আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩০৭২
১৯২৯. যে ব্যক্তি ফার্সী অথবা অন্য কোন অনারবী ভাষায় কথা বলে।
২৮৫৫। মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, হাসান ইবনে আলী (রাযিঃ) সাদ্‌কার খেজুর থেকে একটি খেজুর নিয়ে তা তাঁর মুখে রাখেন। তখন নবী (ﷺ) কাখ্-কাখ্ (ফেলে দাও, ফেলে দাও) বললেন, তুমি কি জানো না যে, আমরা (বনু হাশিম) সাদ্‌কা খাই না। ইকরিমা (রাহঃ) বলেন, সান্নাহ হাবশী ভাষায় সুন্দর অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবূ আবদুল্লাহ (রাহঃ) বলেন, উম্মে খালিদের মত কোন মহিলা এত দীর্ঘজীবী হয়নি।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, হযরত হাসান রাযি. যখন সদাকার খেজুর মুখে দিয়েছিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসে সদাকার খেজুর বণ্টন করছিলেন। সদাকা বলতে সাধারণত যাকাত বোঝানো হয়ে থাকে। হযরত হাসান রাযি. তখন খুব ছোট ছিলেন। বণ্টন শেষে তিনি তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর মুখ থেকে লালা পড়ছিল। সে লালা পবিত্র শরীরে লাগতেই তিনি নাতির দিকে তাকান। তখনই তাঁর মুখে খেজুর দেখতে পান। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় আছে, তাকে খেজুর চুষতে দেখে গালে নাড়া দিয়ে বলেছিলেন,'বাছা এটা ফেলে দাও। বাছা এটা ফেলে দাও'। এখানকার বর্ণনায় আছে, তিনি তাকে ছি, ছি, বলে সেটি ফেলে দিতে বলেছিলেন। সম্ভবত প্রথমে আদর করে বলেছিলেন। কিন্তু তারপরও সেটি না ফেলায় একটু তিরস্কার করেন। শেষে বলেন, 'তুমি জানো না, আমরা সদাকা খাই না?' মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে, 'জানো না সদাকা আমাদের জন্য হালাল নয়?'
অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর ও বনূ হাশেমের জন্য সদাকা যাকাত খাওয়া হালাল নয়। এটা তাদের উচ্চমর্যাদার কারণে।
উল্লেখ্য, কন্যার সন্তানদের বেলায়ও 'বংশধর' শব্দ প্রযোজ্য হয়। কুরআন মাজীদে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের এর বংশধর বলা হয়েছে। এটা তো তাঁর মায়ের সূত্রেই হয়েছে, যেহেতু তাঁর পিতা ছিল না।
এ প্রসঙ্গে দুর্দান্ত প্রতাপশালী শাসক হাজ্জাজ ইবন ইয়ুসুফ ও ইমাম ইয়াহইয়া ইবন ইয়া'মার রহ.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
হযরত হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলের ঘরের নাতি নয় বলে হাজ্জাজ ইবন ইয়ুসুফ তাদেরকে তাঁর বংশধর বলে স্বীকার করত না। তিনি কোনও সূত্রে জানতে পারলেন যে, ইমাম ইয়াহইয়া ইবন ইয়া'মার রহ. তাঁদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলে উল্লেখ করে থাকেন। কাজেই হাজ্জাজ তাকে তলব করলেন। তিনি সামনে আসতেই ধমক দিয়ে বললেন, তুমি কি সেই, যার ধারণা হাসান ও হুসাইন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর? এটা প্রমাণ কর, নয়তো কঠিন শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও। তিনি বললেন, প্রমাণ করতে পারলে আমি নিরাপদ? তিনি বললেন, হাঁ, নিরাপদ। তখন ইয়াহইয়া ইবন ইয়া'মার রহ. কুরআন মাজীদ থেকে তিলাওয়াত করলেন-

وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ كُلًّا هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِنْ قَبْلُ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَى وَهَارُونَ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَى وَعِيسَى

“আমি ইবরাহীমকে দান করেছিলাম ইসহাক (-এর মত পুত্র) ও ইয়াকুব (-এর মত পৌত্র)। তাদের প্রত্যেককে আমি হিদায়াত দান করেছিলাম। আর নূহকে আমি আগেই হিদায়াত দিয়েছিলাম এবং তার বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলায়মান, আইয়ূব, ইয়ুসুফ, মূসা ও হারুনকেও। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। এবং যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা।৪১৫
তিনি বললেন, এ আয়াতে ঈসা আলাইহিস সালামকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধর বলা হয়েছে। তিনি তাঁর বংশধর হয়েছিলেন মায়ের দিক থেকে। তাও হযরত হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি. এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝখানে দূরত্ব মাত্র এক ধাপের। অথচ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মাঝখানে দূরত্ব বহু ধাপের। হাজ্জাজ বললেন, আমি মনে করি তুমি তোমার দাবি প্রমাণ করতে পেরেছ। তারপর আরও কিছু কথাবার্তা হয় এবং সে মজলিসেই হাজ্জাজ তাকে খুরাসানের বিচারপতি করে পাঠান।৪১৬
যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় নাতিকে তরবিয়াত করলেন। তাকে সদাকার খেজুর খাওয়া থেকে বিরত রাখলেন। ছোট্ট বলে প্রশ্রয় দিলেন না। এত আদর-স্নেহ করতেন, তাও এরকম আহ্লাদ দেখালেন না যে, আহা, বাছা মুখে দিয়ে ফেলেছে, এবারের মত খেয়ে নিক, সতর্ক থাকতে হবে, এরপর যেন আর না খায়। না, এরকম মায়া তিনি দেখালেন না। কারণ, বড়দের জন্য যা খাওয়া হারাম, তা ছোটদেরকে খাওয়ানোও হারাম। মায়া করে হারাম খাওয়ানো এক তো শিশুর প্রতি জুলুম, দ্বিতীয়ত শরীআতের হুকুম অমান্য করায় নিজের জন্যও সরাসরি পাপ।
তিনি প্রিয় নাতিকে তিরস্কার করে বললেন, জানো না, আমরা সদাকা খাই না?' কোলের শিশুর তো এটা জানার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তাকে এ কথা বলার উদ্দেশ্য বিষয়টির গুরুত্ব ও সুবিদিত হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা। অর্থাৎ আমাদের বংশের লোকদের জন্য যাকাত সদাকা যে হালাল নয়, এটা সকলেরই জানার কথা এবং এ বিধানটি এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ ব্যাপারে শিথিলতার কোনও অবকাশ নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, ছেলেমেয়েদেরকে শৈশব থেকেই দীনী তরবিয়াত দেওয়া চাই, যাতে ছোটবেলা থেকেই ইসলামী রীতিনীতি ও আদব কায়দা পালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

খ. শিশুদেরকে অন্যায়-অনুচিত কাজে প্রশ্রয় দিতে নেই। এ জাতীয় প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়। এতে তারা অনুচিত কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

গ. সায়্যিদ অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর ও বনূ হাশেমের জন্য সদাকা যাকাত খাওয়া হালাল নয়।

ঘ. এ হাদীছ দ্বারা শিশুদের আদর-সোহাগ করারও শিক্ষা পাওয়া যায়।

৪১৫. সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৮৪-৮৫

৪১৬. ইবন খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ'ইয়ান, ৬ খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন