কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ
৩৫. যুহদ-দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির বর্ণনা
হাদীস নং: ৪২৭৬
আন্তর্জাতিক নং: ৪২৭৬
পুনরুত্থানের আলোচনা
৪২৭৬। আবু বাকর ইবন আবু শায়বা (রাহঃ)....আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন; একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! মানুষকে কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে কিভাবে একত্রিত করা হবে? তিনি বললেনঃ খালি পায়ে, উলঙ্গ শরীরে। আমি বললামঃ মহিলারাও (কি উলঙ্গ হয়ে উঠবে)? তিনি বললেনঃ নারীরাও । আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! এতে কি লজ্জাবোধ হবে না? তিনি বললেনঃ হে আয়েশা! তখনকার অবস্থা এমন কঠিন হবে যে, কেউ কারুর প্রতি তাকানোর অবকাশ পাবে না। (নিজের চিন্তায় বিভোর থাকবে- দৃষ্টির সুযোগ কোথায়?)।
بَاب ذِكْرِ الْبَعْثِ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الأَحْمَرُ، عَنْ حَاتِمِ بْنِ أَبِي صَغِيرَةَ، عَنِ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ، عَنِ الْقَاسِمِ، قَالَ قَالَتْ عَائِشَةُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ " حُفَاةً عُرَاةً " . قُلْتُ وَالنِّسَاءُ قَالَ " وَالنِّسَاءُ " . قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَا يُسْتَحْيَى قَالَ " يَا عَائِشَةُ الأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে হাশর-ময়দানের ভয়ানক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন নারী পুরুষ সকলকে এমনভাবে জড়ো করা হবে যে, কারও পায়ে জুতা থাকবে না, শরীরে পোশাক থাকবে না এবং সকলেই থাকবে খতনাবিহীন অবস্থায়। মানুষ দুনিয়ায় যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই তাদেরকে হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ
(কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বলবেন,) তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমি প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আর আমি তোমাদেরকে যা-কিছু দান করেছিলাম, তা তোমাদের পেছনে ফেলে এসেছ।৩৯৫
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ “তিনি যেভাবে প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমরা সেভাবেই ফিরে আসবে।৩৯৬
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إنكم محشورون حفاة عراة غرلا: (كما بدأنا أول خلق نعيده ﴾ [الأنبياء: ١٠٤] الآية ، وإن أول الخلائق يكسى يوم القيامة : إبراهيم
“কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে খালি পায়ে উলঙ্গ শরীরে খতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন- كما بدأنا أول خلق نعيده (আমি পুনরায় তাকে সৃষ্টি করব, যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম -সূরা আম্বিয়া: ১০৪) কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সবার আগে কাপড় পরানো হবে।৩৯৭
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় মৃত ব্যক্তি যে পোশাকে মারা যায় সে পোশাকেই তাকে উঠানো হবে, যেমন হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি.থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন إن الميت يبعث في ثيابه التي يموت فيها 'নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তিকে উঠানো হবে তার ওই পোশাকেই, যে পোশাকে তার মৃত্যু হয়।৩৯৮
এর উত্তর হলো, সম্ভবত কাউকে কবর থেকে উঠানো হবে নগ্ন অবস্থায় এবং কাউকে পোশাক পরিহিত অবস্থায়। অথবা কবর থেকে সকলকেই পোশাক পরিহিত অবস্থায় উঠানো হবে, তারপর হাশরের সূচনাকালে সকলের পোশাক খুলে পড়ে যাবে এবং সবাইকে নগ্ন অবস্থায় হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে। কারও কারও মতে আবূ সা'ঈদ রাযি. বর্ণিত হাদীছটি শহীদদের সম্পর্কে। তারা যে পোশাক পরিহিত অবস্থায় শহীদ হয়, সে অবস্থায়ই তাদেরকে কবর থেকে উঠিয়ে হাশরে উপস্থিত করা হবে।
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম পোশাক পরানো হবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে। যেমন উপরে উদ্ধৃত হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বর্ণিত হাদীছটি দ্বারা জানা গেল। হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন-
أول من يكسى خليل الله : إبراهيم قبطيتين، ثم يكسى محمد صلى الله عليه وسلم حلة حبرة عن يمين العرش
'কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে কাপড় পরানো হবে আর তা হবে এক জোড়া কুবতী কাপড়। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক জোড়া ডোরাকাটা পোশাক পরিধান করানো হবে। তিনি থাকবেন আরশের ডান দিকে।৩৯৯
প্রকাশ থাকে যে, এটা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক বিশেষ ফযীলত। বিশেষ ফযীলত দ্বারা সামগ্রিকভাবে সকলের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় না। সামগ্রিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন সমস্ত নবী-রাসূলের প্রধান হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটা বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত।
এ হাদীছ শুনে আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. ভীষণ উদ্বিগ্ন হলেন। তাই তিনি বলে উঠলেন يا رسول الله ، الرجال والنساء جميعا ينظر بعضهم الى بعض ؟ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষ ও নারী সকলে? তারা একে অন্যকে দেখবে?)। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার বর্ণনায় আছে, আমাদের কি তখন লজ্জা লাগবে না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন يا عائشة الأمر أشد من أن يهمهم ذلك (হে আয়েশা! এ বিষয়টি যে তাদেরকে ভাবাবে, পরিস্থিতি তারচে' অনেক কঠিন)। অপর এক বর্ণনায় আছে فقالت عائشة : فكيف بالعورات؟ قال: «لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه [عس : ۳۷] ‘হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, তখন সতরের ব্যাপারটা কেমন হবে? তিনি বললেন, (সে চিন্তা করো না। আল্লাহ তা'আলা তো বলেই দিয়েছেন—) لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه (সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সূরা আবাসা : ৩৭)।৪০০
