আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৪- শর্তাবলীর বিধান সংক্রান্ত অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৭১৫
১৬৮৭. ইসলাম গ্রহণ, আহকাম ও ক্রয়-বিক্রয় যে সব শর্ত জায়েয
২৫৩২। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) .... জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেছি, নামায কায়েম করার, যাকাত প্রদান করার এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করার ব্যাপারে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত জারীর ইব্ন আব্দুল্লাহ রাযি. তাঁর এ বর্ণনায় দু'টি বিষয় সম্পর্কে আমাদের অবগত করেছেন। একটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে তাঁর বাই'আত গ্রহণ করা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে সে বাই'আতের বিষয়বস্তু। তিনি জানাচ্ছেন, তিনি বাই'আত গ্রহণ করেছিলেন তিনটি বিষয়ে নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া এবং প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনা করা।

বাই'আত প্রসঙ্গ
মৌলিকভাবে বাই'আত তিন প্রকার।
ক. ইসলাম গ্রহণের বাই'আত। অর্থাৎ কোনও অমুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক কারও হাতে হাত রেখে এই মর্মে অঙ্গীকার করা যে, আমি কুফর ও শিরক পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম, এক আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নিলাম এবং ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে আমি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ে আসা দীন অনুসরণ করে চলব।

খ. নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বাই‘আত। অর্থাৎ যে ব্যক্তিকে মুসলিম জাতির শাসকরূপে মনোনীত করা হয়েছে তার হাতে হাত রেখে জনগণকর্তৃক এ প্রতিশ্রুতিদান যে, তিনি যতদিন আল্লাহর দেওয়া শরী'আত অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবেন, ততদিন আমরা তার অনুগত হয়ে থাকব এবং দেশ পরিচালনায় তার সাহায্য-সহযোগিতা করব।

গ. দীনের কোনও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বাই'আত গ্রহণ করা। যেমন এ হাদীছে নবী 'সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হযরত জারীর ইব্ন 'আব্দুল্লাহ রাযি.-এর বাই'আত। এ বাই'আত হয়েছিল সুনির্দিষ্ট তিনটি বিষয়ে। এমনিভাবে হুদায়বিয়ায় সংঘটিত বাই'আতুর রিযওয়ান। তাতে সাহাবায়ে কিরাম নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত রেখে এই মর্মে বাই'আত গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করবেন না। শরীরের সর্বশেষ রক্তবিন্দুও আল্লাহর পথে উৎসর্গ করবেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম থেকে বাই'আত নিয়েছিলেন। তাসাওউফের প্রচলিত বাই'আতও এরকমই।

সুলূক ও তাসাওউফের প্রচলিত বাই'আত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে ইসলামের শুরু যমানা থেকেই চলে এসেছে। এতে শরী'আতের যাহেরী বিধানাবলী মেনে চলার পাশাপাশি বাতেনী বিধানসমূহ তথা রিয়া, অহংকার, হাসাদ প্রভৃতি মন্দ চরিত্র বর্জন ও ইখলাস, বিনয়, রিযা বিল-কাযা প্রভৃতি সৎগুণ অর্জনের সাধনা সম্পর্কে কোনও খাঁটি মুরশিদ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার করা হয়।

আখলাক-চরিত্রের পরিশুদ্ধি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার একটি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব মৌলিক দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে, এটি তার অন্যতম। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ

তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমতের শিক্ষা দেবে। (সূরা জুমু'আ (৬২), আয়াত ২)
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

بعثت لأتمم مكارم الأخلاق

‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতাবিধানের জন্য। (শারহুস সুন্নাহ, বাগাবী, হাদীছ নং ২৩২৫; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৬০৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৪২২। মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৮)
'হাদীছে জিবরীল' নামক প্ৰসিদ্ধ হাদীছে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পেশ করা হয়েছে। সে মৌলিক শিক্ষার একটি হচ্ছে ইহসান। তাতে ইহসানের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছেঃ-

أن تعبد الله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك

'তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি তাঁকে নাও দেখে থাক, তিনি তো তোমাকে দেখছেন (অন্তরে এ ধ্যান বজায় রাখবে)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৬৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬১০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৯০)

এটা ইখলাসের উচ্চতর স্তর। এ স্তরের ইখলাস অর্জনের চেষ্টা সর্বপ্রকার ইবাদতে কাম্য; প্রত্যক্ষ ইবাদতেও যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি, এবং পরোক্ষ ইবাদতেও যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত মোতাবেক বিবাহ করা, সংসার-জীবন যাপন করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, আত্মীয়তা রক্ষা করা, বিচার নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি।

ইখলাসবিহীন ইবাদত আল্লাহ তা'আলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই রিয়া, সুনাম সুখ্যাতি ও লোক দেখানোর মানসিকতা বর্জন করে ইহসান ও ইখলাসের গুণ অর্জন করা। অবশ্যকর্তব্য। এটা আখলাকের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক; বরং বলা যায় আখলাকের সারবস্তু। ইহসান ও ইখলাস অর্জন হয়ে গেলে আখলাক-চরিত্রের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা অর্জন সহজ হয়ে যায়। তাই সুলূক ও তাসাওউফে একে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। সে গুরুত্বের কারণে সুলূক ও তাসাওউফকে ইহসান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

মোটকথা, আখলাক সংশোধন করা তথা মন্দ স্বভাব পরিহার করে সৎগুণ অর্জনের চেষ্টা করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। এটা শরী'আতের একটি মৌলিক অঙ্গ। ইহসান, সুলূক ও তাসাওউফ চর্চার মূল উদ্দেশ্য এটাই। এর জন্য বাই'আত বিশেষভাবে ফলপ্রসূ। কোনও খাঁটি মুরশিদের হাতে বাই'আত হয়ে তার সাহচর্য-সান্নিধ্যে থেকে আত্মসংশোধনের চেষ্টা যত বেশি উপকার দিয়ে থাকে, অতটা উপকার অন্য কোনও মাধ্যমে সাধারণত হাসিল হয় না। এ কারণেই যুগ যুগ যাবৎ হক্বানী ‘উলামা-মাশায়েখ এ পন্থার গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারও যদি অন্য কোনও পন্থায় আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়ে যায় তাতে আপত্তির কিছু নেই। উদ্দিষ্ট বস্তু হাসিল হওয়াই আসল কথা, তা যে পন্থায়ই হোক। সারকথা- আখলাক-চরিত্রের সংশোধন ফরয, বাই'আত ফরয নয়। হাঁ, এটা উদ্দেশ্য হাসিলের পক্ষে বেশি সহায়ক। যুগ যুগের অভিজ্ঞতা দ্বারা তা প্রমাণিত।

নামায ও যাকাতের গুরুত্ব

হযরত জারীর রাযি.-এর বাই'আতে যে তিনটি বিষয়ের প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছে তার প্রথম দু'টি হচ্ছে যথাক্রমে নামায ও যাকাত। নামায মূল চার ইবাদতের মধ্যে প্রধান। শরী'আত এর এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যে, কোনও মুসলিম নামায না পড়লে তার যেন নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়ারই অধিকার থাকে না। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- بين العبد وبين الكفر ترك الصلاة 'বান্দা ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হল নামায ত্যাগ। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৬৭৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮০৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১০৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪৯৭৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৪৫৩)
অর্থাৎ মু'মিন ব্যক্তি নামায পড়ে আর যে ব্যক্তি কুফরীতে লিপ্ত সে নামায পড়ে না। নামাযের পরপরই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যাকাত। কুরআন মাজীদে যত আয়াতে নামাযের হুকুম দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশেই নামাযের পাশাপাশি যাকাতেরও আদেশ করা হয়েছে। নেসাব পরিমাণ মাল থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যাকাত দেয় না, বে নামাযীর মতই তারও যেন নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার থাকে না। কুরআন-হাদীছে যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তি সম্পর্কে নামায তরককারীর মতই কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নিজ খেলাফতকালে যাকাত আদায়ে গড়িমসিকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইসলামে যাকাত কত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ গুরুত্বের কারণেই এ হাদীছে এ বিধানদু'টি পালন সম্পর্কে বাই'আত নেওয়া হয়েছে।

নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কে বাই'আত

এ হাদীছে বর্ণিত বাই'আতের তৃতীয় বিষয় হল প্রত্যেক মুসলিমের জন্য নসীহত ও কল্যাণকামনা। বাই‘আতগ্রহণ দ্বারা এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে। দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য তার মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করা। হযরত জারীর ইব্ন আব্দুল্লাহ রাযি, জীবনভর এ বাই'আত রক্ষা করেছেন এবং মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থেকেছেন। তাঁর সে কল্যাণকামিতার একটি ঘটনা এরকম যে, একবার তিনি এক ব্যক্তির নিকট থেকে ২০০ দিরহামের বিনিময়ে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন। ঘোড়াটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তাঁর মনে হল। এটির দাম আরও বেশি হওয়ার কথা। এ মনে হতেই তিনি ঘোড়াটি নিয়ে বিক্রেতার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাকে বললেন, তোমার ঘোড়াটির দাম আরও বেশি হয়। এই বলে তিনি তাকে আরও বেশি দাম দিলেন। তারপর ফিরে এসে ঘোড়াটি ব্যবহার করার পর তাঁর কাছে আবার মনে হল এর দাম আরও বেশি হয়। সুতরাং তিনি আবারও বিক্রেতার কাছে চলে গেলেন এবং তাকে বললেন, তোমার ঘোড়াটির দাম আরও বেশি হয়। সেমতে তিনি তাকে আরও বেশি দাম দিলেন। এভাবে তিনি তার কাছে তিনবার আসা-যাওয়া করলেন এবং দাম বাড়াতে থাকলেন। এ করে তা ৮০০ দিরহামে পৌঁছল। আল্লাহু আকবার! কী গভীর কল্যাণকামিতা! এঁরাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী। উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জামাত।

কল্যাণকামনার একটা অংশ উপদেশ দানও। এটা ‘ফরযে কিফায়াহ' স্তরের একটি বিধান। প্রত্যেক এলাকায় একদল লোক যদি এটা পালন করে এবং তাতে সেই এলাকার প্রয়োজন সমাধা হয়, তবে সকলের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু প্রয়োজন পরিমাণে তা না হলে দায়িত্ব আদায় হবে না এবং সে কারণে সকলেই গুনাহগার হবে। তবে এর জন্য শর্ত হল উপদেশদাতার একথা জানা থাকা যে, তার উপদেশ গ্রহণ করা হবে এবং এ দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাকে জুলুম-নিপীড়নের শিকার হতে হবে না। সেরকম আশঙ্কা থাকলে নসীহত করা জরুরি থাকে না। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও যদি কেউ হিম্মতের পরিচয় দেয় এবং জুলুম-নিপীড়নের মুখেও এ দায়িত্ব পালন থেকে পিছপা না হয়, তবে তার সে আমল উচ্চতর জিহাদরূপে গণ্য হবে এবং এজন্য সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অশেষ পুরস্কার লাভ করবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নামায ও যাকাত ঈমানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সুতরাং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই তা পালন করা চাই।

খ. নসীহত ও কল্যাণকামিতা দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এতে অবহেলার কোনও সুযোগ নেই।

গ. সুলূক ও তাসাওউফের বাই'আত ভিত্তিহীন কোনও কাজ নয়; বরং একটি সুন্নত আমল। আত্মশুদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এ সুন্নতের ওপর আমল করা চাই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন