আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৭- সৃষ্টি জগতের সূচনা

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩১৯৭
১৯৮৪. সাত যমীন।
২৯৭০। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না (রাহঃ) .... আবু বাকরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন, সে দিন থেকে সময় যেরূপে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেরূপে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যিলকদ , যিলহজ্ব ও মুহাররম তিনটি মাস পরপর রয়েছে। আর এক মাস হল রজব-ই-মুযার* যা জুমাদা ও শাবান মাসের মধ্যে অবস্থিত।
*মুযার একটি সম্প্রদায়ের নাম। আরবের অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে এ সম্প্রদায়টি রজব মাসের সম্মান প্রদর্শনে অতি কঠোর ছিল। তাই এ মাসটিকে তাদের দিকে সম্বন্ধ করে হাদীসে “রজব-মুযার” বলা হয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আবূ বাকরা রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে– বছরে বারো মাস, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, যার তিনটি পরপর। সে তিনটি হচ্ছে যূ–কা'দা, যুলহিজ্জা ও মুহাররাম আর (চতুর্থটি) মুদার গোত্রের রজব মাস, যা জুমাদাল উখরা ও শা'বান মাসের মাঝখানে।
(তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,) এটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটি কি যুলহিজ্জা নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন নগর? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটা কি (মক্কা) নগর নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
(তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,) এটি কোন দিন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটি কি কুরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
তারপর তিনি বললেন, তোমাদের এই মাসে এই নগরে এ দিনটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুণ্ণ করা হারাম), তেমনি তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন–সম্পদ এবং তোমাদের মান–সম্মানও তোমাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুণ্ণ করা হারাম)। তোমরা অচিরেই তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! তোমরা আমার পরে কাফের অবস্থায় ফিরে যেও না যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেবে। শোন! উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। কেননা অসম্ভব নয় যে, যারা এটা (আমার কাছ থেকে) শুনেছে তাদের কতক অপেক্ষা যাদের কাছে পৌঁছানো হবে তাদের কতক বেশি সংরক্ষণকারী হবে।
তারপর তিনি বললেন, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? আমরা বললাম, হাঁ (আপনি পৌঁছে দিয়েছেন)। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪০৬)

এ বর্ণনায় হযরত আবূ বাকরা রাযি. বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন। ভাষণের এ অংশের মূল আলোচ্য বিষয় মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার প্রতি নিষোধাজ্ঞা। এতে প্রথমে জাহিলী যুগের মানুষের একটি স্বেচ্ছাচারিতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের সে স্বেচ্ছাচারিতাটি হল সম্মানিত মাসসমূহ সম্পর্কে। বারো মাসের মধ্যে চারটি মাস আগে থেকেই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে মর্যাদাপূর্ণ মাস হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। কিন্তু তারা নিজেদের ইচ্ছামত তাতে উলটপালট করত। সাধারণত তা করত যুদ্ধ-বিগ্রহকে কেন্দ্র করে। কোনও মাসে তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা হলে যদি সেই মাসটি সম্মানিত মাসসমূহের একটি হত, তবে ঘোষণা করত- এ বছর এ মাসটির বদলে অমুক মাসকে সম্মানিত মাস ধরা হবে। তাদের এ খামখেয়ালিপনা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-

إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ

এই নাসী (অর্থাৎ মাসকে পিছিয়ে নেওয়া) তো কুফরকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফেরদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা এ কাজকে এক বছর হালাল করে নেয় ও এক বছর হারাম সাব্যস্ত করে, যাতে আল্লাহ যে মাসকে নিষিদ্ধ করেছেন তার গণনা পূরণ করতে পারে এবং (এভাবে) আল্লাহ যা হারাম সাব্যস্ত করেছিলেন তাকে হালাল করতে পারে। তাদের কুকর্মকে তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে দেওয়া হয়েছে। (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৩৭)

পবিত্র মাসসমূহের ব্যাপারে জাহিলী যুগের স্বেচ্ছাচারিতা

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে ইরশাদ করেনঃ-

إن الزمان قد استدار كهيئته يوم خلق الله السّماوات والأرض

'আল্লাহ তাআলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে।' অর্থাৎ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মত মাস-বছরের আবর্তন ও কালচক্র আল্লাহ তা'আলারই সৃষ্টি। এটা এমনি-এমনিই হয়ে যায়নি। কাজেই একে এই অর্থে প্রাকৃতিক বিষয় সাব্যস্ত করা সম্পূর্ণ কুফরী যে, এর পেছনে কোনও সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছা কার্যকর নয়; বরং প্রাকৃতিকভাবে এমনি-এমনিই চলছে।

এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য জাহিলী যুগের মানুষের একটি স্বেচ্ছাচারিতাকে রদ করা। মূলত জাহিলী যুগের মানুষ নিষিদ্ধ মাসের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আদর্শ অনুসরণ করত। কিন্তু পরপর তিন মাস যুদ্ধ পেছানো তাদের পক্ষে কঠিন মনে হত। কাজেই কখনও যদি তাদের এ সময়ের ভেতর যুদ্ধের প্রয়োজন হত, তখন মুহাররম মাসের নিষিদ্ধতা তার পরবর্তী মাসে নিয়ে যেত আর এভাবে সফর মাসকে নিষিদ্ধ মাস বানিয়ে নিত। পরের বছর আবার সে নিষিদ্ধতাকে অন্য মাসে পিছিয়ে দিত। এভাবে তারা প্রতি বছর পেছাতে থাকত। পরিশেষে যে বছর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ করলেন, সে বছর ওই নিষিদ্ধতা তাদের ওই হিসাব অনুযায়ী যুলহিজ্জা ও মুহাররম মাসে ফিরে আসল। এদিকে ইঙ্গিত করেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- আল্লাহ তা'আলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে। অর্থাৎ ওই আবর্তনের ধারায় সম্মানিত মাসসমূহের সম্মান যথারীতি আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। তারপর তিনি ইরশাদ করেনঃ-

السنة إثنا عشر شهرا، منها أربعة حرم

‘বছরে বারো মাস, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।'
حرم শব্দটি حرام -এর বহুবচন। حرام -এর অর্থ দু'টি –নিষিদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ। বারো মাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এ সময় ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। আবার এ সময় পাপকর্ম করা অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিকতর জোরদারভাবে নিষিদ্ধ। একসময় এ চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহও নিষিদ্ধ ছিল। কুরআন মাজীদে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ-

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ

‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা বারটি সেইদিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটাই সহজ-সরল দীন (-এর দাবি)। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহের ব্যাপারে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। (সূরা তাওবা (৯),আয়াত ৩৬)
'জুলুম করো না' মানে পাপকর্ম করো না এবং কোনও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ো না। এ মাসসমূহে যুদ্ধ করা যদিও এককালে নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সে নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে যায়। কাজেই এখন প্রয়োজনে এ মাসসমূহে যুদ্ধ করা জায়েয। তবে সর্বাবস্থায়ই এর বিশেষ মর্যাদার প্রতি লক্ষ রাখা চাই।

তারপর ইরশাদ করেনঃ-

ثلاث متواليات : ذو القعدة، وذو الحجة، والمحرم، ورجب مضر الذي بين جمادى وشعبان

তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, যার তিনটি পরপর। সে তিনটি হচ্ছে যূ-কাদা, যুলহিজ্জা ও মুহাররাম আর (চতুর্থটি) মুদার গোত্রের রজব মাস, যা জুমাদাল উখরা ও শা'বান মাসের মাঝখানে।
রজব মাসকে মুদার গোত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত করার কারণ তারা এ মাসকে আরবের অন্যান্য গোত্রের তুলনায় বেশি মর্যাদা দিত। জাহিলী যুগে এ মাসটি উমরার জন্য বরাদ্দ ছিল। নিষিদ্ধ মাসের বাকি তিন মাস হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন করত আর এ মাসে তারা উমরা পালন করত। এভাবে এ মাসটিও হজ্জের মাসসমূহের মত নিষিদ্ধ মাসে পরিণত হয়ে যায়।

পবিত্র মাস, পবিত্র নগর ও কুরবানীর দিবস সম্পর্কে সাহাবীগণকে প্রশ্ন এবং এর উত্তরদানে তাদের আদব

নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন- اي شهر هذا (এটি কোন্ মাস?)। এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল তাদের চেতনাকে জাগ্রত করা এবং তাদের অন্তরে মাসটির মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। কেননা একটু পরেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরার ছিল আর তা হচ্ছে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা।
সাহাবীগণ উত্তর দিলেন- الله ورسوله اعلم (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন)। তারা সরাসরি উত্তর দিলেন না যে, এটি যুলহিজ্জা মাস। এটা ছিল তাদের আদব। তারা উপলব্ধি করছিলেন যে, আসলে এই মাসটির নাম জানতে চাওয়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়। কেননা এটি যে যুলহিজ্জা মাস তা তাঁর অজানা থাকার কোনও কারণ নেই। কাজেই এ প্রশ্নের হয়তো অন্তর্নিহিত কোনও উদ্দেশ্য আছে আর সে উদ্দেশ্য তো তাদের জানা নেই। তাই তারা আদবের সঙ্গে নিবেদন করলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। যেন স্বীকার করে নিলেন আমরা জানি না।

তারপর তিনি চুপ করলেন। কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকলেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল উপস্থিত জনমণ্ডলীকে সজাগ ও সচেতন করা। কেননা কেউ যখন কথা বলার পর চুপ হয়ে যায়, তখন সকলেরই কান খাড়া হয়ে যায়। কী ব্যাপার? তিনি চুপ করে আছেন কেন? তাঁর এ নীরবতা দেখে তাদের মনে বিভিন্ন ধারণাও উঁকি মারতে থাকল। যেমন হযরত আবূ বাকরা রাযি. বলছেনঃ- فسكت، حتى ظننا أنه سيسميه بغير اسمه “তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন”।

তিনি আপন নীরবতা দ্বারা হয়তো এটাই চাচ্ছিলেন যে, তারা উৎকর্ণ হোক ও কৌতূহলী হয়ে উঠুক। স্বাভাবিক অবস্থায় কথা বললে শ্রোতাগণ অনেক সময় তা হালকাভাবে নিয়ে থাকে। কিন্তু তাদেরকে যদি কোনওভাবে চৌকান্না ও কৌতূহলী করে তোলা যায় আর সে অবস্থায় কোনও কথা বলা হয়, তবে তা তাদের অন্তরে বিশেষভাবে রেখাপাত করে থাকে।

মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা

পরিশেষে তিনি বললেন, এটি কি যুলহিজ্জা মাস নয়? সাহাবীগণ স্বীকার করলেন যে, হাঁ, এটি যুলহিজ্জা মাসই। একইরকম প্রশ্ন তিনি মক্কা নগর এবং কুরবানীর দিন সম্পর্কেও করেছিলেন। একের পর এক প্রশ্ন করা, নীরবতা অবলম্বন, তারপর শ্রোতামণ্ডলীর মুখে পবিত্র মাস, পবিত্র নগর ও পবিত্র দিনটির নাম উচ্চারণ করানোর মাধ্যমে যখন তারা পরিপূর্ণরূপে সজাগ ও সচেতন হয়ে গেলেন, তারপর তিনি মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। ঘোষণা করলেনঃ-

فإن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا في بلدكم هذا في شهركم هذا

“তোমাদের এই মাসে এই নগরে এ দিনটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুণ্ণ করা হারাম), তেমনি তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের মান-সম্মানও তোমাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুণ্ণ করা হারাম)।”

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মু'মিনদের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা ও সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করাকে যুলহিজ্জা মাসে পবিত্র হারামের ভেতর হজ্জের দিনের মর্যাদা ও সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ মুমিনদের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা ঠিক ওইরকম এবং এ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার পাপও ওই পাপতুল্য।
প্রশ্ন হতে পারে, মুমিনদের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা তো আরও বেশি, আর নিয়ম হচ্ছে কোনও জিনিসকে অন্য কোনও জিনিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় কেবল তখনই, যখন উভয়ের মধ্যকার সাধারণ গুণটি যে জিনিসের সঙ্গে তুলনা করা হবে তার মধ্যে বেশি থাকবে, কিন্তু এস্থলে যখন মু'মিনদের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদা তুলনামূলক বেশি, তখন তুলনামূলক কম মর্যাদাসম্পন্ন বিষয়ের সঙ্গে তার তুলনা করা হল কিভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, জাহিলী যুগে মানুষের অন্তরে পবিত্র মাস, পবিত্র নগর ও পবিত্র হজ্জের দিনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও মর্যাদা তাদের কাছে ছিল না। মানুষকে হত্যা করা, মানুষের মাল কেড়ে নেওয়া ও তার ইজ্জতের ওপর আঘাত হানা তাদের দৃষ্টিতে কোনও অন্যায় বলেই বিবেচিত ছিল না। তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তারা মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত হরণ করত। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে যদিও মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদাই বেশি, কিন্তু তারা যেহেতু এ মর্যাদার সঙ্গে পরিচিত ছিল না, তাই যে জিনিসের মর্যাদা তাদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার সাথে তুলনা করে তাদের অন্তরে এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে মানুষের হাজিরা

তারপর ইরশাদ করেনঃ-

وستلقون ربكم فيسألكم عن أعمالكم

“তোমরা অচিরেই তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন।”
অর্থাৎ মৃত্যুর পর তোমাদেরকে অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হতে হবে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-

وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

“এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে যা সে অর্জন করেছে, আর তাদের প্রতি কোনও জুলুম করা হবে না।” (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৮১)

অপর এক আয়াতে ইরশাদঃ-

وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ مُلَاقُوهُ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো আর জেনে রেখ, তোমরা অবশ্যই তাঁর সঙ্গে মিলিত হবে এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ শোনাও। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২২৩) অর্থাৎ জান্নাতের সুসংবাদ দাও।

অপরদিকে যারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করে, তারা হবে জাহান্নামবাসী। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-

إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا وَرَضُوا بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاطْمَأَنُّوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ آيَاتِنَا غَافِلُونَ أُولَئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“নিশ্চয়ই যারা (আখিরাতে) আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আশা রাখে না এবং পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট ও তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলি সম্পর্কে উদাসীন, নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তাদের ঠিকানা জাহান্নাম।” (সূরা ইয়ূনুস (১০), আয়াত ৭-৮)

বস্তুত আখিরাতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সত্যতা, এ সত্যতায় বিশ্বাস রাখার অপরিহার্যতা, এ বিশ্বাসের পুরস্কার এবং একে অবিশ্বাস করার কঠিন পরিণাম সম্পর্কে কুরআন মাজীদে প্রচুর আয়াত আছে। কুরআনের মনোযোগী পাঠক সে সম্পর্কে অবগত।

আখিরাতে মানুষের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ

আখিরাতের সেই সাক্ষাৎকারের দিনে আল্লাহ তা'আলা মানুষকে তাদের কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। এক বর্ণনায় আছে- জিজ্ঞাসাকালে জাহান্নাম থাকবে তোমাদের বাম দিকে, জান্নাত তোমাদের ডান দিকে, দাঁড়িপাল্লা স্থাপিত থাকবে, জাহান্নামের উপরে পুলসিরাত স্থাপিত থাকবে, নবী-রাসূলগণ বলতে থাকবেন হে আল্লাহ! রক্ষা কর, হে আল্লাহ! রক্ষা কর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষী দেবে, মহাবিচারপতি আল্লাহ জাল্লা শানুহূ আত্মপ্রকাশ করবেন এবং সেদিন তিনি এমন ক্রুদ্ধ অবস্থায় থাকবেন যে, এতটা ক্রুদ্ধ এর আগে কখনও হননি, পরেও কখনও হবে না। এরকম এক ভীতিকর অবস্থায় প্রত্যেককে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-

فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

সুতরাং শপথ তোমার প্রতিপালকের, আমি তাদের সকলকে প্রশ্ন করবই সে বিষয়ে, যা তারা করে। (সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯২-৯৩)

কী কী বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, বিভিন্ন হাদীছে তার ব্যাখ্যাও এসেছে। যেমন এক
হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-

لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس: عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم؟

