কিতাবুস সুনান- ইমাম ইবনে মাজা রহঃ
ভূমিকা অধ্যায় (ইত্তেবায়ে সুন্নাহ,ইলম ও সাহাবা রাঃ এর মর্যাদা সংশ্লিষ্ট)
হাদীস নং: ১১
আন্তর্জাতিক নং: ১১
রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নতের অনুসরণ।
১১। আবু সা"য়ীদ ( আব্দুল্লাহ ইবন সায়ীদ ( র ) জাবের ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমরা নবী (ﷺ)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি প্রথমে একটি সোজা রেখা টানলেন এবং তার ডানদিকে দুটো রেখা টানলেন এবং বাঁ দিকেও দুটো রেখা টানলেন। এরপর তিনি রেখার
মধ্যবর্তীস্থানে হাত রেখে বললেনঃ এটা আল্লাহর রাস্তা। এরপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ
و أن هذا صراطي مستقيما فاتبعوه ولا تشبعوا السميل فتفرق بكم عن سبيله “এবং এ পথ-ই সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না। করলে, তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।" (৬:১৫৩)
মধ্যবর্তীস্থানে হাত রেখে বললেনঃ এটা আল্লাহর রাস্তা। এরপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেনঃ
و أن هذا صراطي مستقيما فاتبعوه ولا تشبعوا السميل فتفرق بكم عن سبيله “এবং এ পথ-ই সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না। করলে, তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।" (৬:১৫৩)
بَاب اتِّبَاعِ سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ
حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الأَحْمَرُ، قَالَ سَمِعْتُ مُجَالِدًا، يَذْكُرُ عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَخَطَّ خَطًّا وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَمِينِهِ وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَسَارِهِ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ فِي الْخَطِّ الأَوْسَطِ فَقَالَ " هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ " . ثُمَّ تَلاَ هَذِهِ الآيَةَ (وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ) .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
‘ইস্তিকামাত তথা সরল পথ’- এর ব্যাখ্যা
ইস্তিকামাত (الاستقامة) -এর অর্থ সোজা হওয়া। স্থির ও অবিচল থাকা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, ইস্তিকামাত অর্থ সরল-সঠিক পন্থা আঁকড়ে ধরে রাখা। অর্থাৎ সরলতা ও অবক্রতার সাথে অবিচলতা যুক্ত হলে তা হয় ইস্তিকামাত। ইসলাম সরল সঠিক ধর্ম। এতে কোনও বক্রতা নেই। এ পথ সোজা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ পথে চললে সোজা জান্নাতে পৌছা যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়। তবে সেজন্য দরকার এ পথে অবিচল থাকা অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা।
হযরত 'উমর রাযি. বলেন- ইস্তিকামাত এই যে, তুমি সদাসর্বদা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, তা থেকে শেয়ালের মত এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ অনুসরণ করতে হবে কেবলই আল্লাহর বিধান তথা দীনে ইসলামের, যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদের দিয়েছেন। আর সে অনুসরণ করতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এমন নয় যে, ইসলামের উপর কিছুক্ষণ চললাম আবার কিছুক্ষণ থেমে থাকলাম বা অন্যপথে চললাম। একবার এ পথে আসার পর মৃত্যু পর্যন্ত আর অন্যদিকে ফিরে তাকানো যাবে না। একটানা এ পথেই চলতে হবে এবং বিশ্বাস রাখতে হবে এ পথে চলা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে পারলেই মুক্তি ও জান্নাতলাভ হবে। সুতরাং অটুট বিশ্বাসের সাথে মৃত্যু পর্যন্ত সরল-সঠিক পথ তথা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই হচ্ছে ইস্তিকামাত। তাহলে ইস্তিকামাতের ভিত্তি দুই জিনিসের উপর–
ক. আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান;
খ. জাহিরী ও বাতিনীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো দীনের স্থায়ী অনুসরণ।
এ দুই ভিত্তির দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় দীনে ইসলামের সম্পূর্ণটাই ইস্তিকামাতে অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান বলতে আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক সবকিছুকেই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে ইস্তিকামাতের জন্য জরুরি হল- আকীদা-বিশ্বাসের যত ধারা আছে তার প্রতিটিতে সবরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করা এবং কুরআন-সুন্নাহে যেমনটা বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই তা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হলে পথভ্রষ্টতা দেখা দেয়। ইসলামের আগে যত ধর্ম ছিল তার অনুসারীরা কেন বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কেউ তা হয়েছে ছাড়াছাড়ি কবলে পড়ে। কালক্রমে সেসব ধর্ম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলেছে। তা হারানোর আসল কারণ ইস্তিকামাতের উপর না থাকা। ইস্তিকামাত পরিহার করার কারণে এই উম্মতের মধ্যেও বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজও ইসলামের প্রতিটি আকীদায় প্রকৃত শিক্ষার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। সর্বশেষ দীন হওয়ায় শেষপর্যন্ত তা থাকবেও ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ আকীদা-বিশ্বাস হেফাজতের প্রতি যত্নবান থাকা, যাতে কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হয়ে ইস্তিকামাত থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়ি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সঠিক বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারি।
এমনিভাবে শরী'আত তথা ইসলামী বিধানাবলির প্রতিটি ধারায়ও ইস্তিকামাতের ব্যাপারটা এসে যায়। বাহ্যিক বিধানাবলি তথা আল্লাহর হক ও বান্দার হক সংক্রান্ত প্রতিটি বিধিবিধান নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে রেখে গেছেন, কোনওরকম হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া ঠিক সেভাবে মেনে চললে তা ইস্তিকামাতরূপে গণ্য হবে।
বাতিনী বিধানাবলি তথা আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে শিক্ষা বর্ণিত আছে, ইস্তিকামাতের জন্য তাও হুবহু অনুসরণের চেষ্টা করা জরুরি। আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্র অতি ব্যাপক। ইসলামী শিক্ষায় সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্রের দীর্ঘ তালিকা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল মানুষের সাথে ভালো ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষায় রয়েছে মন্দ আচরণ পরিহার করে চলার জোর তাগিদ। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যবহারিক জীবন আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা। তিনি আপন-পর ও শত্রু-মিত্রের সাথে আচার আচরণসহ চরিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্যমান দৃষ্টান্ত পেশ করে গেছেন, মানুষের ইতিহাসে যার কোনও নজির নেই। তাঁর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমেই একজন মানুষের পক্ষে সত্যিকারের চরিত্রবান হওয়া সম্ভব।
আজ সারাবিশ্বে মানুষের চরিত্র চরম অবক্ষয়ের শিকার। আমরা মুসলিম জাতিও সে অবক্ষয় থেকে মুক্ত নই। এর একমাত্র কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া ভারসাম্যমান চারিত্রিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকা। আমরা তাঁর চারিত্রিক শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণও করছি না। এদিক-ওদিক ঝুঁকে পড়ছি। হয় কার্পণ্য, নয়তো অপব্যয়; হয় মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা, নয়তো অনুচিত নমনীয়তা; হয় পুরোপুরি সংসারমুখিতা, নয়তো সম্পূর্ণ বৈরাগ্য- এভাবে সকল ক্ষেত্রে কোনও একদিকে হেলে পড়ার নীতি অবলম্বন করে আমরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। তাই বিপর্যয় নেমে এসেছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে দীনের উপর ইস্তিকামাতের যে তাগিদ কুরআন-সুন্নাহে দেওয়া হয়েছে, আমাদের প্রত্যেককে তাতে মনোযোগী হতে হবে।
কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ইস্তিকামাতের আদেশ করা হয়েছে। তা দ্বারা এর গুরুত্ব ও ফযীলত উপলব্ধি করা যায়। এ সম্পর্কে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদীছ।
সৎকাজে অগ্রগামিতা
সৎকাজ দ্বারা ছাওয়াব ও পুণ্য লাভ হয়। ছাওয়াব হচ্ছে আখিরাতের পাথেয়। যে যতবেশি ছাওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হবে তার আখিরাতের মুক্তি লাভের সম্ভাবনা ততবেশি । জান্নাতে মর্যাদার তারতম্য হবে ছাওয়াবের তারতম্য অনুযায়ী। যার যতবেশি ছাওয়াব অর্জিত হবে, জান্নাতে সে তত উচ্চমর্যাদার অধিকারী হবে। তাই দুনিয়ার অল্পদিনের আয়ুতে প্রত্যেকের উচিত নেক কাজে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। মানুষ পার্থিব বিষয়ে সাধারণত তা-ই করে। অল্পদিনের এ জীবনে সুখশান্তিতে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতার সাথে মেহনত করে। অথচ মেহনতের সুফল সে কতটুকু পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিষ্ফল প্রতিযোগিতায় অনেকেরই জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে আখিরাতও বরবাদ হয়। দু'দিনের জীবনে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশায় আখিরাত বরবাদ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ করে নিজ আখিরাত ঠিক রেখে। আখিরাত যেহেতু অনন্তকালের জন্য, তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত সেখানকার সাফল্য লাভে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে উৎসাহ দান করা হয়েছে তারা যেন আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণ লাভে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
সৎকাজে গড়িমসি না করা
যে-কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগামাত্রই তা করে ফেলা উচিত। কিছুতেই গড়িমসি ও অলসতা করা উচিত নয়। গড়িমসি করলে ইচ্ছা লোপ পেয়ে যায়। পরে নেক কাজ করার উৎসাহ পাওয়া যায় না। বুযুর্গানে-দীন বলেন, অন্তরে নেক কাজের ইচ্ছা জাগা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আগত মেহমানস্বরূপ। কোনও বাড়িতে যদি মেহমান আসে আর বাড়িওয়ালা তাকে আদরযত্ন ও সম্মান করে, তখন মেহমান তার বাড়িতে থাকতে আগ্রহবোধ করে এবং বার বার আসার উৎসাহ পায়। পক্ষান্তরে সে যদি দেখে বাড়িওয়ালা তাকে অবজ্ঞা করছে এবং তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাচ্ছে না, তবে সে খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় এবং পরে আর কখনও সেই বাড়িতে আসার আগ্রহ পায় না।
তদ্রূপ অন্তরে যখন কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগে এবং সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কাজটি করে ফেলা হয়, তখন নতুন নতুন নেক কাজের ইচ্ছা জাগতেই থাকে। নেক কাজের ইচ্ছা যতবেশি পূরণ করা হয়, অন্তরে ততবেশি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। কোনও নেক কাজ আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করলে তাতে সহজে ক্লান্তিবোধ হয় না। ফলে অলসতাও দেখা দেয় না। নেক কাজের ইচ্ছা পূরণ করতে থাকলে অন্তর থেকে অলসতার রোগ নির্মূল হয়ে যায়। ফলে বেশি বেশি নেক কাজের সুযোগ হয় এবং অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার তাওফীক লাভ হয়। কুরআন ও হাদীছে তাই নানাভাবে বান্দাকে উৎসাহ যোগানো হয়েছে, যাতে সে নেক কাজের ইচ্ছা দেখামাত্রই অলসতা ছেড়ে তাতে মশগুল হয়ে পড়ে।
ইস্তিকামাত (الاستقامة) -এর অর্থ সোজা হওয়া। স্থির ও অবিচল থাকা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, ইস্তিকামাত অর্থ সরল-সঠিক পন্থা আঁকড়ে ধরে রাখা। অর্থাৎ সরলতা ও অবক্রতার সাথে অবিচলতা যুক্ত হলে তা হয় ইস্তিকামাত। ইসলাম সরল সঠিক ধর্ম। এতে কোনও বক্রতা নেই। এ পথ সোজা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ পথে চললে সোজা জান্নাতে পৌছা যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়। তবে সেজন্য দরকার এ পথে অবিচল থাকা অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা।
হযরত 'উমর রাযি. বলেন- ইস্তিকামাত এই যে, তুমি সদাসর্বদা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, তা থেকে শেয়ালের মত এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ অনুসরণ করতে হবে কেবলই আল্লাহর বিধান তথা দীনে ইসলামের, যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদের দিয়েছেন। আর সে অনুসরণ করতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এমন নয় যে, ইসলামের উপর কিছুক্ষণ চললাম আবার কিছুক্ষণ থেমে থাকলাম বা অন্যপথে চললাম। একবার এ পথে আসার পর মৃত্যু পর্যন্ত আর অন্যদিকে ফিরে তাকানো যাবে না। একটানা এ পথেই চলতে হবে এবং বিশ্বাস রাখতে হবে এ পথে চলা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে পারলেই মুক্তি ও জান্নাতলাভ হবে। সুতরাং অটুট বিশ্বাসের সাথে মৃত্যু পর্যন্ত সরল-সঠিক পথ তথা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই হচ্ছে ইস্তিকামাত। তাহলে ইস্তিকামাতের ভিত্তি দুই জিনিসের উপর–
ক. আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান;
খ. জাহিরী ও বাতিনীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো দীনের স্থায়ী অনুসরণ।
এ দুই ভিত্তির দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় দীনে ইসলামের সম্পূর্ণটাই ইস্তিকামাতে অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান বলতে আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক সবকিছুকেই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে ইস্তিকামাতের জন্য জরুরি হল- আকীদা-বিশ্বাসের যত ধারা আছে তার প্রতিটিতে সবরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করা এবং কুরআন-সুন্নাহে যেমনটা বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই তা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হলে পথভ্রষ্টতা দেখা দেয়। ইসলামের আগে যত ধর্ম ছিল তার অনুসারীরা কেন বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কেউ তা হয়েছে ছাড়াছাড়ি কবলে পড়ে। কালক্রমে সেসব ধর্ম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলেছে। তা হারানোর আসল কারণ ইস্তিকামাতের উপর না থাকা। ইস্তিকামাত পরিহার করার কারণে এই উম্মতের মধ্যেও বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজও ইসলামের প্রতিটি আকীদায় প্রকৃত শিক্ষার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। সর্বশেষ দীন হওয়ায় শেষপর্যন্ত তা থাকবেও ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ আকীদা-বিশ্বাস হেফাজতের প্রতি যত্নবান থাকা, যাতে কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হয়ে ইস্তিকামাত থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়ি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সঠিক বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারি।
এমনিভাবে শরী'আত তথা ইসলামী বিধানাবলির প্রতিটি ধারায়ও ইস্তিকামাতের ব্যাপারটা এসে যায়। বাহ্যিক বিধানাবলি তথা আল্লাহর হক ও বান্দার হক সংক্রান্ত প্রতিটি বিধিবিধান নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে রেখে গেছেন, কোনওরকম হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া ঠিক সেভাবে মেনে চললে তা ইস্তিকামাতরূপে গণ্য হবে।
বাতিনী বিধানাবলি তথা আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে শিক্ষা বর্ণিত আছে, ইস্তিকামাতের জন্য তাও হুবহু অনুসরণের চেষ্টা করা জরুরি। আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্র অতি ব্যাপক। ইসলামী শিক্ষায় সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্রের দীর্ঘ তালিকা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল মানুষের সাথে ভালো ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষায় রয়েছে মন্দ আচরণ পরিহার করে চলার জোর তাগিদ। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যবহারিক জীবন আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা। তিনি আপন-পর ও শত্রু-মিত্রের সাথে আচার আচরণসহ চরিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্যমান দৃষ্টান্ত পেশ করে গেছেন, মানুষের ইতিহাসে যার কোনও নজির নেই। তাঁর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমেই একজন মানুষের পক্ষে সত্যিকারের চরিত্রবান হওয়া সম্ভব।
আজ সারাবিশ্বে মানুষের চরিত্র চরম অবক্ষয়ের শিকার। আমরা মুসলিম জাতিও সে অবক্ষয় থেকে মুক্ত নই। এর একমাত্র কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া ভারসাম্যমান চারিত্রিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকা। আমরা তাঁর চারিত্রিক শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণও করছি না। এদিক-ওদিক ঝুঁকে পড়ছি। হয় কার্পণ্য, নয়তো অপব্যয়; হয় মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা, নয়তো অনুচিত নমনীয়তা; হয় পুরোপুরি সংসারমুখিতা, নয়তো সম্পূর্ণ বৈরাগ্য- এভাবে সকল ক্ষেত্রে কোনও একদিকে হেলে পড়ার নীতি অবলম্বন করে আমরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। তাই বিপর্যয় নেমে এসেছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে দীনের উপর ইস্তিকামাতের যে তাগিদ কুরআন-সুন্নাহে দেওয়া হয়েছে, আমাদের প্রত্যেককে তাতে মনোযোগী হতে হবে।
কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ইস্তিকামাতের আদেশ করা হয়েছে। তা দ্বারা এর গুরুত্ব ও ফযীলত উপলব্ধি করা যায়। এ সম্পর্কে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদীছ।
সৎকাজে অগ্রগামিতা
সৎকাজ দ্বারা ছাওয়াব ও পুণ্য লাভ হয়। ছাওয়াব হচ্ছে আখিরাতের পাথেয়। যে যতবেশি ছাওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হবে তার আখিরাতের মুক্তি লাভের সম্ভাবনা ততবেশি । জান্নাতে মর্যাদার তারতম্য হবে ছাওয়াবের তারতম্য অনুযায়ী। যার যতবেশি ছাওয়াব অর্জিত হবে, জান্নাতে সে তত উচ্চমর্যাদার অধিকারী হবে। তাই দুনিয়ার অল্পদিনের আয়ুতে প্রত্যেকের উচিত নেক কাজে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। মানুষ পার্থিব বিষয়ে সাধারণত তা-ই করে। অল্পদিনের এ জীবনে সুখশান্তিতে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতার সাথে মেহনত করে। অথচ মেহনতের সুফল সে কতটুকু পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিষ্ফল প্রতিযোগিতায় অনেকেরই জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে আখিরাতও বরবাদ হয়। দু'দিনের জীবনে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশায় আখিরাত বরবাদ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ করে নিজ আখিরাত ঠিক রেখে। আখিরাত যেহেতু অনন্তকালের জন্য, তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত সেখানকার সাফল্য লাভে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে উৎসাহ দান করা হয়েছে তারা যেন আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণ লাভে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
সৎকাজে গড়িমসি না করা
যে-কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগামাত্রই তা করে ফেলা উচিত। কিছুতেই গড়িমসি ও অলসতা করা উচিত নয়। গড়িমসি করলে ইচ্ছা লোপ পেয়ে যায়। পরে নেক কাজ করার উৎসাহ পাওয়া যায় না। বুযুর্গানে-দীন বলেন, অন্তরে নেক কাজের ইচ্ছা জাগা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আগত মেহমানস্বরূপ। কোনও বাড়িতে যদি মেহমান আসে আর বাড়িওয়ালা তাকে আদরযত্ন ও সম্মান করে, তখন মেহমান তার বাড়িতে থাকতে আগ্রহবোধ করে এবং বার বার আসার উৎসাহ পায়। পক্ষান্তরে সে যদি দেখে বাড়িওয়ালা তাকে অবজ্ঞা করছে এবং তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাচ্ছে না, তবে সে খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় এবং পরে আর কখনও সেই বাড়িতে আসার আগ্রহ পায় না।
তদ্রূপ অন্তরে যখন কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগে এবং সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কাজটি করে ফেলা হয়, তখন নতুন নতুন নেক কাজের ইচ্ছা জাগতেই থাকে। নেক কাজের ইচ্ছা যতবেশি পূরণ করা হয়, অন্তরে ততবেশি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। কোনও নেক কাজ আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করলে তাতে সহজে ক্লান্তিবোধ হয় না। ফলে অলসতাও দেখা দেয় না। নেক কাজের ইচ্ছা পূরণ করতে থাকলে অন্তর থেকে অলসতার রোগ নির্মূল হয়ে যায়। ফলে বেশি বেশি নেক কাজের সুযোগ হয় এবং অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার তাওফীক লাভ হয়। কুরআন ও হাদীছে তাই নানাভাবে বান্দাকে উৎসাহ যোগানো হয়েছে, যাতে সে নেক কাজের ইচ্ছা দেখামাত্রই অলসতা ছেড়ে তাতে মশগুল হয়ে পড়ে।
