কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৩৪. ফিতনাসমূহ ও কিয়ামতপূর্ব আলামতের বর্ণনা

হাদীস নং: ৩৯৭১
আন্তর্জাতিক নং: ৩৯৭১
ফিতনার দিনে রসনা সংযত রাখা
৩৯৭১। আবু বকর (রাহঃ) ...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা নীরবতা অবলম্বন করে।
بَاب كَفِّ اللِّسَانِ فِي الْفِتْنَةِ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ، حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِ، عَنْ أَبِي حَصِينٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَسْكُتْ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের হুকুমদানের আগে আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাসের বরাত দিয়েছেন। অর্থাৎ যার এ বিশ্বাস আছে তার এ বিষয়টি পালনে যত্নবান থাকা একান্ত কর্তব্য।

ঈমানের মূল স্তম্ভ সাতটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস, তাকদীরে বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস। এ হাদীছে তার মধ্যে মাত্র দু'টি অর্থাৎ আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ এ দু'টির উপর যার বিশ্বাস আছে, বাকি পাঁচটিতে বিশ্বাস আপনা-আপনিই তার উপর অবধারিত হয়ে যায়। শরীআতের যাবতীয় বিধানের ভিত্তি মূলত এ দু'টি বিশ্বাসের উপরই। কেননা যার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে এবং আখেরাতের হিসাব-নিকাশেরও ভয় আছে, সেই তো শরীআত মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবে। এরূপ বিশ্বাস থাকলেই সে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলের শিক্ষার দ্বারস্থ হবে। নবী-রাসূলের শিক্ষার উৎস আসমানী কিতাব, যা তাঁরা ফিরিশতাদের মাধ্যমে লাভ করে থাকেন। সুতরাং বিশ্বাসীগণ আসমানী কিতাব ও ফিরিশতাদের উপরও ঈমান রাখবে। আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস থাকলে তাতে বর্ণিত কোনওকিছুর উপরই অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। ফলে তাকদীর ও পুনরুত্থানে বিশ্বাসও অবধারিত হয়ে যায়। ব্যস এভাবে আল্লাহ ও শেষদিবসের বিশ্বাস অন্যসবকিছুর বিশ্বাসকেও অবধারিত করে।

হাদীছে বলা হয়েছে- (যে আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার কর্তব্য ভালো কথা বলা, নয়তো চুপ থাকা)। অর্থাৎ বলবে কেবল সেই কথাই, যা ভালো হয়। বোঝা যাচ্ছে চুপ থাকাটাই আসল। কথা বলার অনুমতি আছে তখনই, যখন কথাটা ভালো হয়। ভালো কথা মানে এমন কথা, যাতে কোনও গুনাহ নেই বরং ছাওয়াব আছে। যেমন সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, ভালো পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا 'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করবে, আমি তাকে মহাপ্রতিদান দেব।

যে কথায় ছাওয়াবও নেই গুনাহও নেই, এরকম প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথা বলারও অনুমতি আছে। কিন্তু যে কথার কোনও প্রয়োজন নেই, তা বাহ্যত বৈধ হলেও সে কথা পরিহার করা উচিত। কেননা তাতে অন্ততপক্ষে সময় তো নষ্ট হয়। অহেতুক সময় নষ্ট করাও ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। এক হাদীছে ইরশাদ من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه 'অহেতুক সবকিছু পরিহার করা কোনও ব্যক্তির ইসলামের সুষ্ঠুতার পরিচায়ক। অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যায় সে একজন ভালো মুসলিম, সে নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের উপর আছে।

বলা হয়েছে, যদি ভালো কিছু বলার না থাকে তাহলে চুপ থাকবে। অর্থাৎ চুপ থাকাটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, অক্ষমতার কারণে নয়। যেমন এক ব্যক্তি বোবা, সে কথাই বলতে পারে না অথবা বাকশক্তি আছে বটে, কিন্তু কোনওকিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস রাখে না, তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে আছে, এরূপ চুপ থাকাটা কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। চুপ থাকা ছাওয়াবের কাজ হবে তখনই, যখন তা ইচ্ছাকৃত হয়। যেমন চাইলে সে কোনও শক্ত ও রূঢ় কথা বলতে পারে, তা সত্ত্বেও বলছে না, এ ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা একটি ছাওয়াবের কাজরূপে গণ্য হবে। একবার এক সাহাবী আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক বিভিন্ন আমলের কথা বলতে থাকেন। সবশেষে ইরশাদ করেন فإن لم تطق ذلك، فكف لسانك إلا من خير ‘যদি তাও না পার, তবে ভালো কথা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তোমার জিহ্বা সংযত রাখবে।
অপর এক হাদীছে ইরশাদ من صمت نجا “যে ব্যক্তি নীরবতা অবলম্বন করল সে মুক্তি পেল।"

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা গুনাহের কাজও বটে। যেমন কারও সামনে কেউ অন্যায় কিছু বলছে, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তার প্রতিবাদ করছে না, এটা অন্যায়কে সমর্থন করারই নামান্তর। এরূপ চুপ থাকা নিঃসন্দেহে একটি গুনাহের কাজ। তাই বলা হয়, যে ব্যক্তি সত্য বলার স্থানে চুপ করে থাকে সে এক বোবা শয়তান। (অবশ্য এটি হাদীছ নয়)।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ জিহ্বা সংযত রাখা। হয় ভালো কথা বলবে, নয়তো চুপ থাকবে।

খ. অন্যায় ও অনুচিত কথা বলা হতে বিরত থাকাও একটি সৎকর্ম
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সুনানে ইবনে মাজা - হাদীস নং ৩৯৭১ | মুসলিম বাংলা