কিয়ামতের দিন নিজ প্রতিপালকের সম্মুখ থেকে আদম সন্তানের পা সরতে পারবে না, যতক্ষণ না পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ হবে- তার আয়ু সম্পর্কে, কিসে তা নিঃশেষ করেছে; তার যৌবন সম্পর্কে, কিসে তা ক্ষয় করেছে; তার মাল সম্পর্কে, কোথা থেকে তা অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে আর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে সে যা জানত সে অনুযায়ী কী আমল করেছে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১৬; আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪৭১০: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৬৪৮: মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ১৪৩৫)

অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

ألا كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته، الإمام راع ومسؤول عن رعيته، والرجل راع في أهله وهو مسؤول عن رعيته، والمرأة راعية في بيت زوجها ومسؤولة عن رعيتها، والخادم راع في مال سيده ومسؤول عن رعيته، فكلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته

শোন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নেতা তার অধীনস্তদের ওপর দায়িত্বশীল, তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে; গৃহকর্তা তার পরিবারবর্গের দায়িত্বশীল, তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে; স্ত্রী তার স্বামীর পরিবারবর্গ ও সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে; খাদেম তার মনীবের অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮৯৩, ২৪০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮২৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৯২৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৪৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৪৮৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৭০৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৮১)

এ সম্পর্কে এছাড়া আরও বহু হাদীছ আছে, যা দ্বারা জানা যায় মানুষকে তার ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, সে তা কতটুকু প্রচার করেছে; কেউ কোনও অন্যায় সম্পর্কে জানতে পারলে সে তার প্রতিবাদ করেছে কি না; জিজ্ঞেস করা হবে আত্মীয়তা সম্পর্কে, তা রক্ষা করা হয়েছে না ছিন্ন করা হয়েছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ সম্পর্কে, এমনকি সে যে কদম ফেলে তার সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হবে যে, এর দ্বারা তার কী উদ্দেশ্য ছিল। সুতরাং আমাদের কর্তব্য প্রতিটি কাজ চিন্তাভাবনা করে করা, যাতে কোনও কাজই শরী'আতবিরোধী না হয় এবং সেজন্য আল্লাহ তা'আলার সামনে কৈফিয়তের সম্মুখীন না হতে হয়।

পরস্পরে মারামারি ও রক্তপাত করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা

তারপর আলোচ্য হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ-

ألا فلا ترجعوا بعدي كفارا يضرب بعضكم رقاب بعض

সাবধান! তোমরা আমার পরে কাফের অবস্থায় ফিরে যেও না যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেবে।

এর দু'টি অর্থ হতে পারে। ক. তোমরা আমার পরে মুরতাদ হয়ে যেয়ো না। অর্থাৎ বাস্তবিকই ইসলাম পরিত্যাগ করে কুফরী ধর্মের দিকে ফিরে যেয়ো না, যার পরিণামে জাহিলী যুগের মত পরস্পরে মারামারি ও খুনোখুনিতে লিপ্ত হবে এবং অন্যায়ভাবে একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেবে।

খ. অথবা এর অর্থ- তোমরা কাফেরদের মত হয়ে যেয়ো না, যাদের কাছে মানুষের জানমালের কোনও মূল্য নেই। ফলে অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করে এবং তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে পরস্পরে খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়। বাস্তবিকপক্ষে অন্যায় রক্তপাত কাফেরদেরই কাজ। এটা মু'মিনদের কাজ হতে পারে না। মু'মিনদের কাজ তো অন্যের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা। সুতরাং তোমরা যদি আমার পর আত্মকলহে লিপ্ত হও এবং অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা কর, তবে তা কাফেরদের মত কাজই হবে। এরকম কাজ তোমরা ইসলাম গ্রহণের আগে জাহিলী যুগে করতে। সাবধান! আমার পরে তোমরা ওইরকম কাজের দিকে ফিরে যেয়ো না।

দাওয়াত ও তাবলীগের হুকুম

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ألا ليبلغ الشاهد الغائب শোন! উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়।
যেহেতু এ উম্মত সর্বশেষ উম্মত এবং ইসলাম সর্বশেষ দীন, কিয়ামত পর্যন্ত এ দীনের হেফাজত ও প্রচার জরুরি, যাতে প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে এ দীনের বিশুদ্ধ শিক্ষা লাভ করে এর যথাযথ অনুসরণের সুযোগ পায়। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ ভাষণে উপস্থিত লোকদের আদেশ করেছেন যেন তারা অনুপস্থিত লোকদের কাছে নিজেদের জানা কথা পৌছে দেয়। এটি একটি ব্যাপক হুকুম। এর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারকার্য অব্যাহত রাখার অপরিহার্যতা প্রমাণ হয়।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাছ থেকে শোনা কথা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে উপস্থিত ব্যক্তির পৌঁছানো কেন জরুরি— তার একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ-

فلعل بعض من يبلغه أن يكون أوعى له من بعض من سمعه

কেননা অসম্ভব নয় যে, যারা এটা (আমার কাছ থেকে) শুনেছে তাদের কতক অপেক্ষা যাদের কাছে পৌছানো হবে তাদের কতক বেশি সংরক্ষণকারী হবে। অর্থাৎ পরবর্তীকালের সেই ব্যক্তি বেশি সংরক্ষণকারী হওয়ায় তার কাছে পৌঁছানো হাদীছ দ্বারা সে নিজেও বেশি উপকৃত হতে পারবে এবং অন্যদেরও বেশি উপকার সাধনে সক্ষম হবে। আর তা এভাবে যে, হাদীছের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করে তাতে নিহিত মূলনীতির আলোকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মাসাইলের সুরাহা করবে। হাদীছে হয়তো একটি মাসআলাই বলা হয়েছে, কিন্তু সে তা থেকে আরও দশটি মাসআলা উদ্ভাবন করবে, যেমনটা আমাদের মুজতাহিদ ইমামগণ করেছেন। এ উম্মতের প্রতি তাদের অবদান অপরিসীম। তাঁরা কুরআন মাজীদের সীমিত সংখ্যক আয়াত এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীমিত সংখ্যক হাদীছের মধ্যে ইজতিহাদ ও গবেষণা করে উম্মতের হাজার হাজার প্রয়োজনীয় মাসাইলের সুরাহা করেছেন। তাঁদের উপস্থাপিত সেসব সুরাহা ও সমাধান তাঁদের মনগড়া নয়; বরং কুরআন ও হাদীছ থেকেই নেওয়া। তাঁরা তাদের গভীর ও ব্যপ্ত জ্ঞানবিদ্যা খাটিয়ে কুরআন ও হাদীছের নুসূস (মূলপাঠ)-এর ভেতর থেকে তা আহরণ করেছেন। তারপর সে আহরণ করা মাসাইল ও সমাধানসমূহ সুবিন্যস্ত আকারে মানুষের সামনে পেশ করেছেন। আজ শত শত বছর যাবৎ এ উম্মত তাদের রেখে যাওয়া সমাধানসমূহের অবলম্বনে অতি সহজেই শরী'আতের অনুসরণ করতে তথা কুরআন-সুন্নাহর পথে চলতে সক্ষম হচ্ছে। এভাবে আইম্মা-মুজতাহিদীনের জ্ঞান-গবেষণা দ্বারা যাতে উম্মতের আমসাধারণ ব্যাপক উপকার লাভ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ নির্দেশ যে, উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়।

প্রকাশ থাকে যে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে মাসাইল উদ্ভাবনে সাহাবায়ে কিরামের যোগ্যতার কোনও কমতি ছিল না; বরং তাঁরা যেহেতু আল্লাহপ্রদত্ত সহজাত প্রতিভার পাশাপাশি কুরআন নাযিলের প্রত্যক্ষদর্শী, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষণ-বক্তব্যের সম্মুখশ্রোতা ও তাঁর কর্মধারার উপস্থিত দর্শক ছিলেন এবং ছিলেন তাঁর সাহচর্যপ্রসূত অভাবনীয় নূরানী আত্মা ও আলোকিত বোধ-বুদ্ধির অধিকারী, তাই কুরআন-সুন্নাহ'র জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তাঁদের আহরণক্ষমতাও তুলনামূলক বেশিই ছিল। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর তাদেরকে দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার সাথে সাথে ভেতর ও বাইরের শত্রুদের হামলা থেকে ইসলামের সুরক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল এবং জীবনের বেশিরভাগ সময় একের পর এক জিহাদের ময়দানেই কাটাতে হচ্ছিল, তাই তাদের পক্ষে ইজতিহাদ ও গবেষণাকে স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, যেমনটা সম্ভব হয়েছিল তাবি'ঈন, তাবে-তাবি'ঈন ও তাদের পরবর্তীকালের উলামা-মুজতাহিদীনের পক্ষে। তা সত্ত্বেও তাঁরা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহে ইজতিহাদ করেছেন এবং তাদের সে ইজতিহাদকৃত মাসাইলের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের সে ইজতিহাদ পরবর্তীকালের মুজতাহিদীনের জন্য তাদের চলার পথে আলো সরবরাহ করেছে।
সবশেষে ইরশাদ হয়েছেঃ-

«ألا هل بلغت؟ ألا هل بلغت؟» قلنا نعم، قال: «اللهم اشهد»

'তারপর তিনি বললেন, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? আমরা বললাম, হাঁ (আপনি পৌঁছে দিয়েছেন)। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন।' অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যা-কিছু পৌছানোর আদেশ আমাকে করা হয়েছে, আমি কি তা পুরোপুরি তোমাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি? সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে, তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ পুরোপুরি আঞ্জাম দিয়েছেন।

নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উত্তর পেয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অন্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি এ কথা তিনবার বলেছিলেন।

রিসালাতের দায়িত্ব আদায়ের সাক্ষ্য

তিনি কেন আল্লাহকে সাক্ষী রাখলেন? এর উত্তর এই যে, আল্লাহ তা'আলা নবী রাসূলগণকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মানুষের হিদায়াতের জন্য। তাঁদের ওপর এক কঠিন যিম্মাদারী ছিল আল্লাহর বার্তা ও তাঁর বিধি-বিধান মানুষের কাছে পৌঁছানো। তা পৌঁছাতে গিয়ে তাদেরকে কঠোর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সবরকম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তাঁরা তাঁদের সে দায়িত্বপালন থেকে সরে তো দাঁড়ানইনি; বিন্দুমাত্র শিথিলতাও করেননি। তাঁদের কওম তাঁদের পক্ষ থেকে কিছুটা ছাড়ের বিনিময়ে আপোষ প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর হুকুম ও ওহীর বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ আপোষহীন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা কখনও বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেও রাজি হননি; বরং রাজি থেকেছেন জান দিয়ে দিতে।

এ ধারার সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি ছিলেন কিয়ামত পর্যন্তকার জন্য সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের নবী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে সর্বাপেক্ষা বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধার মুখেও তিনি আল্লাহর বার্তা পৌঁছানোর ব্যাপারে ছিলেন অটল অবিচল। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হুকুম ছিলঃ-

يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ

হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা-কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা প্রচার কর। যদি (তা) না কর, তবে (তার অর্থ হবে) তুমি আল্লাহর বার্তা পৌঁছালে না। (সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৬৭)

তিনি যে সকল বাধা উপেক্ষা করে আল্লাহর এ হুকুম যথাযথভাবে পালন করেছেন। এবং রিসালাতের যিম্মাদারী পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছেন, প্রথমত সে সাক্ষ্য সাহাবায়ে কিরাম থেকে নিয়েছেন। তারপর সাহাবায়ে কিরামের সে সাক্ষ্যের ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাকে সাক্ষ্য রেখে আপন যিম্মাদারী পালনের ব্যাপারে নিজ সন্তোষ জ্ঞাপন করেছেন। তিনি যেন বলছেন, হে আল্লাহ! আপনি দেখুন এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে—আপনি যে যিম্মাদারী আমার প্রতি অর্পণ করেছিলেন, আমি তা পুরোপুরি পালন করেছি।

যে-কোনও প্রেমিক তার প্রেমাস্পদের হুকুম পালন করে তৃপ্তিবোধ করে থাকে। নবী রাসূলগণ শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিক। সেই শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিকদের শিরোমণি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্ব পালনের সপক্ষে যখন হাজারও সাহাবী সমস্বরে সাক্ষ্যদান করল, তখন তিনি কতটা পরিতৃপ্তি ও কী পরিমাণ আনন্দ লাভ করেছিলেন তা কি ভাবা যায়? বস্তুত আল্লাহকে সাক্ষী রাখা ছিল তাঁর এ মহাপ্রেমিকের সে দায়িত্ব পালনজনিত পরিতৃপ্তিরই বহিঃপ্রকাশ।

আল্লাহকে সাক্ষী রাখার এ অর্থও হতে পারে যে, হাশরের ময়দানে অন্যান্য নবীর উম্মতগণ আপন আপন নবীর দাওয়াত ও তাবলীগের কথা অস্বীকার করবে। তখন সকল নবী এ উম্মতকে তাদের পক্ষে সাক্ষী মানবে। এ উম্মত সাক্ষ্য দেবে যে, হা নবী তাদের উম্মতের কাছে দাওয়াত পৌঁছিয়েছিলেন। তখন যাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের কথা অস্বীকার করতে না পারে, সে লক্ষ্যে তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে তাদের কাছ থেকে তাঁর দায়িত্ব পালনের পক্ষে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছেন এবং সে স্বীকারোক্তি সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলাকে সাক্ষী রেখেছেন।

বিদ'আতী কাজের কদর্যতা

প্রকাশ থাকে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ যে পুরোপুরিভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন, তার সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে তিনি আমাদের কাছে আল্লাহপ্রদত্ত পরিপূর্ণ দীনই পৌছিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং এ দীনে যেমন কোনও কাটছাটের সুযোগ নেই, তেমনি নতুন কিছু যোগ করারও অবকাশ নেই। কাজেই কেউ যদি দীনের নামে নতুন কিছু যোগ করে, তবে সেরকম বিদ'আতী কর্ম দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতী কর্মের পরিপূর্ণতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। যেন সে বলতে চাচ্ছে, তিনি আমাদের কাছে পরিপূর্ণ দীন পৌঁছিয়ে যাননি, আমি আমার এ নতুন সংযোজন দ্বারা তা পরিপূর্ণ করছি—না উযুবিল্লাহি মিন যালিক! নববী দাওয়াত ও দীনের পরিপূর্ণতার ওপর কী কঠিন আঘাত! বস্তুত বিদ'আতী কাজকর্ম দ্বারা দীনের পরিপূর্ণতার ওপরই আঘাত করা হয়। তাই এর থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক ঈমানদারের অবশ্যকর্তব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মাস ও বছরের সুশৃঙ্খল আবর্তন আল্লাহ তা'আলারই সৃষ্টি।

খ. চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাবান। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখায় সচেষ্ট থাকা উচিত।

গ. কাউকে তার জানা বিষয়ে প্রশ্ন করা তার অন্তরে সে বিষয়ের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে সহায়ক হয়, যেমনটা পবিত্র যুলহিজ্জা মাস, পবিত্র মক্কা নগর ও পবিত্র কুরবানীর দিন সম্পর্কে প্রশ্ন করার দ্বারা বোঝা যায়।

ঘ. বক্তব্য ও ভাষণের মাঝখানে বক্তার ক্ষণিকের নীরবতা দ্বারা শ্রোতামণ্ডলীকে অধিকতর সজাগ ও মনোযোগী করে তোলা যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষণিকের নীরবতা দ্বারা তাই হয়েছিল।

৫. মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। এর যে-কোনওটির ওপর জুলুম করা কঠিন পাপ।

চ. কিয়ামতের দিন সকলকেই আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে হবে এবং আপন আপন কৃতকর্মের জবাব দিতে হবে। এ ব্যাপারে সকলের সচেতন থাকা চাই।

ছ. নিজেদের মধ্যে রক্তপাত ও হানাহানি কঠিন পাপ, যা মু'মিনদের নয়; বরং কাফেরদের পক্ষেই শোভা পায়।

জ. যার যতটুকু দীনের সহীহ-শুদ্ধ জ্ঞান অর্জিত আছে, তার কর্তব্য অন্যের কাছে তা পৌঁছানো।

ঝ. ইলম ও জ্ঞান-বিদ্যায় কখনও শাগরিদ তার উস্তাযকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সে ছাড়িয়ে যাওয়াটা উস্তাযের পক্ষে গৌরবজনক।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন