কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ

ভূমিকা অধ্যায় (ইত্তেবায়ে সুন্নাহ,ইলম ও সাহাবা রাঃ এর মর্যাদা সংশ্লিষ্ট)

হাদীস নং: ২০৪
আন্তর্জাতিক নং: ২০৪
যে ব্যক্তি কোন ভাল অথবা মন্দ কাজের প্রচলন করে।
২০৪। 'আব্দুল ওয়ারিস ইবন 'আব্দুস সামাদ ইবন 'আব্দুল ওয়ারিস (রাহঃ).....আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর কাছে আসে। তখন তিনি তাকে দান করার জন্য (লোকদের) উৎসাহিত করলেন। এক ব্যক্তি বললোঃ আমার পক্ষ থেকে এই এই পরিমাণ। রাবী বলেনঃ মজলিসে এমন কেউ অবশিষ্ট রইল না, যে কমবেশী ঐ ব্যক্তিকে দান করেনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের প্রচলন করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করা হয়, সে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান পাবে। আর যারা সে আদর্শ অনুসারে কাজ করবে, তাদের সমপরিমাণ পুরস্কার ঐ ব্যক্তি পাবে, অথচ এতে আমলকারীদের বিনিময়ে কোন ঘাটতি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের প্রচলন করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করা হয়, এর পাপের বোঝা পূর্ণরূপে তার উপর বর্তাবে এবং যারা মন্দ কাজ করে, তাদের পাপের বোঝাও ঐ ব্যক্তির উপর বর্তাবে, অথচ মন্দ কাজকারীদের পাপের বোঝা কোনক্রমইে হালকা হবে না।
بَاب مَنْ سَنَّ سُنَّةً حَسَنَةً أَوْ سَيِّئَةً
حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَارِثِ بْنُ عَبْدِ الصَّمَدِ بْنِ عَبْدِ الْوَارِثِ، حَدَّثَنِي أَبِي، حَدَّثَنِي أَبِي، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَحَثَّ عَلَيْهِ فَقَالَ رَجُلٌ عِنْدِي كَذَا وَكَذَا ‏.‏ قَالَ فَمَا بَقِيَ فِي الْمَجْلِسِ رَجُلٌ إِلاَّ تَصَدَّقَ عَلَيْهِ بِمَا قَلَّ أَوْ كَثُرَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ مَنِ اسْتَنَّ خَيْرًا فَاسْتُنَّ بِهِ كَانَ لَهُ أَجْرُهُ كَامِلاً وَمِنْ أُجُورِ مَنِ اسْتَنَّ بِهِ وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنِ اسْتَنَّ سُنَّةً سَيِّئَةً فَاسْتُنَّ بِهِ فَعَلَيْهِ وِزْرُهُ كَامِلاً وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ اسْتَنَّ بِهِ وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئًا ‏"‏ ‏.‏

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আবূ আমর জারীর ইবন 'আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা দিনের প্রথম ভাগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একদল লোক তাঁর নিকট আসল, যাদের শরীর ছিল অনাবৃত। তারা চট অথবা ‘আবা' পরিহিত ছিল এবং গলায় তরবারি ঝুলানো ছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল মুদার গোত্রের লোক; বরং সবাই–ই মুদার গোত্রের লোক ছিল। তাদের দারিদ্র্যাবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। তিনি গৃহে প্রবেশ করলেন। তারপর বের হয়ে আসলেন এবং বিলাল রাযি.–কে আযান দিতে হুকুম করলেন। হযরত বিলাল রাযি. আযান ও ইকামত দিলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আদায় করে ভাষণ দিলেন। তিনি প্রথমে আয়াত পাঠ করলেন–
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا (1)
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর–নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)–কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। সূরা নিসা (৪), আয়াত ১

তারপর সূরা হাশরের শেষের দিকের এ আয়াতটি পড়লেন–
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (18)
হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা–কিছু কর সে সম্পর্কে আল্লাহ পুরোপুরি অবগত।সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮
তারপর বললেন, প্রত্যেক ব্যক্তি দান করুক তার দীনার থেকে, তার দিরহাম থেকে, তার কাপড় থেকে এবং তার গম ও খেজুর থেকে। এমনকি এ কথাও বললেন যে, এক টুকরো খেজুর হলেও যেন দান করে।
অতঃপর জনৈক আনসারী ব্যক্তি একটি থলি নিয়ে আসলেন। (তা এত ভারী ছিল যে, তা বহন করতে) তার হাত প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ছিল। বরং অক্ষম হয়েই পড়েছিল। তারপর লোকেরা একের পর এক দান করতে থাকল। এমনকি আমি কাপড় ও খাদ্যের দু'টি স্তুপ দেখতে পেলাম। আমি দেখতে পেলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা ঝলমল করছে, যেন তাতে স্বর্ণের রং মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি ইসলামে কোনও ভালো নিয়ম চালু করবে, সে ব্যক্তি তার ছাওয়াব পাবে এবং পরে যারা সে অনুযায়ী আমল করবে—তাদের সমপরিমাণ ছাওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের ছাওয়াব কিছুমাত্র কমবে না। পক্ষান্তরে ইসলামে যে ব্যক্তি কোনও মন্দ নিয়ম চালু করবে, তার ওপর তার বোঝা পড়বে এবং পরে যারা সে অনুযায়ী কাজ করবে, তাদের সকলের বোঝার সমপরিমাণও তার ওপর পড়বে, তাতে তাদের বোঝা কিছুমাত্র কমবে না. মুসলিম। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০১৭: আবূ দাউদ তয়ালিসী, হাদীছ নং ৭০৫। সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৩০৮, বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৪৮: তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৪৩; ইবনুল জা'দ, মুসনাদ, হাদীছ নং ৫১৬)

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষামূলক এক হাদীছ। এর দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরদ ও মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। আরও জানা যায় যে, তিনি নিজ অনুসারীদের অন্তরে এ গুণ ছড়িয়ে দেওয়া এবং অভাবগ্রস্ত মুসলিমদের অভাব-অনটনে সাহায্য-সহযোগিতা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহী করে তোলার প্রতি কেমন যত্নবান ছিলেন।

বনু মুদার আরবের একটি প্রসিদ্ধ গোত্র। তাদের একটি দল তরবারিসজ্জিত অবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়। সম্ভবত সেটা কোনও যুদ্ধের সময় ছিল। কিন্তু তাদের গায়ের কাপড় ছিল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত ও অতি সাধারণ। একটা মাত্র কাপড়ে শরীরের নিম্নাংশ কোনওরকমে ঢেকে নিয়েছিল। উপরের অংশ ছিল খোলা। অনাহারে-অর্ধাহারে শরীর ছিল ক্লান্ত-ক্লিষ্ট। তাদের এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। উম্মতের কষ্ট-ক্লেশ দেখলে তাঁর মন ব্যথিত হত। সে বেদনার ছাপ তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছিল। তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব মেটানোর জন্য প্রথমে তিনি নিজের ঘরে গেলেন। এই আশায় যে কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কিছুই পেলেন না। খালি হাতে ফিরে আসলেন।

ইতোমধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেল। হযরত বিলাল রাযি. আযান দিলেন। তারপর ইকামত দিলেন। তিনি সকলকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। তারপর এই হতদরিদ্র আগন্তুকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে একটি ভাষণ দিলেন।

তিনি প্রথমে আল্লাহ তা'আলার হামদ ও ছানা পড়লেন। এটাই ছিল তাঁর সাধারণ নিয়ম। ভাষণের আগে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করে নিতেন। তারপর সূরা নিসার প্রথম আয়াত এবং সূরা হাশরের ১৮ নং আয়াত তিলাওয়াত করলেন।

এ আয়াতদু'টিতে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতিগ্রহণের শিক্ষা রয়েছে। সূরা নিসার আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا (1)
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১)

মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য
এর সারমর্ম হচ্ছে সমস্ত মানুষ এক আদি পিতামাতার সন্তান। সে হিসেবে তারা সকলে ভাই-ভাই ও ভাই-বোন। এ ভ্রাতৃত্বের কারণে তাদের একের ওপর অন্যের হক আছে। প্রত্যেকের উচিত অন্যের দুঃখ-কষ্টে তার পাশে দাঁড়ানো। পরস্পরে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়াতেই ভ্রাতৃত্বের সার্থকতা। তারপর যদি আবার পরস্পরের মধ্যে আরও বেশি কাছের আত্মীয়তা থাকে, তখন পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য অনেক বেড়ে যায়।

তো এক আদমসন্তান হিসেবে সমস্ত মানুষের প্রতি রয়েছে সাধারণ দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিকটাত্মীয়দের প্রতি রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব-কর্তব্য। এ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম। তাঁর এ হুকুম কে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছে, আল্লাহ তা'আলা তা লক্ষ রাখছেন। আখিরাতে এ সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। কাজেই প্রত্যেকের উচিত অন্তরে সে জিজ্ঞাসাবাদের ভয় রাখা। কেননা উত্তর সঠিক না হলে তার পরিণাম বড় ভয়াবহ। তাই প্রথমেই আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করেছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ ভয়ের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তুলনামূলকভাবে তারচে' যে বেশি দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছে তার পাশে দাঁড়াবে এবং যতটুকু সম্ভব তার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করবে।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেককে হুকুম করেছেন যে, সে যেন আখিরাতের জন্য কতটুকু কী করেছে – সেদিকে লক্ষ রাখে। এ হুকুমের শুরুতেও তাঁকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরেও এ নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এর দ্বারা আখিরাতের লক্ষ্যে কাজ করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

আখিরাতের জীবনই আসল জীবন। ইহজগত সেই জীবনের শস্যক্ষেত্র মাত্র। এখানে যেমন কর্ম হবে, সেখানে তেমনি ফল পাওয়া যাবে। কর্ম ভালো হলে ভালো ফল এবং মন্দ হলে মন্দ ফল। ভালো ফল ভোগের জায়গা জান্নাত আর মন্দ ফলের জন্য আছে জাহান্নাম। সে বড় কঠিন জায়গা। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। প্রত্যেকের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা পূর্ণ অবগত। কাজেই মুক্তি পেতে চাইলে এখনই সতর্কতা দরকার। প্রতিটি কাজ যেন এমনভাবে হয়, যাতে তা দ্বারা আখিরাতের সঞ্চয় হয় এবং সেখানে মুক্তির অছিলা হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহর পথে দান-খয়রাতও সেরকমই এক অছিলা। আল্লাহর বান্দাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যা-কিছু ব্যয় করা হবে তা নেকীরূপে সঞ্চিত হতে থাকবে, যে নেকী সঞ্চয়ের প্রতি এ আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

এ উভয় আয়াতই মুদার গোত্রের তখনকার অবস্থার প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রথম আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সদাকার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

ভূমিকাস্বরূপ আয়াতদু'টি তিলাওয়াত করার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদেরকে সরাসরি দান-খয়রাত করার হুকুম দেন। প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে বলেন। একটি দীনার, একটি দিরহাম, একটা কাপড়, এক সা' গম বা খেজুর, যে যা পারে। এমনকি কেউ যদি একটা খেজুরের অর্ধেকও দিতে পারে, তাও যেন দেয়।

বলাবাহুল্য, এত অল্প পরিমাণ দান কেবল তখনই হয়, যখন বাড়তি কিছু না থাকে। যতটুকু থাকে তাতে নিজ প্রয়োজনও পুরোপুরি মেটে না। এরূপ অবস্থায় দান করতে গেলে দরকার হয় নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজে অভুক্ত থেকে অন্যকে খাওয়ানো বা নিজে সর্বনিম্ন পর্যায়ে খেয়ে অন্যের ক্ষুধা মেটানো। একে “ঈছার' বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান সাহাবীদেরকে ঈছার গুণের ওপর গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং কুরআন মাজীদে এই বলে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (9)
এবং তাদেরকে তারা নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে। যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।" সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দেওয়ামাত্র সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেল। প্রত্যেকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে থাকলেন। তাতে খাদ্য ও কাপড়ের দু'টি স্তুপ হয়ে গেল। তা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ তাঁর চেহারা বেদনায় মলিন ছিল। এবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। সুন্দর ও মুবারক চেহারাখানি খুশিতে এমন ঝলমল করছিল, মনে হচ্ছিল যেন তাতে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।

তাঁর এ আনন্দ ও সন্তুষ্টি ছিল এক তো এই কারণে যে, জীর্ণশীর্ণ আগন্তুকদের উপস্থিত অভাব মোচনের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ তাঁর হুকুম পালনে মহান সাহাবীদের তৎপরতা। এমনই ছিলেন সাহাবায়ে কিরামের জামাত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যে হুকুম করতেন তা বিনাবাক্যে পালন করতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল এতেই তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।

অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সাধারণ নীতি ঘোষণা করে দেন। সে নীতি ভালো ও মন্দ তরিকা চালু করা সম্পর্কে। কেউ কোনও ভালো তরিকা চালু করলে সে নিজ আমলের ছাওয়াব তো পাবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি আরও যারা সে কাজ করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ ছাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের ছাওয়াব কোনও অংশে কমবে না। পক্ষান্তরে কেউ কোনও মন্দ নিয়ম চালু করলে সে নিজ কর্মের জন্য গুনাহগার তো হবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি যত লোক সেই মন্দ কাজটি করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ গুনাহ তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের গুনাহ কোনও অংশে কমবে না।

সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব : ছাওয়াবের বিপুলতায়
এর দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষানুযায়ী দীনের যাবতীয় ভালো কাজের তারাই ছিলেন প্রথম কর্মী। তাঁর শিক্ষানুযায়ী তারা আমলের ধারা চালু করেছেন। তারপর তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের দেখানো পথে আমল করতে থেকেছে। প্রতি যুগে আমলকারীর সংখ্যা বাড়তে থেকেছে বিপুলহারে। মুষ্টিমেয় সাহাবীর দেখানো পথে আজকের পৃথিবীতে আমল করছে কোটি কোটি মানুষ। যুগপরম্পরায় এ পর্যন্ত কত শতকোটি মানুষ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আসছে। এতে তাদের একেকজনের আমলনামায় কত ছাওয়াব লেখা হয়েছে ও লেখা হচ্ছে তা কি কল্পনা করা সম্ভব? ঈমান ও বিশ্বাসের গভীরতার কারণে তাদের নিজ আমলের যে আলাদা মান ও বৈশিষ্ট্য— সে তো স্বতন্ত্র রয়েছেই, সেইসঙ্গে দীনের যাত্রাপথে প্রথম পথিক হওয়ার সুবাদে তাদের ছাওয়াবে যে বিপুল বিস্তার তাতেও তাঁরা অনন্য। এদিক থেকেও তাদের সঙ্গে কারও তুলনার কোনও অবকাশ নেই। রাদিয়াল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম ওয়া রাদূ 'আনহু।

মৃত্যুর পরও এভাবে নেকীর ধারা চালু থাকাকে 'সাদাকায়ে জারিয়া' বলা হয়। মৃত্যুর পরও এভাবে নেকী হাসিলের সুযোগ সবকালেই আছে। এখনও যে ব্যক্তি কোনও ভালো কাজ শুরু করবে আর তার দেখাদেখি অন্যরাও তা করবে এবং পরবর্তীদের মধ্যে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তি তাদের সকলের ছাওয়াবের সমান ছাওয়াব নিজ আমলনামায় পেয়ে যাবে।

এই নিরবচ্ছিন্ন ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটা শর্ত নয় যে, কোনও আমল সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজের থেকে শুরু করতে হবে এবং পূর্বে তার কোনও অস্তিত্ব না থাকতে হবে। বরং প্রচলিত আমল দ্বারাও এ ছাওয়াব পাওয়া সম্ভব। যেমন নামাযের কথাই ধরা হোক। দীনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এ আমল সমাজে চালু আছে। তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজে নামায পড়ার পাশাপাশি তার সন্তান-সন্ততিকে নামাযীরূপে গড়ে তুলবে, অন্য বেনামাযীকেও নামাযী বানানোর চেষ্টা করবে, অতঃপর তাদের ধারায় পরবর্তী প্রজন্মদের মধ্যে নামাযের আমল অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় এদের সকলের নামাযের সমান ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে।

একইভাবে বিচার করা যায় বিদ'আতের বিষয়টাও। যে ব্যক্তি কোনও বিদ'আত চালু করে, তার নিজ আমলের গুনাহ তো তার আছেই। তারপর যত লোক সে বিদ'আতের অনুসরণ করবে, তাদের সকলের গুনাহর সমপরিমাণ যদি তার আমলনামায় লেখা হতে থাকে, তবে সে গুনাহর পরিমাণ কত হয় ভাবা যায় কি? আজ যে সকল বিদ'আতী কর্ম সমাজে চালু আছে, এর প্রথম প্রবক্তা যারা ছিল, কী অবস্থা তাদের আমলনামার? এর থেকে আমাদের সবক নেওয়া দরকার।

খুব সতর্ক থাকা দরকার যাতে আমাদের এমন কোনও মন্দ কাজ না হয়ে যায়, যা আমার দেখাদেখি অন্যরাও করতে শুরু করে। নিজ সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সদস্যবর্গ থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত-অনুরক্ত ও এদের সকলের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর যাতে আমার চালু করা কোনও মন্দ কাজের প্রচলন না হয়ে যায়—সেদিকে লক্ষ রাখা খুব জরুরি। সেরকম কিছু হলে আমি মরে যাব বটে, কিন্তু আমার আমলনামায় পাপ লেখা বন্ধ হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। আখিরাতে ধ্বংস হওয়ার জন্য এই-ই তো যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা এই ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে আমাদের হেফাজত করুন- আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ শিক্ষা দেয় মানুষ হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু হক আমাদের ওপর আছে। তাই যে-কারও দুঃখ-কষ্টে সহমর্মী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।

খ. আত্মীয়-স্বজনের বিশেষ হক রয়েছে। সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা উচিত।

গ. এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর একজন উম্মত হিসেবে আমার মধ্যেও এ গুণ অবশ্যই থাকা চাই।

ঘ. দীনী কাজে চাঁদা দেওয়া সাহাবায়ে কিরামের সুন্নত। এর অনুসরণ বাঞ্ছনীয়।

ঙ পিতামাতা, উস্তায, শায়খ বা এরকম মুরব্বীস্থানীয় কারও চেহারায় কোনও কারণে বেদনার ছাপ পরিলক্ষিত হলে যথাসাধ্য তা দূর করার চেষ্টা করা উচিত, যাতে যথাশীঘ্র সে চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস ফুটে ওঠে।

চ. নিজ ক্ষমতার পরিমণ্ডলে নেক আমলের রেওয়াজ দেওয়া চাই, যাতে আমলনামায় স্থায়ীভাবে ছাওয়াব লেখা হতে থাকে।

ছ. প্রত্যেকের সতর্ক থাকা উচিত যাতে তার দ্বারা কোনওক্রমেই বিদ'আতের প্রচলন না ঘটে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে ইবনে মাজা - হাদীস নং ২০৪ | মুসলিম বাংলা