আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৮৮৬
১৮১০. মহান আল্লাহর পথে যুদ্ধে পাহারাদারী করা
২৬৮৮। ইয়াহয়া ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী (ﷺ) বলেছেন, লাঞ্ছিত হোক দীনার ও দিরহামের গোলাম এবং চাদর ও শালের গোলাম। তাঁকে দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। এই হাদীসটির সনদ ইসরাইল এবং মুহাম্মাদ ইবনে জুহাদা, আবু হুসাইনের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) পর্যন্ত পৌছাননি। আর আমর, আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ..... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে আমাদেরকে অতিরিক্ত বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) বলেছেন, লাঞ্ছিত হোক দীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম এবং শালের গোলাম। তাঁকে দেওয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। এরা লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হলে কেউ তা তুলে দিবে না। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে ঘোড়ার লাগাম ধরে জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যার মাথার চুল এলোমেলো এবং পা ধূলিধূসরিত। তাকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে আর (সৈন্য দলের) পেছনে রাখলে পেছনেই থাকে। সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না এবং কোন বিষয়ে সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।
تَعْسًا বলা হয় فَأَتْعَسَهُمُ اللَّهُ অর্থাৎ আল্লাহ তাদের অপমানিত করুক। طُوبَى অর্থ উত্তম। .... فُعْلَى এর কাঠামোতে গঠিত। মুলত طيبى ছিল। يَاءٌ কে وَاوِ দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে টাকা-পয়সা ও পোশাক-আশাকের যারা দাসত্ব করে তাদের ধ্বংস কামনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে এর থেকে বিরত থাকার প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং এর অনিষ্ট ও ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক করা। দীনার বলা হয় সেকালের স্বর্ণমুদ্রাকে আর দিরহাম বলা হয় রৌপ্যমুদ্রাকে। বোঝানো উদ্দেশ্য টাকা-পয়সা। আর قطيفة (ডোরাকাটা চাদর) ও خميصة (চৌকোণা পশমী চাদর) হল সেকালের দামী পোশাক। এর দাস দ্বারা এমন লোককে বোঝানো হয়েছে, যে এর ভালোবাসায় নিমজ্জিত। সর্বদা তার একই ধান্ধা, কিভাবে টাকা-পয়সা কুড়াবে আর দামী পোশাক-আশাক সংগ্রহ করবে। সেইসঙ্গে এর হেফাজত ও পরিচর্যায় এমনভাবে নিমজ্জিত থাকে যে, দেখলে মনে হয় টাকা-পয়সা ও পোশাক-আশাক তার সেবার জন্য নয়; বরং সে নিজেই এসবের সেবক। সে এরই জন্য জন্ম নিয়েছে। বরং সে যেন এর দাসত্বের নিগড়ে বন্দী, যা থেকে তার মুক্তি নেই।

লক্ষণীয়: হাদীছে টাকা-পয়সার মালিক বা সংগ্রহকারী বলা হয়নি; বরং দাস বলা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য এসবের মালিক হওয়া বা এসবের সংগ্রহে সচেষ্ট থাকা দোষের নয়; দোষ হল গোলামের মত নিজেকে এর সেবক বানিয়ে ফেলা, যেন তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল দুনিয়ার মাল ও আসবাব সংগ্রহ করা।

হাদীছে এ দাসত্বের আলামত বলা হয়েছে এই যে- (যাকে দেওয়া হলে খুশি হয়, না দেওয়া হলে নাখোশ হয়)। অর্থাৎ তাদের যাবতীয় চেষ্টা-মেহনতের লক্ষ্যবস্তুই হচ্ছে পার্থিব প্রতিদান। সে প্রতিদান পেলে খুশি হয়, না পেলে নাখোশ হয়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ
"সদাকা থেকে তাদেরকে (তাদের মনমতো) দেওয়া হলে তারা খুশি হয়ে যায় আর তাদেরকে যদি তা থেকে না দেওয়া হয়, অমনি তারা ক্ষুব্ধ হয়।"

এরূপ লোকের ধ্বংস কামনা করার দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য এরা ধ্বংস হয়ে যায়। কেননা জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মাওলার ইবাদত করা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে আত্মনিবেদিত থাকা। কিন্তু এরূপ লোক সে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে গাফিল থেকে এ নশ্বর জগতের ধন-দৌলত কুড়াতে ব্যস্ত থাকে। ফলে তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ব্যর্থতার পাশাপাশি তার মনুষ্যত্বের মর্যাদাও ধ্বংস হয়ে যায়। সে ছিল মাখদুম। জগৎ-সংসারের যাবতীয় বস্তু ছিল তার খাদেম। ছিল রাজা। তাবৎ মাখলুক তার প্রজা। জীবনের লক্ষ্যবস্তু উল্টে দেওয়ার ফলে এখন সে হয়ে গেল সকলের খাদেম, সকলের প্রজা। সকলে হয়ে গেল তার মাখদুম ও রাজা। এভাবে সে তার মনুষ্যত্বের মহিমা ভূলুণ্ঠিত করল!

যে ব্যক্তি অর্থবিত্তের দাস হয়ে যায়, সে মানবীয় মহৎ গুণাবলীও হারিয়ে ফেলে। সততা, উদারতা, সহমর্মিতা, পরার্থপরতা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট গুণের স্থানে জাকিয়ে বসে দুর্নীতিপরায়ণতা, কৃপণতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি অসৎগুণ। ফলে আকৃতিতে মানুষ থাকলেও তার প্রকৃতি পাশবিকতায় পর্যবসিত হয়। একজন মানুষের পক্ষে এরচে' বড় ধ্বংসের বিষয় আর কী হতে পারে!

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. টাকা-পয়সা, আসবাব-উপকরণ যেহেতু জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন, তাই এর অর্জন ও মালিক হওয়াতে কোনও দোষ নেই। দোষ এর দাস হওয়াতে অর্থাৎ এর লোভে পড়া ও একে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানানোতে।

খ. সম্পদ অর্জন ও এর পরিচর্যায় এত বেশি লিপ্ততা সমীচীন নয়, যাতে মনে হয় জীবন সম্পদের জন্য, সম্পদ জীবনের জন্য নয়।

গ. দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ যতটুকু অর্জিত হয় তাতেই খুশি থাকা চাই, এমনকি প্রার্থীত বস্তু না পেলেও।

ঘ. কারও প্রতি সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ভিত্তি তার পক্ষ হতে কিছু পাওয়া বা না পাওয়াকে বানাতে নেই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন