আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

১০. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১০২৪
আন্তর্জাতিক নং: ১০২৪
সালাতুল জানাযার দুআ।
১০২৪. আলী ইবনে হুজর (রাহঃ) ..... আবু ইবরাহীম আল-আশহালী তার পিতা থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতুল জানাযায় এই দুআ পড়তেনঃ

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا

হে আল্লাহ আপনি ক্ষমা করুন আমাদের যারা জীবিত, যারা মৃত, যারা উপস্থিত, যারা অনুপস্থিত, যারা ছোট, যারা বড় এবং পুরুষ ও মহিলা সকলকে।

ইয়াহয়াহ বলেন আমাকে আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান হাদীসটি অনুরূপ আবু হুরায়রা (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে রিওয়ায়াত করেছেন। তবে এতে আরো বাড়িয়ে বলেছেনঃ

اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ

হে আল্লাহ! আমাদের মাঝে যাদের জীবিত রেখেছেন তাদেরকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন। আর যাদেরকে মৃত্যু দিয়েছেন তাদেরকে ঈমানের উপর মৃত্যু দান করুন। - ইবনে মাজাহ

এই বিষয়ে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, আয়িশা, আবু কাতাদা জাবির ও আওফ ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। ইমাম আবু ঈসা (রাহঃ) বলেন, আবু ইবরাহীম (রাহঃ) এর পিতা বর্ণিত হাদীসটি হাসান-সহীহ্। হিশাম আদ-দাসতাওয়াঈ ও আলী ইবনুল মুবারক (রাহঃ) এই হাদীসটিকে ইয়াহয়া ইবনে আবী কাছীর-আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে মুরাসালরূপে বর্ণনা করেছেন। ইকরিমা ইবনে আম্মার এটিকে ইয়াহয়া ইবনে আবী কাসির -- আবু সালামা -- আয়িশা (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইকরিমা ইবনে আম্মার (রাহঃ) এর রিওয়ায়াতটি মাহফুজ বা সংরক্ষিত নয়। ইকরিমা অনেক সময় ইয়াহয়া এর হাদীস সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পতিত হন। ইয়াহয়া ইবনে আবী কাছীর আব্দুল্লাহ ইবনে আবী কাতাদা তাঁর পিতা কাতাদা (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে এটি বর্ণিত আছে।

ইমাম আবু ঈসা বলেন, আমি মুহাম্মাদ আল বুখারী কে বলতে শুনেছি যে, হাদীসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সহীহ রিওয়ায়াত হল ইয়াহয়া ইবনে আবী কাছীর - আবু ইব্রাহীব আল আশহালী (রাহঃ) তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণিত রিওয়ায়াতটি। তিরমিযী রহঃ আরো বলেন, আমি তাকে আবু ইবরাহীম আল আশহালী রহঃ এর পিতার নাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু তিনি তা জানেন না বলে উল্লেখ করেছেন।
باب مَا يَقُولُ فِي الصَّلاَةِ عَلَى الْمَيِّتِ
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، أَخْبَرَنَا هِقْلُ بْنُ زِيَادٍ، حَدَّثَنَا الأَوْزَاعِيُّ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، حَدَّثَنِي أَبُو إِبْرَاهِيمَ الأَشْهَلِيُّ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا صَلَّى عَلَى الْجَنَازَةِ قَالَ " اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا " .
قَالَ يَحْيَى وَحَدَّثَنِي أَبُو سَلَمَةَ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِثْلَ ذَلِكَ وَزَادَ فِيهِ " اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ " . قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ وَعَائِشَةَ وَأَبِي قَتَادَةَ وَعَوْفِ بْنِ مَالِكٍ وَجَابِرٍ . قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ وَالِدِ أَبِي إِبْرَاهِيمَ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَرَوَى هِشَامٌ الدَّسْتَوَائِيُّ وَعَلِيُّ بْنُ الْمُبَارَكِ هَذَا الْحَدِيثَ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مُرْسَلاً . وَرَوَى عِكْرِمَةُ بْنُ عَمَّارٍ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ عَائِشَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم . وَحَدِيثُ عِكْرِمَةَ بْنِ عَمَّارٍ غَيْرُ مَحْفُوظٍ وَعِكْرِمَةُ رُبَّمَا يَهِمُ فِي حَدِيثِ يَحْيَى . وَرُوِيَ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي قَتَادَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم . قَالَ أَبُو عِيسَى وَسَمِعْتُ مُحَمَّدًا يَقُولُ أَصَحُّ الرِّوَايَاتِ فِي هَذَا حَدِيثُ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ أَبِي إِبْرَاهِيمَ الأَشْهَلِيِّ عَنْ أَبِيهِ . وَسَأَلْتُهُ عَنِ اسْمِ أَبِي إِبْرَاهِيمَ فَلَمْ يَعْرِفْهُ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে জানাযার নামাযের মশহুর একটি দু'আ বর্ণিত হয়েছে। এ দু'আটি অনেকেরই মুখস্থ আছে। এতে জীবিত, মৃত, ছোট, বড়, পুরুষ, নারী, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্যই পাঁচটি বিষয় প্রার্থনা করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হল পাপমার্জনা। বলা হয়েছে- ...اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا (আল্লাহ! আপনি ক্ষমা করুন আমাদের জীবিতকে, মৃতকে...)। অর্থাৎ সমস্ত মুমিন-মুসলিম নর-নারীর সগীরা-কবীরা সবরকম গুনাহ ক্ষমা করে দিন। যদিও মূল উদ্দেশ্য মায়্যিতের জন্য দু'আ করা, কিন্তু দু'আ যত ব্যাপক হয় ততোই তা কবুলের সম্ভাবনা বেশি। আল্লাহ তা'আলার ক্ষমাশীলতা সর্বব্যাপী। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ
'নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল’। (সূরা নাজম, আয়াত ৩২)

তাই ক্ষমাপ্রার্থনাসহ যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় ব্যাপকভাবে সবাইকে শামিল করে নেওয়া চাই। বিশেষত অন্যের গুনাহের মাগফিরাত কামনাকালে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা তো অধিকতর জরুরি। অন্যের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইব আর নিজ গুনাহের কথা ভুলে থাকব, এটা কী করে সম্ভব? এটা নিজ সম্পর্কে এক রকম সুধারণার মধ্যে পড়ে, যদিও তা মুখে না বলা হয়।

এ দু'আয় প্রথমে যে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা হয়েছে, এটাও দু'আর এক নিয়ম। প্রথমে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা বিনয় ও বন্দেগীর দাবি। একজন গুনাহগারের পক্ষে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার পরেই অন্য কিছু কামনা করা সাজে। গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা না করে অন্যকিছু কমনা করা এক রকম ধৃষ্টতা। বান্দার পক্ষে তা কিছুতেই শোভনীয় নয়।

লক্ষণীয়, মাগফিরাতের দু'আয় صغير (ছোট)-কেও শামিল রাখা হয়েছে। ছোট দ্বারা যদি তুলনামূলক ছোটকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ এমন ছোট, যে বালেগ বটে কিন্তু অন্যান্য বয়স্কদের তুলনায় বয়সে ছোট, তবে কোনও প্রশ্ন থাকে না। কেননা এরূপ ছোট গুনাহগার হতে পারে। তাই তারও মাগফিরাত প্রয়োজন। পক্ষান্তরে ছোট যদি হয় নাবালেগ, তখন তার তো কোনও গুনাহ নেই। এ অবস্থায় তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করার কী অর্থ?

কেউ কেউ বলেছেন, এ ক্ষেত্রে মাগফিরাত দ্বারা মর্যাদা উঁচু করা বোঝানো উদ্দেশ্য। যেন বলা হচ্ছে, হে আল্লাহ! আপনি এ শিশুকে উচ্চমর্যাদা দান করুন। এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য শিশুর পরবর্তী জীবন। অর্থাৎ বড় হওয়ার পর তার দ্বারা যদি কোনও গুনাহ হয়ে যায়, তবে আপনি তার জন্য মাগফিরাত নসীব করুন। কারও কারও মতে এখানে ছোটর উল্লেখ কেবলই দু'আর ভেতর অধিকতর ব্যাপকতা আনয়নের জন্য, যেহেতু দু'আ যত বেশি ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের সম্ভাবনা থাকে।

দু'আটির দ্বিতীয় বিষয়বস্তু হল ইসলামের উপর অবিচল থাকার কামনা। বলা হয়েছে– اللهم مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلام (হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখেন, তাকে জীবিত রাখুন ইসলামের উপর)। অর্থাৎ আমরা যে ইসলামের উপর আছি, এটা আপনারই দান। হে আল্লাহ! মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের উপর আপনার এ দান অব্যাহত রাখুন। আমরা যেন কোনও অবস্থায়ই ইসলাম থেকে সরে না যাই। যতদিন জীবিত থাকি, যেন মুসলিমরূপেই জীবিত থাকি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন ইসলামের শিক্ষা মেনে চলি।

দু'আটির তৃতীয় বিষয় হল ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু। বলা হয়েছে– وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيمَانِ (আর যাকে মৃত্যুদান করেন, তাকে মৃত্যুদান করুন ঈমানের উপর)। ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু মানবজীবনের পরম কামনা। এটা মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। কেউ যদি সারা জীবনও ইসলামের উপর জীবনযাপন করে, কিন্তু মৃত্যু ঈমানের সঙ্গে না হয়, তবে সে কিছুতেই নাজাত পাবে না। নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু জরুরি। অনেক সময় মুমিন-মুসলিম ব্যক্তিও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঈমানহারা হয়ে যায় এবং বেঈমান অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে শয়তানও জোর তৎপরতা চালায়। এটা তার জন্য মানুষকে ঈমানহারা করার শেষ সুযোগ। মৃত্যুযন্ত্রণার ভেতর শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে অনেকে ঈমান হারিয়েও ফেলে। তাই ঈমানের সঙ্গে যাতে মৃত্যু হয়, প্রত্যেকেরই সেই আশা ও চেষ্টা থাকা উচিত। সে চেষ্টা হচ্ছে সর্বদা ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা। এ দু'আ অতীব জরুরি হওয়ায় জানাযার নামাযের মধ্যেও একে দাখিল করে দেওয়া হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মায়্যিতসহ জীবিত ও মৃত সকল মুমিন নর-নারীর জন্য কল্যাণকামী থাকা।

খ. গুনাহ থেকে মাগফিরাতলাভ সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। তাই যে-কোনও অবকাশে নিজের ও অন্যদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে হবে।

গ. দু'আ যত ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের আশা থাকে। তাই যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় নিজের সঙ্গে অন্যদেরও শামিল রাখা চাই।

ঘ. আখিরাতের নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ জরুরি। তাই সদাসর্বদা নিজ ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকার পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আও করা উচিত যাতে তিনি ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুদান করেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
rabi
বর্ণনাকারী:
জামে' তিরমিযী - হাদীস নং ১০২৪ | মুসলিম বাংলা