অপর এক বর্ণনায় এসেছে। হযরত আয়েশা রাযি. বলে উঠেন-
وا سوأتاه، الرجال والنساء يحشرون جميعا، ينظر بعضهم إلى سوءة بعض؟ فقال: لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه» الآية، وزاد: ولا ينظر الرجال إلى النساء، ولا النساء إلى الرجال، شغل بعضهم عن بعض
'কী লজ্জার কথা! নারী-পুরুষ সকলকে একত্র করা হবে আর তারা একে অন্যের সতর দেখবে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সূরা আবাসা : ৩৭”। পুরুষগণ নারীদের দিকে তাকাবে না, নারীরাও পুরুষদের দিকে তাকাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, অন্যকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পাবে না।৪০১
সারকথা, মানুষ তো একে অন্যের দিকে লক্ষ করে যখন আরামে থাকে। হাশরের ময়দান আরামের জায়গা নয়। সকলেই থাকবে ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। তখন বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যাবে। এমনকি মা'ও তার সন্তানের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কার শরীরে কাপড় আছে বা নেই, কারও সেদিকে তাকানোর ফুরসত থাকবে না। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে আমাদেরকে সেদিনের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ ইসলামের এ মৌলিক আকীদা প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পর অবশ্যই পুনরুত্থান হবে। হাশরের মাঠে হিসাব-নিকাশের জন্য দাঁড়াতে হবে।
খ. হাশরের ময়দান চরম বিভীষিকাময়। ইহজীবনের আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
গ. একে অন্যের সামনে উলঙ্গ অবস্থায় থাকা হাশরের ভয়ানক পরিস্থিতির অংশ। এটা ইহজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই কোনও মুমিন-মুসলিমের অন্যের সামনে উলঙ্গ বা অর্ধোলঙ্গ হয়ে থাকার বেহায়াপনা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৯৫. সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৯৪
৩৯৬. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৯
৩৯৭, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫২৬, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৬০, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪২৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২০৮২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩২৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৫৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩১২,
৩৯৮. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩১১৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩১৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৬২০৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৬০৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৫৩
৩৯৯. ইবনুল মুবারাক, আয্ যুহদ, ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ৪৬৭ পৃ.এর বরাতে।
৪০০. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২০৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৫৮৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫১
৪০১. যাখীরাতুল উকবা বিশারহিল মুজতাবা, ২০ খণ্ড, ১৭২ পৃষ্ঠা। ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ৪৭০ পৃষ্ঠা।
وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ
(কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বলবেন,) তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমি প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আর আমি তোমাদেরকে যা-কিছু দান করেছিলাম, তা তোমাদের পেছনে ফেলে এসেছ।৩৯৫
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ “তিনি যেভাবে প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমরা সেভাবেই ফিরে আসবে।৩৯৬
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إنكم محشورون حفاة عراة غرلا: (كما بدأنا أول خلق نعيده ﴾ [الأنبياء: ١٠٤] الآية ، وإن أول الخلائق يكسى يوم القيامة : إبراهيم
“কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে খালি পায়ে উলঙ্গ শরীরে খতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন- كما بدأنا أول خلق نعيده (আমি পুনরায় তাকে সৃষ্টি করব, যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম -সূরা আম্বিয়া: ১০৪) কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সবার আগে কাপড় পরানো হবে।৩৯৭
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় মৃত ব্যক্তি যে পোশাকে মারা যায় সে পোশাকেই তাকে উঠানো হবে, যেমন হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি.থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন إن الميت يبعث في ثيابه التي يموت فيها 'নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তিকে উঠানো হবে তার ওই পোশাকেই, যে পোশাকে তার মৃত্যু হয়।৩৯৮
এর উত্তর হলো, সম্ভবত কাউকে কবর থেকে উঠানো হবে নগ্ন অবস্থায় এবং কাউকে পোশাক পরিহিত অবস্থায়। অথবা কবর থেকে সকলকেই পোশাক পরিহিত অবস্থায় উঠানো হবে, তারপর হাশরের সূচনাকালে সকলের পোশাক খুলে পড়ে যাবে এবং সবাইকে নগ্ন অবস্থায় হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে। কারও কারও মতে আবূ সা'ঈদ রাযি. বর্ণিত হাদীছটি শহীদদের সম্পর্কে। তারা যে পোশাক পরিহিত অবস্থায় শহীদ হয়, সে অবস্থায়ই তাদেরকে কবর থেকে উঠিয়ে হাশরে উপস্থিত করা হবে।
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম পোশাক পরানো হবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে। যেমন উপরে উদ্ধৃত হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বর্ণিত হাদীছটি দ্বারা জানা গেল। হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন-
أول من يكسى خليل الله : إبراهيم قبطيتين، ثم يكسى محمد صلى الله عليه وسلم حلة حبرة عن يمين العرش
'কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে কাপড় পরানো হবে আর তা হবে এক জোড়া কুবতী কাপড়। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক জোড়া ডোরাকাটা পোশাক পরিধান করানো হবে। তিনি থাকবেন আরশের ডান দিকে।৩৯৯
প্রকাশ থাকে যে, এটা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক বিশেষ ফযীলত। বিশেষ ফযীলত দ্বারা সামগ্রিকভাবে সকলের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় না। সামগ্রিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন সমস্ত নবী-রাসূলের প্রধান হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটা বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত।
এ হাদীছ শুনে আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. ভীষণ উদ্বিগ্ন হলেন। তাই তিনি বলে উঠলেন يا رسول الله ، الرجال والنساء جميعا ينظر بعضهم الى بعض ؟ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষ ও নারী সকলে? তারা একে অন্যকে দেখবে?)। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার বর্ণনায় আছে, আমাদের কি তখন লজ্জা লাগবে না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন يا عائشة الأمر أشد من أن يهمهم ذلك (হে আয়েশা! এ বিষয়টি যে তাদেরকে ভাবাবে, পরিস্থিতি তারচে' অনেক কঠিন)। অপর এক বর্ণনায় আছে فقالت عائشة : فكيف بالعورات؟ قال: «لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه [عس : ۳۷] ‘হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, তখন সতরের ব্যাপারটা কেমন হবে? তিনি বললেন, (সে চিন্তা করো না। আল্লাহ তা'আলা তো বলেই দিয়েছেন—) لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه (সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সূরা আবাসা : ৩৭)।৪০০
অপর এক বর্ণনায় এসেছে। হযরত আয়েশা রাযি. বলে উঠেন-
وا سوأتاه، الرجال والنساء يحشرون جميعا، ينظر بعضهم إلى سوءة بعض؟ فقال: لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه» الآية، وزاد: ولا ينظر الرجال إلى النساء، ولا النساء إلى الرجال، شغل بعضهم عن بعض
'কী লজ্জার কথা! নারী-পুরুষ সকলকে একত্র করা হবে আর তারা একে অন্যের সতর দেখবে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সূরা আবাসা : ৩৭”। পুরুষগণ নারীদের দিকে তাকাবে না, নারীরাও পুরুষদের দিকে তাকাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, অন্যকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পাবে না।৪০১
সারকথা, মানুষ তো একে অন্যের দিকে লক্ষ করে যখন আরামে থাকে। হাশরের ময়দান আরামের জায়গা নয়। সকলেই থাকবে ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। তখন বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যাবে। এমনকি মা'ও তার সন্তানের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কার শরীরে কাপড় আছে বা নেই, কারও সেদিকে তাকানোর ফুরসত থাকবে না। আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে আমাদেরকে সেদিনের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ ইসলামের এ মৌলিক আকীদা প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পর অবশ্যই পুনরুত্থান হবে। হাশরের মাঠে হিসাব-নিকাশের জন্য দাঁড়াতে হবে।
খ. হাশরের ময়দান চরম বিভীষিকাময়। ইহজীবনের আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
গ. একে অন্যের সামনে উলঙ্গ অবস্থায় থাকা হাশরের ভয়ানক পরিস্থিতির অংশ। এটা ইহজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই কোনও মুমিন-মুসলিমের অন্যের সামনে উলঙ্গ বা অর্ধোলঙ্গ হয়ে থাকার বেহায়াপনা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৯৫. সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৯৪
৩৯৬. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৯
৩৯৭, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫২৬, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৬০, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪২৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২০৮২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩২৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৫৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩১২,
৩৯৮. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩১১৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩১৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৬২০৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৬০৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৫৩
৩৯৯. ইবনুল মুবারাক, আয্ যুহদ, ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ৪৬৭ পৃ.এর বরাতে।
৪০০. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২০৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৫৮৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫১
৪০১. যাখীরাতুল উকবা বিশারহিল মুজতাবা, ২০ খণ্ড, ১৭২ পৃষ্ঠা। ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ৪৭০ পৃষ্ঠা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
