আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৪০১
২০২৫. খাযির (আলাইহিস সালাম) ও মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর সম্পর্কিত ঘটনা
৩১৬২। আলী ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রাযিঃ)- কে বললাম, নাওফল বাকালী ধারণা করছে যে, খিযিরের সঙ্গী মুসা বনী ইসরাঈলের নবী মুসা (আলাইহিস সালাম) নন; নিশ্চয়ই তিনি অপর কোন মুসা। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর দুশমন মিথ্যা কথা বলেছে। উবাই ইবনে কা‘ব (রাযিঃ) নবী (ﷺ) থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, একবার মুসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমি। মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর এ উত্তরে আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। কেননা তিনি জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করেন নি। আল্লাহ তাঁকে বললেন, বরং দুই নদীর সংযোগ স্থলে আমার একজন বান্দা আছে, সে তোমার চেয়ে বেশী জ্ঞানী।
মুসা (আলাইহিস সালাম) আরয করলেন, হে আমার রব! তাঁর কাছে পৌঁছতে কে আমাকে সাহায্য করবে ? কখনো সুফিয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, হে আমার রব! আমি তাঁর সাথে কিভাবে সাক্ষাৎ করব ? আল্লাহ্ বললেন, তুমি একটি মাছ ধর এবং তা (ভাজা করে) একটি থলের মধ্যে ভরে রাখ। যেখানে গিয়ে তুমি মাছটি হারিয়ে ফেলবে সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন। তারপর মুসা (আলাইহিস সালাম) একটি মাছ ধরলেন এবং (তা ভাজা করে) থলের মধ্যে ভরে রাখলেন। এরপর তিনি এবং তাঁর সাথী ইউশা ইবনে নূন চলতে লাগলেন অবশেষে তাঁরা উভয়ে (নদীর তীরে) একটি পাথরের নিকট এসে পৌছে তার উপর উভয়ে মাথা রেখে বিশ্রাম করলেন। এ সময় মুসা (আলাইহিস সালাম) ঘুমিয়ে পড়লেন আর মাছটি (জীবিত হয়ে) নড়াচড়া করতে করতে থলে থেকে বের হয়ে নদীতে নেমে গেল। এরপর সে নদীতে সুড়ঙ্গ আকারে আপন পথ করে নিল আর আল্লাহ মাছটির চলার পথে পানির গতি থামিয়ে দিলেন। ফলে তার গমন পথটি সুড়ঙ্গের ন্যায় হয়ে গেল।
এ সময় নবী (ﷺ) হাতের ইশারা করে বললেন, এভাবে সুড়ঙ্গের মত হয়েছিল। এরপর তাঁরা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন। অবশেষে যখন পরের দিন ভোর হল তখন মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর যুবক সাথীকে বললেন, আমার ভোরের খাবার আন। আমি এ সফরে খুব ক্লান্তি অনুভব করছি। বস্তুতঃ মুসা (আলাইহিস সালাম) যে পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশিত স্থানটি অতিক্রম না করেছেন সে পর্যন্ত তিনি সফরে কোন ক্লান্তিই অনুভব করেন নি।
তখন তাঁর সাথী তাঁকে বললেন, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন সেই পাথরটির কাছে বিশ্রাম নিয়েছিলাম (তখন মাছটি পানিতে চলে গেছে) মাছটি চলে যাওয়ার কথা বলতে আমি একেবারেই ভুলে গেছি। প্রকৃতপক্ষে আপনার কাছে তা উল্লেখ করতে একমাত্র শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। বস্তুতঃ মাছটি নদীতে আশ্চার্যজনকভাবে নিজের পথ করে নিয়েছে। (রাবী বলেন) পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত, আর তাঁদের জন্য ছিল একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে বললেন, সেটাইতো সেই স্থান যা আমার খুঁজে বেড়াচ্ছি। এরপর উভয়ে নিজ নিজ পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে পিছনের দিকে ফিরে চললেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা উভয়ে সেই পাথরটির কাছে এসে পৌছলেন এবং দেখলেন সেখানে একজন লোক কাপড়ে আবৃত হয়ে আছেন। মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো ? তিনি বললেন, আমি মূসা (আমি এ দেশের লোক নই।) তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈলের (নবী) মূসা ? তিনি বললেন, হাঁ, আমি আপনার নিকট এসেছি, সরল সঠিক জ্ঞানের ঐ সব কথাগুলো শিখার জন্য যা আপনাকে শিখানো হয়েছে। তিনি বললেন, হে মুসা! আমার আল্লাহ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে যা আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনি তা জানেন। আর আপনারও আল্লাহ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আমি তা জানি না। মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি আমার সাথে থেকে ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হবেন না, আর আপনি এমন বিষয়ে ধৈর্য রাখবেন কি করে, যার রহস্য অনুধাবন করা আপনার জানা নেই? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে একজন ধৈর্য ধারণকারী হিসেবে দেখতে পাবেন। আমি আপনার কোন নির্দেশই অমান্য করব না। এরপর তাঁরা উভয়ে রওয়ানা হয়ে নদীর তীর দিয়ে চলতে লাগলেন।
এমন সময় একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তারা তাদেরকেও নৌকায় উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলেন। তারা খাযির (আলাইহিস সালাম)- কে চিনে ফেললেন এবং তারা তাঁকে তাঁর সঙ্গীসহ পারিশ্রমিক ব্যতিরেকেই নৌকায় তুলে নিল। তাঁরা দু’জন যখন নৌকায় আরোহণ করলেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির এক পাশে বসল এবং একবার কি দু’বার নদীর পানিতে সে তার ঠোঁট ডুবাল। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে মুসা! আমার এবং তোমার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহর জ্ঞান হতে ততটুকুও হ্রাস পায়নি যতটুকু এ পাখিটি তার ঠোঁটের সাহায্যে পানি হ্রাস করেছে। তারপর খাযির (আলাইহিস সালাম) হঠাৎ করে একটি কুঠার নিয়ে নৌকার একটি তক্তা খুলে ফেললেন, মুসা (আলাইহিস সালাম) অকস্মাৎ দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন তিনি খুঠার দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেন। তখন তাঁকে তিনি বললেন, আপনি এ কি করলেন? লোকেরা আমাদের পারিশ্রমিক ছাড়া নৌকায় তুলে নিল, আর আপনি তাদের নৌকার আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকাটি ছিদ্র করে দিলেন? এত আপনি একটি গুরুতর কাজ করলেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি কখনও আমার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি সে বিষয়টি ভুলে গেছি, তার জন্য আমাকে দোষারোপ করবেন না। আর আমার এ আচরণে আমার প্রতি কঠোর হবেন না। মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর পক্ষ থেকে প্রথম এই কথাটি ছিল ভুলক্রমে।
এরপর যখন তাঁরা উভয়ে নদী পার হয়ে আসলেন, তখন তাঁরা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন সে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলছিল। খাযির (আলাইহিস সালাম) তার মাথা ধরলেন এবং নিজ হাতে ছেলেটির ঘাড় পৃথক করে ফেললেন। একথাটি বুঝানোর জন্য সুফিয়ান (রাহঃ) তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলোর অগ্রভাগ দ্বারা এমনভাবে ইশারা করলেন যেন তিনি কোন জিনিস ছিড়ে নিচ্ছিলেন। এতে মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, আপনি কি একটি নিষ্পাপ ছেলেকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? নিশ্চয়ই আপনি এটা গর্হিত কাজ করলেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনাকে বলিনি যে,আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি তাহলে আপনি আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখবেন না। কেননা আপনার ওযর আপত্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এরপর তাঁরা চলতে লাগলেন শেষ পর্যন্ত তাঁরা এক লোকালয়ে এসে পৌছলেন।
তাঁরা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাঁদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। তারপর তাঁরা সেখানেই একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তা একদিকে ঝুঁকে গিয়েছিল। খাযির (আলাইহিস সালাম) তা নিজের হাতে সোজা করে দিলেন। রাবী আপন হাতে এভাবে ইশারা করলেন। আর সুফিয়ান (রাহঃ) এমনিভাবে ইঙ্গিত করলেন যেন তিনি কোন জিনিস উপরের দিকে উচিয়ে দিচ্ছেন। “ঝুকে পড়েছে” একথাটি আমি সুফিয়ানকে মাত্র একবার বলতে শুনেছি। মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, তারা এমন মানুষ যে, আমরা তাদের কাছে আসলাম, তারা আমাদেরকে না খাবার পরিবেশন করল, না আমাদের মেহমানদারী করল আপনি এদের প্রাচীর সোজা করতে গেলেন। আপনি ইচ্ছা করলে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, এখানেই আপনার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ হল। তবে এখনই আমি আপনাকে অবহিত করছি ঐসব কথার গুঢ় রহস্য, যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি।
নবী (ﷺ) বলেছেন, আমাদেরতো ইচ্ছা যে, মুসা (আলাইহিস সালাম) ধৈর্যধারণ করলে আমাদের কাছে তাঁদের আরো অনেক বেশী খবর বর্ণিত হতো। সুফিয়ান বর্ণনা করেন নবী (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর উপর রহমত বর্ষন করুন। তিনি যদি ধৈর্যধারণ করতেন, তাহলে তাদের উভয়ের ব্যাপারে আমাদের কাছে আরো অনেক ঘটনা বর্ণিত হতো।
রাবী (সাইদ ইবনে জুবাইর) বলেন, ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এখানে পড়েছেন, তাদের সামনে একজন বাদশাহ ছিল, সে প্রতিটি নিখুঁত নৌকা যবরদস্তিমূলক ছিনিয়ে নিত। আর সে ছেলেটি ছিল কাফির, তার মা-বাবা ছিলেন মুমিন। তারপর সুফিয়ান (রাহঃ) আমাকে বলেছেন, আমি এ হাদীসটি তাঁর (আমর ইবনে দীনার) থেকে দু’বার শুনেছি এবং তাঁর নিকট হতেই মুখস্থ করেছি। সুফিয়ান (রাহঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কি আমর ইবনে দীনার (রাহঃ) থেকে শোনার আগেই তা মুখস্থ করেছেন না অপর কোন লোকের নিকট শুনে তা মুখস্থ করেছেন? তিনি বললেন, আমি কার নিকট থেকে তা মুখস্থ করতে পারি? আমি ছাড়া আর কেউ কি এ হাদীস আমরের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন? আমি তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি দুইবার কি তিনবার। আর তাঁর থেকেই তা মুখস্থ করেছি। আলী ইবনে খুশরম (রাহঃ) সুফিয়ান (রাহঃ) সূত্রে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
মুসা (আলাইহিস সালাম) আরয করলেন, হে আমার রব! তাঁর কাছে পৌঁছতে কে আমাকে সাহায্য করবে ? কখনো সুফিয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, হে আমার রব! আমি তাঁর সাথে কিভাবে সাক্ষাৎ করব ? আল্লাহ্ বললেন, তুমি একটি মাছ ধর এবং তা (ভাজা করে) একটি থলের মধ্যে ভরে রাখ। যেখানে গিয়ে তুমি মাছটি হারিয়ে ফেলবে সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন। তারপর মুসা (আলাইহিস সালাম) একটি মাছ ধরলেন এবং (তা ভাজা করে) থলের মধ্যে ভরে রাখলেন। এরপর তিনি এবং তাঁর সাথী ইউশা ইবনে নূন চলতে লাগলেন অবশেষে তাঁরা উভয়ে (নদীর তীরে) একটি পাথরের নিকট এসে পৌছে তার উপর উভয়ে মাথা রেখে বিশ্রাম করলেন। এ সময় মুসা (আলাইহিস সালাম) ঘুমিয়ে পড়লেন আর মাছটি (জীবিত হয়ে) নড়াচড়া করতে করতে থলে থেকে বের হয়ে নদীতে নেমে গেল। এরপর সে নদীতে সুড়ঙ্গ আকারে আপন পথ করে নিল আর আল্লাহ মাছটির চলার পথে পানির গতি থামিয়ে দিলেন। ফলে তার গমন পথটি সুড়ঙ্গের ন্যায় হয়ে গেল।
এ সময় নবী (ﷺ) হাতের ইশারা করে বললেন, এভাবে সুড়ঙ্গের মত হয়েছিল। এরপর তাঁরা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন। অবশেষে যখন পরের দিন ভোর হল তখন মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর যুবক সাথীকে বললেন, আমার ভোরের খাবার আন। আমি এ সফরে খুব ক্লান্তি অনুভব করছি। বস্তুতঃ মুসা (আলাইহিস সালাম) যে পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশিত স্থানটি অতিক্রম না করেছেন সে পর্যন্ত তিনি সফরে কোন ক্লান্তিই অনুভব করেন নি।
তখন তাঁর সাথী তাঁকে বললেন, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন সেই পাথরটির কাছে বিশ্রাম নিয়েছিলাম (তখন মাছটি পানিতে চলে গেছে) মাছটি চলে যাওয়ার কথা বলতে আমি একেবারেই ভুলে গেছি। প্রকৃতপক্ষে আপনার কাছে তা উল্লেখ করতে একমাত্র শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। বস্তুতঃ মাছটি নদীতে আশ্চার্যজনকভাবে নিজের পথ করে নিয়েছে। (রাবী বলেন) পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত, আর তাঁদের জন্য ছিল একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে বললেন, সেটাইতো সেই স্থান যা আমার খুঁজে বেড়াচ্ছি। এরপর উভয়ে নিজ নিজ পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে পিছনের দিকে ফিরে চললেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা উভয়ে সেই পাথরটির কাছে এসে পৌছলেন এবং দেখলেন সেখানে একজন লোক কাপড়ে আবৃত হয়ে আছেন। মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করলেন। তিনি সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো ? তিনি বললেন, আমি মূসা (আমি এ দেশের লোক নই।) তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈলের (নবী) মূসা ? তিনি বললেন, হাঁ, আমি আপনার নিকট এসেছি, সরল সঠিক জ্ঞানের ঐ সব কথাগুলো শিখার জন্য যা আপনাকে শিখানো হয়েছে। তিনি বললেন, হে মুসা! আমার আল্লাহ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে যা আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনি তা জানেন। আর আপনারও আল্লাহ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আমি তা জানি না। মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি আমার সাথে থেকে ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হবেন না, আর আপনি এমন বিষয়ে ধৈর্য রাখবেন কি করে, যার রহস্য অনুধাবন করা আপনার জানা নেই? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে একজন ধৈর্য ধারণকারী হিসেবে দেখতে পাবেন। আমি আপনার কোন নির্দেশই অমান্য করব না। এরপর তাঁরা উভয়ে রওয়ানা হয়ে নদীর তীর দিয়ে চলতে লাগলেন।
এমন সময় একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তারা তাদেরকেও নৌকায় উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলেন। তারা খাযির (আলাইহিস সালাম)- কে চিনে ফেললেন এবং তারা তাঁকে তাঁর সঙ্গীসহ পারিশ্রমিক ব্যতিরেকেই নৌকায় তুলে নিল। তাঁরা দু’জন যখন নৌকায় আরোহণ করলেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির এক পাশে বসল এবং একবার কি দু’বার নদীর পানিতে সে তার ঠোঁট ডুবাল। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, হে মুসা! আমার এবং তোমার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহর জ্ঞান হতে ততটুকুও হ্রাস পায়নি যতটুকু এ পাখিটি তার ঠোঁটের সাহায্যে পানি হ্রাস করেছে। তারপর খাযির (আলাইহিস সালাম) হঠাৎ করে একটি কুঠার নিয়ে নৌকার একটি তক্তা খুলে ফেললেন, মুসা (আলাইহিস সালাম) অকস্মাৎ দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন তিনি খুঠার দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেন। তখন তাঁকে তিনি বললেন, আপনি এ কি করলেন? লোকেরা আমাদের পারিশ্রমিক ছাড়া নৌকায় তুলে নিল, আর আপনি তাদের নৌকার আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকাটি ছিদ্র করে দিলেন? এত আপনি একটি গুরুতর কাজ করলেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি কখনও আমার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি সে বিষয়টি ভুলে গেছি, তার জন্য আমাকে দোষারোপ করবেন না। আর আমার এ আচরণে আমার প্রতি কঠোর হবেন না। মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর পক্ষ থেকে প্রথম এই কথাটি ছিল ভুলক্রমে।
এরপর যখন তাঁরা উভয়ে নদী পার হয়ে আসলেন, তখন তাঁরা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন সে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলছিল। খাযির (আলাইহিস সালাম) তার মাথা ধরলেন এবং নিজ হাতে ছেলেটির ঘাড় পৃথক করে ফেললেন। একথাটি বুঝানোর জন্য সুফিয়ান (রাহঃ) তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলোর অগ্রভাগ দ্বারা এমনভাবে ইশারা করলেন যেন তিনি কোন জিনিস ছিড়ে নিচ্ছিলেন। এতে মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, আপনি কি একটি নিষ্পাপ ছেলেকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? নিশ্চয়ই আপনি এটা গর্হিত কাজ করলেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনাকে বলিনি যে,আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না? মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি তাহলে আপনি আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখবেন না। কেননা আপনার ওযর আপত্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এরপর তাঁরা চলতে লাগলেন শেষ পর্যন্ত তাঁরা এক লোকালয়ে এসে পৌছলেন।
তাঁরা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাঁদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। তারপর তাঁরা সেখানেই একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তা একদিকে ঝুঁকে গিয়েছিল। খাযির (আলাইহিস সালাম) তা নিজের হাতে সোজা করে দিলেন। রাবী আপন হাতে এভাবে ইশারা করলেন। আর সুফিয়ান (রাহঃ) এমনিভাবে ইঙ্গিত করলেন যেন তিনি কোন জিনিস উপরের দিকে উচিয়ে দিচ্ছেন। “ঝুকে পড়েছে” একথাটি আমি সুফিয়ানকে মাত্র একবার বলতে শুনেছি। মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, তারা এমন মানুষ যে, আমরা তাদের কাছে আসলাম, তারা আমাদেরকে না খাবার পরিবেশন করল, না আমাদের মেহমানদারী করল আপনি এদের প্রাচীর সোজা করতে গেলেন। আপনি ইচ্ছা করলে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। খাযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, এখানেই আপনার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ হল। তবে এখনই আমি আপনাকে অবহিত করছি ঐসব কথার গুঢ় রহস্য, যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি।
নবী (ﷺ) বলেছেন, আমাদেরতো ইচ্ছা যে, মুসা (আলাইহিস সালাম) ধৈর্যধারণ করলে আমাদের কাছে তাঁদের আরো অনেক বেশী খবর বর্ণিত হতো। সুফিয়ান বর্ণনা করেন নবী (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ মুসা (আলাইহিস সালাম)- এর উপর রহমত বর্ষন করুন। তিনি যদি ধৈর্যধারণ করতেন, তাহলে তাদের উভয়ের ব্যাপারে আমাদের কাছে আরো অনেক ঘটনা বর্ণিত হতো।
রাবী (সাইদ ইবনে জুবাইর) বলেন, ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এখানে পড়েছেন, তাদের সামনে একজন বাদশাহ ছিল, সে প্রতিটি নিখুঁত নৌকা যবরদস্তিমূলক ছিনিয়ে নিত। আর সে ছেলেটি ছিল কাফির, তার মা-বাবা ছিলেন মুমিন। তারপর সুফিয়ান (রাহঃ) আমাকে বলেছেন, আমি এ হাদীসটি তাঁর (আমর ইবনে দীনার) থেকে দু’বার শুনেছি এবং তাঁর নিকট হতেই মুখস্থ করেছি। সুফিয়ান (রাহঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কি আমর ইবনে দীনার (রাহঃ) থেকে শোনার আগেই তা মুখস্থ করেছেন না অপর কোন লোকের নিকট শুনে তা মুখস্থ করেছেন? তিনি বললেন, আমি কার নিকট থেকে তা মুখস্থ করতে পারি? আমি ছাড়া আর কেউ কি এ হাদীস আমরের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন? আমি তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি দুইবার কি তিনবার। আর তাঁর থেকেই তা মুখস্থ করেছি। আলী ইবনে খুশরম (রাহঃ) সুফিয়ান (রাহঃ) সূত্রে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


বর্ণনাকারী: