আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ

১০. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ৯৭৭
আন্তর্জাতিক নং: ৯৭৭
রুগ্ন ব্যক্তিকে মৃত্যুর সময় কালিমা শোনানো এবং তার জন্য দুআ করা।
৯৭৯. হান্নাদ (রাহঃ) ...... উম্মে সালামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদিগকে বলেছেন, তোমরা কোন অসুস্থ বা মৃত ব্যক্তির কাছে হাযির হলে তার বিষয়ে তোমরা ভাল বলবে। কেননা, তোমরা যা বল ফিরিশতাগণ তদবিষয়ে আমীন বলে থাকেন। উম্মে সালামা (রাযিঃ) বলেন, আবু সালামা (রাযিঃ) এর মৃত্যু হলে আমি নবী (ﷺ) এর কাছে এসে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (আমার স্বামী) আবু সালামা তো ইন্‌তিকাল করেছেন। তিনি বললেন, তুমি বল, হে আল্লাহ আপনি আমাকে এবং তাকে মাফ করে দিন এবং তার পরে আমাকে এর চাইতে উত্তম প্রতিদান দিন। উম্মে সালামা (রাযিঃ) বলেন, পরে আমি বুঝতে পারলাম যে, তার পরবর্তীতে আমাকে আল্লাহ তাআলা তার চাইতে উত্তম ব্যক্তি দান করেছেন। তিনি হলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। - ইবনে মাজাহ, মুসলিম

ইমাম আবু ঈসা (রাহঃ) বলেন, শকীক হচ্ছেন ইবনে সালামা আবু ওয়ায়েল আসাদী। ইমাম আবু ঈসা (রাযিঃ) আরো বলেন, উম্মে সালামা বর্ণিত হাদীসটি হাসান-সহীহ। রোগীকে ইন্‌তিকালের সময় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর তালকীন করা মুস্তাহাব। কতক আলিম বলেন, যদি একবার সে এই কালিমা বলে নেয় তবে পরে অন্য কথা না বললে তাকে পুনরায় তালকীন করা সমীচীন নয় এবং এই বিষয়ে তাকে বার বার চাপ দেওয়া ঠিক নয়। ইবনে মুবারক (রাহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে জনৈক ব্যক্তি তাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর তালকীন করতে থাকে এবং তাকে বার বার এই বিষয়ে তাকিদ করতে থাকে। তখন তিনি বললেন, আমি যখন একবার তা বলেছি তখন পরে অন্য কথা না বলা পর্যন্ত তো আমি এই কথাতেই আছি। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাহঃ) এর এই কথার মর্ম হল তাই যা নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত আছে যে, যার শেষ কথা হবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
باب مَا جَاءَ فِي تَلْقِينِ الْمَرِيضِ عِنْدَ الْمَوْتِ وَالدُّعَاءِ لَهُ عِنْدَهُ
حَدَّثَنَا هَنَّادٌ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ شَقِيقٍ، عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ قَالَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِذَا حَضَرْتُمُ الْمَرِيضَ أَوِ الْمَيِّتَ فَقُولُوا خَيْرًا فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ يُؤَمِّنُونَ عَلَى مَا تَقُولُونَ " . قَالَتْ فَلَمَّا مَاتَ أَبُو سَلَمَةَ أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أَبَا سَلَمَةَ مَاتَ . قَالَ " فَقُولِي اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَلَهُ وَأَعْقِبْنِي مِنْهُ عُقْبَى حَسَنَةً " . قَالَتْ فَقُلْتُ فَأَعْقَبَنِي اللَّهُ مِنْهُ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنْهُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم . قَالَ أَبُو عِيسَى شَقِيقٌ هُوَ ابْنُ سَلَمَةَ أَبُو وَائِلٍ الأَسَدِيُّ . قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ أُمِّ سَلَمَةَ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَقَدْ كَانَ يُسْتَحَبُّ أَنْ يُلَقَّنَ الْمَرِيضُ عِنْدَ الْمَوْتِ قَوْلَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ . وَقَالَ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ إِذَا قَالَ ذَلِكَ مَرَّةً فَمَا لَمْ يَتَكَلَّمْ بَعْدَ ذَلِكَ فَلاَ يَنْبَغِي أَنْ يُلَقَّنَ وَلاَ يُكْثَرَ عَلَيْهِ فِي هَذَا . وَرُوِيَ عَنِ ابْنِ الْمُبَارَكِ أَنَّهُ لَمَّا حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ جَعَلَ رَجُلٌ يُلَقِّنُهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَكْثَرَ عَلَيْهِ فَقَالَ لَهُ عَبْدُ اللَّهِ إِذَا قُلْتُ مَرَّةً فَأَنَا عَلَى ذَلِكَ مَا لَمْ أَتَكَلَّمْ بِكَلاَمٍ . وَإِنَّمَا مَعْنَى قَوْلِ عَبْدِ اللَّهِ إِنَّمَا أَرَادَ مَا رُوِيَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم " مَنْ كَانَ آخِرُ قَوْلِهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অন্য বর্ণনায় হাদীসটি কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমার স্বামী) আবু সালামার কাছে আসলেন। (তাঁর মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল) তাঁর চোখ খোলা অবস্থায় ছিল। তিনি তা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, রূহ যখন কবজ করা হয়, তখন চোখ তার অনুগামী হয়। এ কথায় ঘরের লোকেরা চিৎকার করে উঠল। তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের জন্য কেবল কল্যাণেরই দু'আ করো। কেননা ফিরিশতাগণ তোমরা যা বল তাতে আমীন বলে থাকে। তারপর বললেন, হে আল্লাহ আবু সালামাকে ক্ষমা করুন। তার মর্যাদা হিদায়াতপ্রাপ্তদের স্থানে উন্নীত করুন। তার পরে যারা অবশিষ্ট আছে, তাদের মধ্যে কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে দিন। ইয়া রাব্বাল আলামীন! আমাদেরকে এবং তাকেও ক্ষমা করুন। তার কবর প্রশস্ত করে দিন। এবং তার জন্য তাতে আলোর ব্যবস্থা করে দিন।

ব্যাখ্যাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী আবু সালামা রাযি. উহুদের যুদ্ধে জখম হয়েছিলেন। তাঁর সে জখমের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। তিনি মৃত্যুমুখে। তিনি মদীনা থেকে খানিকটা দূরে আওয়ালিতে বাস করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শিয়রে হাজির হলেন। ততক্ষণে তাঁর ইন্তিকাল হয়ে গেছে। তাঁর চোখদু'টি খোলা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ইরশাদ করলেন-
إِنَّ الرُّوْحَ إِذَا قُبِضَ، تَبِعَهُ الْبَصَرُ (রূহ যখন কবজ করা হয়, তখন চোখ তার অনুগামী হয়)। অর্থাৎ চোখ তখন রূহের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চলে যাওয়াটা দেখে। প্রশ্ন হতে পারে, চোখ তো ততক্ষণই দেখতে পায়, যতক্ষণ মানুষ জীবিত থাকে, যখন রূহ বের হয়ে যায় এবং মানুষের মৃত্যু ঘটে, তখন অন্যান্য অঙ্গের মতো চোখও তার শক্তি হারিয়ে ফেলে, এ অবস্থায় সে রূহকে দেখে কী করে?

এর উত্তর হল, এটা সেই অবস্থার কথা, যখন রূহ পা থেকে শুরু করে উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং শরীরের অধিকাংশ স্থান থেকে বের হয়ে যায়, কেবল মাথা ও চোখে অবশিষ্ট থাকে। অর্থাৎ যখন মুখ থেকে রূহ বের হতে শুরু করে, তখন চোখ সেদিকে তাকিয়ে থাকে এবং বের হওয়াটা লক্ষ করে। যখন রূহ পুরোপুরি বের হয়ে যায়, তখন দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি লোপ পায়। কেননা মৃত্যু দ্বারা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র অচল হয়ে যাওয়ায় চোখের উপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দৃষ্টিশক্তির সচল থাকাটা তো স্নায়ুতন্ত্রেরই কাজ। স্নায়ুতন্ত্র অচল হওয়ায় সে শক্তিও অচল হয়ে যায়। এ কারণের মৃত্যুকালে তো রূহের চলে যাওয়াটা দেখার জন্য চোখ তাকিয়ে রয়েছিল, যেহেতু তখন স্নায়ু কার্যকর ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পর স্নায়ুর কার্যক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় সেই বেলা চোখ আর বন্ধ হতে পারে না; খোলা অবস্থায়ই থেকে যায়। ফলে তাকিয়ে থাকা চোখ আর বন্ধ হতে পারে না। এ কারণেই মৃত্যুর পর মৃতব্যক্তির চোখ খোলা থাকে। এ হিসেবে 'কবজ করা হয়' এর অর্থ কবজ করা শুরু হয়।

এর আরেকটি জবাব হল, রূহ কবজ হয়ে যাওয়ার পরও শরীরের সঙ্গে এক রকম সম্পর্ক বাকি থাকে। ফলে তখনও মৃতব্যক্তি দেখতে পায়, শুনতে পায় এবং সালামের জবাবও দেয়। তবে তার নড়াচড়া করার শক্তি না থাকায় আমরা তার এসব বিষয় বুঝতে পারি না।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বললেন 'রূহ যখন কবজ করা হয়, তখন চোখ তার অনুগামী হয়', তখন ঘরের লোকজন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। হয়তো কেউ কেউ নিজের সম্পর্কে বদদু'আ করছিল। যেমন প্রিয়জনের মৃত্যুতে কেউ কেউ সীমালঙ্ঘন করে বলে ফেলে- আমার কেন মরণ হল না, সে যখন চলে গেছে তখন আমার বেঁচে থাকার দরকার নেই, আজরাঈল কি আমাকে দেখল না (না'উযুবিল্লাহ) ইত্যাদি। তা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
لَا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ إِلَّا بِخَيْرٍ (তোমরা নিজেদের জন্য কেবল কল্যাণেরই দু'আ করো)। অর্থাৎ নিজেদের জন্য অমঙ্গল কামনা না করে আল্লাহর কাছে মঙ্গল কামনা করো। যে ব্যক্তি চলে গেছে সে তো চলেই গেছে। তাকে তো আর ফেরাতে পারবে না। তার শোকে আকুল হয়ে নিজেদের জন্য কেন অমঙ্গল ডেকে আনবে? বরং দু'আ করো আল্লাহ যেন তোমাদের ধৈর্য দেন, যতদিন হায়াত আছে ততোদিন যেন তাতে বরকত দেন, ঈমান ও আমালে সালিহার উপর রাখেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব করেন।

فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ يُؤَمِّنُوْنَ عَلَى مَا تَقُوْلُوْنَ (কেননা ফিরিশতাগণ তোমরা যা বল তাতে আমীন বলে থাকে)। বলাবাহুল্য তারা মা'সূম সত্তা। তারা কখনও কোনও পাপ করেন না। তারা আল্লাহর অনেক বেশি নিকটবর্তী। ফলে তাদের দু'আ কবুল হয়। এখন তোমরা যদি নিজেদের প্রতি বদদু'আ কর আর তাতে তারা আমীন বলেন, তবে তা তো কবুল হয়ে যাবে। এটা কতইনা বিপজ্জনক কথা। তারচে' নিজেদের জন্য কল্যাণের দু'আ করো। তাতে তারা আমীন বলবেন। ফলে আল্লাহ তা'আলা তা কবুল করবেন। তোমরা কল্যাণের অধিকারী হয়ে যাবে।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ সালামা রাযি.-এর জন্য বড়ই সারগর্ভ দু'আ করেন। দু'আটি হল-
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لأَبِي سَلَمَةَ ، وَارْفَعْ دَرَجَتَهُ فِي الْمَهْدِيِّينَ ، وَاخْلُفْهُ فِي عَقِبِهِ فِي الْغَابِرِينَ ، وَاغْفِرْ لَنَا وَلَهُ يَا رَبَّ الْعَالَمِينَ ، اللَّهُمَّ افْسَحْ فِي قَبْرِهِ وَنَوِّرْ لَهُ فِيهِ
'হে আল্লাহ! আবু সালামাকে ক্ষমা করুন। তার মর্যাদা হিদায়াতপ্রাপ্তদের স্থানে উন্নীত করুন। তার পরে যারা অবশিষ্ট আছে, তাদের মধ্যে কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে দিন। ইয়া রাব্বাল আলামীন! আমাদেরকে এবং তাকেও ক্ষমা করুন। তার কবর প্রশস্ত করে দিন এবং তার জন্য তাতে আলোর ব্যবস্থা করে দিন।'

আমরাও আমাদের মায়্যিতের জন্য এরূপ দু'আ করতে পারি; বরং করাই উচিত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও সম্পর্কে যদি জানা যায় সে মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে, তবে দ্রুত তার কাছে উপস্থিত হওয়া উচিত।

খ. মৃতব্যক্তির খোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দিতে হয়।

গ. প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তখনই উত্তমরূপে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া চাই।

ঘ. উপস্থিত গণ্যমান্যদের উচিত মৃতব্যক্তির পরিবারবর্গকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেওয়া।

ঙ. বিপদ-আপদে অধৈর্য হয়ে বদদু'আ করতে নেই। বরং খুব সতর্কতার সঙ্গে কল্যাণের দু'আ করা উচিত। কেননা সে দু'আয় ফিরিশতাগণ আমীন বলে থাকে এবং তা কবুল হয়ে যায়।

চ. কেউ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তার জন্য দু'আ করা উচিত, যাতে তার মাগফিরাত লাভ হয়, তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়, তার কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়, তার কবরে আলো দেওয়া হয় এবং তার রেখে যাওয়া
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন