কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৩৫. যুহদ-দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির বর্ণনা

হাদীস নং: ৪১০৯
আন্তর্জাতিক নং: ৪১০৯
দুনিয়ার উপমা
৪১০৯। ইয়াহইয়া ইবন হাকীম (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী (ﷺ) খেজুর পাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তাঁর দেহ মুবারকে মাদুরের দাগ পড়ে যায়। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি যদি আমাদিগকে অনুমতি দিতেন, তাহলে আমরা আপনার জন্য এর উপর কিছু বিছিয়ে দিতাম, যা আপনাকে দাগ লাগা থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আমি এবং দুনিয়া, বস্তুত এর উপমা হচ্ছে একজন আরোহীর মত, যে একটি বৃক্ষের ছায়ায় অবস্থান করে, এরপর সে তা ছেড়ে চলে যায়।
بَاب مَثَلُ الدُّنْيَا
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ حَكِيمٍ، حَدَّثَنَا أَبُو دَاوُدَ، حَدَّثَنَا الْمَسْعُودِيُّ، أَخْبَرَنِي عَمْرُو بْنُ مُرَّةَ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ اضْطَجَعَ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ عَلَى حَصِيرٍ فَأَثَّرَ فِي جِلْدِهِ فَقُلْتُ بِأَبِي وَأُمِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوْ كُنْتَ آذَنْتَنَا فَفَرَشْنَا لَكَ عَلَيْهِ شَيْئًا يَقِيكَ مِنْهُ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ مَا أَنَا وَالدُّنْيَا إِنَّمَا أَنَا وَالدُّنْيَا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দারিদ্র্য ভালোবাসতেন। তিনি স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর খাওয়া-পরা এবং জীবনাচারের সবকিছুই ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। খেজুর পাতার চাটাইয়ে শুইতেন। তাতে তাঁর শরীরে চাটাইয়ের বুননের ছাপ পড়ে যেত, যেমন এ হাদীছে বলা হয়েছে। কখনও তিনি খাটেও শুতেন। কিন্তু তা কেমন খাট? সে খাটের ছাউনী ছিল রশির। তাঁর শরীরে সে রশির দাগ বসে যেত। তাঁর পবিত্র শরীর ছিল অত্যন্ত কোমল। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
ما مَسسْتُ شَيْئًا قط را وَلا حَرِيرًا ألين مِنْ كفْ رَسُولِ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে বেশি কোমল কোনওকিছু কখনও স্পর্শ করিনি। না রেশম, না অন্যকিছু।

মানুষ হাত দিয়ে কাজকর্ম করে থাকে। তাই অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় হাত বেশি শক্ত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে হাতই যখন এমন কোমল ছিল, তখন তাঁর পবিত্র দেহের অন্যান্য অঙ্গ কেমন কোমল ছিল? এমন কোমল শরীরের জন্য তো কোমল বিছানাই দরকার। অথচ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করতেন শক্ত বিছানা। শরীরের আরামের প্রতি তাঁর কোনও খেয়াল ছিল না। কিন্তু সাহাবীগণ তো তাঁকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ কিভাবে তারা মেনে নেবেন? তিনি নিজে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করলেও তাদের পক্ষে তা ছিল অসহনীয়। তাই তারা আরয করলেন-
يا رسول الله، لو اتخذنا لك وطاء (ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যদি আপনার জন্য একটা বিছানা বানিয়ে দিতাম।)। অর্থাৎ নরম বিছানা বানিয়ে দিতাম, তাতে আপনার একটু আরামবোধ হতো! অপর এক বর্ণনায় আছে-
يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوْ كُنتَ أذنتَنَا فَفَرَشنَا لَكَ عَلَيْهِ شَيْئًا بَقِيكَ مِنْهُ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি আমাদের অনুমতি দিতেন তবে আপনার জন্য এমন কিছু বিছাতাম, যা আপনাকে এ কষ্ট থেকে বাঁচাত।"

এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ما لي وللدنيا؟ (দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?)। অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি আমার কোনও মহব্বত ও ভালোবাসা নেই। দুনিয়াও নয় আমার সঙ্গী। কাজেই আমি দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হব কী কারণে? অথবা এর অর্থ- দুনিয়া ও আমার মধ্যে মিলটা কোথায় যে, আমি তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ব? এর সাদামাটা অর্থ এমনও হতে পারে যে, দুনিয়া দিয়ে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি দুনিয়ায় বাস তো করতেন। সে হিসেবে একটা সম্পর্ক ছিলই। তবে সে সম্পর্ক আমাদের মত নয়। তিনি সে সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন-
ما أنا في الدنيا إلا كراكب استظل تحت شجرة ثم راح وتركها (দুনিয়ায় তো আমি একজন মুসাফিরস্বরূপ, যে কোনও গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করে, তারপর তা ছেড়ে চলে যায়)। অর্থাৎ দুনিয়া স্থায়ীভাবে থাকার জায়গা নয়। এটা আরামের ঠিকানা নয়। এটা তো অতিক্রম করে যাওয়ার নিবাস। এর বাসিন্দা অবিরত এ ঠিকানা পার হয়ে যাচ্ছে। সে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে আখিরাতের দিকে। সুতরাং এ দুনিয়ায় মানুষ হল একজন মুসাফিরের মত। সে পথিমধ্যে কোনও গাছতলায় বিশ্রাম নেয়। রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য গাছের ছায়ার আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপর রোদের তাপ কিছুটা কমে আসলে আবার যাত্রা শুরু করে এবং ক্ষণিকের সে বিশ্রামস্থল ছেড়ে চলে যায়। তো এই যখন দুনিয়ার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অবস্থা, তখন এই দুনিয়ার আরাম-আয়েশে পড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সাজে কি?

প্রকাশ থাকে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথা বলার উদ্দেশ্য দুনিয়া ত্যাগ করা নয়; বরং দুনিয়ার ভালোবাসা ত্যাগ করা। ক্ষণিকের জন্য হলেও গাছের যে ছায়ায় অবস্থান করার প্রয়োজন হয়, সে ছায়াকে তো সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা চলে না। বরং ছায়া সন্ধান করতে হয়। তা মিলে যাওয়ার পর হেফাজতও করতে হয়। অর্থাৎ কোনওভাবে যাতে তা নষ্ট না হয় এবং বিশ্রামের উপযুক্ত থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। ঠিক তেমনি দুনিয়া আমাদের পক্ষে মুসাফিরখানা হলেও কিছুক্ষণের জন্য উপকারী তো বটে। তাই কিছুক্ষণ যাতে স্বস্তিতে ও নিরুপদ্রবে থাকা যায় সেজন্য একটা স্থান অবশ্যই চাই।

কাজেই দুনিয়ার প্রয়োজনীয় আসবাব-উপকরণ অবশ্যই অর্জন করতে হবে। অর্জিত হওয়ার পর যাতে অযথা নষ্ট না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। তবে সর্বাবস্থায় জীবনের আসল লক্ষ্যবস্তু হবে আখিরাতের স্থায়ী ঠিকানা। দুনিয়ার আসবাব-উপকরণের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার এমনভাবে করতে হবে, যাতে এর দ্বারা সে আসল ঠিকানা হাতছাড়া না হয়; বরং তা অর্জনের পক্ষে সহায়ক হয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ আমাদেরকে দুনিয়ার প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত না হওয়ার উৎসাহ যোগায়।

খ. দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় লিপ্ত হওয়া প্রকৃত নবীপ্রেমিকের পক্ষে সাজে না।

গ. দুনিয়ায় যতদিন থাকা হয়, ততদিন নিজেকে একজন মুসাফিরের বেশি কিছু ভাবা উচিত নয়।

ঘ. দুনিয়ার এ অস্থায়ী ঠিকানা যখন গাছের ছায়াতুল্য, তখন একে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা চলে না। ক্ষণিকের জন্য হলেও ঈমান ও ইজ্জত নিয়ে থাকার একটা ব্যবস্থা করা চাই।

ঙ. দুনিয়াকে অবশ্যই গাছের ছায়াতুল্য গণ্য করব, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এর আসবাব-উপকরণ নষ্ট করব না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
সুনানে ইবনে মাজা - হাদীস নং ৪১০৯ | মুসলিম বাংলা