কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ
২২. জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়
হাদীস নং: ২৮৬৭
আন্তর্জাতিক নং: ২৮৬৭
বায়'আত গ্রহণ
২৮৬৭। হিশাম ইব্ন আম্মার (রাহঃ) আওফ ইবন মালিক আশজাঈ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা সাত আট অথবা নয় ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর নিকট ছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের কাছে বায়'আত হবে না? অতএব আমরা আমাদের হাত প্রসারিত করে দিলাম। এক ব্যক্তি বললো ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (ﷺ)! আমরা তো আপনার নিকট (ইতিপূর্বে) বায়'আত হয়েছি, এখন (আবার) কিসের জন্য আপনার নিকট বায়'আত হবো? তখন তিনি বললেন; (তোমরা এই বিষয়ে বায়'আত হবে যে,) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্তের নামায কায়েম করবে, শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করবে। (একটি কথা তিনি গোপনে বললেন)ঃ মানুষের কাছে কিছু চাবে না। রাবী বলেন, অতঃপর আমি তাদের কাউকে দেখেছি যে, তার চাবুক পড়ে যেত, কিন্তু কাউকে তা তুলে দেয়ার জন্য বলতেন না।
بَاب الْبَيْعَةِ
حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ مُسْلِمٍ، حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ التَّنُوخِيُّ، عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ أَبِي إِدْرِيسَ الْخَوْلاَنِيِّ، عَنْ أَبِي مُسْلِمٍ، قَالَ حَدَّثَنِي الْحَبِيبُ الأَمِينُ، - أَمَّا هُوَ إِلَىَّ فَحَبِيبٌ وَأَمَّا هُوَ عِنْدِي فَأَمِينٌ - عَوْفُ بْنُ مَالِكٍ الأَشْجَعِيُّ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم سَبْعَةً أَوْ ثَمَانِيَةً أَوْ تِسْعَةً فَقَالَ " أَلاَ تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللَّهِ " . فَبَسَطْنَا أَيْدِيَنَا فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا قَدْ بَايَعْنَاكَ فَعَلاَمَ نُبَايِعُكَ فَقَالَ " أَنْ تَعْبُدُوا اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَتُقِيمُوا الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ وَتَسْمَعُوا وَتُطِيعُوا - وَأَسَرَّ كَلِمَةً خُفْيَةً - وَلاَ تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا " . قَالَ فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولَئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُهُ فَلاَ يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের নববী ধারা
এ হাদীছের বিভিন্ন বর্ণনায় হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন যে, আমরা সাত-আটজন কিংবা নয়জন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে বসা ছিলাম। এরকম আরও বহু বর্ণনা আছে, যা দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সাহাবীদের বসে থাকার কথা পাওয়া যায়। তাদের সে বসা ছিল তাঁর নিকট থেকে দীনের শিক্ষাগ্রহণ ও তাঁর সাহচর্যলাভের উদ্দেশ্যে। সাহচর্য দ্বারাও মূলত শিক্ষালাভই উদ্দেশ্য। সাহাবীগণ তাঁর কাছে ইসলামের বায়'আত গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়ে যেতেন না। এমন নয় যে, ইসলামগ্রহণের পর তারা যে যার মতো করে জীবনযাপন করতে থাকলেন। বরং যথারীতি তাঁর মজলিসে আসতেন। তাঁর নিকট থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তিনিও পরম যত্নে তাদেরকে শিক্ষাদান করতেন। তিনি নিজের সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বলেই দিয়েছেন যে, আমাকে শিক্ষকরূপে পাঠানো হয়েছে। সুতরাং তিনি পিতৃসুলভ মমতায় সাহাবীদেরকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, যত্ন সহকারে তা তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে দীনের পরিপূর্ণ শিক্ষা তাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন। তারা তাঁর নিকট থেকে যেমন দীনের পরিপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তেমনি শিক্ষাদানের নীতিও যথাযথভাবে রপ্ত করেছেন। পরবর্তী জীবনে তারা নিজেরাও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষাদানের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। শিক্ষাদানের এই যে পদ্ধতি অর্থাৎ শিক্ষার্থীগণ উসতাযের মজলিসে হাজির হবে আর উসতায স্নেহ-মমতার সঙ্গে তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষাদান করবেন, এর সূচনা হয়েছে ইসলামের প্রারম্ভকাল থেকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যকার শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাধ্যমে। আর সে ধারায় আজও পর্যন্ত দীনের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের মহতি সাধনা অব্যাহত আছে। কতইনা সৌভাগ্যবান তারা, যাদের এ পবিত্র ধারায় যুক্ত হওয়ার তাওফীক লাভ হয়েছে!
বিশেষ বিশেষ আমলের জন্য বায়'আতের বৈধতা
এ হাদীছটিতে একটি বিশেষ বায়'আতের কথা বর্ণিত হয়েছে। বায়'আত অর্থ হাতে হাত রেখে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। সাহাবীগণ ইসলাম গ্রহণকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বায়'আত গ্রহণ করতেন অর্থাৎ তাঁর হাতে হাত রেখে ইসলামের উপর অঙ্গীকারাবদ্ধ হতেন। প্রত্যেক সাহাবীই ইসলাম গ্রহণকালে এভাবে তাঁর নিকট বায়'আত গ্রহণ করেছেন। তবে মহিলাদের ইসলাম গ্রহণকালে তিনি তাদের হাত স্পর্শ করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণের বায়'আত ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সাহাবীদের নিকট থেকে বায়'আত গ্রহণ করেছেন। বায়'আতুর রিযওয়ান তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাজেই তাসাওউফ ও তরিকতে শায়খ ও মুরীদের মধ্যে যে বায়'আত হয়, তা অভিনব কিছু নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল দ্বারাই এর বৈধতা প্রমাণিত।
আলোচ্য হাদীছে যে বায়'আতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ইসলাম গ্রহণের বায়'আত নয়। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বললেন তোমরা কি আমার নিকট বায়'আত গ্রহণ করবে না, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, তিনি এ কথা কেন বলছেন, আমরা তো তাঁর নিকট ইসলাম গ্রহণের বায়'আত করেছিই? আর সে বায়'আত এখনও পুরোনো হয়নি। হাদীসে আছে, হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন-
وَكُنَّا حَدِيْثي عَهْد بِبَيْعَةٍ (অথচ আমরা মাত্র কিছুকাল আগেই বায়'আত গ্রহণ করেছি)। অর্থাৎ আমরা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং ইসলাম গ্রহণকালে বায়'আতও গ্রহণ করেছি।
তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করেও বললেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো আপনার নিকট বায়'আত গ্রহণ করেছি! তারপরও তিনি তাদেরকে ওই একই কথা বললেন যে, তোমরা কি আমার নিকট বায়'আত গ্রহণ করবে না? এবার সাহাবীগণ বুঝতে পারলেন যে, এটা ইসলামগ্রহণের বায়'আত নয়; বরং অন্য কোনও বায়'আত। তাই তারা বায়'আত গ্রহণের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে জানতে চাইলেন যে, এবার কোন বিষয়ে আমরা আপনার নিকট বায়'আত গ্রহণ করব? তিনি এক আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক না করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ও আনুগত্য করার বিষয়ে বায়'আতের কথা বললেন। সেইসঙ্গে নিচু আওয়াজে আরও একটা বিষয় উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন-
وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا (তোমরা মানুষের কাছে কিছু চাবে না)। এ কথাটি নিচুস্বরে বললেন বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। অনেক সময় আমরাও এরকম করে থাকি। স্বাভাবিক আওয়াজে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলার মাঝখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রসঙ্গ এসে গেলে আওয়াজ নিচু করে সে বিষয়টি ব্যক্ত করা হয়। তখন শ্রোতা বুঝতে পারে এ বিষয়টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই এভাবে বলা হচ্ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত অনেক মর্যাদাবান। তারা মানবজাতির সেরা। কোনও অবস্থায়ই সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। অন্যের কাছে হাত পাতার দ্বারা মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তাই তাঁর উম্মত যাতে অন্যের কাছে হাত না পাতে, কারও কাছে কিছু না চায়, সে লক্ষ্যে তিনি আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়েও বায়'আত নেন এবং বিশেষ গুরুত্বদানের উদ্দেশ্যে এ বিষয়টি নিচু স্বরে ব্যক্ত করেন।
কারও কাছে কিছু না চাওয়ার কথা বলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষার তালিম দিয়েছেন, তেমনি অন্যের দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা, অভাব-অনটনে সবর করা এবং নিজের যা আছে তাতে খুশি থাকারও শিক্ষাদান করেছেন।
‘কারও কাছে কিছু চাবে না’ কথাটি দ্বারা বাহ্যত অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চাইতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু সাহাবীগণ কথাটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। 'চাওয়া'- এর মধ্যে পড়ে এমন সবকিছু থেকেই তারা বিরত থাকতেন, তা যত তুচ্ছ বিষয়ই হোক না কেন। তাদের সে অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন-
فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُ أَحَدِهِمْ فَمَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ (তারপর আমি সেই দলের কাউকে কাউকে দেখেছি, তাদের কারও হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও কাউকে তা তুলে দেওয়ার জন্য বলতেন না)। এটা সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করলে সে অঙ্গীকার রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। কোনওভাবেই যাতে অঙ্গীকারের বিপরীত কাজ না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। যেহেতু কারও কাছে কোনওকিছু চাইবেন না বলে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন, তাই তুচ্ছ বিষয়ও কারও কাছে চাইতেন না। উটের পিঠে থাকা অবস্থায় যদি হাত থেকে লাঠি বা লাগাম পড়ে যায়, তবে তা নিজে তুলে আনা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রথমে উট বসাতে হবে। তারপর তার পিঠ থেকে নেমে তা তুলতে হবে। তারপর সে উটের পিঠে বসে সেটিকে দাঁড় করাতে হবে। উটের পিঠে বসতে গেলেও সরাসরি বসা যায় না। কোনও একটা কিছু রেখে তার উপর পা দিয়ে উঠতে হয়। এতকিছু ঝামেলা তারা পোহাতেন, তবুও কাউকে সে লাগাম বা লাঠি তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন না। কারণ তা হলে কারও কাছে কিছু না চাওয়ার যে ওয়াদা করা হয়েছিল, কিছুটা হলেও তা ভঙ্গ হয়ে যাবে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তাকে ওয়াদাভঙ্গ বলা যায় না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন উচ্চমাত্রার বিশ্বস্ততা রক্ষার জন্যই তো তাদের এত উচ্চমর্যাদা। রাযিয়াল্লাহু তা'আলা 'আনহুম, ওয়া রাযূ ‘আনহু।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দীনের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এর ধারা সূচিত হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যকার শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাধ্যমে।
খ. ইসলাম গ্রহণের বায়'আত ছাড়াও বিশেষ বিশেষ আমলের জন্য বায়'আত হতে পারে।
গ. বিশেষ ঠেকা না হলে কারও কাছে কোনও জিনিস চাইতে নেই।
ঘ. কোনও বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে সে অঙ্গীকার রক্ষায় বিশেষভাবে যত্নবান থাকা চাই।
ঙ. সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসরণে যেমনটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তার তুলনা নেই। সুতরাং তাদের মর্যাদা উপলব্ধি করা উচিত।
এ হাদীছের বিভিন্ন বর্ণনায় হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন যে, আমরা সাত-আটজন কিংবা নয়জন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে বসা ছিলাম। এরকম আরও বহু বর্ণনা আছে, যা দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সাহাবীদের বসে থাকার কথা পাওয়া যায়। তাদের সে বসা ছিল তাঁর নিকট থেকে দীনের শিক্ষাগ্রহণ ও তাঁর সাহচর্যলাভের উদ্দেশ্যে। সাহচর্য দ্বারাও মূলত শিক্ষালাভই উদ্দেশ্য। সাহাবীগণ তাঁর কাছে ইসলামের বায়'আত গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়ে যেতেন না। এমন নয় যে, ইসলামগ্রহণের পর তারা যে যার মতো করে জীবনযাপন করতে থাকলেন। বরং যথারীতি তাঁর মজলিসে আসতেন। তাঁর নিকট থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তিনিও পরম যত্নে তাদেরকে শিক্ষাদান করতেন। তিনি নিজের সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বলেই দিয়েছেন যে, আমাকে শিক্ষকরূপে পাঠানো হয়েছে। সুতরাং তিনি পিতৃসুলভ মমতায় সাহাবীদেরকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, যত্ন সহকারে তা তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এভাবে দীনের পরিপূর্ণ শিক্ষা তাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন। তারা তাঁর নিকট থেকে যেমন দীনের পরিপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তেমনি শিক্ষাদানের নীতিও যথাযথভাবে রপ্ত করেছেন। পরবর্তী জীবনে তারা নিজেরাও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষাদানের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। শিক্ষাদানের এই যে পদ্ধতি অর্থাৎ শিক্ষার্থীগণ উসতাযের মজলিসে হাজির হবে আর উসতায স্নেহ-মমতার সঙ্গে তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষাদান করবেন, এর সূচনা হয়েছে ইসলামের প্রারম্ভকাল থেকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যকার শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাধ্যমে। আর সে ধারায় আজও পর্যন্ত দীনের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের মহতি সাধনা অব্যাহত আছে। কতইনা সৌভাগ্যবান তারা, যাদের এ পবিত্র ধারায় যুক্ত হওয়ার তাওফীক লাভ হয়েছে!
বিশেষ বিশেষ আমলের জন্য বায়'আতের বৈধতা
এ হাদীছটিতে একটি বিশেষ বায়'আতের কথা বর্ণিত হয়েছে। বায়'আত অর্থ হাতে হাত রেখে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। সাহাবীগণ ইসলাম গ্রহণকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বায়'আত গ্রহণ করতেন অর্থাৎ তাঁর হাতে হাত রেখে ইসলামের উপর অঙ্গীকারাবদ্ধ হতেন। প্রত্যেক সাহাবীই ইসলাম গ্রহণকালে এভাবে তাঁর নিকট বায়'আত গ্রহণ করেছেন। তবে মহিলাদের ইসলাম গ্রহণকালে তিনি তাদের হাত স্পর্শ করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণের বায়'আত ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সাহাবীদের নিকট থেকে বায়'আত গ্রহণ করেছেন। বায়'আতুর রিযওয়ান তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাজেই তাসাওউফ ও তরিকতে শায়খ ও মুরীদের মধ্যে যে বায়'আত হয়, তা অভিনব কিছু নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল দ্বারাই এর বৈধতা প্রমাণিত।
আলোচ্য হাদীছে যে বায়'আতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ইসলাম গ্রহণের বায়'আত নয়। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বললেন তোমরা কি আমার নিকট বায়'আত গ্রহণ করবে না, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, তিনি এ কথা কেন বলছেন, আমরা তো তাঁর নিকট ইসলাম গ্রহণের বায়'আত করেছিই? আর সে বায়'আত এখনও পুরোনো হয়নি। হাদীসে আছে, হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন-
وَكُنَّا حَدِيْثي عَهْد بِبَيْعَةٍ (অথচ আমরা মাত্র কিছুকাল আগেই বায়'আত গ্রহণ করেছি)। অর্থাৎ আমরা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং ইসলাম গ্রহণকালে বায়'আতও গ্রহণ করেছি।
তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করেও বললেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো আপনার নিকট বায়'আত গ্রহণ করেছি! তারপরও তিনি তাদেরকে ওই একই কথা বললেন যে, তোমরা কি আমার নিকট বায়'আত গ্রহণ করবে না? এবার সাহাবীগণ বুঝতে পারলেন যে, এটা ইসলামগ্রহণের বায়'আত নয়; বরং অন্য কোনও বায়'আত। তাই তারা বায়'আত গ্রহণের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে জানতে চাইলেন যে, এবার কোন বিষয়ে আমরা আপনার নিকট বায়'আত গ্রহণ করব? তিনি এক আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক না করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ও আনুগত্য করার বিষয়ে বায়'আতের কথা বললেন। সেইসঙ্গে নিচু আওয়াজে আরও একটা বিষয় উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন-
وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا (তোমরা মানুষের কাছে কিছু চাবে না)। এ কথাটি নিচুস্বরে বললেন বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। অনেক সময় আমরাও এরকম করে থাকি। স্বাভাবিক আওয়াজে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলার মাঝখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রসঙ্গ এসে গেলে আওয়াজ নিচু করে সে বিষয়টি ব্যক্ত করা হয়। তখন শ্রোতা বুঝতে পারে এ বিষয়টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই এভাবে বলা হচ্ছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত অনেক মর্যাদাবান। তারা মানবজাতির সেরা। কোনও অবস্থায়ই সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। অন্যের কাছে হাত পাতার দ্বারা মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তাই তাঁর উম্মত যাতে অন্যের কাছে হাত না পাতে, কারও কাছে কিছু না চায়, সে লক্ষ্যে তিনি আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়েও বায়'আত নেন এবং বিশেষ গুরুত্বদানের উদ্দেশ্যে এ বিষয়টি নিচু স্বরে ব্যক্ত করেন।
কারও কাছে কিছু না চাওয়ার কথা বলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষার তালিম দিয়েছেন, তেমনি অন্যের দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা, অভাব-অনটনে সবর করা এবং নিজের যা আছে তাতে খুশি থাকারও শিক্ষাদান করেছেন।
‘কারও কাছে কিছু চাবে না’ কথাটি দ্বারা বাহ্যত অন্যের কাছে অর্থসাহায্য চাইতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু সাহাবীগণ কথাটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। 'চাওয়া'- এর মধ্যে পড়ে এমন সবকিছু থেকেই তারা বিরত থাকতেন, তা যত তুচ্ছ বিষয়ই হোক না কেন। তাদের সে অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আওফ ইবন মালিক রাযি. বলেন-
فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُ أَحَدِهِمْ فَمَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ (তারপর আমি সেই দলের কাউকে কাউকে দেখেছি, তাদের কারও হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও কাউকে তা তুলে দেওয়ার জন্য বলতেন না)। এটা সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করলে সে অঙ্গীকার রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। কোনওভাবেই যাতে অঙ্গীকারের বিপরীত কাজ না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। যেহেতু কারও কাছে কোনওকিছু চাইবেন না বলে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন, তাই তুচ্ছ বিষয়ও কারও কাছে চাইতেন না। উটের পিঠে থাকা অবস্থায় যদি হাত থেকে লাঠি বা লাগাম পড়ে যায়, তবে তা নিজে তুলে আনা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রথমে উট বসাতে হবে। তারপর তার পিঠ থেকে নেমে তা তুলতে হবে। তারপর সে উটের পিঠে বসে সেটিকে দাঁড় করাতে হবে। উটের পিঠে বসতে গেলেও সরাসরি বসা যায় না। কোনও একটা কিছু রেখে তার উপর পা দিয়ে উঠতে হয়। এতকিছু ঝামেলা তারা পোহাতেন, তবুও কাউকে সে লাগাম বা লাঠি তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন না। কারণ তা হলে কারও কাছে কিছু না চাওয়ার যে ওয়াদা করা হয়েছিল, কিছুটা হলেও তা ভঙ্গ হয়ে যাবে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তাকে ওয়াদাভঙ্গ বলা যায় না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন উচ্চমাত্রার বিশ্বস্ততা রক্ষার জন্যই তো তাদের এত উচ্চমর্যাদা। রাযিয়াল্লাহু তা'আলা 'আনহুম, ওয়া রাযূ ‘আনহু।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দীনের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এর ধারা সূচিত হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যকার শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাধ্যমে।
খ. ইসলাম গ্রহণের বায়'আত ছাড়াও বিশেষ বিশেষ আমলের জন্য বায়'আত হতে পারে।
গ. বিশেষ ঠেকা না হলে কারও কাছে কোনও জিনিস চাইতে নেই।
ঘ. কোনও বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে সে অঙ্গীকার রক্ষায় বিশেষভাবে যত্নবান থাকা চাই।
ঙ. সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসরণে যেমনটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তার তুলনা নেই। সুতরাং তাদের মর্যাদা উপলব্ধি করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: