আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
১৬. নিহতের রক্তপণ সংক্রান্ত অধ্যায়
হাদীস নং: ১৪২২
আন্তর্জাতিক নং: ১৪২২
কাসামা।[১]
১৪২৬. কুতায়বা (রাহঃ) ..... সাহল ইবনে আবী হাছমা ও রাফি ইবনে মাসউদ ইবনে যায়দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তারা উভয়ে বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে সাহল ইবনে যায়দ এবং মুহায়্যিসা ইবনে মাসউদ ইবনে যায়দ (কাজের উদ্দেশ্যে) ঘর থেকে বের হয়ে পড়েন। খায়বর পৌছে তারা বিছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে যান। পরে মুহায়্যিসা (রাযিঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে সাহলকে নিহত হিসাবে দেখতে পান। অনন্তর তিনি হুওয়ায়্যিসা ইবনে মাসউদ ও আব্দুর রহমান ইবনে সাহল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে এলেন। এদের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ট ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে সাহল। তিনি তার সঙ্গীদের পূর্বে কথা বলতে গেলেন কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন, বড়কে বড় হিসাবে মর্যাদা দাও। ফলে তিনি চুপ করলেন এবং তার দুই সঙ্গী কথা বলল তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে আব্দুল্লাহ ইবনে সাহলের হত্যার কথা উল্লেখ করল তখন তিনি তাদের বললেন, তোমাদের পঞ্চাশ জন কি কসম করতে পারবে? আর এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের (সঙ্গীর) হত্যাকারীর অধিকার পেয়ে যাবে। তারা বলল, কেমন করে আমরা কসম করব আমরা তো প্রত্যক্ষ করি নি? তিনি বললেন, তা হলে ইয়াহুদীরা পঞ্চশজন কসম করে তোমাদের (কসম) করা থেকে মুক্ত করে দিবে। তারা বলল, কাফির সম্প্রদায়ের কসম আমরা কেমন করে গ্রহণ করতে পারি? শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের থেকে তার দিয়াত দিয়ে দিলেন। - ইবনে মাজাহ ২৬৭৭, নাসাঈ
[১]অর্থাৎ কোন মহল্লায় কাউকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেলে মহল্লার পঞ্চাশজন অধিবাসী এবং তাদের আশেপাশের লোকেরা শপথ করে বলবে যে, তারা তাকে হত্যা করেনি এবং হত্যাকারী সম্পর্কেও তারা কিছু জানেনা। এ ধরণের কসমের পর স্থানীয় অধিবাসীরা হত্যার দায়িত্ব থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।
হাসান ইবনে আলী খাললাল (রাহঃ) ...... সাহল ইবনে আবী হাছমা এবং রাফি ইবনে খাদীজ (রাযিঃ) থেকে এ মর্মে বর্ণিত আছে। ইমাম আবু ঈসা (রাহঃ) বলেন, এই হাদীসটি হাসান-সহীহ। কাসামার বিষয়ে এতদনুসারে আলেমগণের আমল রয়েছে। মদীনার কতক ফকীহ কাসামার মাধ্যমে কিসাস গ্রহণের মত প্রকাশ করেছেন। কুফাবাসী এবং অপরাপর কতক আলিম বলেন, কাসামার মাধ্যমে কিসাস হয় না, এতে দিয়াত ধার্য হয়।[ এ হল ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-এর অভিমত ]
[১]অর্থাৎ কোন মহল্লায় কাউকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেলে মহল্লার পঞ্চাশজন অধিবাসী এবং তাদের আশেপাশের লোকেরা শপথ করে বলবে যে, তারা তাকে হত্যা করেনি এবং হত্যাকারী সম্পর্কেও তারা কিছু জানেনা। এ ধরণের কসমের পর স্থানীয় অধিবাসীরা হত্যার দায়িত্ব থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।
হাসান ইবনে আলী খাললাল (রাহঃ) ...... সাহল ইবনে আবী হাছমা এবং রাফি ইবনে খাদীজ (রাযিঃ) থেকে এ মর্মে বর্ণিত আছে। ইমাম আবু ঈসা (রাহঃ) বলেন, এই হাদীসটি হাসান-সহীহ। কাসামার বিষয়ে এতদনুসারে আলেমগণের আমল রয়েছে। মদীনার কতক ফকীহ কাসামার মাধ্যমে কিসাস গ্রহণের মত প্রকাশ করেছেন। কুফাবাসী এবং অপরাপর কতক আলিম বলেন, কাসামার মাধ্যমে কিসাস হয় না, এতে দিয়াত ধার্য হয়।[ এ হল ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-এর অভিমত ]
باب مَا جَاءَ فِي الْقَسَامَةِ
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا اللَّيْثُ بْنُ سَعْدٍ، عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، عَنْ بُشَيْرِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ أَبِي حَثْمَةَ، قَالَ يَحْيَى وَحَسِبْتُ عَنْ رَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ، أَنَّهُمَا قَالاَ خَرَجَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَهْلِ بْنِ زَيْدٍ وَمُحَيِّصَةُ بْنُ مَسْعُودِ بْنِ زَيْدٍ حَتَّى إِذَا كَانَا بِخَيْبَرَ تَفَرَّقَا فِي بَعْضِ مَا هُنَاكَ ثُمَّ إِنَّ مُحَيِّصَةَ وَجَدَ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ سَهْلٍ قَتِيلاً قَدْ قُتِلَ فَدَفَنَهُ ثُمَّ أَقْبَلَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم هُوَ وَحُوَيِّصَةُ بْنُ مَسْعُودٍ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ سَهْلٍ وَكَانَ أَصْغَرَ الْقَوْمِ ذَهَبَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ لِيَتَكَلَّمَ قَبْلَ صَاحِبَيْهِ قَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " كَبِّرِ الْكُبْرَ " . فَصَمَتَ وَتَكَلَّمَ صَاحِبَاهُ ثُمَّ تَكَلَّمَ مَعَهُمَا فَذَكَرُوا لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَقْتَلَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَهْلٍ فَقَالَ لَهُمْ " أَتَحْلِفُونَ خَمْسِينَ يَمِينًا فَتَسْتَحِقُّونَ صَاحِبَكُمْ أَوْ قَاتِلَكُمْ " . قَالُوا وَكَيْفَ نَحْلِفُ وَلَمْ نَشْهَدْ قَالَ " فَتُبَرِّئُكُمْ يَهُودُ بِخَمْسِينَ يَمِينًا " . قَالُوا وَكَيْفَ نَقْبَلُ أَيْمَانَ قَوْمٍ كُفَّارٍ فَلَمَّا رَأَى ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَعْطَى عَقْلَهُ .
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَخْبَرَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ بُشَيْرِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ أَبِي حَثْمَةَ، وَرَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ، نَحْوَ هَذَا الْحَدِيثِ بِمَعْنَاهُ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ فِي الْقَسَامَةِ وَقَدْ رَأَى بَعْضُ فُقَهَاءِ الْمَدِينَةِ الْقَوَدَ بِالْقَسَامَةِ . وَقَالَ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَهْلِ الْكُوفَةِ وَغَيْرِهِمْ إِنَّ الْقَسَامَةَ لاَ تُوجِبُ الْقَوَدَ وَإِنَّمَا تُوجِبُ الدِّيَةَ . آخِرُ أَبْوَابِ الدِّيَاتِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ .
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَخْبَرَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ بُشَيْرِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ سَهْلِ بْنِ أَبِي حَثْمَةَ، وَرَافِعِ بْنِ خَدِيجٍ، نَحْوَ هَذَا الْحَدِيثِ بِمَعْنَاهُ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ فِي الْقَسَامَةِ وَقَدْ رَأَى بَعْضُ فُقَهَاءِ الْمَدِينَةِ الْقَوَدَ بِالْقَسَامَةِ . وَقَالَ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَهْلِ الْكُوفَةِ وَغَيْرِهِمْ إِنَّ الْقَسَامَةَ لاَ تُوجِبُ الْقَوَدَ وَإِنَّمَا تُوجِبُ الدِّيَةَ . آخِرُ أَبْوَابِ الدِّيَاتِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি খায়বার যুদ্ধপরবর্তী একটি ঘটনা। বিভিন্ন হাদীসে ঘটনাটি সংক্ষেপে/ বিস্তারিত বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় সামান্য গরমিলও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কিছুটা ব্যাখ্যা সহকারে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো।
এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।
তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।
এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।
যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?
বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।
লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :
ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।
খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।
গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৭ম সালে। এখানকার অধিবাসীগণ ছিল ইহুদী। যুদ্ধে ইহুদীদের পরাজয় হয়। এখানকার সমস্ত দুর্গ ও জমি-জায়েদাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তিনি চাইলে সমস্ত ইহুদীকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তা না করে তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। তাদেরকে এ শর্তে এখানে থাকার অনুমতি দেন যে, তারা মুসলিমদের পক্ষে চাষাবাদের কাজ করবে। তাতে যে ফল ও ফসল উৎপন্ন হবে তার অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে। এভাবে বর্গাচাষের চুক্তিতে তারা এখানে অবস্থানের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করাই যাদের স্বভাব, তাদের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষার আশা কিভাবে করা যায়? গোপনে তারা একের পর এক দুষ্কৃতি করে যেতে থাকে। ইতিহাস ও হাদীছ গ্রন্থসমূহে তাদের দুষ্কৃতির নানা ঘটনা বর্ণিত আছে। এ হাদীছেও সেরকম একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
ইহুদী এলাকায় একজন মুসলিম হত্যার ঘটনা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি. ও মুহায়্যিসা ইবন মাস'উদ রাযি. খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে খায়বার গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তারা দু'জন খেজুরের সন্ধানে দুই দিকে চলে যান। পরে মুহায়্যিসা রাযি. সংবাদ পান যে, কে বা কারা আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে আসেন। এসে দেখতে পান ঠিকই আব্দুল্লাহ রাযি.-কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছেন। সেখানকার ইহুদীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কেউ তাঁকে হত্যা করার কথা স্বীকার করল না। অগত্যা তিনি সেখানে তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন করে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসলেন।
তারপর আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাযি.-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. এবং মাস'উদের পুত্রদ্বয় মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. — এ তিনজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তিনজনই একই গোত্রের লোক। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা অর্থাৎ মুহায়্যিসা রাযি. ও হুওয়ায়্যিসা রাযি. ছিলেন আব্দুর রহমান রাযি.-এর পিতা সাহলের চাচাতো ভাই।
এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবন সাহল রাযি. ছিলেন বয়সে সকলের ছোট। তিনি যেহেতু নিহতের ভাই, তাই বিচার প্রার্থনার জন্য সবার আগে তিনি কথা বলতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাঁকে ক্ষান্ত করে দিলেন যে, বড়দের কথা বলতে দাও। সুতরাং তিনি ক্ষান্ত হয়ে গেলেন এবং অপর দু'জন কথা বললেন। বিভিন্ন বর্ণনা সামনে রাখলে বোঝা যায় মৌলিকভাবে কথা বলেছিলেন হুওয়ায়্যিসা রাযি। তিনি বয়সে সকলের বড় ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় যে দু'জনই কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এ হিসেবে যে, সম্ভবত হুওয়ায়্যিসা রাযি. -এর কথা বলার মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মুহায়্যিসা রাযি.-ও দু’-একটি কথা বলেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এ ঘটনায় হুওয়ায়্যিসা রাযি. উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন মুহায়্যিসা রাযি.। তবে মামলার মূল বাদী ছিলেন নিহতের ভাই আব্দুর রহমান রাযি। একই খান্দানের হওয়ায় আব্দুর রহমান রাযি.-এর সহযোগী হিসেবে অপর দু'জন উপস্থিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মুহায়্যিসা রাযি. তো আব্দুল্লাহ রাযি.-এর সফরসঙ্গীই ছিলেন এবং দাফন-কাফনের কাজও তিনিই সম্পন্ন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়োজ্যেষ্ঠ হুওয়ায়্যিসা রাযি.-কে যে কথা বলতে বলেছিলেন তা মূলত বাদী হিসেবে নয়; বরং কেবলই তাঁর শোনা কথার বর্ণনাদাতা হিসেবে। অর্থাৎ তিনি মুহায়্যিসা রাযি.-এর নিকট যা-কিছু শুনেছেন হুবহু তা বর্ণনা করতে বলেছেন। যখন দাবির পর্যায় আসে, তখন আব্দুর রহমান রাযি.-কেই কথা বলতে বলা হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে যে, আব্দুর রহমান রাযি. তাঁদের দু'জনকে নিজের পক্ষ থেকে ওকিল বানিয়ে দিয়েছিলেন।
যাহোক মামলার পূর্ণ বিবরণ সামনে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা কি কসম করবে এবং তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণের অধিকার লাভ করবে?
বিভিন্ন বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। সে অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদীপক্ষকে বলেছিলেন— তোমাদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে তোমাদের নিহত ব্যক্তির রক্তপণ গ্রহণের অধিকার পেতে পার। তারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কিভাবে হতে পারে? আমরা তো নিজ চোখে তা দেখিনি, সুতরাং কিভাবে কসম করব? তখন তিনি বললেন, তাহলে ইহুদীদের মধ্য থেকে ৫০ জন কসম খেয়ে অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করুক। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা তো একটি কাফের সম্প্রদায়। অর্থাৎ তারা মিথ্যা কসম করতে দ্বিধাবোধ করবে না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করে দিলেন। তার পরিমাণ ছিল ১০০ উট। পরিভাষায় এ রক্তপণকে দিয়াত বলা হয়।
লক্ষণীয়, এ মামলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে ফয়সালা দান করেননি। নিহত ব্যক্তি একজন মুসলিম ও সাহাবী। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদীদের এলাকায়। স্পষ্ট কথা সন্দেহের তির তাদের দিকেই যায়। তাদেরকে চাপে ফেলার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। দিয়াতের ১০০টি উট সম্মিলিতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিলেন। তিনি দিয়াতের উট নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করলেন। বাদীপক্ষও বঞ্চিত হলো না এবং বিবাদীরাও হয়রানির শিকার হলো না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
হাদীছটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিম্নরূপ :
ক. বয়সে যে বড় তাকে সম্মান দেখানো চাই। তার একটা দিক এইও যে, কথা বলার সময় বড়কে আগে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।
খ. চাচাতো ভাই বা চাচাতো ভাতিজা কোনও বিপদের সম্মুখীন হলে 'চাচাতো' বলে পাশ কাটাতে নেই; বরং তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া চাই।
গ. সফরসঙ্গীর একটা হক হলো তার মসিবতে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করা। সফরসঙ্গী মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ. বিচারকের উচিত বিচারকার্যে পরিপূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দেওয়া এবং উভয়পক্ষের উপর মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
