আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৮- নবীগণের আঃ আলোচনা

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩৭৭
২০১৬. আল্লাহ তাআলার বাণীঃ আর সামুদ জাতির প্রতি তাদেরই ভাই সালিহকে (আমি নবী করে পাঠিয়েছিলাম)(১১:৬১) আল্লাহ আরো বলেন, হিজরবাসীরা রাসুলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে। (১৫ঃ ৮০) الْحِجْرُ সামুদ সম্প্রদায়ের বসবাসের স্থান। حَرْثٌ حِجْرٌ অর্থ নিষিদ্ধ ক্ষেত। প্রত্যেক নিষিদ্ধ বস্তুকে حِجْرٌ বলা হয়। আর এই অর্থেই حِجْرٌ مَحْجُورٌ বলা হয়ে থাকে। الْحِجْرُ তুমি যে সব ভবন নির্মাণ কর। তুমি যমীনের যে অংশ ঘেরাও করে রাখ তাও حِجْرٌ। এ কারণেই হাতীমে কাবাকে حِجْرٌ নামে অবহিত করা হয় তা যেন حَطِيمُ শব্দটি مَحْطُومٍ অর্থে ব্যবহৃত যেমন قَتِيلٍ শব্দটি مَقْتُولٍ অর্থে ব্যবহৃত। ঘোড়ীকেও حِجْرٌ বলা হয়। আর বুদ্ধি বিবেকের অর্থে حِجْرٌ وَحِجًى বলা হয়। তবে حَجْرُ الْيَمَامَةِ একটি স্থানের নাম।
৩১৩৮। হুমায়দী (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে যাম‘আ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ) থেকে শুনেছি, এবং তিনি যে লোক (সালিহ (আঃ)- এর) উঠনী যখম করেছিল তাঁর উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, উটনীকে হত্যা করার জন্য এমন এক লোক (কিদার) তৈরী হয়েছিল যে তাঁর গোত্রের মধ্যে প্রবল ও শক্তিশালী ছিল, যেমন ছিল আবু যাম‘আ।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম ও তাঁর উটনী

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে অতীতের যে সমস্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির ঘটনা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে ছামূদ জাতি। এ সম্প্রদায় মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও তাদের সমাজে নানা রকম অন্যায়-অপরাধ বিস্তার লাভ করেছিল। হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম ছিলেন এ জাতিরই একজন লোক। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর লক্ষ্যে তাঁকে নবী করে পাঠান। কিন্তু কওমের অধিকাংশ লোকই তাঁর কথা প্রত্যাখ্যান করল।
হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম যৌবন থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত ক্রমাগত তাদের মধ্যে তাবলীগের কাজ করে যেতে থাকেন। শেষপর্যন্ত তারা দাবি করল, আপনি যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকেন, তবে আপনি এই পাহাড় থেকে কোনও উটনী বের করে আমাদের সামনে উপস্থিত করুন। এটা করতে পারলে আমরা আপনার প্রতি ঈমান আনব। হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম দুআ করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দুআয় পাহাড় থেকে একটি উটনী বের করে দেখালেন। তা দেখে কিছু লোক তো ঈমান আনল, কিন্তু তাদের বড় বড় সর্দার কথা রাখল না। তারা যে তাদের জেদ বজায় রাখল তাই নয়; বরং অন্য যেসব লোক ঈমান আনতে ইচ্ছুক ছিল তাদেরকেও নিবৃত্ত করল।
হযরত সালিহ আলাইহিস সালামের আশঙ্কা হল, ওয়াদা ভঙ্গের কারণে তাদের উপর আল্লাহ তাআলার কোনও আযাব এসে যেতে পারে। তাই তাদেরকে বললেন, তোমরা অন্ততপক্ষে এ উটনীটির কোনও ক্ষতি করো না। তাকে স্বাধীনভাবে চলে ফিরে খেতে দাও।
উটনীটির পূর্ণ এক কুয়া পানি দরকার হত। তাই তিনি পালা বণ্টন করে দিলেন যে, একদিন উটনীটি পানি পান করবে এবং একদিন এলাকার লোকে। কিন্তু কওমের লোক গোপনে চক্রান্ত করল। তারা ঠিক করল উটনীটিকে হত্যা করবে। পরিশেষে ‘কুদার' নামক এক ব্যক্তি সেটিকে হত্যা করল। এ অবস্থায় হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে সতর্ক করে দিলেন যে, এখন শাস্তি আসতে মাত্র তিন দিন বাকি আছে। অতঃপর তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
কোনও কোনও রেওয়ায়েতে আরও আছে, তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই তিন দিনের প্রতিদিন তাদের চেহারার রং পরিবর্তন হতে থাকবে। প্রথম দিন চেহারার রং হবে হলুদ, দ্বিতীয় দিন লাল এবং তৃতীয় দিন সম্পূর্ণ কালো হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও জেদি সম্প্রদায়টি তাওবা ও ইস্তিগফারে রত হল না; বরং তারা হযরত সালিহ আলাইহিস সালামকেই হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পথেই ধ্বংস করে দেন। ফলে তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্যদিকে হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম যেমন বলেছিলেন, সেভাবেই তাদের তিন দিন কাটে। এ অবস্থায়ই প্রচণ্ড ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। সেইসাথে আসমান থেকে এক ভয়াল শব্দ আসতে থাকে এবং তাতে গোটা সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যায়।
যে ব্যক্তি উটিনীটিকে হত্যা করেছিল, কুরআন মাজীদে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا (যখন তাদের দূর্ভাগা লোকটি উদ্যত হল)। এরই ব্যাখ্যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- (সেটিকে হত্যা করতে উদ্যত হল এক প্রভাবশালী দুরাচার ব্যক্তি, যে নিজ গোত্রে ছিল অত্যন্ত শক্তিমান)। সে ছিল ছামূদ জাতির একজন প্রতাপশালী লোক। ছিল অত্যন্ত দুষ্কৃতিপরায়ণ, নানারকম অশান্তি ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বেড়াত এবং ছিল শক্তিশালী ও সুরক্ষিত। যে-কোনও প্রতিকূলতায় তার লোকজন তাকে সুরক্ষা দিত।
কিন্তু এসব শক্তি-ক্ষমতা আল্লাহর আযাব থেকে তাকে রক্ষা করতে পারল না। উটনী হত্যার পরিণামে তাকে তো বটেই, তার কাজে সমর্থন যোগানোর অপরাধে গোত্রের সকলকেও চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে فَدَمْدَمَ عَلَيْهِمْ رَبُّهُمْ بِذَنْبِهِمْ فَسَوَّاهَا পরিণামে তাদের প্রতিপালক তাদের গুনাহের কারণে তাদেরকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে সব একাকার করে ফেললেন।৩২৬

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবীর শিক্ষা অমান্য করা দুর্ভাগার কাজ। তাই মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

খ. কোনও ব্যক্তি বা জাতি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আল্লাহর আযাব ও গবর থেকে বাঁচতে পারে না। আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করা।

৩২৬. সূরা শামস (৯১), আয়াত ১৪
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন