কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৩৫. যুহদ-দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির বর্ণনা

হাদীস নং: ৪১১৫
আন্তর্জাতিক নং: ৪১১৫
লোকে যাকে গুরুত্ব দেয় না
৪১১৫। হিশাম ইব্‌ন আম্মার (রাহঃ)......মু'আয ইব্‌ন জাবাল (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমি কি তোমাকে জান্নাতের বাদশাহদের সম্পর্কে অবহিত করবো না। আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ দুর্বল লোকদের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের এবং দু'টো ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত ব্যক্তি, যাকে হিসাবে গণ্য করা হয় না। সে যদি আল্লাহর নামে কোন বিষয়ে শপথ করে, তা অবশ্যই তিনি সত্যে পরিণত করেন, (সে হবে জান্নাতের বাদশাহ)।
بَاب مَنْ لَا يُؤْبَهُ لَهُ
حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنَا سُوَيْدُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ، عَنْ زَيْدِ بْنِ وَاقِدٍ، عَنْ بُسْرِ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ، عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ الْخَوْلاَنِيِّ، عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏"‏ أَلاَ أُخْبِرُكَ عَنْ مُلُوكِ الْجَنَّةِ ‏"‏ ‏.‏ قُلْتُ بَلَى ‏.‏ قَالَ ‏"‏ رَجُلٌ ضَعِيفٌ مُسْتَضْعَفٌ ذُو طِمْرَيْنِ لاَ يُؤْبَهُ لَهُ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্য জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া ও জান্নাতের অধিকারী হওয়া। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন রাখার চেষ্টা করতেন। এর জন্য যেমন তাদের সামনে জাহান্নামের কঠিন আযাব ও জান্নাতের পরম সুখ-শান্তির উপকরণসমূহ তুলে ধরতেন, তেমনি যেসকল আমল দ্বারা জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া যায় ও জান্নাতের অধিকারী হওয়া যায় তাও বয়ান করতেন। আলোচ্য হাদীছে তিনি কী চরিত্রের লোক জান্নাতবাসী হবে তার নমুনা তুলে ধরেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তো বটেই, কিয়ামত পর্যন্ত এ হাদীছের সকল শ্রোতা ও পাঠককে এটি জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এখন আমাদের কর্তব্য জান্নাতবাসীর নমুনা অনুযায়ী নিজ জীবন গড়ে তোলা।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করেন যে, আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করব না কারা জান্নাতের বাদশাহ? এ প্রশ্ন দ্বারা তিনি তাদের অন্তরে জান্নাত লাভ করা ও নিজেদেরকে জান্নাতীসুলভ ব্যক্তিরূপে গড়ে তোলার আগ্রহ জাগানোর চেষ্টা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা আগ্রহ ব্যক্তও করেছেন, যদিও বর্ণনায় বর্ণনাকারী তা উল্লেখ করেননি। কেননা সে কথা এমনিই বোঝা যায়। তারা আগ্রহ ব্যক্ত করলে তিনি বললেন-ضَعِيفٌ مُسْتَضْعَفٌ ذُو طِمْرَيْنِ لاَ يُؤْبَهُ لَهُ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ " (দুর্বল লোকদের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের এবং দু'টো ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত ব্যক্তি, যাকে হিসাবে গণ্য করা হয় না। সে যদি আল্লাহর নামে কোন বিষয়ে শপথ করে, তা অবশ্যই তিনি সত্যে পরিণত করেন)। এখানে পাশাপাশি ضعيف ও مُسْتَضْعَفٌ এ দু'টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উভয়টির মূলধাতু ضعف , অর্থ দুর্বলতা। ضعيف বলা হয় ওই দুর্বল ব্যক্তিকে, যার পার্থিব আসবাব উপকরণ খুব কম এবং চারিত্রিক দিক থেকে বিনয়ী।
مُسْتَضْعَفٌ শব্দটির দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, লোকে দুনিয়াবী অবস্থার দুর্বলতাহেতু যাকে দুর্বল ও তুচ্ছ গণ্য করে এবং তার উপর নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করে।
সারকথা এ শব্দদু'টি দ্বারা এমন গরীব দীনদারকে বোঝানো হয়, যে নির্মোহ, বিনয়নম্র, প্রচারবিমুখ ও অতি সাধারণ জীবনযাপনকারী। বাক্যের পরবর্তী অংশটি প্রথম অংশের বিশেষণ, যা দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এ শ্রেণীর লোকদের মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হচ্ছে- لو أقسم على الله لأبره (যে আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ অবশ্যই তার শপথ রক্ষা করেন)। অর্থাৎ তার শপথের মর্যাদা রক্ষার্থে সে যে উদ্দেশ্যে শপথ করেছে, আল্লাহ তাআলা তা পূর্ণ করেন। এ ব্যাপারে হযরত আনাস ইবনুন নাযর রাযি. ও তাঁর বোন রুবায়্যি রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

হযরত রুবায়্যি রাযি.-এর সঙ্গে একবার এক মহিলার কলহ দেখা দেয়। তাতে হযরত রুবায়্যি রাযি.-এর এক আঘাতে সে মহিলার একটি দাঁত ভেঙে যায়। তাঁর পক্ষের লোকজন সে মহিলার পক্ষের লোকজনকে অনুরোধ জানাল যেন তারা ক্ষমা করে দেয়। তারা ক্ষমা করতে রাজি হল না। তারপর অনুরোধ জানাল, তাহলে তোমরা এর অর্থমূল্য নিয়ে নাও। তাতেও রাজি হল না। তাদের এক দাবি- দাঁতের বদলে দাঁত, আমরা রুবায়্যিরও একটা দাঁত ভেঙ্গে দেব।
শেষপর্যন্ত বিচার আসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদালতে। তিনি রায় দিলেন- রুবায়্যিরও দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া হবে। এ রায় শুনে হযরত আনাস ইবনুন নাযর রাযি. বলে উঠলেন- রুবায়্যির দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হবে? ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওই আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন! রুবায়্যির দাঁত ভাঙ্গা হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কী বলছ হে আনাস, এটা তো আল্লাহর বিধান, কিসাস গ্রহণ তাঁর কিতাবের ফয়সালা? কিন্তু তাঁর একই কথা- তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। এটা কুরআনের বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফয়সালা অমান্য করা নয়; বরং আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ তাআলা কোনও সহজ সুরত পয়দা করে দেবেন। সে কারণেই তিনি কসম করে বলছিলেন- তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর কসমের মর্যাদা রাখলেন। অপরপক্ষ কিসাস গ্রহণের দাবি ত্যাগ করল এবং অর্থদণ্ড গ্রহণে রাজি হয়ে গেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকস্মিক পরিবর্তনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তারপর তিনি মন্তব্য করলেন-

إن من عباد الله من لو أقسم على الله لأبره

"আল্লাহর এমন কোনও কোনও বান্দাও আছে, যে আল্লাহর নামে কসম করলে আল্লাহ তা পূর্ণ করেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লক্ষ্যবস্তু ছিল উম্মতকে জান্নাতের জন্য প্রস্তুত করা।

খ. মুমিনদের চেষ্টা করা উচিত অন্তরে কঠোরতার পরিবর্তে নম্রতা ও দয়ামায়া সৃষ্টির চেষ্টা করা।

ঘ. চলাফেরায় দর্পিতভঙ্গি অত্যন্ত নিন্দনীয়। চলাফেরায় বিনয়ভঙ্গি বজায় রাখাই প্রকৃত মুমিনের শান।

ঙ. ভোগ-বিলাসিতা পরিহার করে যথাসম্ভব যুহৃদ ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান