করা।
২১৯৪. ইমরান ইবনে মুসা কাযযায বসরী (রাহঃ) ..... আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে দিন থাকতেই (অর্থাৎ একেবারে আওয়াল ওয়াক্তে) আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি খুতবা দিতে দাঁড়ান। এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সবকিছু সম্পর্কে তিনি আমাদের অবহিত করেন। যার মনে রাখার তা মনে রেখেছে আর যার ভুলে যাওয়ার সে তা ভুলে গিয়েছে। এতে তিনি যা বলেছিলেন তার মধ্যে ছিলঃ

এ দুনিয়া দেখতে শ্যামল এবং মধূর। আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এর উত্তরাধিকারী করেছেন। এরপর তোমরা কি আমল করছ তা তিনি লক্ষ্য করেছেন। শোন, দুনিয়া থেকে বেঁচে থাকবে আর মেয়েদের থেকেও সতর্ক থাকবে। তিনি আরো বলেছেনঃ শোন, যখন কোন সত্য সম্পর্কে জানবে তখন তোমাদের কাউকে কোন মানুষের ভয় যেন তা বলতে কখনো বিরত না রাখে। বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর আবু সাঈদ (রাযিঃ) কেঁদে ফেললেন। বললেন আল্লাহর কসম, অনেক বিষয় আমরা হতে দেখছি কিন্তু তা বলতে মানুষকে ভয় করেছি। তিনি (নবী (ﷺ)) আরও বলেছিলেনঃ শুনে রাখ, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাস ঘাতককেই তার বিশ্বাস ঘাতকতার পরিমাণ অনুসারে এক একটি নিশান লাগিয়ে দেওয়া হবে। মুসলিম রাষ্ট্র নায়ক কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে আর ভীষণ কোন বিশ্বাসঘাতকতা নাই। তার এই নিশান তার নিতম্বের কাছে বেঁধে দেওয়া হবে।

ঐদিনের আরো যে কথা আমরা স্মরণ রেখেছি তার মধ্যে ছিল, শুনে রাখ, আদম সন্তানকে বিভিন্ন শ্রেণীতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তো একদল এমন যারা মু‘মিনরূপেই জন্ম নিয়েছে এবং মু‘মিনরূপেই তাদের জীবন অতিবাহিত হয়েছে আর মু‘মিনরূপেই তাদের মৃত্যু ঘটেছে; আরেক শ্রেণী হল, যারা কাফিররূপে জন্ম নিয়েছে এবং কাফিররূপে তারা জীবন অতিবাহিত করেছে আর কাফিররূপেই তাদের মৃত্যু ঘটেছে; আরেক শ্রেণী হল মু‘মিনরূপে জন্মগ্রহণ করেছে, মু‘মিনরূপে জীবন কাটিয়েছে কিন্তু কাফিররূপে তার মৃত্যু ঘটেছে; আরেক শ্রেণী হল, কাফিররূপে জন্ম লাভ করেছে, কাফিররূপেই জীবন কাটিয়েছে কিন্তু মু‘মিনরূপে মৃত্যুবরণ করেছে।

শুনে রাখ, মানুষের মধ্যে কেউ তো এমন আছে যার দেরীতে রাগ আসে আর তাড়াতাড়ি তা প্রশমিত হয়ে যায়, কেউ তো আছে যার ক্রোধ আসেও তাড়াতাড়ি আবার তা প্রশমিতও হয় তাড়াতাড়ি। সুতরাং উহার পরিবর্তে ইহা।

শোন, কেউ তো আছে এমন যার ক্রোধ সঞ্চার হয় তাড়াতাড়ি কিন্তু প্রশমিত হয় দেরীতে। শোন, তাদের মধ্যে উত্তম হল যার ক্রোধ সঞ্চার হয় দেরীতে প্রশমন হয় তাড়াতাড়ি। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট হল যার ক্রোধ সঞ্চার হয় তাড়াতাড়ি কিন্তু প্রশমন হয় দেরীতে।

শোন, মানুষের মাঝে কেউ তো এমন আছে যে পরিশোধের ক্ষেত্রেও সে সুন্দর আবার তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রেও সে ভদ্র; কেউ তো এমন যে পরিশোধের ক্ষেত্রে খারাপ কিন্তু তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রে ভদ্র; কেউ তো এমন যে পরিশোধের ক্ষেত্রে তো সুন্দর কিন্তু তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অভদ্র। সুতরাং এ ক্ষেত্রে একটি আরেকটির বদলা হয়ে যায়। শোন, কেউ তো হল এমন, পরিশোধের ক্ষেত্রেও খারাপ এবং তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রেও অভদ্র। শোন, তাদের মাঝে সর্বোত্তম হল সে, যে পরিশোধের ক্ষেত্রেও সুন্দর এবং তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রেও ভদ্র। শোন, তাদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হল সে, যে পরিশোধের ক্ষেত্রেও খারাপ এবং তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অভদ্র। শোন, ক্রোধ হল মানুষের মনের এক অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। তোমরা কি দেখনি, ক্রোধান্বিত ব্যক্তির চক্ষু লাল হয়ে যায়, তার রগ ফুলে উঠে তোমাদের কেউ যদি এ ধরণের কিছু টের পায় তাহলে সে যেন মাটির সাথে লেপটে যায়। রাবী বলেনঃ আমরা সূর্যের দিকে তাকাচ্ছিলাম এখনও (অস্ত যেতে) কিছু বাকী আছে কিনা।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ দুনিয়ার যাতটুকু অতীত হয়ে গেছে সে হিসাবে এতটুকুও আর বাকী নাই যেটুকু আজকের দিনের বাকী আছে যা অতিবাহিত হয়েছে সে তুলনায়।
باب ما جاء ما أخبر النبي صلى الله عليه وسلم أصحابه بما هو كائن إلى يوم القيامة
حَدَّثَنَا عِمْرَانُ بْنُ مُوسَى الْقَزَّازُ الْبَصْرِيُّ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ زَيْدِ بْنِ جُدْعَانَ الْقُرَشِيُّ، عَنْ أَبِي نَضْرَةَ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا صَلاَةَ الْعَصْرِ بِنَهَارٍ ثُمَّ قَامَ خَطِيبًا فَلَمْ يَدَعْ شَيْئًا يَكُونُ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ إِلاَّ أَخْبَرَنَا بِهِ حَفِظَهُ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ وَكَانَ فِيمَا قَالَ " إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللَّهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَنَاظِرٌ كَيْفَ تَعْمَلُونَ أَلاَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ " . وَكَانَ فِيمَا قَالَ " أَلاَ لاَ يَمْنَعَنَّ رَجُلاً هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ " . قَالَ فَبَكَى أَبُو سَعِيدٍ فَقَالَ قَدْ وَاللَّهِ رَأَيْنَا أَشْيَاءَ فَهِبْنَا . وَكَانَ فِيمَا قَالَ " أَلاَ إِنَّهُ يُنْصَبُ لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقَدْرِ غَدْرَتِهِ وَلاَ غَدْرَةَ أَعْظَمَ مِنْ غَدْرَةِ إِمَامِ عَامَّةٍ يُرْكَزُ لِوَاؤُهُ عِنْدَ اسْتِهِ " . وَكَانَ فِيمَا حَفِظْنَا يَوْمَئِذٍ " أَلاَ إِنَّ بَنِي آدَمَ خُلِقُوا عَلَى طَبَقَاتٍ شَتَّى فَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ مُؤْمِنًا وَيَحْيَا مُؤْمِنًا وَيَمُوتُ مُؤْمِنًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ كَافِرًا وَيَحْيَا كَافِرًا وَيَمُوتُ كَافِرًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ مُؤْمِنًا وَيَحْيَا مُؤْمِنًا وَيَمُوتُ كَافِرًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ كَافِرًا وَيَحْيَا كَافِرًا وَيَمُوتُ مُؤْمِنًا أَلاَ وَإِنَّ مِنْهُمُ الْبَطِيءَ الْغَضَبِ سَرِيعَ الْفَىْءِ وَمِنْهُمْ سَرِيعُ الْغَضَبِ سَرِيعُ الْفَىْءِ فَتِلْكَ بِتِلْكَ أَلاَ وَإِنَّ مِنْهُمْ سَرِيعَ الْغَضَبِ بَطِيءَ الْفَىْءِ أَلاَ وَخَيْرُهُمْ بَطِيءُ الْغَضَبِ سَرِيعُ الْفَىْءِ أَلاَ وَشَرُّهُمْ سَرِيعُ الْغَضَبِ بَطِيءُ الْفَىْءِ أَلاَ وَإِنَّ مِنْهُمْ حَسَنَ الْقَضَاءِ حَسَنَ الطَّلَبِ وَمِنْهُمْ سَيِّئُ الْقَضَاءِ حَسَنُ الطَّلَبِ وَمِنْهُمْ حَسَنُ الْقَضَاءِ سَيِّئُ الطَّلَبِ فَتِلْكَ بِتِلْكَ أَلاَ وَإِنَّ مِنْهُمُ السَّيِّئَ الْقَضَاءِ السَّيِّئَ الطَّلَبِ أَلاَ وَخَيْرُهُمُ الْحَسَنُ الْقَضَاءِ الْحَسَنُ الطَّلَبِ أَلاَ وَشَرُّهُمْ سَيِّئُ الْقَضَاءِ سَيِّئُ الطَّلَبِ أَلاَ وَإِنَّ الْغَضَبَ جَمْرَةٌ فِي قَلْبِ ابْنِ آدَمَ أَمَا رَأَيْتُمْ إِلَى حُمْرَةِ عَيْنَيْهِ وَانْتِفَاخِ أَوْدَاجِهِ فَمَنْ أَحَسَّ بِشَيْءٍ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَلْصَقْ بِالأَرْضِ " . قَالَ وَجَعَلْنَا نَلْتَفِتُ إِلَى الشَّمْسِ هَلْ بَقِيَ مِنْهَا شَيْءٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أَلاَ إِنَّهُ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا فِيمَا مَضَى مِنْهَا إِلاَّ كَمَا بَقِيَ مِنْ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيمَا مَضَى مِنْهُ " . قَالَ أَبُو عِيسَى وَفِي الْبَابِ عَنْ حُذَيْفَةَ وَأَبِي مَرْيَمَ وَأَبِي زَيْدِ بْنِ أَخْطَبَ وَالْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ وَذَكَرُوا أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم حَدَّثَهُمَ بِمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى أَنْ تَقُومَ السَّاعَةُ . وَهَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

حلوة এর অর্থ মিষ্ট। আর خضرة এর অর্থ সবুজ। অর্থাৎ সবুজ বর্ণবিশিষ্ট। দ্বিতীয় অর্থ সবুজ বর্ণের এক প্রকার তৃণ বা ঘাস, যা গবাদি পশু খেয়ে থাকে। এ হাদীছে দুই অর্থের যে-কোনও অর্থই বোঝানো হতে পারে। প্রথম অর্থ ধরলে হাদীছের অর্থ হবে- দুনিয়া মিষ্টি ও সবুজময়। এ দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে দুনিয়া মানুষের কাছে আকর্ষণীয়। কেননা মিষ্ট বস্তু সুস্বাদু হওয়ায় তার প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ থাকে। আর সবুজ শ্যামল পরিবেশ নয়নপ্রীতিকর হয়। দেখতে ভালো লাগে। আর যে বস্তু দেখতে ভালো লাগে, তার প্রতিও মানুষ আকৃষ্ট হয়। তো বোঝানো উদ্দেশ্য দুনিয়া এক আকর্ষণীয় স্থান। এর যাবতীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ আছে। কেননা এর প্রতিটি বস্তু হয় ভোগের, নয়তো উপভোগের। হয়তো খেতে সুস্বাদু, নয়তো দেখতে শুনতে শোভনীয়। কোনও না কোনও রকমের ইন্দ্রিয়সুখ তার মধ্যে আছেই। এজন্যই মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ-

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
অর্থ : মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রূপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগ-সামগ্রী।

خضرة এর দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে হাদীছের অর্থ হবে দুনিয়া সুস্বাদু সবুজ ঘাসের মত, যা গবাদি পশুর কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু সে আকর্ষণে কোনও পশু যদি তা অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে, তবে তার বদহজম হয়ে যায়। অনেক সময় সে কারণে মারাও যায়। আবার একদম না খেলেও মারা যাবে বৈকি। তার মানে খাওয়া উচিত পরিমিতভাবে। যে পশু পরিমিতভাবে খায়, সে খেয়ে বাঁচে এবং তার জন্য তা উপকারী হয়। এর দ্বারা দু'টি বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য।

এক. দুনিয়া ও এর বস্তুরাজি পশুখাদ্য তুল্য। এটা এমন কিছু মূল্যবান জিনিস নয়, যার প্রতি মানুষের মত মহান সৃষ্টি আসক্ত হতে পারে। জীবন কাটানোর উপকরণ হিসেবে সে এগুলো ব্যবহার করবে ঠিক, কিন্তু এগুলোকে জীবনের লক্ষ্যবস্ত্র বানানো তার পক্ষে শোভা পায় না। তার লক্ষ্যবস্তু হবে কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ। আর সেজন্য তার শারীরিক ও আত্মিক শক্তিসমূহ শরী'আত মোতাবেক ব্যবহারে মনোযোগী থাকা।

দুই. দ্বিতীয়ত বোঝানো উদ্দেশ্য- দুনিয়া ও এর বস্তুরাজি যেহেতু জীবনের লক্ষ্যবস্তু নয়; বরং কেবল ইহজীবন কাটানোর উপকরণ, সেহেতু মানুষের উচিত এসব পরিমিতভাবে গ্রহণ করা। একদম বর্জন করাও ঠিক নয়, আবার মাত্রাতিরিক্ত ভোগে লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়। একদম বর্জন যেমন প্রাণঘাতী, তেমনি অতিরিক্ত ভোগও ধ্বংসাত্মক। এগুলো উপকারী হবে কেবল ততক্ষণই, যতক্ষণ পরিমাণমত গ্রহণ করা হবে।

মোটকথা দুনিয়া একটি চাকচিক্যময় ও আকর্ষণীয় স্থান। এর সবকিছু মানুষকে আকর্ষণ করে ও নিজের দিকে ডাকে। মানুষের কর্তব্য এখানে নিজ বুদ্ধি ব্যবহার করা। পশুর মত নির্বিচারে ভোগে রত হয়ে পড়া তার জন্য শোভনীয় নয়। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন- আর আল্লাহ তোমাদেরকে এখানে স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন। তিনি দেখতে চান তোমরা কেমন কাজ কর। অর্থাৎ তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ছিল। তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতায় মেতে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছিল। পাপাচারের পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যে বহু জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন। ইহুদী ও খৃষ্টান জাতিও দুনিয়ার আসক্তিতে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে তাদেরকেও বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তারপর তাদের জায়গায় তোমাদের বসানো হয়েছে। তোমাদের কাছে সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ কিতাব পাঠানো হয়েছে।

এ উম্মতকে আল্লাহ তা'আলা বিগত জাতির স্থলাভিষিক্ত কেন করেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিনি দেখতে চান তোমরা কেমন কাজ কর। অর্থাৎ তোমরা তাদের অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর ও তাদের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা কর, নাকি তোমরাও তাদের মত দুনিয়ার মোহে বিভোর থাক? তোমরা তাদের মত দুনিয়ার বহুমুখী আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষণস্থায়ী ইহজীবনকে প্রাধান্য দাও, না আখিরাতকে লক্ষ্যবস্তু বানাও? তোমরা হালাল-হারাম নির্বিচারে দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত হও, না আয়-রোজগারে নির্মোহ থাক ও শরী'আতের বিধান মেনে চল? এমনিভাবে তোমরা পার্থিব ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধান কর, না হারাম পথে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে বিরত থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি কুড়াও? মোটকথা ইহজগতে তোমরা পরীক্ষার মধ্যে আছ। দুনিয়াকে আকর্ষণীয় ও এর বস্ত্ররাজিকে লোভনীয় বানিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। তোমাদের কর্তব্য সে পরীক্ষা সম্পর্কে সচেতন থাকা। বিশেষত পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা, যাতে তাদের মত বিপথগামী হয়ে আল্লাহর আযাব ও গযবের উপযুক্ত হয়ে না যাও।

দুনিয়া আকর্ষণীয় ও এর বস্তুরাজি লোভনীয় হওয়ার কারণে তার প্রতি মানুষ পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করছেন- তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাক। অর্থাৎ দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে তোমরা বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিও না। এর ধোঁকায় পড়ো না। এর আকর্ষণ ও প্রলোভনের শিকার হয়ে আখিরাত ভুলে যেও না। মনে রেখ, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। আখিরাত চিরস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আকর্ষণ মানুষের চিরস্থায়ী আখিরাত বরবাদ করে দেয়। পূর্বের জাতিসমূহ এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

فوالله ما الفقر أخشى عليكم، ولكني أخشى أن تبسط عليكم الدنيا كما بسطت على من كان قبلكم، فتنافسوها كما تنافسوها، وتهلككم كما أهلكتهم

আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্র্যের ভয় করি না। আমি ভয় করি সুনিয়ার যে, তোমাদেরকে তার প্রাচুর্য দিয়ে দেওয়া হবে, যেমন তার প্রাচুর্য দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের। ফলে তোমরা এর প্রতি আসক্ত হয়ে যাবে, যেমন তারাও এর প্রতি আসক্ত হয়েছিল। এবং তা তোমাদের ধ্বংস করে দেবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করে দিয়েছিল।

তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে নারীদের ব্যাপারে সতর্ক করেন। কেননা দুনিয়ায় যা-কিছু আছে, তার মধ্যে নারীই সর্বাপেক্ষা বেশি আকর্ষণীয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ হিকমতে নারীদের বেশি আকর্ষণীয় বানিয়েছেন। সে হিকমতের একটা দিক এইও যে, নর-নারীর মিলনকে আল্লাহ তা'আলা মানুষের বংশ বিস্তারের মাধ্যম বানিয়েছেন। এর জন্য নারীর আকর্ষণীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল, যাতে পুরুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয় ও বিবাহের আগ্রহ বোধ করে। দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার স্থান, তাই প্রয়োজনীয় সবকিছু দ্বারাই তাকে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর ভেতর আকর্ষণও রেখেছেন, প্রত্যেকের মধ্যে তার প্রতি স্বভাবগত চাহিদা রেখেছেন এবং তা ব্যবহারের জন্য কিছু নীতিমালাও দিয়েছেন। যদি নীতিমালা রক্ষা করে তা দ্বারা নিজ চাহিদা পূরণ করা হয়, তবে তা বৈধ হবে। পক্ষান্তরে তার আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে নীতিমালা উপেক্ষা করলে এবং যথেচ্ছভাবে নিজ চাহিদা পূরণ করলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টা এরকমই। তার আছে নিজস্ব আকর্ষণ এবং পুরুষমনে আছে তার প্রতি চাহিদা। পুরুষ যদি এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী নিজ চাহিদা পূরণ করে, তবে তা বৈধ হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে। নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ ও চাহিদা মূলত সেই কল্যাণ সাধনেরই জন্য। সে হিসেবে এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান। এটা ক্ষতিকর হয় তখনই, যখন মানুষ এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে। তো এ ক্ষেত্রে আল্লাহর পরীক্ষা এই যে, তিনি দেখেন বান্দা তার চাহিদা পূরণে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা রক্ষা করে ও তাঁর দেওয়া সীমারেখার মধ্যে থাকে, নাকি বল্গাহীনভাবে চাহিদা পূরণে রত হয় এবং এ ব্যাপারে সব নীতিমালা ও সীমারেখা ছাড়িয়ে যায়?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়া অতি চাকচিক্যময় এক ক্ষণস্থায়ী জায়গা। এর চাকচিক্যে মাতোয়ারা হয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

খ. এ দুনিয়ায় আমরা পূর্ববর্তী জাতিসমূহের স্থলাভিষিক্ত। আমাদের কর্তব্য তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া।

গ. দুনিয়া পরীক্ষার স্থান। ভোগ-বিলাসিতায় মেতে থাকার জায়গা নয়। এখানকার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করতে হবে। তবেই পরীক্ষায় পাস করা যাবে।

ঘ. নারীদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। যাতে কোনও অবস্থায়ই তাদের ব্যাপারে শরী'আতের সীমালঙ্ঘন না হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ২১৯১ | মুসলিম বাংলা