কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

১. পবিত্রতা অর্জন ও তার সুন্নাতসমূহ

হাদীস নং: ৩৯৮
আন্তর্জাতিক নং: ৩৯৮
উযূ করার সময় বিসমিল্লাহ বলা
৩৯৮। হাসান ইবন 'আলী খাল্লাল (রাহঃ) …… সা'য়ীদ ইবন যায়দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ যার উযূ নেই, তার সালাত হয় না। আর যে ব্যক্তি উযূর সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে না, তার উযূ হয় না।
بَاب مَا جَاءَ فِي التَّسْمِيَةِ عَلَى الْوُضُوءِ
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ، أَنْبَأَنَا يَزِيدُ بْنُ عِيَاضٍ، حَدَّثَنَا أَبُو ثِفَالٍ، عَنْ رَبَاحِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي سُفْيَانَ، أَنَّهُ سَمِعَ جَدَّتَهُ بِنْتَ سَعِيدِ بْنِ زَيْدٍ، تَذْكُرُ أَنَّهَا سَمِعَتْ أَبَاهَا، سَعِيدَ بْنَ زَيْدٍ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لاَ وُضُوءَ لَهُ وَلاَ وُضُوءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অযূ শুরু করার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলার বিধান হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এটা কি সুন্নাত, মুস্তাহাব না ওয়াজিব, সে সম্পর্কে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। ইমাম আযম আবূ হানীফা, ইমাম শাফিঈ, ইমাম মালিক ও হাম্বলীদের পক্ষ থেকে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় ১. সুন্নাত, ২. মুস্তাহাব।

হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাব আল-হিদায়ার লেখক শায়খ বুরহানুদ্দীন মুরগীনানী (মৃ. ৫৯৩ হি./১১৯৭ খৃ.) একে সুন্নাতের মধ্যে উল্লেখ করলেও মুস্তাহাব হবার বর্ণনাটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন والاصح انها مستحبة অর্থাৎ অধিকতর সঠিক হল, অযূতে বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। হানাফী মাযহাবের অপর এক বিজ্ঞ আলিম শায়খ ইব্‌ন হুমাম (মৃ. ৮৬১/১৪৫৭) অযূতে বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব বলে মত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তাঁরই বিশিষ্ট ছাত্র আল্লামা কাসিম ইন কুত্-লুবুগা (মৃ. ৮৭৯/১৪৭৪) এটাকে তাঁর শায়খের স্বতন্ত্র অভিমত, যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন।

ইমাম মালিক (র) থেকে সুন্নাত ও মুসতাহার হবার মত বর্ণিত আছে; ইমাম শাফিঈ ও মালিক (র)-এর সঠিক মত হল, অযূর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নাত। আহমাদ ইবন হাম্বল (র)-এর দুই রিওয়ায়াতের মধ্যে ইবন কুদামা (মৃ. ৬২০ / ১২২৩) যিনি হাম্বলী ফিক্‌হ-এর সবচে নির্ভরযোগ্য রাবী তিনি মুসতাহাব হওয়ার রায়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। কেউ কেউ ইমাম আহমদ-এর প্রতি ওয়াজিব হবার মত আরোপ করলেও তা সঠিক নয়। কারণ ইবন কুদামা দু'টি রিওয়ায়াতই উল্লেখ করেছেন, অতঃপর শেষোক্তটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ইসহাক ইব্‌ন রাহওয়ায়াহ (মৃ. ৩৩৭/৯৪৯) ও কোন কোন আহলে যাহের একে ওয়াজিব বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাদের দলীল হল 'অযূর মাসনূন তরীকা' শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীস لا وضوء لمن لم يذكر اسم الله যে বিসমিল্লাহ বলবে না, তার অযূ হবে না।”

তাদের মতে কেউ জেনে শুনে, ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ ত্যাগ করলে তাঁর অযু হবে না, পুনরায় অযূ করতে হবে। আর ভুলবশত না পড়লে তা মাফ হয়ে যাবে।

জমহুর উলামায়ে কিরাম অন্যান্য হাদীসের আলোকে উল্লিখিত হাদীসের এই অর্থ করেন যে, "বিসমিল্লাহ না বললে অযূ হবে না অর্থ পূর্ণাঙ্গ অযু হবে না, যেমন এক হাদীসে বলা হয়েছে عن أبي هريرة قال قال رسول الله ﷺ لا صلوة لجار المسجد الا في المسجد

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : মসজিদের প্রতিবেশীর জন্য মসজিদে ছাড়া সালাত হয় না।

এর বিশ্লেষণ নিম্নরূপ :

১. অযূর শুরুতে বিস্-মিল্লাহ বলা ওয়াজিব হওয়া কোন শক্তিশালী দ্বারা প্রমাণিত নয়। উল্লিখিত হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। যেমন ইমাম আহমদ (র)-এর মন্তব্য ইমাম তিরমিযী (র) উদ্ধৃত করেছেন যে,

قال أحمدُ بنُ حَنْبَلٍ لَا أَعْلَمُ في هذا الباب حديثا لَهُ اسْنَادُ. جيد
আহমাদ ইব্‌ন হাম্বাল (র) বলেন, এ বিষয়ে এমন কোন হাদীস আমার জানা নেই, যে হাদীসটির সনদ জায়্যিদ বা উত্তম বলা যেতে পারে।

হাদীস দুর্বল হবার কারণ হল, এ হাদীসের মূলভিত্তি রাবাহ ইব্‌ন আবদুর রাহমান-এর উপর। হাফিয ইব্‌ন হাজার আসকালানী (মৃ. ৮৫২/১৪৪৯) তাঁর التلخيص الحبير গ্রন্থে তাকে মাজহূল বা অজ্ঞাত পরিচয় রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু তিনি আবূ যুর'আ (মৃ. ৮২১/১৪২৩) ও আবূ হাতিম (মৃ. ৩২২/৯৩৩) এর উক্তি ও বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা রাবাহকে মাজহূল বলেছেন।

ইব্‌ন হিব্বান (মৃ. ৩৫৪.৯৬৫) অবশ্য তাঁর 'কিতাবুস সিকাত' (كتاب الثقات) গ্রন্থে রাবাহকে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আল্লামা সুয়ূতী (মৃ. ৯১১/১৫০৫) তাঁর তাদরীবুর রাবী (تدريب الراوى) গ্রন্থে এ কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ইব্‌ন হিব্বানের পরিভাষা জমহূর মুহাদ্দিসের পরিভাষা থেকে ভিন্ন। তাঁর মতে কোন বিশ্বস্ত রাবী কারো কাছ থেকে হাদীস রিওয়ায়াত করলে সে ব্যক্তি (তার কাছ থেকে রিওয়ায়াত করা হচ্ছে) মাজহূল থাকা সত্ত্বেও বিশ্বস্ত রাবী বলে বিবেচিত হবেন। তাই ইব্‌ন হিব্বান-এর কিতাবুস সিকাত-এ উল্লেখ থাকলেই সে রাবী প্রকৃত বিশ্বস্ত হয়ে যাবেন না।

হাদীসটিতে দ্বিতীয় দুর্বলতা হল, তাতে আবূ ছিফাল আল-মুরবীর নাম উল্লিখিত হয়েছে। তার সম্পর্কে আল-হায়সামী (১.৮০৭ হি.) স্বীয় গ্রন্থ 'মাজমাউয যাওয়াইদ' এ লিখিছেন যে قال البخارى فى حديثه نظر অর্থাৎ ইমাম বুখারী (র) বলেছেন তার হাদীসে দুর্বল ও আপত্তি রয়েছে ।

২. বহু সাহাবী অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অযূর বিবরণ দিয়েছেন। এসবের কোথাও 'বিসমিল্লাহ' বলার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘উযূর মাসনূন তরীকা' শীর্ষক আলোচনা উল্লিখিত হযরত উসমান ও হযরত আলী (রা)-এর বর্ণিত হাদীসদ্বয় ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন যায়িদ (রা) থেকেও এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন ঃ

عَنْ عَمْرِو بْنِ أَبِي حَسَن سَأَلَ عَبْدُ اللهِ بْنُ زَيْدٍ عَنْ وَضَوْءِ النَّبِيِّ ﷺ فَدَعَا بِتَوْرٍ مِّنْ مَّاءٍ فَتَوَضَّاءَ لَهُمْ وَضَوْءَ النَّبِيِّ ﷺ فَأَكْفَا عَلَى يَدِهِ مِنْ التَّوْرِ فَغَسَلَ يَدَيْهِ ثَلَاثًا ثُمَّ أَدْخَلَ يَدَهُ فِي التَّوْرِ فَمَضْمَضَ وَاسْتَنْشَق وَاسْتَنْثَرَ ثَلَاثَ غُرْفَات ثُمَّ أَدْخَلَ يَدَهُ فَمَسَحَ رَأسَهُ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ مَرَّةً وَاحِدَةً ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَيْهِ إِلَى الْكَعْبَينِ

আমর উব্‌ন আবূ হাসান (র) থেকে বর্ণিত, তিনি আবদুল্লাহ ইব্‌ন যায়িদ (রা) কে নবী (সা)-এর অযূ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি তখন এক পাত্র পানি আনালেন এবং তাদের (দেখাবার) জন্য নবী (সা)-এর মত অযূ করলেন। তিনি পাত্র থেকে দু'হাতে পানি ঢাললেন।। তা দিয়ে হাত দু'টি তিনবার ধুলেন। তারপর পাত্রের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তিন আঁজলা পানি নিয়ে কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়লেন। তারপর আবার হাত ঢুকালেন। তিনবার তাঁর মুখমণ্ডল মুবারক করলেন। তারপর আবার হাত ঢুকিয়ে (পানি নিয়ে) দুই হাত কনুই পর্যন্ত দু'বার ধুলেন। তারপর আবার হাত ঢুকিয়ে উভয় হাত দিয়ে সামনে এবং পিছনে একবার মাত্র মাথা মাসেহ করলেন । তারপর দু' পা গিরা পর্যন্ত ধুলেন।

সুতরাং 'বিসমিল্লাহ' বলা যদি ওয়াজিবই হত তবে এ সব হাদীসে অবশ্যই তার উল্লেখ থাকত ।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান