কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৫১. বিভিন্ন (হালাল-হারাম) পানীয়ের বিধান
হাদীস নং: ৫৭১১
আন্তর্জাতিক নং: ৫৭১১
সন্দেহযুক্ত বস্তু ত্যাগের প্রতি উৎসাহ দান
৫৭১১. মুহাম্মাদ ইবনে আবান (রাহঃ) ......... আবুল হাওরা সাদী (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হাসান ইবনে আলী (রাযিঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোন কথা স্মরণ রেখেছেন? তিনি বললেনঃ আমি তার থেকে স্মরণ রেখেছি, যা তোমাকে সন্দেহে নিপতিত করে, তা পরিত্যাগ করবে। আর যাতে কোন সন্দেহ নেই তা-ই করবে।
الْحَثُّ عَلَى تَرْكِ الشُّبُهَاتِ
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبَانَ قَالَ حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ إِدْرِيسَ قَالَ أَنْبَأَنَا شُعْبَةُ عَنْ بُرَيْدِ بْنِ أَبِي مَرْيَمَ عَنْ أَبِي الْحَوْرَاءِ السَّعْديِّ قَالَ قُلْتُ لِلْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا مَا حَفِظْتَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ حَفِظْتُ مِنْهُ دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيبُكَ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এখানে يريبك ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি ريب থেকে। ريب এর আভিধানিক অর্থ মনের খটখটানি ও অস্থিরতা। কোনও বিষয়ে মনে সন্দেহ দেখা দিলে সে বিষয়ে মনে একটা অস্থিরতা ও খটখটানিভাব দেখা দেয়। তাই সন্দেহকেও ريب বলে। এ হাদীছে বলা হচ্ছে, কোনও বিষয়ে তোমার মনে যদি খটকা ও সন্দেহ দেখা দেয় যে, তা হালাল না হারাম, জায়েয না নাজায়েয, তখন সে বিষয়টি পরিত্যাগ করে যে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই তা অবলম্বন কর। তাতেই নাজাত ও মুক্তি। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষে হারাম ও নাজায়েযও হতে পারে। কাজেই তাতে লিপ্ত হলে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। যে-কোনও হারাম ও নাজায়েয কাজে লিপ্ত হওয়া মানেই নিজেকে ধ্বংস করা। বিভিন্ন হাদীছে নাজায়েয কাজকে 'মূবিকাত' ও 'মুহলিকাত' (ধ্বংসাত্মক) বলা হয়েছে। হারাম কাজে যেহেতু গুনাহ হয় আর গুনাহ মানুষকে জাহান্নামে নেয়, তাই হারাম কাজ ধ্বংসাত্মকই বটে। সেই ধ্বংস থেকে বাঁচার লক্ষ্যে সন্দেহযুক্ত কাজ পরিহার করা অবশ্যকর্তব্য। তাছাড়া সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত হলে সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস জন্মায়। তা ধীরে ধীরে হারাম কাজের দিকে নিয়ে যায়। এক হাদীছে বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
الحلال بَيْن والحَرامُ بَيْلُ، وَبَيْنَهُمَا أُمُورُ مُشتبِهَاتٌ لا يَعْلَمُهُنَّ كَثِير من الناس، فمن اللي الشبهات إستمرا لدينه و عرضه، وَ مَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الحَرَامِ، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه ، ألا وإن لكل ملك حتى أَلَا وَإِن حتى الله محارمة
নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়। বহু মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল। ঠিক ওই রাখালের মত, যে সরকারি সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চড়ায়। অসতর্কতাবশত তার সংরক্ষিত ভূমিতে ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। শোন হে! প্রত্যেক বাদশারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে। শোন হে! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। (বুখারী ৫২ ও মুসলিম ১৫৯৯)
তো সংরক্ষিত এলাকার আশেপাশে পশু চড়ালে যেমন সেই এলাকার ভেতরে ঢুকে পড়ার ভয় থাকে, তেমনি স্পষ্ট হারাম কাজের কাছাকাছি বিষয় তথা সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত হলেও স্পষ্ট হারাম কাজের ভেতর লিপ্ত হয়ে পড়ার ভয় থাকে। কাজেই স্পষ্ট হারাম বিষয় থেকে বাঁচার জন্য জরুরি এমনসব কাজ থেকেও দূরে থাকা, যা হারাম বলে সন্দেহ হয়। অর্থাৎ করতে হবে কেবল এমন কাজই, যা স্পষ্টভাবে হালাল ও বৈধ। আর যা হারাম তা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। আর যে কাজে সন্দেহ হয় তা হালাল না হারাম, তাও এই চিন্তায় পরিহার করা চাই যে, তা বাস্তবিকরূপে হারাম হলে তো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আর বাস্তবিকপক্ষে হারাম না হলে হারামের সন্দেহ আছে, তাই এরূপ কাজে লিপ্ত হলে ধীরে ধীরে হারামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
বোঝাই যাচ্ছে এরূপ কাজ পরিহার করা ফরয বা ওয়াজিব নয়। বরং কেবলই সতর্কতা অর্থাৎ মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু মুস্তাহাব হলেও এ কারণে অবহেলা করা যায় না যে, তাতে লিপ্ত হওয়াটা বিপজ্জনক, যেহেতু এতে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
এ সতর্কতা অবলম্বন দ্বারা একদিক থেকে তো সরাসরি নিজ দীনদারীর হেফাজত হয়, যেহেতু এটা হারাম থেকে বাঁচার উপায়। দ্বিতীয়ত এর দ্বারা নিজ মান-সম্মানও রক্ষা হয়। কেননা সন্দেহযুক্ত কাজ করলে অন্যের মনে সন্দেহ জন্মাতে পারে- সে বুঝি হারাম কাজ করছে। এভাবে বেশি বেশি সন্দেহপূর্ণ কাজ করতে থাকলে ব্যাপকভাবেই মানুষ সন্দেহ করতে শুরু করবে। ফলে তার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। মানুষের দৃষ্টিতে আস্থাহীন হয়ে পড়াটা খুবই অসম্মানজনক। এর থেকে বাঁচা জরুরি। কেননা আত্মসম্মান রক্ষা করাও শরীআতের হুকুম। সন্দেহপূর্ণ জিনিস থেকে বেঁচে থাকাও আত্মসম্মান রক্ষার একটা উপায়। তাই তো উপরে উল্লিখিত হাদীছে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল।
হালাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে করণীয়
উল্লেখ্য, কোনও বিষয়ে যদি সন্দেহ দেখা দেয় তা হালাল না হারাম এবং জায়েয না নাজায়েয, তবে মুজতাহিদ পর্যায়ের লোক তো চিন্তা-ভাবনা করে দলীল-প্রমাণের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যদি মুজতাহিদ না হয়ে সাধারণ পর্যায়ের লোক হয়, তার কর্তব্য, উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞাসা করা। তারা জায়েয বা নাজায়েয যাই বলুক, তাতে যদি সন্তুষ্টি লাভ হয় এবং মন পুরোপুরি আস্বস্ত হয়ে যায়, তবে তো সে অনুযায়ী আমল করা হবে। আর যদি তাদের উত্তরে মন সন্তুষ্ট না হয় এবং অন্তরে খটকা বাকি থেকেই যায়, তবে সে কাজ পরিহার করাই শ্রেয়। হাদীছে সে নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেন-
والإثم ما حاك في النفس وتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ وَ إِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ
তা-ই গুনাহ, যে সম্পর্কে অন্তরে খটকা দেখা দেয় ও মনে সন্দেহ থাকে, যদিও লোকে তার স্বপক্ষে ফতোয়া দেয়।
বোঝা গেল, মনের সাক্ষ্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো এই হাদীসের শেষ অংশে বলা হয়েছে, সত্য (অন্তরে) স্বস্তিদায়ক আর মিথ্যা সন্দেহ সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তা সত্যে স্বস্তিবোধ করে এবং অসত্যকে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। তাতে অস্থিরতা বোধ করে, যদিও কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এবং কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, দলীল প্রমাণ দ্বারা তা জানা না থাকে।
শরীআতে যা সুস্পষ্ট বৈধ, শরীআতের জ্ঞান না থাকলেও সে বিষয়টি শুনলে মনে একরকম স্বস্তিবোধ হয়। কেননা সত্য-সঠিক বিষয়ের মধ্যে একধরনের উদ্ভাস ও সৌন্দর্য থাকে। আর মু'মিনের অন্তরে ঈমানের নূর ও আলো তো থাকেই। যখন সত্য-সঠিকতার উদ্ভাস ঈমানের নূরের সাথে মিলিত হয়, তখন অন্তর তাতে প্রীত হয় ও স্বস্তি বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যা মিথ্যা ও নাজায়েয, তার ভেতর থাকে অন্ধকার ও মলিনতা। অন্ধকার ও মলিনতা ঈমানের আলোর সাথে মিলিত হতে পারে না। তাই মু'মিন ব্যক্তির অন্তর তাতে স্বস্তিবোধ করে না ও আরাম পায় না। এমনকি সে সম্পর্কে শরঈ জ্ঞান না থাকলেও মন তা গ্রহণে প্রস্তুত হয় না। এজন্যই সন্দেহযুক্ত বিষয়কে মনের আয়নায় ধরতে বলা হয়েছে। তা সত্যিকারের বৈধ হলে মু'মিনের অন্তর তাতে প্রশান্তি বোধ করবে আর বৈধ না হলে খটকা থেকেই যাবে, যদিও লোকে তার বৈধতার পক্ষে ফতোয়া দান করে। সুতরাং কোনও জিনিসের প্রতি (খাঁটি মুমিন ব্যক্তির) মনের ঝোঁক সেই জিনিসের বৈধতার একটি আলামত। এমনিভাবে তার প্রতি মনের বিতৃষ্ণা তা অবৈধ হওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে।
এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন রজব হাম্বলী রহ. একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে যাতে সন্দেহ নেই তা গ্রহণ কর। লোকটি বলল, তা কী করে বুঝব? তিনি বললেন, যখন কোনও কাজের ইচ্ছা কর, তখন নিজ বুকে হাত রাখবে। কেননা মুমিনের অন্তর হারাম কাজে অস্বস্তি বোধ করে আর হালালে স্বস্তি বোধ করে। মুত্তাকী-পরহেযগার ব্যক্তি তো বড় গুনাহে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে ছোট গুনাহ পরিহার করেই চলবে। হাদীছটি হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত। ইমাম ইবন রজব অবশ্য এটিকে যঈফ বলেছেন। হযরত ওয়াসিলা ইবন আসকা' রাঃ থেকেও এ হাদীছটি বর্ণিত আছে। তাতে অতিরিক্ত আছে, বলা হল, পরহেযগার কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়া থেকে ক্ষান্ত থাকে।
সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা যে প্রকৃত পরহেযগার হওয়া যায়, হযরত উমর রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি., হযরত আবুদ দারদা রাযি. প্রমুখ সাহাবী থেকেও তা বর্ণিত আছে। এ উম্মতের সালিহীন ও বুযুর্গানে দীন কঠোরভাবে এ পন্থা অবলম্বন করতেন। তারা প্রয়োজনে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি স্বীকার করতেন, তবুও সন্দেহযুক্ত মুনাফা স্পর্শ করতেন না। হিশাম ইবনে হাসসান রহ. বলেন, মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রাহঃ এমন চল্লিশ হাজার দিরহাম পরিত্যাগ করেছিলেন, যা গ্রহণে তোমরা কোনও দোষ মনে কর না। ইমাম আবু হানীফা রহ. কাপড়ের ব্যবসা করতেন । একবার তার এক বান্ডিল কাপড় ত্রিশ হাজার দিরহামে বিক্রি করা হয়। তাতে একটা কাপড় ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কর্মচারী ভূলে সে কথা ক্রেতাকে জানায়নি। এ কারণে তিনি ত্রিশ হাজার দিরহামের সবটাই সদাকা করে দেন। বুযুর্গানে দীনের এরকম শত শত ঘটনা বর্ণিত আছে।
মুত্তাকী হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায়
বস্তুত মুত্তাকী হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায় সন্দেহযুক্ত জিনিস পরিহার করা। এবং মূলত এটা কঠিন কোনও কাজ নয়। ফুযায়ল ইবনে ইয়ায রহ. বলেন, লোকে বলে পরহেযগারী কঠিন কাজ। তোমার কাছে যা সন্দেহযুক্ত, তা পরিহার করে সন্দেহমুক্ত কাজ কর। তবেই পরহেযগার হয়ে যাবে। হাসসান ইবনে আবু সিনান রহ. বলেন, পরহেযগারীর চেয়ে সহজ কিছু নেই। যে বস্তুতে তোমার সন্দেহ লাগে তা পরিহার কর। এটাই তো পরহেযগারী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযি. বলেন, সন্দেহযুক্ত বিষয়ে তুমি জড়াতে চাও কেন, যখন তোমার চারধারে হাজারও এমন বিষয় আছে, যাতে কোনও সন্দেহ নেই?
এ হাদীছে সাধারণভাবে বলা হয়েছে- যে বিষয়ে তোমার মনে সন্দেহ দেখা দেয় তা পরিহার কর। কোন কোন বিষয় তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। তা দেওয়া হয়নি এজন্য যে, সন্দেহ দেখা দিতে পারে ইবাদত-বন্দেগীতে, আর্থিক লেনদেনে এবং জীবনের যাবতীয় কাজকর্মে। শরীআতের নির্দেশনা আছে মানবজীবনের যাবতীয় বিষয়েই। তার মধ্যে যেসব বিষয় সুস্পষ্ট হালাল ও বৈধ, তাতে মু'মিনের মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয় না। কাজেই নির্দ্বিধায় সে তা করবে। এমনিভাবে যা-কিছু হারাম ও নাজায়েয বলে স্পষ্ট বর্ণিত আছে, তাতেও মু'মিনের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে না। তাও সে অবশ্যই পরিহার করবে। হ্যাঁ, কিছু কিছু জিনিস এমন আছে, যা হালাল না হারাম সে বিষয়ে শরীআতের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। সে বিষয়ে পরস্পরবিরোধী যুক্তি আছে। তাই কেউ কেউ তাকে হালাল মনে করেন, কেউ মনে করেন হারাম। এ কারণেই সে সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, তা আসলে হালাল না হারাম। এরূপ বিষয়েই পরহেযগারীর দাবি তা পরিহার করা। মুমিন সম্পর্কে এ ধারণা করা যায় না যে, সে হালাল কাজকে হারাম গণ্য করবে। আবার এ ধারণাও করা যায় না যে, সে হারামকে হালাল মনে করে তাতে লিপ্ত হবে। বাস এই দুই ক্ষেত্রে তো সে পুরোপুরিভাবে শরী'আতের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাকি থাকল সন্দেহযুক্ত জিনিস। সে যদি তা পরিহার করে চলে, তবে পরিপূর্ণরূপে দীনদার হয়ে গেল। শরী'আত মু'মিনকে সেই পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে চায় বলেই তাকে এরূপ বিষয় পরিহার করতে বলা হয়েছে। এজন্যই বলা হয়, পরহেযগারীর সবটাই সন্দেহপূর্ণ বিষয় পরিহার করার মধ্যে নিহিত। উলামায়ে কিরাম বলেন, এ হাদীছ দীনের এক প্রধান স্তম্ভ ও পরহেযগারীর ভিত্তি। এরই উপর ইয়াকীনের বুনিয়াদ স্থাপিত।
এটাই সবরকম সংশয় সন্দেহের জুলুম থেকে হৃদয়-মনকে বাঁচানোর দাওয়াই।
অকারণ সন্দেহ ধর্তব্য নয়
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে ওইসকল সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে সন্দেহ সৃষ্টির যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সুতরাং অকারণ সন্দেহ এর আওতায় পড়বে না। বরং শরী'আত অকারণ সন্দেহকে পাত্তা দিতেই নিষেধ করেছে। তাই ওযূ করে নামাযে দাঁড়ানোর পর ওযু ভাঙল কি ভাঙল না এই সন্দেহ দেখা দিলে সে সন্দেহকে গুরুত্ব দিতে নেই; বরং মনে করতে হবে ওটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা। কোনও পানিতে নাপাকী পড়তে দেখা না গেলে অহেতুক সে পানি সম্পর্কে নাপাক হওয়ার সন্দেহ করা ঠিক নয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তি পশু যবাই করার পর সে বিসমিল্লাহ বলেছে কি বলেনি, এ সন্দেহের পেছনে পড়াও উচিত নয়। এসব অমূলক সন্দেহ। একে গুরুত্ব দিলে শয়তান প্রশ্রয় পায়। এতে করে সে সবরকম ইবাদত- বন্দেগীতেই সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ নেয়। এ কৌশলে শয়তান যার উপর সওয়ার হয়, একপর্যায়ে ইবাদত-বন্দেগীতে তার বিরক্তি ধরে যায়। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। কাজেই এ পর্যায়ে পৌঁছার আগে শুরু থেকেই অমূলক সন্দেহ পরিহার করা কর্তব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারাও সত্যে অবিচল থাকার শিক্ষা পাওয়া যায়।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকার পক্ষে সহায়ক।
গ. সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পক্ষে মনের সাক্ষ্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. সততা অবলম্বন মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রকৃষ্ট উপায়।
ঙ. মিথ্যাচার মনে অশান্তি সৃষ্টি করে ও সন্দেহের বীজ বোনে।
চ. শরী'আতের দৃষ্টিতে কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা জানার জন্য অবশ্যই উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
الحلال بَيْن والحَرامُ بَيْلُ، وَبَيْنَهُمَا أُمُورُ مُشتبِهَاتٌ لا يَعْلَمُهُنَّ كَثِير من الناس، فمن اللي الشبهات إستمرا لدينه و عرضه، وَ مَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الحَرَامِ، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه ، ألا وإن لكل ملك حتى أَلَا وَإِن حتى الله محارمة
নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়। বহু মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল। ঠিক ওই রাখালের মত, যে সরকারি সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চড়ায়। অসতর্কতাবশত তার সংরক্ষিত ভূমিতে ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। শোন হে! প্রত্যেক বাদশারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে। শোন হে! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। (বুখারী ৫২ ও মুসলিম ১৫৯৯)
তো সংরক্ষিত এলাকার আশেপাশে পশু চড়ালে যেমন সেই এলাকার ভেতরে ঢুকে পড়ার ভয় থাকে, তেমনি স্পষ্ট হারাম কাজের কাছাকাছি বিষয় তথা সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত হলেও স্পষ্ট হারাম কাজের ভেতর লিপ্ত হয়ে পড়ার ভয় থাকে। কাজেই স্পষ্ট হারাম বিষয় থেকে বাঁচার জন্য জরুরি এমনসব কাজ থেকেও দূরে থাকা, যা হারাম বলে সন্দেহ হয়। অর্থাৎ করতে হবে কেবল এমন কাজই, যা স্পষ্টভাবে হালাল ও বৈধ। আর যা হারাম তা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। আর যে কাজে সন্দেহ হয় তা হালাল না হারাম, তাও এই চিন্তায় পরিহার করা চাই যে, তা বাস্তবিকরূপে হারাম হলে তো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আর বাস্তবিকপক্ষে হারাম না হলে হারামের সন্দেহ আছে, তাই এরূপ কাজে লিপ্ত হলে ধীরে ধীরে হারামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
বোঝাই যাচ্ছে এরূপ কাজ পরিহার করা ফরয বা ওয়াজিব নয়। বরং কেবলই সতর্কতা অর্থাৎ মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু মুস্তাহাব হলেও এ কারণে অবহেলা করা যায় না যে, তাতে লিপ্ত হওয়াটা বিপজ্জনক, যেহেতু এতে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
এ সতর্কতা অবলম্বন দ্বারা একদিক থেকে তো সরাসরি নিজ দীনদারীর হেফাজত হয়, যেহেতু এটা হারাম থেকে বাঁচার উপায়। দ্বিতীয়ত এর দ্বারা নিজ মান-সম্মানও রক্ষা হয়। কেননা সন্দেহযুক্ত কাজ করলে অন্যের মনে সন্দেহ জন্মাতে পারে- সে বুঝি হারাম কাজ করছে। এভাবে বেশি বেশি সন্দেহপূর্ণ কাজ করতে থাকলে ব্যাপকভাবেই মানুষ সন্দেহ করতে শুরু করবে। ফলে তার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। মানুষের দৃষ্টিতে আস্থাহীন হয়ে পড়াটা খুবই অসম্মানজনক। এর থেকে বাঁচা জরুরি। কেননা আত্মসম্মান রক্ষা করাও শরীআতের হুকুম। সন্দেহপূর্ণ জিনিস থেকে বেঁচে থাকাও আত্মসম্মান রক্ষার একটা উপায়। তাই তো উপরে উল্লিখিত হাদীছে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল।
হালাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে করণীয়
উল্লেখ্য, কোনও বিষয়ে যদি সন্দেহ দেখা দেয় তা হালাল না হারাম এবং জায়েয না নাজায়েয, তবে মুজতাহিদ পর্যায়ের লোক তো চিন্তা-ভাবনা করে দলীল-প্রমাণের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যদি মুজতাহিদ না হয়ে সাধারণ পর্যায়ের লোক হয়, তার কর্তব্য, উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞাসা করা। তারা জায়েয বা নাজায়েয যাই বলুক, তাতে যদি সন্তুষ্টি লাভ হয় এবং মন পুরোপুরি আস্বস্ত হয়ে যায়, তবে তো সে অনুযায়ী আমল করা হবে। আর যদি তাদের উত্তরে মন সন্তুষ্ট না হয় এবং অন্তরে খটকা বাকি থেকেই যায়, তবে সে কাজ পরিহার করাই শ্রেয়। হাদীছে সে নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেন-
والإثم ما حاك في النفس وتَرَدَّدَ فِي الصَّدْرِ وَ إِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ
তা-ই গুনাহ, যে সম্পর্কে অন্তরে খটকা দেখা দেয় ও মনে সন্দেহ থাকে, যদিও লোকে তার স্বপক্ষে ফতোয়া দেয়।
বোঝা গেল, মনের সাক্ষ্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো এই হাদীসের শেষ অংশে বলা হয়েছে, সত্য (অন্তরে) স্বস্তিদায়ক আর মিথ্যা সন্দেহ সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তা সত্যে স্বস্তিবোধ করে এবং অসত্যকে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। তাতে অস্থিরতা বোধ করে, যদিও কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এবং কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, দলীল প্রমাণ দ্বারা তা জানা না থাকে।
শরীআতে যা সুস্পষ্ট বৈধ, শরীআতের জ্ঞান না থাকলেও সে বিষয়টি শুনলে মনে একরকম স্বস্তিবোধ হয়। কেননা সত্য-সঠিক বিষয়ের মধ্যে একধরনের উদ্ভাস ও সৌন্দর্য থাকে। আর মু'মিনের অন্তরে ঈমানের নূর ও আলো তো থাকেই। যখন সত্য-সঠিকতার উদ্ভাস ঈমানের নূরের সাথে মিলিত হয়, তখন অন্তর তাতে প্রীত হয় ও স্বস্তি বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যা মিথ্যা ও নাজায়েয, তার ভেতর থাকে অন্ধকার ও মলিনতা। অন্ধকার ও মলিনতা ঈমানের আলোর সাথে মিলিত হতে পারে না। তাই মু'মিন ব্যক্তির অন্তর তাতে স্বস্তিবোধ করে না ও আরাম পায় না। এমনকি সে সম্পর্কে শরঈ জ্ঞান না থাকলেও মন তা গ্রহণে প্রস্তুত হয় না। এজন্যই সন্দেহযুক্ত বিষয়কে মনের আয়নায় ধরতে বলা হয়েছে। তা সত্যিকারের বৈধ হলে মু'মিনের অন্তর তাতে প্রশান্তি বোধ করবে আর বৈধ না হলে খটকা থেকেই যাবে, যদিও লোকে তার বৈধতার পক্ষে ফতোয়া দান করে। সুতরাং কোনও জিনিসের প্রতি (খাঁটি মুমিন ব্যক্তির) মনের ঝোঁক সেই জিনিসের বৈধতার একটি আলামত। এমনিভাবে তার প্রতি মনের বিতৃষ্ণা তা অবৈধ হওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে।
এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন রজব হাম্বলী রহ. একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে যাতে সন্দেহ নেই তা গ্রহণ কর। লোকটি বলল, তা কী করে বুঝব? তিনি বললেন, যখন কোনও কাজের ইচ্ছা কর, তখন নিজ বুকে হাত রাখবে। কেননা মুমিনের অন্তর হারাম কাজে অস্বস্তি বোধ করে আর হালালে স্বস্তি বোধ করে। মুত্তাকী-পরহেযগার ব্যক্তি তো বড় গুনাহে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে ছোট গুনাহ পরিহার করেই চলবে। হাদীছটি হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত। ইমাম ইবন রজব অবশ্য এটিকে যঈফ বলেছেন। হযরত ওয়াসিলা ইবন আসকা' রাঃ থেকেও এ হাদীছটি বর্ণিত আছে। তাতে অতিরিক্ত আছে, বলা হল, পরহেযগার কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়া থেকে ক্ষান্ত থাকে।
সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা যে প্রকৃত পরহেযগার হওয়া যায়, হযরত উমর রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি., হযরত আবুদ দারদা রাযি. প্রমুখ সাহাবী থেকেও তা বর্ণিত আছে। এ উম্মতের সালিহীন ও বুযুর্গানে দীন কঠোরভাবে এ পন্থা অবলম্বন করতেন। তারা প্রয়োজনে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি স্বীকার করতেন, তবুও সন্দেহযুক্ত মুনাফা স্পর্শ করতেন না। হিশাম ইবনে হাসসান রহ. বলেন, মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন রাহঃ এমন চল্লিশ হাজার দিরহাম পরিত্যাগ করেছিলেন, যা গ্রহণে তোমরা কোনও দোষ মনে কর না। ইমাম আবু হানীফা রহ. কাপড়ের ব্যবসা করতেন । একবার তার এক বান্ডিল কাপড় ত্রিশ হাজার দিরহামে বিক্রি করা হয়। তাতে একটা কাপড় ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কর্মচারী ভূলে সে কথা ক্রেতাকে জানায়নি। এ কারণে তিনি ত্রিশ হাজার দিরহামের সবটাই সদাকা করে দেন। বুযুর্গানে দীনের এরকম শত শত ঘটনা বর্ণিত আছে।
মুত্তাকী হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায়
বস্তুত মুত্তাকী হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায় সন্দেহযুক্ত জিনিস পরিহার করা। এবং মূলত এটা কঠিন কোনও কাজ নয়। ফুযায়ল ইবনে ইয়ায রহ. বলেন, লোকে বলে পরহেযগারী কঠিন কাজ। তোমার কাছে যা সন্দেহযুক্ত, তা পরিহার করে সন্দেহমুক্ত কাজ কর। তবেই পরহেযগার হয়ে যাবে। হাসসান ইবনে আবু সিনান রহ. বলেন, পরহেযগারীর চেয়ে সহজ কিছু নেই। যে বস্তুতে তোমার সন্দেহ লাগে তা পরিহার কর। এটাই তো পরহেযগারী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযি. বলেন, সন্দেহযুক্ত বিষয়ে তুমি জড়াতে চাও কেন, যখন তোমার চারধারে হাজারও এমন বিষয় আছে, যাতে কোনও সন্দেহ নেই?
এ হাদীছে সাধারণভাবে বলা হয়েছে- যে বিষয়ে তোমার মনে সন্দেহ দেখা দেয় তা পরিহার কর। কোন কোন বিষয় তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। তা দেওয়া হয়নি এজন্য যে, সন্দেহ দেখা দিতে পারে ইবাদত-বন্দেগীতে, আর্থিক লেনদেনে এবং জীবনের যাবতীয় কাজকর্মে। শরীআতের নির্দেশনা আছে মানবজীবনের যাবতীয় বিষয়েই। তার মধ্যে যেসব বিষয় সুস্পষ্ট হালাল ও বৈধ, তাতে মু'মিনের মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয় না। কাজেই নির্দ্বিধায় সে তা করবে। এমনিভাবে যা-কিছু হারাম ও নাজায়েয বলে স্পষ্ট বর্ণিত আছে, তাতেও মু'মিনের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে না। তাও সে অবশ্যই পরিহার করবে। হ্যাঁ, কিছু কিছু জিনিস এমন আছে, যা হালাল না হারাম সে বিষয়ে শরীআতের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। সে বিষয়ে পরস্পরবিরোধী যুক্তি আছে। তাই কেউ কেউ তাকে হালাল মনে করেন, কেউ মনে করেন হারাম। এ কারণেই সে সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, তা আসলে হালাল না হারাম। এরূপ বিষয়েই পরহেযগারীর দাবি তা পরিহার করা। মুমিন সম্পর্কে এ ধারণা করা যায় না যে, সে হালাল কাজকে হারাম গণ্য করবে। আবার এ ধারণাও করা যায় না যে, সে হারামকে হালাল মনে করে তাতে লিপ্ত হবে। বাস এই দুই ক্ষেত্রে তো সে পুরোপুরিভাবে শরী'আতের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাকি থাকল সন্দেহযুক্ত জিনিস। সে যদি তা পরিহার করে চলে, তবে পরিপূর্ণরূপে দীনদার হয়ে গেল। শরী'আত মু'মিনকে সেই পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে চায় বলেই তাকে এরূপ বিষয় পরিহার করতে বলা হয়েছে। এজন্যই বলা হয়, পরহেযগারীর সবটাই সন্দেহপূর্ণ বিষয় পরিহার করার মধ্যে নিহিত। উলামায়ে কিরাম বলেন, এ হাদীছ দীনের এক প্রধান স্তম্ভ ও পরহেযগারীর ভিত্তি। এরই উপর ইয়াকীনের বুনিয়াদ স্থাপিত।
এটাই সবরকম সংশয় সন্দেহের জুলুম থেকে হৃদয়-মনকে বাঁচানোর দাওয়াই।
অকারণ সন্দেহ ধর্তব্য নয়
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে ওইসকল সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে সন্দেহ সৃষ্টির যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সুতরাং অকারণ সন্দেহ এর আওতায় পড়বে না। বরং শরী'আত অকারণ সন্দেহকে পাত্তা দিতেই নিষেধ করেছে। তাই ওযূ করে নামাযে দাঁড়ানোর পর ওযু ভাঙল কি ভাঙল না এই সন্দেহ দেখা দিলে সে সন্দেহকে গুরুত্ব দিতে নেই; বরং মনে করতে হবে ওটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা। কোনও পানিতে নাপাকী পড়তে দেখা না গেলে অহেতুক সে পানি সম্পর্কে নাপাক হওয়ার সন্দেহ করা ঠিক নয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তি পশু যবাই করার পর সে বিসমিল্লাহ বলেছে কি বলেনি, এ সন্দেহের পেছনে পড়াও উচিত নয়। এসব অমূলক সন্দেহ। একে গুরুত্ব দিলে শয়তান প্রশ্রয় পায়। এতে করে সে সবরকম ইবাদত- বন্দেগীতেই সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ নেয়। এ কৌশলে শয়তান যার উপর সওয়ার হয়, একপর্যায়ে ইবাদত-বন্দেগীতে তার বিরক্তি ধরে যায়। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। কাজেই এ পর্যায়ে পৌঁছার আগে শুরু থেকেই অমূলক সন্দেহ পরিহার করা কর্তব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারাও সত্যে অবিচল থাকার শিক্ষা পাওয়া যায়।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকার পক্ষে সহায়ক।
গ. সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পক্ষে মনের সাক্ষ্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. সততা অবলম্বন মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রকৃষ্ট উপায়।
ঙ. মিথ্যাচার মনে অশান্তি সৃষ্টি করে ও সন্দেহের বীজ বোনে।
চ. শরী'আতের দৃষ্টিতে কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা জানার জন্য অবশ্যই উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
