আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩১২৯
১৯৫৩. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইসলামী শাসকদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী যোদ্ধাদের সম্পদে, জীবনে ও মৃত্যুর পরে যে বরকত সৃষ্টি হয়েছে
২৯০৯। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উষ্ট্রযুদ্ধের দিন যুবাইর (রাযিঃ) যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান গ্রহণ করে আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে বললেন, হে পুত্র! আজকের দিন জালিম অথবা মাযলুম ব্যতীত কেউ নিহত হবে না। আমার মনে হয়, আমি আজ মাযলুম হিসেবে নিহত হব। আর আমি আমার ঋণ সম্পর্কে বেশী চিন্তিত। তুমি কি মনে কর যে, আমার ঋণ আদায় করার পর আমার সম্পদে কিছু অবশিষ্ট থাকবে? তারপর তিনি বললেন, হে পুত্র! আমার সম্পদ বিক্রয় করে আমার ঋণ পরিশোধ করে দিও। তিনি এক তৃতীয়াংশের ওসীয়্যাত করেন। আর সেই এক তৃতীয়াংশের এক তৃতীয়াংশ ওসীয়্যাত করেন। তাঁর (আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের) পুত্রদের জন্য তাঁর অর্থাৎ আব্দুল্লাহ, তিনি বললেন, এক তৃতীয়াংশকে তিন ভাগে বিভক্ত করবে ঋণ পরিশোধ করার পর যদি আমার সম্পদের কিছু উদ্ধৃত্ত থাকে, তবে তার এক তৃতীয়াংশ তোমার পুত্রদের জন্য।
হিশাম (রাহঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ)-এর কোন কোন পুত্র যুবাইর (রাযিঃ)-এর পুত্রদের সমবয়সী ছিলেন। যেমন খুবাইব ও আব্বাদ। আর মৃত্যুকালে তাঁর নয় পুত্র ও নয় কন্যা ছিল। আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন, তিনি আমাকে তাঁর ঋণ সম্পর্কে ওসীয়্যাত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, হে পুত্র! যদি এ সবের কোন বিষয়ে তুমি অক্ষম হও, তবে এ ব্যাপারে আমার মাওলার সাহায্য চাইবে। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি বুঝে উঠতে পারি নি যে, তিনি মাওলা দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করেছেন। অবশেষে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে পিতা! আপনার মাওলা কে? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহ। আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যখনই তাঁর ঋণ আদায়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, তখনই বলেছি, হে যুবাইরের মাওলা! তাঁর পক্ষ থেকে তাঁর ঋণ আদায় করে দিন। আর তাঁর করয শোধ হয়ে যেত।
এরপর যুবাইর (রাযিঃ) শহীদ হলেন এবং তিনি নগদ কোন দীনার রেখে যাননি আর না কোন দিরহাম। তিনি কিছু জমি রেখে যান যার মধ্যে একটি হল গাবা। আরো রেখে যান মদীনায় এগারোটি বাড়ী, বসরায় দু’টি, কূফায় একটি ও মিসরে একটি। আবুদল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বলেন, যুবাইর (রাযিঃ)-এর ঋণ থাকার কারণ এই ছিল যে, তাঁর নিকট কেউ যখন কোন মাল আমানত রাখতে আসতো তখন যুবাইর (রাযিঃ) বলতেন, না, এভাবে নয়’ তুমি তা আমার কাছে ঋণ হিসাবে রেখে যাও। কেননা, আমি ভয় করছি যে, তোমার মাল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যুবাইর (রাযিঃ) কখনো কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা বা কর আদায়কারী অথবা অন্য কোন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। অবশ্য তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর সঙ্গী হয়ে অথবা আবু বকর, উমর ও উসমান (রাযিঃ)- এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বলেন, তারপর আমি তাঁর ঋণের পরিমাণ হিসাব করলাম এবং দেখলাম তাঁর ঋণের পরিমাণ বাইশ লাখ পেলাম। রাবী বলেন, সাহাবী হাকিম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেন, হে ভাতিজা। বল তো আমার ভাইয়ের কত ঋণ আছে? তিনি তা প্রকাশ না করে বললেন, এক লাখ। তখন হাকিম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এ সম্পদ দ্বারা এ পরিমাণ ঋণ শোধ হতে পারে, আমি এরূপ মনে করি না। তখন আবুদল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) তাকে বললেন, যদি ঋণের পরিমাণ বাইশ লাখ হয়, তবে কি ধারণা করেন? হাকীম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) বললেন, আমি মনে করি না যে, তোমরা এর সামর্থ রাখ। যদি তোমরা এ বিষয়ে অক্ষম হও, তবে আমার সহযোগীতা গ্রহণ করবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বলেন, যুবাইর (রাযিঃ) গাবাস্থিত ভূমিটি এক লাখ সত্তর হাজারে কিনেছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) তা ষোল লাখের বিনিময়ে বিক্রয় করেন। আর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, যুবাইর (রাযিঃ)-এর নিকট কারা পাওনাদার রয়েছে, তারা আমার সঙ্গে গাবায় এসে মিলিত হবে। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাযিঃ) তাঁর নিকট এলেন। যুবাইর (রাযিঃ)- এর নিকট তাঁর চার লাখ পাওনা ছিল। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ)-কে বললেন, তোমরা চাইলে আমি তা তোমাদের জন্য ছেড়ে দিব। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, না। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাযিঃ) বললেন, যদি তোমরা তা পরে দিতে চাও, তবে তা পরে পরিশোধের অন্তর্ভুক্ত করতে পার। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, না। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাযিঃ) বললেন, তবে আমাকে এক টুকরা ভূমি দাও। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, এখান থেকে ওখান পর্যন্ত জমি আপনার।
রাবী বলেন, তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) গাবার জমি থেকে বিক্রয় করে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করেন। তখনও তাঁর নিকট গাবার জমির সাড়ে চার অংশ অবশিষ্ট থেকে যায়। তারপর তিনি মুআবিয়া (রাযিঃ)-এর কাছে এলেন। সে সময় তাঁর কাছে আমর ইবনে উসমান, মুনযির ইবনে যুবাইর ও আব্দুল্লাহ ইবনে যামআ (রাযিঃ) উপস্থিত ছিলেন। মুআবিয়া (রাযিঃ) তাঁকে বললেন, গাবার মূল্য কত নির্ধারিত হয়েছে? তিনি বললেন, প্রত্যেক অংশ এক লাখ হারে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কত অবশিষ্ট আছে? আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বললেন, সাড়ে চার অংশ। তখন মুনযির ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, আমি এক অংশ এক লাখে নিলাম। আমর ইবনে উসমান (রাযিঃ) বললেন, আমি একাংশ এক লাখে নিলাম। আর আব্দুল্লাহ ইবনে যামআ (রাযিঃ) বললেন, আমি একাংশ এক লাখে নিলাম। তখন মুআবিয়া (রাযিঃ) বললেন, আর কি পরিমাণ অবশিষ্ট আছে? আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, দেড় অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। মুআবিয়া (রাযিঃ) বললেন, আমি তা দেড় লাখে নিলাম।
রাবী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রাযিঃ) তাঁর অংশ মুআবিয়া (রাযিঃ)-এর নিকট ছয় লাখে বিক্রয় করেন। তারপর যখন ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) তাঁর পিতার ঋণ পরিশোধ করে সারলেন, তখন যুবাইর (রাযিঃ)- এর পুত্ররা বললেন, আমাদের মীরাস ভাগ করে দিন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাযিঃ) বললেন, না, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের মাঝে ভাগ করব না, যতক্ষণ আমি চারটি হজ্জ মৌসুমে এ ঘোষণা প্রচার না করি যে, যদি কেউ যুবাইর (রাযিঃ)- এর কাছে ঋণ পাওনা থাকে, সে যেন আমাদের কাছে আসে, আমরা তা পরিশোধ করব। রাবী বলেন, তিনি প্রতি হজ্জের মৌসুমে ঘোষণা প্রচার করেন। তারপর যখন চার বছর অতিবাহিত হল, তখন তিনি তা তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। রাবী বলেন, যুবাইর (রাযিঃ)-এর চার স্ত্রী ছিলেন। এক তৃতীয়াংশ পৃথক করে রাখা হল। প্রত্যেক স্ত্রী বার লাখ করে পেলেন। আর যুবাইর (রাযিঃ)- এর মোট সম্পত্তি পাঁচ কোটি দু’লাখ ছিল

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি. তাঁর পিতার দেনা কিভাবে পরিশোধ করেছিলেন তা বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। সুতরাং তার কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে দেনার বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কিছু কথা এসেছে, যা ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছুটা আলোচনা দরকার। নিচে সেই প্রাসঙ্গিক কথাগুলোরই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।

এক.

হযরত যুবায়র রাযি. পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-

إِنَّهُ لاَ يُقْتَلُ اليَوْمَ إِلَّا ظَالِمٌ أَوْ مَظْلُومٌ، وَإِنِّي لاَ أُرَانِي إِلَّا سَأُقْتَلُ اليَوْمَ مَظْلُومًا

(আজ কেবল জালেম বা মজলুমই নিহত হবে। আমি নিজের সম্পর্কে মনে করি যে, আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব)। প্রশ্ন হয়, সব যুদ্ধই তো এরকম যে, তাতে একপক্ষ জালেম ও অন্যপক্ষ মজলূম হয়, কাজেই তাতে জালেম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা জালেমরূপে এবং মজলূম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা মজলূমরূপেই নিহত হবে এই তো স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও হযরত যুবায়র রাযি. এ কথা কেন বলছেন যে, আজ যে নিহত হবে সে হয় জালেম নয়তো মজলূমরূপে নিহত হবে?
এর উত্তর হচ্ছে, এ যুদ্ধে উভয়পক্ষে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা ছিলেন সাহাবী। তারা সকলেই ইখলাসের অধিকারী ছিলেন এবং শরী'আতের সীমারেখা মেনে চলতেন। কাজেই তাদের জালেম হওয়ার প্রশ্ন আসে না। তাদের যে-কেউ নিহত হবেন, নিঃসন্দেহে তিনি মজলূমরূপেই নিহত হবেন। যেমন এর আগে তারা যত যুদ্ধ করেছেন, তাতে তাদের পক্ষের নিহতগণ শহীদ ও মজলুমই ছিলেন। অপরপক্ষে ছিল কাফের ও মুশরিক সম্প্রদায়। তাদের নিহত হওয়া বা বেঁচে থাকা সবটাই হত জালেমরূপে। কিন্তু এটা একটা ব্যতিক্রম যুদ্ধ। কেননা এটাই প্রথম যুদ্ধ, যাতে উভয়পক্ষেই মুসলিম ও সাহাবী। তাই এ ক্ষেত্রে কোনও একপক্ষের নয়; বরং উভয়পক্ষের নিহতগণেরই মজলুম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তাহলে জালেম কারা? জালেম হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা এতে শরীক হয়েছে কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। যাদের উদ্দেশ্য আখিরাত নয়; কেবলই দুনিয়া। বিশেষত ওই সাবাঈ গোষ্ঠী, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হযরত উছমান রাযি.-এর হত্যাকর্মে অংশগ্রহণ করেছিল।

তারপর তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন- আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব। তিনি একথা বলেছিলেন খুবসম্ভব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে যে-

بَشِّر قَاتِلَ ابْنِ صَفِيَّةَ بِالنَّارِ

(আমার ফুফু) সাফিয়্যার পুত্রের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সংবাদ দিও।

সেইসঙ্গে তাঁর নিজের এ আত্মবিশ্বাস তো ছিলই যে, তিনি কোনও মন্দ উদ্দেশ্যে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি এতে অংশগ্রহণ করেছেন বিদ্রোহী ঘাতকদের বিচারের উদ্দেশ্যে এবং তাও করেছেন ইজতিহাদের ভিত্তিতে, মনগড়া ধারণার বশবর্তীতে নয়।

হযরত যুবায়র রাযি.-এর ভাবনা সত্যে পরিণত হয়েছিল। 'আল জামাল'-এর যুদ্ধকালে সত্যিই তিনি নিহত হন। তাও রণক্ষেত্রে নয়; বরং ওয়াদী সিবা' নামক এক উপত্যকায় নিঃসঙ্গ অবস্থায়। যুদ্ধ শুরুর আগেই হযরত আলী রাযি.-এর বোঝানোতে তিনি আপন শিবির পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। ওই উপত্যকায় রাত্রী যাপনকালে বিদ্রোহী গ্রুপের জনৈক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন। সুতরাং তিনি যে যথার্থই মজলূম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন এতে কোনও সন্দেহ নেই।

দুই.

তাঁর এত বিপুল দেনা কিভাবে হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বলেছেন যে, তা হয়েছিল মানুষের রাখা আমানতকে ঋণরূপে গ্রহণের কারণে। অর্থাৎ যে-কেউ তাঁর কাছে টাকা-পয়সা ও মালামাল আমানত রাখতে চাইত তাকেই তিনি বলতেন, আমি এটা আমানতরূপে না রেখে ঋণ হিসেবে নিয়ে নিচ্ছি।

তিনি এটা করতেন আমানতকারীর কল্যাণার্থে। কেননা আমানতের মাল হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে জরিমানা দিতে হয় না। বলাবাহুল্য তা হারানো বা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই। আর বাস্তবিকই যদি তা হয়ে যায়, তবে আমানতকারী যেহেতু তার বিপরীতে কিছু পাবে না, সেহেতু তার ক্ষতিই হয়ে গেল। পক্ষান্তরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তা হারিয়ে যাক, নষ্ট হয়ে যাক বা অন্য যা-ই হোক না কেন।

এটা প্রমাণ করে হযরত যুবায়র রাযি. কতটা উদারপ্রাণ এবং মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি অনেক বড় দানশীল ছিলেন। কাজেই যে যা-কিছু আমানত রাখার জন্য নিয়ে আসত, তা ঋণরূপে নিয়ে খরচ করে ফেলতেন। হয়তো দান-সদাকা করতেন কিংবা মেহমানদারী করতেন বা অন্য কোনওভাবে খরচ করতেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসও ছিল গভীর। বিশ্বাস ছিল বলেই তো তাঁর কাছে আমানত রাখার জন্য আসত। কাজেই তাদের এ আস্থাও ছিল যে, ঋণ হিসেবে নিলেও তিনি তা অবশ্যই পরিশোধ করবেন। এ আস্থার কারণে প্রচুর লোক তাঁর কাছে অর্থকড়ি নিয়ে আসত আর তিনিও তা খুশিমনে রেখে দিতেন। এই করে করেই তাঁর এতটা মোটা অঙ্কের ঋণ হয়ে যায়।

তিন.

তিনি ঋণ পরিশোধের অসিয়ত করার পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করারও অসিয়ত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. যে বর্ণনা দিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা সাংঘর্ষিক মনে হয়। কেননা প্রথমে বলেছেন-

وَأَوْصَى بِالثُّلُثِ، وَثُلُثِهِ لِبَنِيهِ - يَعْنِي بَنِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ - ثُلُثُ الثُّلُثِ

"তারপর তিনি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন আর তার (অর্থাৎ সেই এক-তৃতীয়াংশের) এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন তার পুত্রদের জন্য। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়রের পুত্রদেরকে এক-তৃতীয়াংশের তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার অসিয়ত করলেন"।

আবার পরক্ষণেই বলেছেন-

فإن فضل من مالنا بعد قضاء الدين شيء فثلثه لبنيك

"দেনা পরিশোধের পর আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার পুত্রদের দিও"।
প্রথম কথার অর্থ দাঁড়ায় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দান-খয়রাতের অসিয়ত করেছেন এবং সেই এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আব্দুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন। কিন্তু পরের কথা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাঁর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন দেনা পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার এক-তৃতীয়াংশ।
এর উত্তর হচ্ছে, মূলত প্রথম কথার অর্থও এটাই যে, ঋণ পরিশোধের পর কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে তার এক-তৃতীয়াংশ অসিয়তের খাতে ব্যয় হবে, যার তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়া হবে আব্দুল্লাহ রাযি.-এর ছেলেদেরকে। কেননা অসিয়ত কার্যকর করা যায় কেবল মানুষের হক আদায়ের পরই। যদি সবটা সম্পদই দেনা পরিশোধে লেগে যায়, তবে অসিয়তের কার্যকারিতা থাকে না। ব্যস এ হিসেবে উভয় কথার মধ্যে আর কোনও বিরোধ থাকল না।

এখানে আরও একটি বিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রথমে বলা হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আদুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে হবে, পরের বাক্যে বলা হয়েছে তাদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের সবটা। মূলত এখানেও কোনও বিরোধ নেই। পরের বাক্যটি সংক্ষেপ। প্রথমে যখন খুলে বলা হল- তার পুত্রদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ, তখন পরের বাক্যেও এক- তৃতীয়াংশ দ্বারা এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশই বুঝতে হবে। তখন আর কোনও বিরোধ থাকবে না।

উল্লেখ্য, অসিয়ত প্রযোজ্য হয় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে, তাও ঋণ পরিশোধ এবং মানুষের অন্যান্য হক আদায়ের পর। সম্পূর্ণ সম্পদ দানের অসিয়ত জায়েয নয়। কেননা তা ওয়ারিশদের হক। শরী'আত তাদেরকে বঞ্চিত করার অনুমতি দেয়নি।

চার.

দেনা পরিশোধে অক্ষমতা দেখা দিলে তখন কী করতে হবে, সে সম্পর্কে হযরত যুবায়র রাযি, পুত্রকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন-

إِنْ عَجَزْتَ عَن شَيْءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِنْ بِمَوْلاَيَ

"তুমি যদি দেনার কোনও অংশ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়, তবে সে ব্যাপারে আমার মাওলার কাছে সাহায্য চেয়ো"। হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. আমাদের জানাচ্ছেন যে, হযরত যুবায়র রাযি. 'মাওলা' বলে কাকে বোঝাচ্ছিলেন তিনি তা বুঝতে পারেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. কেন তা বুঝতে পারেননি?
উত্তর হচ্ছে, আমরা আমাদের ভাষায় 'মাওলা' বলে সাধারণত আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু আরবীতে এ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন মনিব, অভিভাবক,নেতা, কর্তৃত্ববান ব্যক্তি, বন্ধু, সঙ্গী, চুক্তিবদ্ধ মিত্র, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, মুক্তিদাতা মনিব ইত্যাদি। কাজেই শব্দটি দ্বারা যেমন আল্লাহকে বোঝানো যায়, তেমনি উল্লিখিত অর্থসমূহের যে-কোনও অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কুরআন ও হাদীছে এসব অর্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ

(জেনে রেখ) তার (রাসূলের) মাওলা (সঙ্গী ও সাহায্যকারী) আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ। সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৪
আলেমদেরকে যে 'মাওলানা' বলা হয়ে থাকে তাও এ হিসেবেই যে, তারা দীনের অভিভাবক, সাহায্যকারী, নেতা ইত্যাদি।

তো 'মাওলা' দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও যেহেতু বোঝানো হয় এবং ঋণ পরিশোধে সাহায্য চাওয়াটা যেমন দু'আর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার কাছে হতে পারে, তেমনি কোনও মানুষের কাছেও এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। দুনিয়ার কাজে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ায় শরী'আতের কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। কাজেই এ ক্ষেত্রে এটা বোঝার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে, হযরত যুবায়র রাযি. ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে তাঁর যে মাওলার কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন, তিনি তাঁর কোনও বন্ধু, চুক্তিবদ্ধ মিত্র বা অন্য কেউ-ও হতে পারে। তাই হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বুঝতে পারছিলেন না যে, তাঁর পিতা 'মাওলা' বলে ঠিক কাকে বোঝাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি পিতাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। পিতা বলে দিলেন যে, মাওলা বলে তিনি আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়েছেন।

এটা আল্লাহ তা'আলার প্রতি হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি.-এর চূড়ান্ত তাওয়াক্কুল ও পরম নির্ভরতারই পরিচয় বহন করে। সেইসঙ্গে এটা পরিচয় বহন করে তাঁর গভীর তাকওয়া ও আল্লাহভীতিরও। তাঁর ভয় ছিল শহীদ হয়ে গেলে তাঁর ঋণ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে? এটা বান্দার হক। এ হক পরিশোধ না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন কী উপায় হবে? তিনি বড় কোনও ব্যবসায়ী ছিলেন না, মোটা অঙ্কের নগদ টাকা-পয়সা বা সোনা-রূপারও মালিক ছিলেন না। তাঁর যা সম্পদ তা কেবলই স্থাবর সম্পত্তি জমি-জায়েদাদ, যা তিনি যুদ্ধে গনীমতের অংশ হিসেবে পেয়েছিলেন। বাহ্যত তা দ্বারা এত বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ হওয়া সম্ভবপর ছিল না। তাঁর উল্লিখিত কথা দ্বারা সে আশঙ্কার প্রতি ইশারাও হয়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা। তাঁর বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলার কাছে পরিপূর্ণ আস্থার সাথে সাহায্য চাইলে তিনি অবশ্যই তা পরিশোধের একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। যারা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা করে এবং অন্তরে তাঁর ভয়ও রাখে, আল্লাহ তা'আলা অকল্পনীয়ভাবে তাদের সাহায্য করে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ

যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে-কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ২-৩

বাস্তবেও তা-ই হল। এত বিপুল অঙ্কের ঋণ খুব আসানীর সঙ্গে পরিশোধ হয়ে গেল। এর জন্য তাঁর সবটা সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়নি। গাবা'র ভূমিই যথেষ্ট হয়ে গেছে। এটা বরকত ছাড়া কিছুই নয়। জমির যে মূল্য হওয়ার কথা ছিল, কার্যত তারচে' বহুগুণ বেশি মূল্যে তা বিক্রি হয়েছে। সুবহানাল্লাহ, এভাবে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাওয়াক্কুল করার সুফল কেবল আখিরাতে নয়; বরং দুনিয়ায়ও লাভ হয়ে থাকে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দেনা বান্দার হক। মৃত্যুর আগে নিজে তা পরিশোধ করতে না পারলে ওয়ারিশদেরকে তা পরিশোধের জন্য অসিয়ত করে যাওয়া চাই।

খ. যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছু আমানত রাখে, আমানতগ্রহীতার কর্তব্য তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।

গ. কেউ দেনা রেখে মারা গেলে সচ্ছল ও সম্পদশালী ব্যক্তিদের উচিত তা পরিশোধে সহযোগিতা করা, যেমন হযরত হাকিম ইবন হিযাম রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-এর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ঘ. পাওনাদার ব্যক্তির উচিত তার পাওনা পরিশোধের জন্য দেনাদারের প্রতি কঠোরতা না করে সে যাতে তা আসানীর সাথে পরিশোধ করতে পারে সেই সুযোগ দেওয়া, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-কে সেই সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

ঙ. আল্লাহ তা'আলার প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল থাকলে অবশ্যই তার সুফল পাওয়া যায়।

চ. বড় পুত্রের কর্তব্য পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের ব্যাপারে শরী'আতসম্মতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমনটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি, করেছিলেন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন