আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং: ২৬১০
আন্তর্জতিক নং: ২৮০৪

পরিচ্ছেদঃ ১৭৫২. আল্লাহ তাআলার বাণীঃ হে নবী, আপনি বলে দিন, তোমরা কি আমাদের ব্যাপারে দু’টি কল্যাণের যে কোন একটি অপেক্ষা করছ?(৯ঃ৫২) যুদ্ধ হচ্ছে বড় পানি পাত্রের ন্যায়

২৬১০। ইয়াহয়া ইবনে বুকাইর (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব (রাযিঃ) তাঁকে জানিয়েছেন যে, হিরাকল (রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস) তাঁকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁর (রাসূলুল্লাহ) সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধের ফলাফল কিরূপ ছিল? তুমি বলেছ যে, যুদ্ধ বড় পানির পাত্র এবং ধন সম্পদের মত। রাসূলগণ এভাবেই পরীক্ষিত হয়ে থাকেন। তারপর ভাল পরিণতি তাদেরই হয় (তাঁরাই পুরস্কারপ্রাপ্ত হন)।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

হিজরী ৬ষ্ঠ সালে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সন্ধি স্থাপিত হয়। হিজরতের পর থেকে সন্ধিস্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে। অধিকাংশ সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে চতুর্দিকে ইসলাম প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যায়নি। হিজরী ৬ষ্ঠ সালে তিনি প্রায় দেড় হাজার সাহাবীসহ উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকগণ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির ফেলতে বাধ্য হন। সেখানে অনেক আলাপ-আলোচনার পর কুরায়শদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থাপিত হয়। এ চুক্তির ফলে পূর্ণোদ্যমে দাওয়াতী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ হয়। অভ্যন্তরীণ প্রচার প্রচারণার বাইরেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাদের কাছে দাওয়াতীপত্র প্রেরণ করতে থাকেন। এরকম একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল রোমের (বায়জেন্টাইন সাম্রাজ্যের) বাদশার কাছেও। পত্রবাহক ছিলেন হযরত দিহয়া কালবী রাযি। রোম সম্রাটের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি ও সম্রাটের তদন্ত তখনকার রোমের বাদশা ছিলেন হিরাক্ল (হেরাক্লিয়াস)। তিনি ৬১০ খ্রী. -৬৪১ খ্রী. ক্ষমতাসীন থাকেন। তার উপাধি কায়সার/কাইযার। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি যখন তার হাতে পৌঁছায়, তখন তিনি ঈলিয়া (বায়তুল মুকাদ্দাস) অবস্থান করছিলেন। এর আগে ৬১১ খ্রীষ্টাব্দে পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন। পারস্য রাজা কিসরা রোম সাম্রাজ্যাধীন ফিলিস্তীন ও মিশরসহ এশিয়া মাইনরের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন। এমনকি পারস্যবাহিনী কায়সারের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। কায়সারের পক্ষ থেকে বার বার সন্ধির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু অপর পক্ষ থেকে উত্তর ছিল একটাই- আমরা হিরাক্লিয়াসের মাথা ছাড়া অন্যকিছুতে রাজি নই। তাদের রাজি হওয়ার কথাও নয়। কেননা তাদের হাতে রোম সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়। দূর ভবিষ্যতেও যে এ সাম্রাজ্য ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ও তাদের লুপ্ত শক্তি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে তা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে কুরআন মাজীদের এক বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়। ইরশাদ হয় الم غُلِبَتِ الرُّومُ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ فِي بِضْعِ سِنِينَ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْ بَعْدُ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ 'আলিফ-লাম-মীম। রোমকগণ (হিজাযের) নিকটবর্তী (মিশর, ফিলিস্তীন, সিরিয়া প্রভৃতি) অঞ্চলে পরাজিত হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের পরাজয়ের পর বিজয় অর্জন করবে বছর কয়েকের মধ্যেই। সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহরই, পূর্বেও এবং পরেও। সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে রোমান ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন বলেন, যখন সুস্পষ্ট ভাষায় এ ভবিষ্যদ্বাণীটি করা হয়, তখন এটি পূরণ হওয়া ছিল এক অসম্ভব কল্পনা।কেননা রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের শাসনকালের প্রথম দশ বছরে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু সব অসম্ভব কল্পনাকে সম্ভব করে দিয়ে মাত্র সাত বছরের মাথায় এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। অভাবনীয়রূপে রোমান বাহিনীর কাছে পারস্য বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এবার শুরু হয় কায়সারের বিজয়ের পালা। এসময় তার সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী হিসে অবস্থানকালে তিনি একরাতে স্বপ্ন দেখেন খতনাকারী জাতির রাজা আবির্ভূত হয়েছেন। এ স্বপ্ন দেখে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হন। পারিষদবর্গ তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল যে, খতনা করার প্রচলন আছে ইহুদী সম্প্রদায়ে। কিন্তু এ সম্প্রদায়টি আপনার শাসনাধীন এক দুর্বল জনগোষ্ঠী। তাদের দিক থেকে আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কথাটি যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও পুরোপুরি চিন্তামুক্ত তিনি হতে পারলেন না। ওদিকে সম্রাট হিরাক্লিয়াস তার পরাজয়কালীন দিনগুলোর কোনও এক সময় মানত করেছিলেন ভবিষ্যতে তিনি কিসরাকে হারাতে পারলে পদযোগে বায়তুল মুকাদ্দাস গমন করবেন এবং এখানকার পবিত্র মসজিদে ইবাদত করবেন। কাজেই সে মানত পূরণের লক্ষ্যে তিনি বিচলিত মনে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছতেই হযরত দিহয়া কালবী রাযি.-এর মাধ্যমে পাঠানো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতীপত্র তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়। পত্র পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াসের উদ্বেগ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তবে তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক ছিলেন। চিঠি পাওয়ার পর চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তিনি চাইলেন পত্রপ্রেরক (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাঁর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রদান আরবের কোনও লোকের পক্ষেই সম্ভব ছিল। সে লোক যদি মক্কার হয়, বিশেষত তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেউ হয়, তবে আরও ভালো। এমন কোনও লোক পাওয়া যায় কিনা, তিনি খোঁজ নিতে বললেন। ঘটনাক্রমে আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এ সময় ফিলিস্তীনের গাযায় অবস্থান করছিল। হিরাক্লিয়াসের লোকজন তার এ বাণিজ্য কাফেলার সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা তাদেরকে রাজদরবারে নিয়ে হাজির করল। কাফেলার প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার পর জানা গেল আবূ সুফয়ানই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। উভয়ে একই কুরায়শ বংশের লোক ও মক্কার বাসিন্দা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা ভালো ধারণা তিনিই দিতে পারবেন। কাজেই কথোপকথনের জন্য তাকেই বেছে নেওয়া হলো। রোম সম্রাটের দরবারে আবূ সুফয়ান সম্রাটের পারিষদবর্গের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন দরবারে উপস্থিত। আবূ সুফয়ানকে তাদের সামনে বসানো হলো। তার সঙ্গীদের বসানো হলো তার পেছনে। এটা ছিল হিরাক্লিয়াসের সতর্কতা, যাতে তারা পরস্পর ইশারা-ইঙ্গিতে ভাবের লেনদেন করতে না পারে। হিরাক্লিয়াস তাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। আবূ সুফয়ান তার প্রত্যেকটির সঠিক উত্তর দান করেন। একটি প্রশ্নেরও উত্তরে কোনও অসত্য কথা বলেননি। রাজনৈতিক কুটকৌশলের দিকে লক্ষ করলে এ ক্ষেত্রে তার মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কথা ছিল। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার শত্রু। তাঁকে দমন করার জন্য এ যাবৎকাল অনেক শক্তি ক্ষয় করেছেন। কিন্তু তাতে সফলতা লাভ করতে পারেননি। এবার সফলতা লাভের একটা বড় সুযোগ হাতে এসে গেছে। রোমসম্রাট বলতে কথা। তখনকার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি। তাকে যদি ক্ষিপ্ত করে তোলা যায়, তবে মদীনায় হামলা চালিয়ে নিমিষেই সবকিছু চুরমার করে দিতে পারে। ইসলামের মূলোৎপাটন করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রু দমনের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না। আবূ সুফয়ানেরও তা করার কথা নয়। কিন্তু সেজন্য যে কিছু মিথ্যাকথা বলতে হয়! সমস্যা এখানেই। আবূ সুফয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! আমি মিথ্যা বলি- এ কথা দেশময় প্রচার হয়ে যাবে। সেই লজ্জাবোধ না হলে আমি অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতাম ৷ এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। আবূ সুফয়ান তখনও কাফের এবং ইসলামের ঘোরশত্রু। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা বলাকে নিজের পক্ষে লজ্জাস্কর মনে করেছেন। আজ আমাদের কী অবস্থা! আমরা মুসলিম। নিজেদের মুসলিম বলে গর্ববোধ করি, অথচ অসত্য বলতে দ্বিধাবোধ করি না! কথায় কথায় মিথ্যা বলি। তা জনসম্মুখে প্রকাশ্যেই বলি। একটুও লজ্জাবোধ হয় না। আহা! অমুসলিম অবস্থায় আবূ সুফয়ান মিথ্যা বলতে যেই লজ্জা বোধ করেছেন, সেই লজ্জাটুকুও যদি আমাদের থাকত! সম্রাটের সঙ্গে আবূ সুফয়ানের যে কথোপকথন হয় তা নিম্নরূপ : হিরাক্লিয়াস : তাঁর বংশ-মর্যাদা কেমন? আবূ সুফয়ান : আমাদের মধ্যে তাঁর বংশ-মর্যাদা খুবই উচ্চ। হিরাক্লিয়াস : তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কখনও বাদশা ছিল? আবূ সুফয়ান : না। হিরাক্লিয়াস। : নবুওয়াত দাবির আগে তোমরা কি কখনও তাঁকে মিথ্যা বলতে শুনেছ? আবূ সুফয়ান না। হিরাক্লিয়াস : তাঁর অনুসরণ কি তোমাদের অভিজাত লোকেরা করছে, না দুর্বলেরা? আবূ সুফয়ান : দুর্বলেরা। হিরাক্লিয়াস : তাঁর অনুসারী বাড়ছে, না কমছে? আবূ সুফয়ান : বাড়ছে। হিরাক্লিয়াস : তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কেউ কি ভক্তিশ্রদ্ধা হারিয়ে তাঁর দীন পরিত্যাগ করেছে? আবূ সুফয়ান না। হিরাক্লিয়াস : তাঁর সঙ্গে কি তোমাদের কখনও যুদ্ধ হয়েছে? আবূ সুফয়ান হয়েছে। হিরাক্লিয়াস : তার ফলাফল কী হয়েছে? আবূ সুফয়ান : কখনও আমরা জয়ী হয়েছি, কখনও তিনি। হিরাক্লিয়াস : তিনি কখনও বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন? আবূ সুফয়ান : না, তবে তাঁর ও আমাদের মধ্যে সম্প্রতি একটা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তাতে কী করবেন জানি না। হিরাক্লিয়াস : তোমাদের মধ্যে ইতঃপূর্বে কেউ কি এ রকমের দাবি করেছে? আবূ সুফয়ান না। হিরাক্লিয়াস আবূ সুফয়ানের এসব উত্তরের যে পর্যালোচনা করেন তা অত্যন্ত সারগর্ভ। তা দ্বারা তার গভীর জ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বললেন, নবীগণ সর্বদা উন্নত বংশেই জন্ম নিয়ে থাকেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা বাদশা থাকলে ধারণা করা যেত নিজ পূর্বপুরুষের রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য একপ দাবি করছেন। নবীগণের অনুসারী সর্বকালে এরূপ দুর্বল শ্রেণীই হয়েছে। আর যে ব্যক্তি মানুষ সম্পর্কে কোনও বিষয়ে মিথ্যা বলেন না, তিনি আল্লাহ সম্পর্কে কী করে মিথ্যা বলতে পারেন? নবীদের অনুসারীরা সর্বদা পরিপক্ব ঈমানদারই হয়ে থাকে, যে কারণে তারা ধর্ম ত্যাগ করে না। নবীদের অনুসারী সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধিই পেয়ে থাকে। রণক্ষেত্রে নবীদের অবস্থা এমনই হয়ে থাকে, কখনও তাঁরা জয়ী হন এবং কখনও প্রতিপক্ষ জয়ী হয়, তবে চূড়ান্ত বিজয় নবীদেরই হয়ে থাকে। নবীগণ কখনও বিশ্বাসভঙ্গ করেন না। তোমাদের মধ্যে ইতঃপূর্বে কেউ এ রকম দাবি করে থাকলে ধারণা করা যেত, ইনিও হয়ত তা শুনে এ রকম দাবি করছেন। তারপর তিনি আবূ সুফয়ানের কাছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও দাওয়াত সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আবূ সুফয়ান বললেন, তিনি আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেন। এছাড়া তিনি নামায, রোযা, আত্মীয়তা রক্ষা ও সচ্চরিত্রের শিক্ষাদান করেন। ইতোমধ্যে সম্রাট এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আরব জাতির মধ্যেও খতনার প্রচলন আছে। সব জানাশোনার পর সেদিনের দেখা দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা যেন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি স্পষ্টই দেখতে পেলেন, এক নতুন যুগের সূত্রপাত হয়ে গেছে। এক নতুন বিশ্বের ভিত্তি রচিত হয়ে গেছে। সুতরাং তিনি আবূ সুফয়ান ও তার সঙ্গীদের সামনে অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন- তুমি যা বললে তা যদি সত্য হয়, তবে অবশ্যই তিনি একজন নবী। আমরা জানতাম, তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। কিন্তু তোমাদের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হবেন, সেই ধারণা ছিল না। আহা, আমি যদি তাঁর সাক্ষাত লাভ করতে পারতাম। আমি যদি তাঁর কাছে থাকতাম, তবে তাঁর পা ধুইয়ে দিতাম। জান, এই মুহূর্তে আমার পা যেখানে আছে, তাঁর রাজত্ব একদিন সেখান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সংক্ষিপ্ত নববী শিক্ষার ভেতর পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ছবি ইমাম নববী রহ. উল্লিখিত দীর্ঘ বর্ণনার অংশবিশেষ এস্থলে উল্লেখ করেছেন। সে অংশটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা সম্পর্কিত। লক্ষ করলে দেখা যায় সংক্ষিপ্ত এ শিক্ষার ভেতর ইসলামের মূল বিষয়সমূহ এসে গেছে। ইসলামের সর্বপ্রধান শিক্ষা আকীদা-বিশ্বাস। আকীদা-বিশ্বাসের ভেতর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাওহীদ। অর্থাৎ আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি তোমাদেরকে কী আদেশ করেন? তিনি উত্তর দেন يقول : اعبدوا الله وحده ، ولا تشركوا به شيئا ، واتركوا ما يقول آباؤكم (তিনি বলে থাকেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করো না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষগণ যা বলে তা পরিত্যাগ কর)। বলা যেতে পারে এটা আকীদা বিষয়ক একটি শিরোনাম। আখেরাত, রিসালাত, তাকদীর প্রভৃতি বিষয়ক বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। মু'মিন হওয়ার জন্য তার সবগুলোতেই বিশ্বাস রাখা জরুরি। তবে সবার আগে যেহেতু তাওহীদ, তাই শিরোনাম হিসেবে এখানে তাওহীদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিহার করতে বলার দ্বারা মূলত শিরক পরিহারের কথাই বলা হয়েছে। আরবে যুগ-যুগ ধরে মূর্তিপূজা চলে আসছিল। পরের প্রজন্ম আগের প্রজন্মকে দেখে দেখে সেটাকেই সত্যধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। এর বিপরীত কোনও কথা তারা মানতে রাজি ছিল না। সাধারণভাবে সর্বত্র এটাই মানুষের চরিত্র। বাপ-দাদাদের যা দেখে আসে তাতেই করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার বিপরীত কিছু মানতে রাজি হয় না। আরব মুশরিকগণও তা মানছিল না। তাদের বড় অভিযোগ ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আবূ সুফয়ান হয়তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষাটিকে অভিযোগ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি নিজেও বাপ-দাদার পথকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে নতুন পথে চলছেন, অন্যদেরও সে পথে চালাতে চাচ্ছেন। এভাবে বাপ-দাদাকে গোমরাহ সাব্যস্ত করা ও যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ধর্মমতকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করা কি কোনও সমর্থনযোগ্য কথা? এজন্যই আমরা তার নতুন ধর্ম সমর্থন করতে পারছি না। সম্ভবত এ কথা বলে তিনি হিরাক্লিয়াসকেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। কারণ হিরাক্লিয়াস ও তার জাতিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া সত্যধর্মের বিপরীতে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ভ্রান্ত রীতি-নীতি অনুসরণ করছিল আর তাকেই প্রকৃত খ্রীষ্টধর্ম বলে বিশ্বস করছিল। কিন্তু আবূ সুফয়ানের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। কেননা তার মুখ থেকে যাবতীয় তথ্য শোনার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সত্য নবী এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বর, যাঁর সম্পর্কে আগের সমস্ত নবী-রাসূল ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এ কারণে হিরাক্লিয়াস নিজেও ঈমান আনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু পারিষদবর্গ ও যাজক-পুরোহিতগণ তাঁর বিরোধিতা করছিল। তিনি আশঙ্কাবোধ করলেন ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে সিংহাসন হারাতে হবে। ফলে ভ্রান্ত জানা সত্ত্বেও প্রচলিত খ্ৰীষ্ট ধর্মমতেই অবিচল থাকলেন। প্রকাশ থাকে যে, বাপ-দাদার কথা পরিত্যাগ করার প্রশ্ন আসে তখনই, যখন সে কথা ভ্রান্ত ও অসত্য হয়। পক্ষান্তরে বাপ-দাদার কথা যদি সত্য-সঠিক হয় এবং কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয়, তবে তা পরিত্যাগের প্রশ্ন আসে না; বরং এরূপ ক্ষেত্রে বাপ-দাদার প্রতি এ কারণে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, তাদের মাধ্যমে অতি সহজে সত্য সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া গেল। তাদের মাধ্যমে তা না পেলে হয়তো অনেক চিন্তা ভাবনা, সাধনা গবেষণা ও কষ্ট পরিশ্রম করতে হতো। আর তাতে সফল না হওয়ারও আশঙ্কা থাকত। আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানী যে, তিনি ফুকাহা-মুজতাহিদীনের শ্রম সাধনার ফল প্রজন্মপরম্পরার সহজ মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। এজন্য আল্লাহ তাআলার শোকর। তিনি আমাদের বাপ-দাদা তথা ফুকাহা-মুজতাহিদীন ও আসাতিযা-মাশায়েখকে উম্মতের পক্ষ থেকে অনেক অনেক জাযায়ে খায়র দান করুন। দ্বিতীয় বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন ইবাদত। এটা দীনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইবাদতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নামায। আবূ সুফয়ান বলেন ويأمرنا بالصلاة (তিনি আমাদেরকে আদেশ করেন নামাযের)। নামায যেহেতু সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তাই এ ইবাদতকে শিরোনাম বানানো হয়েছে। উদ্দেশ্য নামাযসহ যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী আদায়ের আদেশ করা। এমনও বলা যায় যে, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকভাবে আদায় করবে, সে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী আদায়েও যত্নবান থাকবে। সে কারণেই বিশেষভাবে নামাযের আদেশ করা হয়েছে। আবূ সুফয়ান তার এ বর্ণনায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও যেসকল শিক্ষার উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে- والصدق والعفاف والصلة (এবং আদেশ করেন সত্যবাদিতা, পবিত্র জীবনযাপন ও আত্মীয়তা রক্ষার) । الصدق অর্থ সত্যবাদিতা। এটা সচ্চরিত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সে হিসেবে এটাও যেন একটি শিরোনাম। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্যে ভালো ভালো যত চরিত্র আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এটা তাঁর আনীত ধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। العفاف এর অর্থ চারিত্রিক শুদ্ধতা। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু হারাম করেছেন তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলা। নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেকে কলুষিত না করা। অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হওয়ার নফস ও শয়তানী প্ররোচনার ক্ষেত্রে নিজেকে সংযত রাখা। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু হালাল করেছেন এবং যাকে যে পরিমাণ নি'আমত দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থেকে সবরকম সীমালঙ্ঘন থেকে নিজেকে সংযত রাখাই হচ্ছে 'আফাফ। ভিক্ষা করা বা অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত। আফাফকে এককথায় ইন্দ্রিয়সংযমও বলা যায়। অর্থাৎ‍ ইন্দ্রিয়চাহিদা পূরণে কোনও অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করে বৈধ পন্থায় সন্তুষ্ট থাকা। মৌলিকভাবে আফাফকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়- ক. যৌনচাহিদায় আত্মসংযম ও খ. উদরচাহিদায় আত্মসংযম। প্রথম ক্ষেত্রে সংযমের অর্থ ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা এবং ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহ যোগায় এমন যাবতীয় বিষয় পরিহার করে চলা, যেমন পরনারীর দিকে তাকানো, নারীদের বেপর্দা চলাফেরা করা, নর-নারীর অবাধ মেলামেশা করা, দুই নর-নারীর নির্জন জায়গায় অবস্থান করা, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এমন ভাব-ভঙ্গি করা ও এমন ভাব-ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলা ইত্যাদি। উদরচাহিদা পূরণে আত্মসংযম মানে হারাম পানাহার বর্জন করা, অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকা, ভিক্ষাবৃত্তি পরিহার করা, অর্থবিত্তের লোভ না করা ইত্যাদি। অভাব অনটনের ক্ষেত্রেও অন্যের কাছে হাত না পাতাই শরীআতের শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন- তারা যেন কোনও অবস্থায়ই অন্যের কাছে কিছু না চায়। তারা সে প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছিলেন। এমনকি উটের পিঠে থাকা অবস্থায় কারও হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলে সে লাঠিটি তুলে দেওয়ার জন্যও কাউকে অনুরোধ করতেন না। এটাও আফাফের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, মানুষ তার অভাব-অনটনের কথা কেবল আল্লাহ তাআলাকেই জানাবে, কোনও মাখলূককে নয়। الصلة অর্থ আত্মীয়তা রক্ষা। আত্মীয়তা রক্ষা করা ফরয। আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব আত্মীয়তার পর্যায়ক্রম অনুযায়ী। অর্থাৎ‍ যে যত কাছের আত্মীয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ততবেশি জরুরি। এ ব্যাপারে পিতা-মাতা ও ভাইবোন সবার উপরে। তারপর রক্তসম্পর্কিত আত্মীয় রক্তসম্পর্কহীন আত্মীয় অপেক্ষা বেশি কাছের। তাই তুলনামূলকভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় বেশি যত্নবান থাকা চাই। আত্মীয়তা রক্ষার অর্থ আত্মীয়দের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ও সুখে দুঃখে তাদের পাশে থাকা। এ সংক্ষিপ্ত হাদীছে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, আর্থিক লেনদেন, আখলাক চরিত্র ও সামাজিকতা——ইসলামের এই মৌলিক বিষয়সমূহ সংক্ষেপে এসে গেছে। এ হাদীছ যেন পূর্ণাঙ্গ ইসলামের সংক্ষিপ্ত চিত্র। হিরাক্লিয়াসের প্রশ্নের উত্তরে আবূ সুফয়ান সংক্ষেপে যেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের বিষয়বস্তু তথা গোটা ইসলামেরই ছবি এঁকে দিয়েছেন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ এ হাদীছ দ্বারা যেসকল শিক্ষা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ ক. এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক না করা ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এ অঙ্গ রক্ষা করা ছাড়া কেউ মুসলিম থাকতে পারে না।। খ. সত্যবাদিতা ইসলামী আখলাক ও নৈতিকতার অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে সততা ও সত্যবাদিতা রক্ষা করে চলা। গ. ইসলামী দাওয়াতের পদ্ধতি হলো- সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া হবে, তারপর নামাযের, তারপর পর্যায়ক্রমে আখলাক-চরিত্র ও অন্যান্য বিষয়ের। ঘ. বাপ-দাদার ধর্মমত যদি সত্য না হয় এবং তাদের রীতি-নীতি যদি শরীআতসম্মত না হয়, তবে তা অবশ্যবর্জনীয়। ঙ. সকল কলুষ-কালিমা থেকে নিজ চরিত্র পবিত্র রাখা ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। চ. ইসলামে আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং আমাদেরকে সর্বাবস্থায় আত্মীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন