কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৩৫. যুহদ-দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির বর্ণনা

হাদীস নং: ৪২১৭
আন্তর্জাতিক নং: ৪২১৭
আল্লাহ ভীতি ও তাকওয়া
৪২১৭। আলী ইব্‌ন মুহাম্মাদ (রাহঃ)...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ হে আবু হুরায়রা! তুমি পরহেযগার হয়ে যাও, তাহলে লোকদের মাঝে শ্রেষ্ঠ ইবাদতগুয়ার হতে পারবে। তুমি অল্পে তুষ্ট থাকো, তাহলে লোকদের মাঝে উত্তম শোকরগুযার বান্দা হতে পারবে। তুমি মানুষের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ কর, তাহলে তুমি পূর্ণ মু'মিন হতে পারবে। তুমি তোমার প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করবে, তাহলে তুমি সত্যিকার মুসলমান হতে পারবে। আর তুমি হাসি-তামাশা কম করবে, কেননা, অধিক হাসি-তামাশা মানুষের দিল মেরে ফেলে।
بَاب الْوَرَعِ وَالتَّقْوَى
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنْ أَبِي رَجَاءٍ، عَنْ بُرْدِ بْنِ سِنَانٍ، عَنْ مَكْحُولٍ، عَنْ وَاثِلَةَ بْنِ الأَسْقَعِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ كُنْ وَرِعًا تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ وَكُنْ قَنِعًا تَكُنْ أَشْكَرَ النَّاسِ وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا وَأَحَسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَكَ تَكُنْ مُسْلِمًا وَأَقِلَّ الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছে বলা হয়েছে, নিজের জন্য যা পছন্দ কর। অনেক সময় লোকে নিজের জন্য এমন জিনিসও পছন্দ করে, যা শরীয়তে বৈধ নয়। একজন লোক হয়ত জুয়া খেলতে বা মদ পান করতে পছন্দ করে, আর হাদীসে বলা হয়েছে, মুমিন হতে হলে নিজের জন্য যা পছন্দ করা হয়, অন্যের জন্যও তা পছন্দ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি ওই ব্যক্তি জুয়া খেলা ও মদ পান করাকে অন্যের জন্য পছন্দ করবে? না, হাদীসে এ কথা বুঝানো হয়নি। কেননা মদ পান করা বা জুয়া খেলা কোনো মুমিনের জন্য পছন্দনীয় হতেই পারে না। যে ব্যক্তি তা পছন্দ করে, সে অসুস্থ। তার মধ্যে ঈমানী দুর্বলতা আছে বলেই তা পছন্দ করে থাকে। নয়ত সে এসবকে ঘৃণা করত। ঈমানের দাবি হচ্ছে, শরীয়ত যা-কিছু নাজায়েয ও হারাম করেছে, তা ঘৃণার সঙ্গে পরিত্যাগ করে চলা। যে ব্যক্তি তা পরিত্যাগ না করে উল্টো গ্রহণ করছে, তা করছে মস্তিষ্কের অসুস্থতার কারণে। সুতরাং তার পছন্দ গ্রহণযোগ্য নয়।

অন্য বর্ণনায় আছে,
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৩: সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৪৫। জামে তিরমিযী হাদীস নং ২৫১৫। সুনানে নাসায়ী হাদীস নং ৫০১৬;)

হাদীসের সূচনায় ঈমান শব্দ ব্যবহার করে ইশারা করা হয়েছে যে, পছন্দটা ঈমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। সেরকম পছন্দ কেবল বৈধ ও জায়েয বিষয়েই হতে পারে। কোনো কোনো হাদীসে স্পষ্টভাবে তা বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন: নাসায়ী, ইবনে হিব্বান ও আবূ ই'য়ালা প্রমুখের বর্ণনায় হাদীসটির শেষে من الخير শব্দ আছে। (সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০১৭: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৩৫; মুসনাদ আবু ইয়ালা,হাদীছ নং ৩০৮১; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা, হাদীছ নং ৯১)

الخير শব্দটি ব্যাপক অর্থমূলক। এর দ্বারা সর্বপ্রকার ইবাদত বন্দেগী এবং যাবতীয় মুবাহ ও বৈধ কাজসমূহ বুঝানো হয়ে থাকে। নিষিদ্ধ বিষয়াবলি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং হাদীসটির অর্থ দাঁড়ালো নিজের জন্য বৈধ ও উৎকৃষ্ট যা-কিছু পছন্দ করা হয়, মুসলিম ভাইদের জন্যও তা পছন্দ করতে হবে। বলা হয়েছে, এটা না করা পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। সাধারণত এর দ্বারা বোঝানো হয়, পরিপূর্ণ মুমিন। অর্থাৎ‍ পরিপূর্ণ মুমিন হতে চাইলে তোমাকে এ গুণ অবশ্যই অর্জন করতে হবে, অন্যথায় তোমার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করবে না।

নিজের জন্য যা পছন্দ করা হয় অন্যের জন্য তা পছন্দ করা ঈমানের একটি শ্রেষ্ঠতম শাখাও বটে। একবার হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ঈমানের শ্রেষ্ঠতম শাখা সম্পর্কে জানতে চাইলে এক পর্যায়ে বলেছিলেনঃ-

أن تحب للناس ما تحب لنفسك وتكره لهم ما تكره لنفسك

"নিজের জন্য যা পছন্দ কর, অন্য মানুষের জন্যও তা পছন্দ করবে এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ কর, অন্য মানুষের জন্যও তা অপছন্দ করবে। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৭৪, তাবারানী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৭০)

এটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ আমল, একটি হাদীছ দ্বারা তা আরও বেশি স্পষ্ট হয়। তাতে এ আমলটিকে জান্নাতলাভের একটি উপায় সাব্যস্ত করা হয়েছে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সাহাবীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তুমি কি জান্নাতে যাওয়ার আশা কর? তিনি বললেন, জি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসবে, যা নিজের জন্য ভালোবাস। (মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭৩১৩)

হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

من أحب أن يزحزح عن النار ويدخل الجنة، فلتدركه منيته وهو يؤمن بالله واليوم الآخر، ويأتي إلى الناس الذي يحب أن يؤتى إليه

যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশের আশা করে সে যেন এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, যখন সে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে এবং সে যেন মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করে, যেমনটা আচরণ তার নিজের সঙ্গে করা হোক বলে পছন্দ করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৮০৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬১৪: সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯১)

এ গুণ প্রয়োগের আখলাকী উপকার
বস্তুত এ হাদীছটি আমাদের পক্ষে অতি মূল্যবান একটি চারিত্রিক শিক্ষা। কেননা নিজের জন্য যা পছন্দ করা হয় তা অন্যের জন্য পছন্দ করা এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ করা হয় তা অন্যের জন্য অপছন্দ করা হবে কেবল তখনই, যখন নিজের ভেতর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না এবং থাকবে না অহংকার। অহংকারী ব্যক্তি সবকিছুতে অন্যের উপরে থাকতে চায়। কেউ তার সমান হয়ে উঠুক তা সে বরদাশত করে না। আর হিংসুটে ব্যক্তিও অন্যের ভালো পছন্দ করে না। কেউ তার উপরে উঠে যাক বা তার সমপর্যায়ে চলে আসুক তা মেনে নিতে পারে না। অথচ ঈমানের দাবি এর বিপরীত।

ঈমান চায় আল্লাহ তা'আলা তাকে যা কিছু নি'আমত দিয়েছেন, অন্যসব মানুষও তা পেয়ে যাক। সবাই তার মত ঈমানদার হয়ে যাক এবং দীন ও দুনিয়ার যত কল্যাণ সে লাভ করেছে, অন্য সকলেও তা লাভ করুক। আলোচ্য হাদীছ সে শিক্ষাই দেয়। তো এ হাদীছের শিক্ষার ওপর আমল করতে হলে নিজের ভেতর থেকে অহংকার ও হাসাদ নির্মূল করতে হবে। যখন তা নির্মূল হবে, তখন অন্তরে বিনয় জন্ম নেবে এবং নিজেকে আল্লাহ তা'আলা যেসব নি'আমত দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্টির গুণ অর্জিত হবে। এভাবে ব্যক্তিচরিত্র উৎকর্ষমণ্ডিত হয়ে উঠবে।

এ গুণটির ব্যবহারিক পন্থা
মানুষের পছন্দনীয় বিষয় দু'রকম। ক. দীনী এবং খ. দুনিয়াবী।
দীনী যেসব বিষয় কাম্য ও পছন্দনীয় তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈমান। সুতরাং প্রত্যেক মু'মিনের কামনা হবে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ঈমানদার হয়ে যাক। এ লক্ষ্যে কর্তব্য দাওয়াতী মেহনত অব্যাহত রাখা। তারপর দীনী ইলমও একটি অতি কাম্য ও পছন্দনীয় নি'আমত। তাই মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য নিজে তা অর্জনের চেষ্টা করা এবং অপরাপর মানুষ যাতে তা পেয়ে যায় সেই কামনা করা আর সে লক্ষ্যে দীনী ইলমের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখা। এমনিভাবে ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় সুন্নত মানুষের জন্য অনেক বড় নি'আমত। তাই এগুলো নিজে অর্জনের পাশাপাশি অন্যান্য মানুষেরও অর্জিত হয়ে যাওয়ার কামনা থাকা চাই। এসব অর্জনের জন্য যোগ্য 'উলামা-মাশায়েখ পাওয়াও আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নি'আমত। যারা তা পাবে তাদের কর্তব্য অন্যদেরও তার সন্ধান দেওয়া। এসবই আলোচ্য হাদীছের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

দুনিয়াবী পছন্দনীয় বিষয় হচ্ছে সুস্বাস্থ্য এবং জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা সুস্বাস্থ্য দিয়েছেন তাদের কর্তব্য অন্যদের জন্যও তা কামনা করা। সকল মানুষ যাতে সুস্থ ও নিরোগ থাকে সেজন্য যার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তা করা এ হাদীছের দাবি। জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তার বিষয়টিও এরকম। যাদের তা অর্জিত আছে তাদের কামনা থাকবে যাতে অন্যরাও তার অধিকারী হয়ে যায়। সুতরাং নিজে কারও জান, মাল ও ইজ্জতের ওপর আঘাত তো করবেই না; বরং অন্য কারও দ্বারাও যদি অন্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সে অন্যদেরও সতর্ক করবে এবং তাকেও তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে।

গভীরভাবে লক্ষ করলে পার্থিব জীবনের পক্ষে যা-কিছু প্রয়োজন সবই এর মধ্যে এসে যায়। জীবন রক্ষা এবং জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যত আসবাব-উপকরণ আছে সকল ক্ষেত্রেই এ হাদীছটি প্রযোজ্য।

প্রত্যেকেরই এগুলো কামনা থাকে এবং নিজের এসব অর্জিত হয়ে যাক তা সকলেই চায়। কাজেই হাদীছটির শিক্ষা অনুযায়ী অন্যের জন্যও তা চাওয়া কাম্য। এমনিভাবে সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য যা-কিছু ক্ষতিকর প্রত্যেকেই তা থেকে বাঁচতে চায়। প্রত্যেকেরই কামনা থাকে ক্ষতিকর কোনওকিছুই তাকে স্পর্শ না করুক। সুতরাং অন্য কোনও মানুষ বিশেষত অন্য কোনও মুসলিম যাতে কোনওরকম ক্ষতির শিকার না হয় তা কামনা করাও ঈমানের দাবি এবং এ হাদীছটির শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ হাদীছটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। তাই উলামায়ে কিরাম এ হাদীছটিকেও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা সম্বলিত কয়েকটি হাদীছের একটিরূপে গণ্য করেছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীনী ও দুনিয়াবী যাবতীয় কল্যাণকর ও উপকারী বিষয় নিজের জন্য কামনা করার পাশাপাশি সকল মানুষের জন্যও কামনা করা চাই।

খ. অপছন্দনীয় ও ক্ষতিকর বিষয়সমূহ থেকে নিজে যেমন বেঁচে থাকার চেষ্টা করা হয়, তেমনি অন্য কেউ যাতে ক্ষতির শিকার না হয় সেই কামনা ও চেষ্টাও থাকা উচিত।

গ. প্রত্যেক মু'মিনের কামনা করা উচিত যাতে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ঈমানদার হয়ে যায়।

ঘ. এ হাদীছের ওপর আমল করার জন্য অহংকার ও হাসাদ অনেক বড় বাধা। কাজেই এ রিপু যাতে দমন করা যায় সে চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান