আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৮৯৬
১৮১৬. দুর্বল ও সৎ লোকদের উসীলায় যুদ্ধে সাহায্য চাওয়া। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন যে, আবু সুফিয়ান (রাযিঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রোম সম্রাট কায়সার আমাকে বললেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তার অনুসরণ করছে প্রভাবশালী লোক, না তাদের মধ্যে দুর্বলরা? তুমি বলছ যে, তাদের মধ্যকার দুর্বলরা- এরাই রাসুলদের অনুসারী হয়।
২৬৯৬। সুলাইমান ইবনে হারব (রাহঃ) .... মুসআব ইবনে সা‘দ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন সা‘দ (রাযিঃ)- এর ধারণা ছিল অন্যদের চাইতে তাঁর মর্যাদা বেশী। তখন নবী (ﷺ) বললেন, ‘তোমরা দুর্বলদের উসিলায়ই সাহায্য ও রিযক প্রাপ্ত হচ্ছো।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীছটির বর্ণনায় মুসআব রহ. তাঁর পিতা হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. সম্পর্কে বলেন যে- أَنَّ لَهُ فَضْلًا عَلى مَنْ دُوْنَهُ (হযরত সা'দ দেখলেন অন্যদের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে)। তাঁর সে শ্রেষ্ঠত্ব কোন্ দিক থেকে ছিল তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তিনি একদম প্রথম দিকের একজন মুসলিম। তিনি আল্লাহর পথে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গিত। তিনি আশারায়ে মুবাশশারার একজন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিজ মামা পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা কেউ পারলে এরকম মামা দেখাও তো! হযরত উমর ফারূক রাযি. যে ছয় সদস্যবিশিষ্ট শূরা গঠন করে গিয়েছিলেন, তিনি তার গুরত্বপূর্ণ সদস্য। এরকম আরও বহু উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর আছে। কিন্তু তিনি যেহেতু একজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী, যাদের ইখলাস ও আল্লাহভীতি ছিল উচ্চতর পর্যায়ের, তাই এর কোনওটি দ্বারা তিনি অন্যদের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত থাকার ধারণা করবেন তা ভাবা যায় না, বিশেষত অন্যান্য সাহাবীদের উপর। তাই হাদীছের ভাষ্যকারগণ বিশেষভাবে তাঁর বীরত্ব ও বাহাদুরীর বিষয়টিকে শনাক্ত করেছেন। তিনি একজন অমিতবিক্রম যোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সেনাপতিত্বে কাদেসিয়া ও মাদাইনের যুদ্ধ হয়েছে এবং তাতে শত শত বছরের সুদীর্ঘ সাসানি রাজত্বের পতন ঘটেছে।
বাহুবল ও শারীরিক অন্যান্য ক্ষমতার তুলনামূলক কমবেশি হওয়াটা একটি চাক্ষুষ বিষয়। এ ক্ষেত্রে যে বেশি শক্তিমান, সে তুলনামূলক কম শক্তিমানদের উপর নিজের শক্তি বেশি থাকার কথাটা ভাবতেই পারে। এটা অহংকারের মধ্যে পড়ে না এবং এতে দোষেরও কিছু নেই। এর বিপরীত ভাবাটাই অসম্ভব। কাজেই হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. যদি মনে করে থাকেন তাঁর বাহুবল ও বীরত্ব অন্য অনেকের তুলনায় বেশি, তাতে কোনও দোষ নেই।
যুদ্ধজয়ে বীরত্বের বিশেষ ভূমিকা থাকে। কাজেই বীরযোদ্ধা যদি মনে করে যুদ্ধে অর্জিত সম্পদে (গনীমতে) তার প্রাপ্যও অন্যদের তুলনায় বেশি হবে, তবে বাহ্যত সে ভাবনারও অবকাশ রয়েছে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. নিজের তুলনামূলক বেশি বীরত্বের কথা ভেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোনও ব্যক্তি যদি নিজ কওমের একজন সংরক্ষকরূপে দায়িত্ব পালন করে এবং সঙ্গীদের সুরক্ষায় শত্রুদের প্রতিহত করে, তবে কি তার প্রাপ্য অংশ অন্যদের সমান হবে?৩০৭ এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلَّا بِضُعَفَائِكُمْ (তোমরা তো কেবল তোমাদের দুর্বলদের অসিলায়ই সাহায্য ও রিযিক পেয়ে থাক)। অর্থাৎ যুদ্ধজয় কেবল বাহুবল দ্বারা অর্জিত হয় না, তা হয় আল্লাহর রহমত ও সাহায্য দ্বারা। আল্লাহর রহমত ও সাহায্য তো পাওয়া যায় দুর্বলদের অসিলায়। তাদেরই কারণে আল্লাহ তাআলা তোমাদের রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা দুর্বল হওয়ায় নিজ শক্তি-ক্ষমতার উপর ভরসা করে না। তাদের ভরসা একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার উপর। তারা বিনীত ও কাতর ভঙ্গিতে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা তাদের সে দুআ কবুলও করেন। সে দুআ কবুলেরই বরকত যে, তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ কর এবং অভাব-অনটনের ভেতর রিযিক পেয়ে থাক। সুতরাং হে সা'দ। বাহুবলের কারণে যেমন তোমার একরকম প্রাধান্য আছে, তেমনি ইখলাস ও দুআর কারণেও ওই দুর্বলদের একরকম প্রাধান্য আছে। তাই গনীমতে উভয়ের প্রাপ্যও সমান সমানই হবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাক্য দ্বারা একদিকে দুর্বল ও শক্তিমানের মধ্যে গনীমত বণ্টনে সমতা রক্ষার হাকীকত বয়ান করেছেন, তেমনি অন্যদিকে উম্মতকে এ মহান চরিত্রের শিক্ষাও দান করেছেন যে, কেউ যেন নিজ বাহুবলের উপর নির্ভর না করে, কাউকে যেন তার শৌর্য-বীর্য অহংকার-অহমিকার দিকে টেনে নিতে না পারে এবং কেউ যেন কোনও দুর্বলকে তার দুর্বলতার কারণে তুচ্ছ মনে না করে; বরং দুর্বল শ্রেণীকে এ কারণে ভক্তি-শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে যে, তাদের ইখলাস ও দুআর বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা সাহায্য ও রিযিক দান করে থাকেন।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الصَّعِيْفِ، وَفِي كُلَّ خَيْرٌ
'দুর্বল মুমিন অপেক্ষা শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।
তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে।৩০৮
এ হাদীছে দুর্বল মুমিন অপেক্ষা শক্তিশালী মুমিনকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। কুরআন মাজীদেও আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে মুমিনদেরকে শক্তি-ক্ষমতা অর্জনের হুকুম দেওয়া
হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের (মোকাবেলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব- ছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে।৩০৯
এর দ্বারা শক্তি ও ক্ষমতার বিশেষ গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে এবং শত্রুদের দমন ও তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভে এর কার্যকারিতা আছে বলেও ইশারা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আলোচ্য হাদীছটি দুর্বলদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্যলাভের তাদের ইখলাস ও দুআকে আসল বলা হচ্ছে। উভয়ের মধ্যে কি বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে না?
এর উত্তর এই যে, প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। একটু লক্ষ করলেই তা বুঝে আসে। প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছে যে শক্তিশালী মুমিনকে উত্তম বলা হয়েছে, তা দ্বারা শারীরিক শক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং ঈমান ও আত্মিক শক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য। আর দুর্বল দ্বারাও শারীরিকভাবে দুর্বলকে নয়; বরং আত্মিক শক্তির দিক থেকে যারা দুর্বল তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে যে দুর্বলদের অসিলায় সাহায্য ও জীবিকা লাভ হয় বলা হয়েছে, তা হচ্ছে শারীরিক ও আর্থিক দুর্বলতা, ঈমানী ও আত্মিক দুর্বলতা নয়। সুতরাং উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকল না।
আর আয়াতে যে শক্তি অর্জনের কথা বলা হয়েছে তা বাহ্যিক শক্তি বটে, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, বাহ্যিক শক্তি ব্যবহার দ্বারাই বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে। বরং আয়াতেই তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তা দ্বারা তোমরা আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখবে। তারা যেহেতু কাফের ও বেঈমান, তাই আল্লাহর উপর তাদের কোনও ভরসা নেই। তাদের সব ভরসা বাহুবল ও অস্ত্রসস্ত্রের উপর। তারা যখন দেখবে মুসলিমগণ অস্ত্রশক্তিতে খুব বলীয়ান, তখন তারা তাদেরকে ভয় করবে। কিন্তু মুমিনদের বিজয় এর দ্বারাই অর্জিত হয়ে যাবে না; সেজন্য তাদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে।
দুনিয়া দারুল আসবাব হিসেবে তারা সবরকম আসবাব-উপকরণ অবলম্বন করবে। তা করবে এ কারণে যে, কোনও কারণে পরাজয় ঘটলে যাতে নজর আসবাব- উপকরণের দিকে না যায় আর অন্তরে এই ধারণা না জন্মায় যে, আহা, যদি আরও বেশি আসবাব-উপকরণ থাকত, তাহলে হয়তো পরাজয় ঘটত না। এরূপ ধারণা ঈমানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আসবাব-উপকরণ অবলম্বনের হুকুম। কিন্তু সর্বাবস্থায় ভরসা থাকবে আল্লাহ তাআলার উপরই যে, অস্ত্রসস্ত্রে যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, জয়লাভ হবে আল্লাহ তাআলার সাহায্যেই। তিনি সাহায্য না করলে কোনওকিছুর দ্বারাই বিজয় অর্জিত হবে না। তিনি সাহায্য করলে সবদিক থেকে দুর্বল হয়েও জয় নিশ্চিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ
‘এমন কত ছোট দলই না রয়েছে, যারা আল্লাহর হুকুমে বড় দলের উপর জয়যুক্ত হয়েছে! আর আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন, যারা সবরের পরিচয় দেয়।৩১০
সুতরাং বাহ্যিক ব্যবস্থাপনা যথাসম্ভব গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার কাছে কাকুতি-মিনতির সঙ্গে দুআ করাও কর্তব্য। যেহেতু দুর্বলদের দুআ বেশি কবুল হয়ে থাকে, তাই যুদ্ধসহ অন্যসকল ক্ষেত্রেও তাদের মূল্যায়ন করা চাই। বনু উমাইয়া আমলের মহান বীর কুতাইবা ইবন মুসলিম রহ. মধ্য-এশিয়ায় যুদ্ধরত অবস্থায় একদিন বিখ্যাত বুযুর্গ মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. কোথায় আছেন খোঁজ নিলেন। তিনিও তখন তার সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যাকে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল সে ফিরে এসে বলল, তাকে দেখেছি নির্জন এক স্থানে আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বিড়বিড় করে কী বলছে। কুতায়বা ইবন মুসলিম রহ. বললেন, আমার কাছে তাঁর ওই উত্তোলিত আঙ্গুল তারুণ্যে ভরপুর একলক্ষ শাণিত তরবারিধারী অপেক্ষাও বেশি প্রিয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নিজ বাহুবলের উপর ভরসা না করে ভরসা থাকা চাই আল্লাহ তাআলার রহমত ও সাহায্যের উপর।
খ. বীরত্ব বেশি থাকায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদে বেশি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
গ. দুর্বলদেরকে তুচ্ছ মনে করতে নেই। তাদের কারণেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও জীবিকা লাভ হয়ে থাকে।
ঘ. ছোটদের চিন্তা-চেতনাগত কোনও ত্রুটি লক্ষ করা গেলে বড়দের কর্তব্য তা শুধরে দেওয়া।
৩০৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৯৬
৩০৭. মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৬৯১
৩০৮. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৬৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৯১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১১৪৭; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৩৮২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০১৭৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৯১; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬২৫১
৩০৯. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৬০
৩১০. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৪৯
বাহুবল ও শারীরিক অন্যান্য ক্ষমতার তুলনামূলক কমবেশি হওয়াটা একটি চাক্ষুষ বিষয়। এ ক্ষেত্রে যে বেশি শক্তিমান, সে তুলনামূলক কম শক্তিমানদের উপর নিজের শক্তি বেশি থাকার কথাটা ভাবতেই পারে। এটা অহংকারের মধ্যে পড়ে না এবং এতে দোষেরও কিছু নেই। এর বিপরীত ভাবাটাই অসম্ভব। কাজেই হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. যদি মনে করে থাকেন তাঁর বাহুবল ও বীরত্ব অন্য অনেকের তুলনায় বেশি, তাতে কোনও দোষ নেই।
যুদ্ধজয়ে বীরত্বের বিশেষ ভূমিকা থাকে। কাজেই বীরযোদ্ধা যদি মনে করে যুদ্ধে অর্জিত সম্পদে (গনীমতে) তার প্রাপ্যও অন্যদের তুলনায় বেশি হবে, তবে বাহ্যত সে ভাবনারও অবকাশ রয়েছে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. নিজের তুলনামূলক বেশি বীরত্বের কথা ভেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোনও ব্যক্তি যদি নিজ কওমের একজন সংরক্ষকরূপে দায়িত্ব পালন করে এবং সঙ্গীদের সুরক্ষায় শত্রুদের প্রতিহত করে, তবে কি তার প্রাপ্য অংশ অন্যদের সমান হবে?৩০৭ এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلَّا بِضُعَفَائِكُمْ (তোমরা তো কেবল তোমাদের দুর্বলদের অসিলায়ই সাহায্য ও রিযিক পেয়ে থাক)। অর্থাৎ যুদ্ধজয় কেবল বাহুবল দ্বারা অর্জিত হয় না, তা হয় আল্লাহর রহমত ও সাহায্য দ্বারা। আল্লাহর রহমত ও সাহায্য তো পাওয়া যায় দুর্বলদের অসিলায়। তাদেরই কারণে আল্লাহ তাআলা তোমাদের রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা দুর্বল হওয়ায় নিজ শক্তি-ক্ষমতার উপর ভরসা করে না। তাদের ভরসা একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার উপর। তারা বিনীত ও কাতর ভঙ্গিতে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা তাদের সে দুআ কবুলও করেন। সে দুআ কবুলেরই বরকত যে, তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ কর এবং অভাব-অনটনের ভেতর রিযিক পেয়ে থাক। সুতরাং হে সা'দ। বাহুবলের কারণে যেমন তোমার একরকম প্রাধান্য আছে, তেমনি ইখলাস ও দুআর কারণেও ওই দুর্বলদের একরকম প্রাধান্য আছে। তাই গনীমতে উভয়ের প্রাপ্যও সমান সমানই হবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাক্য দ্বারা একদিকে দুর্বল ও শক্তিমানের মধ্যে গনীমত বণ্টনে সমতা রক্ষার হাকীকত বয়ান করেছেন, তেমনি অন্যদিকে উম্মতকে এ মহান চরিত্রের শিক্ষাও দান করেছেন যে, কেউ যেন নিজ বাহুবলের উপর নির্ভর না করে, কাউকে যেন তার শৌর্য-বীর্য অহংকার-অহমিকার দিকে টেনে নিতে না পারে এবং কেউ যেন কোনও দুর্বলকে তার দুর্বলতার কারণে তুচ্ছ মনে না করে; বরং দুর্বল শ্রেণীকে এ কারণে ভক্তি-শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে যে, তাদের ইখলাস ও দুআর বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা সাহায্য ও রিযিক দান করে থাকেন।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الصَّعِيْفِ، وَفِي كُلَّ خَيْرٌ
'দুর্বল মুমিন অপেক্ষা শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।
তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে।৩০৮
এ হাদীছে দুর্বল মুমিন অপেক্ষা শক্তিশালী মুমিনকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। কুরআন মাজীদেও আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে মুমিনদেরকে শক্তি-ক্ষমতা অর্জনের হুকুম দেওয়া
হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের (মোকাবেলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব- ছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে।৩০৯
এর দ্বারা শক্তি ও ক্ষমতার বিশেষ গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে এবং শত্রুদের দমন ও তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভে এর কার্যকারিতা আছে বলেও ইশারা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আলোচ্য হাদীছটি দুর্বলদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্যলাভের তাদের ইখলাস ও দুআকে আসল বলা হচ্ছে। উভয়ের মধ্যে কি বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে না?
এর উত্তর এই যে, প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। একটু লক্ষ করলেই তা বুঝে আসে। প্রশ্নে বর্ণিত হাদীছে যে শক্তিশালী মুমিনকে উত্তম বলা হয়েছে, তা দ্বারা শারীরিক শক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং ঈমান ও আত্মিক শক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য। আর দুর্বল দ্বারাও শারীরিকভাবে দুর্বলকে নয়; বরং আত্মিক শক্তির দিক থেকে যারা দুর্বল তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে যে দুর্বলদের অসিলায় সাহায্য ও জীবিকা লাভ হয় বলা হয়েছে, তা হচ্ছে শারীরিক ও আর্থিক দুর্বলতা, ঈমানী ও আত্মিক দুর্বলতা নয়। সুতরাং উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকল না।
আর আয়াতে যে শক্তি অর্জনের কথা বলা হয়েছে তা বাহ্যিক শক্তি বটে, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, বাহ্যিক শক্তি ব্যবহার দ্বারাই বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে। বরং আয়াতেই তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তা দ্বারা তোমরা আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখবে। তারা যেহেতু কাফের ও বেঈমান, তাই আল্লাহর উপর তাদের কোনও ভরসা নেই। তাদের সব ভরসা বাহুবল ও অস্ত্রসস্ত্রের উপর। তারা যখন দেখবে মুসলিমগণ অস্ত্রশক্তিতে খুব বলীয়ান, তখন তারা তাদেরকে ভয় করবে। কিন্তু মুমিনদের বিজয় এর দ্বারাই অর্জিত হয়ে যাবে না; সেজন্য তাদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে।
দুনিয়া দারুল আসবাব হিসেবে তারা সবরকম আসবাব-উপকরণ অবলম্বন করবে। তা করবে এ কারণে যে, কোনও কারণে পরাজয় ঘটলে যাতে নজর আসবাব- উপকরণের দিকে না যায় আর অন্তরে এই ধারণা না জন্মায় যে, আহা, যদি আরও বেশি আসবাব-উপকরণ থাকত, তাহলে হয়তো পরাজয় ঘটত না। এরূপ ধারণা ঈমানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আসবাব-উপকরণ অবলম্বনের হুকুম। কিন্তু সর্বাবস্থায় ভরসা থাকবে আল্লাহ তাআলার উপরই যে, অস্ত্রসস্ত্রে যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, জয়লাভ হবে আল্লাহ তাআলার সাহায্যেই। তিনি সাহায্য না করলে কোনওকিছুর দ্বারাই বিজয় অর্জিত হবে না। তিনি সাহায্য করলে সবদিক থেকে দুর্বল হয়েও জয় নিশ্চিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ
‘এমন কত ছোট দলই না রয়েছে, যারা আল্লাহর হুকুমে বড় দলের উপর জয়যুক্ত হয়েছে! আর আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন, যারা সবরের পরিচয় দেয়।৩১০
সুতরাং বাহ্যিক ব্যবস্থাপনা যথাসম্ভব গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার কাছে কাকুতি-মিনতির সঙ্গে দুআ করাও কর্তব্য। যেহেতু দুর্বলদের দুআ বেশি কবুল হয়ে থাকে, তাই যুদ্ধসহ অন্যসকল ক্ষেত্রেও তাদের মূল্যায়ন করা চাই। বনু উমাইয়া আমলের মহান বীর কুতাইবা ইবন মুসলিম রহ. মধ্য-এশিয়ায় যুদ্ধরত অবস্থায় একদিন বিখ্যাত বুযুর্গ মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. কোথায় আছেন খোঁজ নিলেন। তিনিও তখন তার সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যাকে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল সে ফিরে এসে বলল, তাকে দেখেছি নির্জন এক স্থানে আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বিড়বিড় করে কী বলছে। কুতায়বা ইবন মুসলিম রহ. বললেন, আমার কাছে তাঁর ওই উত্তোলিত আঙ্গুল তারুণ্যে ভরপুর একলক্ষ শাণিত তরবারিধারী অপেক্ষাও বেশি প্রিয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নিজ বাহুবলের উপর ভরসা না করে ভরসা থাকা চাই আল্লাহ তাআলার রহমত ও সাহায্যের উপর।
খ. বীরত্ব বেশি থাকায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদে বেশি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না।
গ. দুর্বলদেরকে তুচ্ছ মনে করতে নেই। তাদের কারণেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও জীবিকা লাভ হয়ে থাকে।
ঘ. ছোটদের চিন্তা-চেতনাগত কোনও ত্রুটি লক্ষ করা গেলে বড়দের কর্তব্য তা শুধরে দেওয়া।
৩০৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৯৬
৩০৭. মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৬৯১
৩০৮. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৬৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৯১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১১৪৭; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৩৮২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭২১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০১৭৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৯১; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬২৫১
৩০৯. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৬০
৩১০. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৪৯


বর্ণনাকারী: