আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩০৭৪
১৯৩১. গনীমতের সামান্য পরিমাণ মাল আত্মসাৎ করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ বর্ণনায় তিনি আত্মসাৎকারীর মালপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছেন" কথাটি উল্লেখ করেন নি। আর এটাই বিশুদ্ধ।
২৮৫৭। আলী ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর পাহারা দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তি নিযুক্ত ছিল। তাকে কারকারা নামে ডাকা হত। সে মারা গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে জাহান্নামী! লোকেরা তার অবস্থা দেখতে গেল তারা একটি আবা পেল যা সে আত্মসাত করেছিল। আবু আব্দুল্লাহ (রাহঃ) বলেন, ইবনে সালাম (রাহঃ) বলেছেন, কারকারা।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে কিরকিরা বা কারকিরা নামক জনৈক ব্যক্তির অবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম ওয়াকিদী রহ.-এর বর্ণনা মোতাবেক তিনি এক কৃষ্ণাঙ্গ গোলাম ছিলেন। এ হাদীছে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে- كان على ثقل النبي ﷺ (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মালপত্রের দায়িত্বে ছিল)। ثقل (ছাকাল) অর্থ পোষ্য ও পরিবারবর্গ। যে মালপত্র বহন করতে কষ্ট হয় তাকেও ছাকাল বলে। সম্ভবত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভারী মালপত্র কোনও বাহনে করে আনা-নেওয়া করা তার একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল। কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাহনের লাগাম ধরতেন।

আবূ সা'দ নাইসাবুরী রহ. 'শারাফুল মুস্তফা' নামক গ্রন্থে বলেন, ইয়ামামার শাসক হাওযা ইবন আলী আল-হানাফী তাকে হাদিয়াস্বরূপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে আযাদ করে দেন। কিন্তু বালাযুরী রহ.-এর বর্ণনামতে গোলাম অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল, এ বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। হতে পারে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আবার যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতও হয়ে থাকতে পারেন।

তার মৃত্যুসংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান যে, সে জাহান্নামে। অর্থাৎ তাকে তার পাপের কারণে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অথবা এর অর্থ- আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা না করলে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথা শুনে সাহাবায়ে কিরামের আশ্চর্য বোধ হল। কেননা যুদ্ধকালে যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটের লাগাম ধরে রাখতেন, দীনের জন্য তার ত্যাগ ও কুরবানী কতই না বড়! যে-কোনও মুহূর্তেই শাহাদাত নসীব হতে পারে। এরকম ব্যক্তির তো জান্নাতেরই সুসংবাদ পাওয়ার কথা। সেখানে তার জাহান্নামী হওয়ার সংবাদ! তাদের মনে জানার কৌতূহল জাগল যে, কেন তার এ পরিণাম? তাই তারা খোঁজখবর নেওয়ার জন্য চলে গেলেন। অনুসন্ধান করে তারা জানতে পারলেন যে, তিনি গনীমতের মাল থেকে একটি আবা লুকিয়ে রেখেছিলেন। গনীমতের মাল আত্মসাৎ করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। সেই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণেই তার এ পরিণাম।

'আবা' বলা হয় একপ্রকার কালো ডোরাযুক্ত চাদর বা কম্বলকে। একপ্রকার ঢোলাঢালা জামাকেও আবা বলা হয়ে থাকে। غل শব্দটির উৎপত্তি غلول থেকে। এর মূল অর্থ গোপন করা। শব্দটি গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ মাল আত্মসাৎ করার অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেহেতু আত্মসাৎকারী প্রথমে তা লুকিয়ে রাখে। গনীমতের মাল অল্প হোক বা বেশি, গুরুত্বপূর্ণ মাল হোক বা তুচ্ছ কিছু, সর্বাবস্থায়ই তা আত্মসাৎ করা কঠিন পাপ। কেননা তাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক মুজাহিদের হক আছে। ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ হরণ করলে তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু যে বস্তুতে বহু লোকের হক সম্পৃক্ত, তা হরণ করলে প্রত্যেকের কাছ থেকেই মাফ করিয়ে নেওয়া জরুরি। এটা তো অনেক কঠিন ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয় না। পরিণামে জাহান্নামে যাওয়া অনিবার্য হয়ে যায়। সে কারণেই এ ব্যক্তির বিপুল ত্যাগ ও কুরবানী সত্ত্বেও তুচ্ছ একটি আবার কারণে তাকে জাহান্নামী হতে হয়েছে। সুতরাং যারা সরকারি বা জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে তাদের পরিণাম কত কঠিন হবে, এর দ্বারা সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই সকলেরই এ ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. গনীমতের মাল আত্মসাৎ করা কঠিন পাপ, তা যতই তুচ্ছ জিনিস হোক না কেন।

খ. কিছুতেই সরকারি বা জাতীয় সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে নেই। কেননা তার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া বড়ই কঠিন।

গ. কোনও ব্যক্তি যত মহৎ কাজেই নিযুক্ত থাকুক না কেন, বলা যায় না আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ কোনও কাজের কারণে সেও আটকে যেতে পারে। কাজেই সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে আল্লাহভীতির সঙ্গে কাজ করা উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন