কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

৫. নামাযের আদ্যোপান্ত বর্ণনা এবং সুন্নাতসমূহ

হাদীস নং: ১০৬১
আন্তর্জাতিক নং: ১০৬১
যথাযথভাবে সালাত আদায় করা
১০৬১। মুহাম্মাদ ইবন বাশশার (রাহঃ) .....মুহাম্মাদ ইবন 'আমর ইবন 'আতা (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবু হুমায়দ সা'য়িদী (রাযিঃ)-কে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দশজন সাহাবীর উপস্থিতিতে, যাঁদের মধ্যে আবু কাতাদা (রাযিঃ)-ও ছিলেন, বলতে শুনেছিঃ আবু হুমায়দ (রাযিঃ) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সালাতের ব্যাপারে আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞাত। তারা বললঃ তা কী ভাবে? আল্লাহর কসম! তুমি আমাদের চেয়ে তাঁর অধিক অনুসরণকারী নও এবং সাহচর্যলাভের দিক থেকেও তুমি আমাদের অগ্রগামী নও। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তাঁরা বললঃ তুমি তোমার বক্তব্য পেশ কর। তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন সালাতে দাঁড়াতেন সঙ্গে সঙ্গে তাকবীর বলতেন। তারপর তিনি তাঁর উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। এ সময় তাঁর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্ব-স্ব স্থানে থাকত। এরপর তিনি কিরাআত পাঠ করতেন, তারপর তাকবীর বলে তাঁর উভয় কাঁধ বরাবর উভয় হাত উঠালেন। এরপর তিনি রুকূ করতেন তাঁর দু'হাত যথাযথভাবে দু’ হাঁটুর উপরে রাখতেন। তবে মাথা অধিক উঁচু কিংবা নীচু না করে সমানভাবে রাখতেন। এরপর তিনি 'সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ' বলে উভয় হাত উভয় কাঁধ বরাবর উঠাতেন, এমনকি তাঁর প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ স্ব স্ব স্থানে থাকত। এরপর তিনি (সিজদার জন্য) যমীনের দিকে ঝুঁকে পড়তেন এবং সিজদার সময় পার্শ্বদেশ থেকে উভয় হাত পৃথক রাখতেন। তারপর তিনি মাথা উঠিয়ে বাঁ পা বিছিয়ে এর উপর বসতেন এবং তিনি সিজদার সময় উভয় পায়ের আংগুলগুলো ছড়িয়ে রাখতেন, তারপর সিজদা করতেন। এরপর তাকবীর বলে (সিজদা থেকে উঠে) বাম পায়ের উপর বসতেন। এমনকি তাঁর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্ব স্ব স্থানে থাকত। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দ্বিতীয় রাক'আতেও অনুরূপ করতেন। এরপর তিনি যখন দ্বিতীয় রাক'আত থেকে দাঁড়াতেন, তখন তিনি তাঁর উভয় হাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন, যেমন উঠাতেন সালাত শুরু করার সময়। আর তিনি অবশিষ্ট সালাত এভাবে আদায় করেন, এমনকি শেষ সিজদা করে সালাম ফিরিয়ে এক পা আগে-পিছে করে, বাম দিকের নিতম্বের উপর ভর করে বসতেন। তারা বলল তুমি ঠিকই বলেছ। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এভাবেই সালাত আদায় করতেন।
بَاب إِتْمَامِ الصَّلَاةِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا أَبُو عَاصِمٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْحَمِيدِ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَمْرِو بْنِ عَطَاءٍ، قَالَ سَمِعْتُ أَبَا حُمَيْدٍ السَّاعِدِيَّ، فِي عَشْرَةٍ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فِيهِمْ أَبُو قَتَادَةَ فَقَالَ أَبُو حُمَيْدٍ أَنَا أَعْلَمُكُمْ بِصَلاَةِ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏.‏ قَالُوا لِمَ فَوَاللَّهِ مَا كُنْتَ بِأَكْثَرِنَا لَهُ تَبَعَةً وَلاَ أَقْدَمَنَا لَهُ صُحْبَةً ‏.‏ قَالَ بَلَى ‏.‏ قَالُوا فَاعْرِضْ ‏.‏ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ إِذَا قَامَ إِلَى الصَّلاَةِ كَبَّرَ ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا مَنْكِبَيْهِ وَيَقِرَّ كُلُّ عُضْوٍ مِنْهُ فِي مَوْضِعِهِ ثُمَّ يَقْرَأُ ثُمَّ يُكَبِّرُ وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا مَنْكِبَيْهِ ثُمَّ يَرْكَعُ وَيَضَعُ رَاحَتَيْهِ عَلَى رُكْبَتَيْهِ مُعْتَمِدًا لاَ يَصُبُّ رَأْسَهُ وَلاَ يُقْنِعُ مُعْتَدِلاً ثُمَّ يَقُولُ ‏ "‏ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ ‏"‏ ‏.‏ وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا مَنْكِبَيْهِ حَتَّى يَقِرَّ كُلُّ عَظْمٍ إِلَى مَوْضِعِهِ ثُمَّ يَهْوِي إِلَى الأَرْضِ وَيُجَافِي يَدَيْهِ عَنْ جَنْبَيْهِ ثُمَّ يَرْفَعُ رَأْسَهُ وَيَثْنِي رِجْلَهُ الْيُسْرَى فَيَقْعُدُ عَلَيْهَا وَيَفْتَخُ أَصَابِعَ رِجْلَيْهِ إِذَا سَجَدَ ثُمَّ يَسْجُدُ ثُمَّ يُكَبِّرُ وَيَجْلِسُ عَلَى رِجْلِهِ الْيُسْرَى حَتَّى يَرْجِعَ كُلُّ عَظْمٍ مِنْهُ إِلَى مَوْضِعِهِ ثُمَّ يَقُومُ فَيَصْنَعُ فِي الرَّكْعَةِ الأُخْرَى مِثْلَ ذَلِكَ ثُمَّ إِذَا قَامَ مِنَ الرَّكْعَتَيْنِ رَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى يُحَاذِيَ بِهِمَا مَنْكِبَيْهِ كَمَا صَنَعَ عِنْدَ افْتِتَاحِ الصَّلاَةِ ثُمَّ يُصَلِّي بَقِيَّةَ صَلاَتِهِ هَكَذَا حَتَّى إِذَا كَانَتِ السَّجْدَةُ الَّتِي يَنْقَضِي فِيهَا التَّسْلِيمُ أَخَّرَ إِحْدَى رِجْلَيْهِ وَجَلَسَ عَلَى شِقِّهِ الأَيْسَرِ مُتَوَرِّكًا ‏.‏ قَالُوا صَدَقْتَ هَكَذَا كَانَ يُصَلِّي رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

তাশাহহুদে বসার সুন্নাত পদ্ধতিঃ
নামাযে ১ম ও শেষ বৈঠকে বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসা ও ডান পা খাড়া রাখা সুন্নত।

বাম পা বিছিয়ে দেওয়া ও ডান পা খাড়া রাখার দলিল

১. হযরত আয়েশা রা. বলেন,

كَانَ )رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-( يَقُولُ فِى كُلِّ رَكْعَتَيْنِ التَّحِيَّةَ وَكَانَ يَفْرِشُ رِجْلَهُ الْيُسْرَى وَيَنْصِبُ رِجْلَهُ الْيُمْنَى. أخرجه مسلم في باب صفة الصلاة (٤٩٨) وابن أبي شيبة، (٢٩٤٣)

অর্থ: তিনি ( রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক দুই রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়তেন। এবং বাম পা বিছিয়ে দিতেন ও ডান পা খাড়া রাখতেন। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ২৯৪৩; আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস নং ১৬৫১, আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং ৩০৫০; মুসনাদে ইসহাক, হাদীস নং ১৩৩১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২৪০৩০, ইবনে মাজাহ,হাদীস নং ৮৯৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ৭৮৩; আবু আওয়ানা, হাদীস নং ২০০৪।

২: হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বলেন,

قدمت المدينة قلت لأنظرن إلى صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم فلما جلس يعني للتشهد افترش رجله اليسرى ووضع يده اليسرى يعني على فخذه اليسرى ونصب رجله اليمنى. أخرجه الترمذي(٢٩٢ )وقال حسن صحيح وابن أبي شيبة، (٢٩٤٢).

অর্থ: আমি মদীনায় আসলাম, আর (মনে মনে) বললাম, আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখবো। (তিনি বলেন), যখন তিনি বৈঠক করলেন, অর্থাৎ তাশাহহুদের জন্য তখন তাঁর বাম পা বিছিয়ে দিলেন, এবং তাঁর বাম হাত বাম উরুর উপর রাখলেন। আর ডান পা খাড়া রাখলেন। তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৯২; তিনি বলেছেন, এটি হাসান সহীহ। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ২৯৪২; নাসাঈ, হাদীস নং ১১৫৯; সুনানে দারিমী, ১/৩১৪, মুসনাদে আহমদ, ৪/৩১৮, তাহাবী ১/১৫২; বায়হাকী, ২/১৩২।

৩ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেছেন,

إنما سنة الصلاة أن تنصب رجلك اليمنى وتثنى اليسرى. أخرجه البخاري(٨٢٧) والنسائي(١١٥٧-١١٥٨) وابن أبي شيبة (٢٩٤٤).

অর্থ: নামাযে সুন্নত হলো ডান পা খাড়া রাখবে এবং বাম পা বিছিয়ে দেবে। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৮২৭; নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ১১৫৭, ১১৫৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ২৯৪৪।

নাসায়ী শরীফে বাম পায়ের উপর বসার কথাও বর্ণিত হয়েছে।

মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় হযরত কা’ব রা., হযরত আলী রা., মুহাম্মদ ইবনে সীরীন র. ও ইবরাহীম নাখায়ী র. প্রমুখের আমলও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।

এসব হাদীসে ১ম ও ২য় বৈঠকের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুধু আবূ হুমায়দ আস সাইদী রা. বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ বৈঠকে উভয় পা ডান দিকে বের করে দিয়ে (বুখারী শরীফের বর্ণনানুসারে বাম পা এগিয়ে দিয়ে ডান পা খাড়া করে) নিতম্বের উপর বসে পড়তেন। এ হাদীসটির কারণে কোন কোন ফকীহ ও মুহাদ্দিস মনে করেন, উপরোক্ত হাদীসগুলো ১ম বৈঠক সম্পর্কে। কিন্তু হাদীসগুলোর বর্ণনাভঙ্গি দ্বারা তা সঠিক মনে হয় না। অনেকেই মনে করেন, আবূ হুমায়দ রা. এর হাদীসটিতে যে পদ্ধতিতে বসার কথা বর্ণিত হয়েছে, সেটা বরং উযরের কারণে ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় উভয় বৈঠকে একইভাবে বসা হতো। যা উপরের হাদীসগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে কম সংখ্যক ফকীহ হযরত আবু হুমায়দ রা. বর্ণিত হাদীসের নিয়মানুসারে আমল করতেন। ইমাম তিরমিযী র. আবু হুমায়দ রা.এর হাদীসটি উল্লেখপূর্বক লিখেছেন,

وبه يقول بعض أهل العلم وهو قول الشافعي وأحمد وإسحاق

অর্থাৎ কিছু কিছু আলেম এই মত অবলম্বন করেছেন। শাফেয়ী র. আহমাদ র. ও ইসহাক র. এর মতও অনুরূপ।

পক্ষান্তরে হযরত ওয়াইল রা.এর হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর তিরমিযী র. লিখেছেন,

والعمل عليه عند أكثر أهل العلم وهو قول سفيان الثوري وابن المبارك وأهل الكوفة

অর্থাৎ অধিকাংশ আলেমের আমল হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. এর হাদীস অনুসারে। সুফিয়ান ছাওরী র., আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক র. ও কূফাবাসীর মতও ছিল অনুরূপ।

লক্ষ্য করুন, পূর্বসূরি আলেমগণের অধিকাংশের আমল কি প্রমাণ করে না যে, হযরত আবূ হুমায়দ রা. বর্ণিত পদ্ধতিটি উযরের কারণে ছিল? কথিত আহলে হাদীস বা গায়রে মুকাল্লিদগণ নিজেদেরকে সালাফী (পূর্বসূরিদের অনুসারী) বলে পরিচয় দেয়। অথচ তারা পূর্বসূরিগণের অধিকাংশের আমল ছেড়ে দিয়েছে! শুধু ছেড়ে দিয়েছে তাই নয়, বরং সেটিকে সুন্নতের পরিপন্থী ঠাওরাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সুফিয়ান ছাওরী র. ও ইবনুল মুবারক র. প্রমুখ হাদীসের সাগর-মহাসাগর বেঁচে থাকলে তাদেরকেও এরা সুন্নত শিখিয়ে দিত। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সুমতি দান করুন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান