আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৫- অছিয়াত সম্পর্কিত অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৭৫২
১৭১৫. যখন আত্মীয়-স্বজনের জন্য ওয়াক্ফ বা অসীয়াত করা হয় এবং আত্মীয় কারা? সাবিত (রাযিঃ) আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) আবু তালহাকে বলেন, তুমি (তোমার বাগানটি) তোমার গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে দাও। তারপর তিনি বাগণটি হাসসান ও উবাই ইবনে কা‘বকে দিয়ে দেন। আনসারী (রাহঃ) বলেন, আমার পিতা সুমামা এর মাধ্যমে আনাস (রাযিঃ) থেকে সাবিত (রাযিঃ)- এর অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, বাগানটি তোমার গরীব আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে দাও। আনাস (রাযিঃ) বলেন, আবু তালহা (রাযিঃ) বাগাণটি হাসসান ও উবাই ইবনে কা‘ব (রাযিঃ) কে দিলেন আর তারা উভয়েই আমার চেয়ে তার নিকটাত্মীয় ছিলেন। আবু তালহা (রাযিঃ)-এর সঙ্গে হাসসান এবং উবাই (রাযিঃ) এর সম্পর্ক ছিল এরূপঃ আবু তালহা (রাযিঃ) নাম- যায়দ ইবনে সাহল ইবনে আসওয়াদ ইবনে হারাম ইবনে আমর ইবনে যায়দ যিনি ছিলেন মানাত ইবনে আদী ইবনে আমর ইবনে মালিক ইবনে নাজ্জার। (হাসসানের বংশ পরিচয় হলোঃ) হাসসান ইবনে সাবিত ইবনে মুনযির ইবনে হারাম। কাজেই উভয়ে হারাম নামক পুরুষে মিলিত হন। যিনি তৃতীয় পিতৃপুরুষ ছিলেন এবং হারাম ইবনে আমর ইবনে যায়দ যিনি মানাত ইবনে আদী ইবনে আমর ইবনে মালিক ইবনে নাজ্জার। অতএব হাসসান, আবু তালহা ও উবাই (রাযিঃ) ষষ্ঠ পুরুষে এসে আমর ইবনে মালিকের সঙ্গে মিলিত হন। আর উবাই হলেন উবাই ইবনে কা‘ব ইবনে কায়স ইবনে উবাইদ ইবনে যায়দ ইবনে মুআবিয়া ইবনে আমর ইবনে মালিক ইবনে নাজ্জার। কাজেই আমর ইবনে মালিক এসে হাসসান আবু তালহা ও উবাই একত্র হয়ে যায়। কারো কারো মতে নিজের আত্মীয়-স্বজনের জন্য অসীয়াত করলে তা তার মুসলিম বাপ-দাদার জন্য প্রযোজ্য হবে।
২৫৬৫। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) .... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) আবু তালহা (রাযিঃ)- কে বলেন আমার মত হল,তোমার বাগানটি তোমার আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে দাও। আবু তালহা (রাযিঃ) বলেন, আমি তা-ই করব ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাই আবু তালহা (রাযিঃ) তার বাগানটি তার আত্মীয়-স্বজন ও চাচাত ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দেন। ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, যখন এই আয়াতটি নাযিল হলঃ (হে মুহাম্মদ) আপনার নিকট আত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দেন। (২৬ঃ ২১৪)। তখন নবী (ﷺ) কুরাইশ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রদের ডেকে বললেন, হে বনু ফিহ্র, হে বনু আদী, তোমরা সতর্ক হও। আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন যে, যখন কুরআনের এই আয়াত নাযিল হলঃ (হে মুহাম্মাদ) আপনি আপনার নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দিন (২৬ঃ ২১৪)। তখন নবী (ﷺ) বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে দান করা
আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাই মানুষের আসল সম্পদ; বরং সেটাই তার সম্পদ। দুনিয়ায় যা রেখে যাওয়া হয় তা পরের সম্পদ। মৃত্যুর পর তাতে কারও কোনও ক্ষমতা থাকে না। আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয় তা আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে। মৃত্যুর পর তা পাওয়া যাবে। সেই সম্পদই যখন আসল সম্পদ, তখন তার প্রতিই বিশেষভাবে মনোযোগী থাকা যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। সে বুদ্ধিমত্তার দাবি হচ্ছে আল্লাহর পথে নিজ প্রিয়বস্তু দান করা ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা।
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা এ কারণেও প্রয়োজন যে, তা দেওয়া হচ্ছে আল্লাহকে। যে-কোনও বস্তু দান করলে তার প্রথম গ্রহীতা আল্লাহ। কোনও বান্দার হাতে যাওয়ার আগে প্রথমে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে। আল্লাহর পথে দান করা হয় আল্লাহর ভালোবাসায়। এটা এক সাধারণ নিয়ম, ভালোবাসার জনকে কিছু দেওয়া হলে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তুই দেওয়া হয়ে থাকে। এক আল্লাহপ্রেমিকের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। অতএব আল্লাহর উদ্দেশ্যে যা দান করা হবে, আল্লাহপ্রেমের দাবিতেই তা সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুই হওয়ার কথা। অনেকে দানের এ মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে না। ফলে দায়সারাভাবে কোনও একটা কিছু দিয়ে দেয়। বরং অনেক সময় সবচে' অপসন্দের ও সবচে' কম দামীটাই দেওয়া হয়ে থাকে। বলা যায় এটাই ব্যাপক। বলাবাহুল্য এটা আল্লাহর পক্ষে দানের মহিমা নষ্ট করে।
আবার আল্লাহর পথে যা-কিছু দান করা হয় তা তো আল্লাহ আল্লাহ তাআলারই দেওয়া। তাঁর দেওয়া বস্তু তাঁর পথে ব্যয় করার সময় খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেওয়া বা অপ্রিয়টা দেওয়া একরকম নাশুকরীও বটে। এ নাশুকরী থেকে বাঁচার লক্ষ্যেও প্রত্যেক দাতার কর্তব্য আল্লাহর পথে প্রিয়বস্তু দান করা ও ভালোটা দেওয়া।
মানুষ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকার কারণে দান খয়রাতের ক্ষেত্রে এসকল দিক চিন্তা করে না। ফলে আখেরাতের বিচারে সে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। সে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে তাকে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ হাদীছে মূলত হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর একটি ঘটনার কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে। অন্য বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। আল্লাহ তাআলা যখন আয়াত নাযিল করলেন-لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ “তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ বাইরাহা নামক বাগানটি দান করে দিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে প্রিয়বস্তু দান করতে। তিনি সবচে' বেশি প্ৰিয়টা দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর হুকুম মানার কী উৎকৃষ্টতর নমুনা। এমনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ। এ কেবল তাঁর একার কথা নয়, বহু সাহাবীই এরকম করেছিলেন। হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর সবচে' প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম ছিল 'সাবাল'। তিনি ঘোড়াটির কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি জান আমার কাছে এ ঘোড়াটির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কোনও সম্পদ নেই। এই বলে তিনি ঘোড়াটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, এটি আল্লাহর পথে দিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে বললেন, তুমি এটা নিয়ে নাও। এতে হযরত যায়দ রাযি. যেন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা উপলব্ধি করে তিনি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমার দান কবুল করেছেন।
হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ। সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
হাদীসে আছে এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।
হাদীসে আছে এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।
অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।
খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।
ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।
ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।
চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।
আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাই মানুষের আসল সম্পদ; বরং সেটাই তার সম্পদ। দুনিয়ায় যা রেখে যাওয়া হয় তা পরের সম্পদ। মৃত্যুর পর তাতে কারও কোনও ক্ষমতা থাকে না। আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয় তা আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে। মৃত্যুর পর তা পাওয়া যাবে। সেই সম্পদই যখন আসল সম্পদ, তখন তার প্রতিই বিশেষভাবে মনোযোগী থাকা যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। সে বুদ্ধিমত্তার দাবি হচ্ছে আল্লাহর পথে নিজ প্রিয়বস্তু দান করা ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা।
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা এ কারণেও প্রয়োজন যে, তা দেওয়া হচ্ছে আল্লাহকে। যে-কোনও বস্তু দান করলে তার প্রথম গ্রহীতা আল্লাহ। কোনও বান্দার হাতে যাওয়ার আগে প্রথমে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে। আল্লাহর পথে দান করা হয় আল্লাহর ভালোবাসায়। এটা এক সাধারণ নিয়ম, ভালোবাসার জনকে কিছু দেওয়া হলে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তুই দেওয়া হয়ে থাকে। এক আল্লাহপ্রেমিকের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। অতএব আল্লাহর উদ্দেশ্যে যা দান করা হবে, আল্লাহপ্রেমের দাবিতেই তা সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুই হওয়ার কথা। অনেকে দানের এ মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে না। ফলে দায়সারাভাবে কোনও একটা কিছু দিয়ে দেয়। বরং অনেক সময় সবচে' অপসন্দের ও সবচে' কম দামীটাই দেওয়া হয়ে থাকে। বলা যায় এটাই ব্যাপক। বলাবাহুল্য এটা আল্লাহর পক্ষে দানের মহিমা নষ্ট করে।
আবার আল্লাহর পথে যা-কিছু দান করা হয় তা তো আল্লাহ আল্লাহ তাআলারই দেওয়া। তাঁর দেওয়া বস্তু তাঁর পথে ব্যয় করার সময় খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেওয়া বা অপ্রিয়টা দেওয়া একরকম নাশুকরীও বটে। এ নাশুকরী থেকে বাঁচার লক্ষ্যেও প্রত্যেক দাতার কর্তব্য আল্লাহর পথে প্রিয়বস্তু দান করা ও ভালোটা দেওয়া।
মানুষ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকার কারণে দান খয়রাতের ক্ষেত্রে এসকল দিক চিন্তা করে না। ফলে আখেরাতের বিচারে সে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। সে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে তাকে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ হাদীছে মূলত হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর একটি ঘটনার কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে। অন্য বর্ণনায় বিস্তারিত আছে। আল্লাহ তাআলা যখন আয়াত নাযিল করলেন-لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ “তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ বাইরাহা নামক বাগানটি দান করে দিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে প্রিয়বস্তু দান করতে। তিনি সবচে' বেশি প্ৰিয়টা দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর হুকুম মানার কী উৎকৃষ্টতর নমুনা। এমনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ। এ কেবল তাঁর একার কথা নয়, বহু সাহাবীই এরকম করেছিলেন। হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর সবচে' প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম ছিল 'সাবাল'। তিনি ঘোড়াটির কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি জান আমার কাছে এ ঘোড়াটির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কোনও সম্পদ নেই। এই বলে তিনি ঘোড়াটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, এটি আল্লাহর পথে দিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে বললেন, তুমি এটা নিয়ে নাও। এতে হযরত যায়দ রাযি. যেন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা উপলব্ধি করে তিনি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমার দান কবুল করেছেন।
হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ। সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
হাদীসে আছে এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।
হাদীসে আছে এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।
অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।
খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।
ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।
ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।
চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।
