আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩০৪৬
১৯১২. বন্দীকে মুক্ত করা। এ বিষয়ে আবু মুসা (রাযিঃ) কর্তৃক নবী (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণিত রয়েছে
২৮৩২। কুতাইবা ইবনে সাঈদ (রাহঃ) .... আবু মুসা (আশআরী) (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা বন্দীকে মুক্ত কর, ক্ষুধার্তকে আহার দান কর এবং রোগীর সেবা-শুশ্রুষা কর।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ তিনটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হল রোগীকে দেখতে যাওয়া। এটা মুসলিম ভাইয়ের হক এবং অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من عاد مريضا لم يزل يخوض في الرحمة حتى يجلس، فإذا جلس يغمس فيها
'যে ব্যক্তি কোনও রোগীকে দেখতে যায়, সে রহমতের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে, যাবৎ না তার কাছে গিয়ে বসে। যখন সে বসে, তখন রহমতের ভেতর তাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়’। (মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১০৮৩৪; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৯৫৬: হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১২৯৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৬৫৮৩; শু'আবুল ঈমান: ৮৭৪৯)

হাদীছটিতে সাধারণভাবে রোগী দেখতে যেতে বলা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে-কোনও রোগীকেই দেখতে গেলে ছাওয়াব হয়, যদিও মুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়ার ছাওয়াব বেশি। ইসলাম যে মানবিকতার শিক্ষাদান করে, তার দাবি হল যদি কোনও অমুসলিম ব্যক্তিও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, তবে তাকেও দেখতে যাওয়া চাই। এক ইহুদি বালক অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গিয়েছিলেন।

হাদীছটির দ্বিতীয় হুকুম হল ক্ষুধার্তকে অন্নদান করা সম্পর্কে। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি যেই হোক, তাকে খাদ্যদান করা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো পশু-পাখির ক্ষুধা নিবারণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। সুতরাং কোনও মানুষ যদি ক্ষুধার্ত থাকে, তবে তার ক্ষুধা নিবারণ করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। হাঁ, মুসলিম ব্যক্তি অনাহারে থাকলে তাকে খাবার খাওয়ানো অধিকতর ছাওয়াবের কাজ হবে। বিশেষত ক্ষুধার্ত ব্যক্তি যদি হয় প্রতিবেশীও, তবে তাকে খাওয়ানো ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِي يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ
'ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে উদরপূর্তি করে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকে’। (বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ১১২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১২৭৪১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৯৬৬৮; শুআবুল ঈমান ৩১১৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২৬৯৯)

হাদীছটির তৃতীয় হুকুম বন্দীদের মুক্তিদান করা সম্পর্কে। বন্দী বিভিন্ন রকম হতে পারে। এক তো সেই বন্দী, যে অমুসলিমদের হাতে আটক রয়েছে। তাকে অর্থের বিনিময়ে বা বন্দীমুক্তির বিনিময়ে কিংবা অন্য কোনও পন্থায় মুক্ত করে আনা একান্ত কর্তব্য। এটা মুসলিম রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যে-কোনও উপায়ে এ দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। এর জন্য জিহাদের প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্র তা থেকে পিছপা হবে না। হযরত উমর রাযি. বলেন, কাফেরদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা আমার কাছে সমগ্র জাযীরাতুল আরব অপেক্ষাও বেশি প্রিয়।

আরেক হল দাস-দাসী। অর্থাৎ যেসকল যুদ্ধবন্দী মুসলমানদের নিকট দাস-দাসীরূপে অবস্থান করছে। তাদেরকে মুক্তিদান করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। ইসলাম নানা পন্থায় দাসমুক্তির কাজে উৎসাহ প্রদান করেছে।

তৃতীয় প্রকার বন্দী হল দেনার দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। দেনা পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ায় আদালত যে দেনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দিয়েছে, সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কর্তব্য দেনা পরিশোধ করে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা।

চতুর্থ প্রকার বন্দী হল জুলুম ও অবিচারের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। এরূপ বন্দীগণ মজলুম হওয়ায় তাদের মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করা ঈমানের দাবি। এই সকল প্রকার বন্দীকেই মুক্ত করা এ হাদীছের আদেশের অন্তর্ভুক্ত। মৌলিকভাবে তো এটা রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
انَّ عَلَى الْمُسْلِمِينَ فِي فَيْئِهِمْ أَنْ يُفَادُوا أَسِيرَهُمْ وَيُؤَدُّوا عَنْ غَارِمِهِمْ
'মুসলিমদের কর্তব্য তাদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তাদের বন্দীদের মুক্ত করা এবং তাদের ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করা’। (সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৮২১)

রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন না করলে জনগণকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এটা তাদের ঈমানী কর্তব্য। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ বটে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি জোর উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ (12) فَكُّ رَقَبَةٍ (13) أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ (14) يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ (15) أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ (16)
'তুমি কি জান সে ঘাঁটি কী? (তা হচ্ছে কারও) গর্দানকে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করা অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান করা কোনও এতিম আত্মীয়কে অথবা এমন কোনও মিসকীনকে, যে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি খায়’। (সূরা বালাদ, আয়াত ১২-১৬)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أيما رجل أعتق امرأ مسلما، استنقذ الله بكل عضو منه عضوا منه من النار
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রত্যেক অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রত্যেক অঙ্গ জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবেন’।
(সহীহ বুখারী : ২৫১৭; সহীহ মুসলিম : ১৫০৯; জামে তিরমিযী: ১৫৪৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৪৮৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ২৫২২; সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৪২১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১২৬৩২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৭২০; শুআবুল ঈমান: ৪০২৯)

যে ব্যক্তি বন্দীজীবন যাপন করে, তার কষ্ট দুঃসহ। বর্তমানকালে পৃথিবীর কারাগারসমূহে বন্দীদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হয়, তাতে কোনও ঈমানদারের প্রাণ না কেঁদে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করছে। দুনিয়ার শক্তিমানেরা তাদের দুর্বল প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে কারাগারে শাস্তিভোগ করাচ্ছে। স্বৈরশাসকদের জুলুম-নিপীড়নের শিকার হয়ে কত অসহায় মানুষ কারাপ্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরছে। তাদের জন্য প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের অপরিহার্য করণীয় রয়েছে। যে-কোনও মূল্যে তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্ত করা মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানী চেতনাসমৃদ্ধ কোনও ব্যক্তি তাদেরকে জালেম নিপীড়কদের হাতে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرب يَوْمِ الْقِيَامَةِ
'এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনকে সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন’। (সহীহ বুখারী : ২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৫১২; শুআবুল ঈমান : ৭২০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৩৩)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত। এটা তার হক।

খ. কেউ ক্ষুধার্ত থাকলে তার ক্ষুধা নিবারণ করা অন্যদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

গ. অমুসলিম রাষ্ট্রে বন্দী থাকা মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিককে মুক্ত করা এবং যে-কোনও স্থানে বিনা অপরাধে আটক ব্যক্তিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া চাই। এটা ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। দাস-দাসীকে মুক্তিদান করাও অতি বড় ছাওয়াবের কাজ।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন